0

প্রবন্ধ - নীলাঞ্জন মুখার্জ্জী

Posted in

প্রবন্ধ


সেইসব মিথ্যাদেবী
নীলাঞ্জন মুখার্জ্জী


ট্যারানটিনোর কিল বিল। নায়িকা বিট্রিক্স কিডো পাগলের মতো খুঁজে বেড়াচ্ছে খুনি বিলকে। খুঁজতে খুঁজতে সে পৌঁছে গেল বিলের বাবা, দালাল এস্তেবান ভিহাইওর কাছে। এস্তেবান ব্রিটিক্সের (উমা থরম্যান) সোনালি চুল দেখে নোংরা হাসল। তারপর বলল বিলের ছোটবেলার একটা ঘটনা। এস্তেবান বিলকে মেরিলিন মনরোর সিনেমা দেখাতে নিয়ে গিয়েছিল। বিল সেখানে হাঁ করে মনরোর দিকে তাকিয়ে ছিল। আর সমানে নিজের মুখে বুড়ো আঙুল ঢুকিয়ে চুষছিল।

এস্তেবান চুরুটের ধোঁয়ায় নোংরা হয়ে যাওয়া দাঁতে হেসে বলে - আমি তখনই জানতাম, ছেলে আমার সোনালি চুলের মেয়েদের পিছনে সারাজীবন পাগল হবে। 

বিট্রিক্স কিডোর চুল সোনালি। তার জীবন বরবাদ হয়ে গিয়েছিল বিলের পাগলের মতো ভালবাসায়।

দৃশ্যটা দেখতে দেখতে আমার বিজয়ের কথা মনে পড়ল। বিজয় আমার সাথে একই স্কুলে পড়ত। কাছাকাছি পাড়ায় থাকত। দূরদর্শনের সাদাকালো পোর্টেবল পর্দায় হেলেনের নাচ হোক বা বিন্দুর ছলাকলা, শশীকলার কোমর দুলিয়ে হাঁটা হোক বা অরুনা ইরানির ঘাগরা পড়ে ফর্সা পা দেখিয়ে নাচ, এই সবকিছু দেখতে দেখতে বিজয় মুখে বুড়ো আঙুল পুরে চুষত। 

টিভি দেখতে থাকা মাসি পিসিরা বিজয়কে বকাবকি করত, মাঝে মাঝে নিজেদের মধ্যে কিছু বুঝে হি হি করে হাসত। আমরা ছোটরাও কিছু না বুঝে হাসতাম। বড় হয়ে বিজয় আমাকে উত্তর কলকাতার এক সিনেমা হলে করিশ্মা কাপুরের অশোকাতে সন সনা না দেখতে দেখতে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেছিল - ধুঃ শ্লা, ভ্যাম্পরা মাইরি হারিয়ে গেল।

আমি পর্দায় চোখ রেখে বলেছিলাম - কেন বস? নায়িকারা তো আছে। অসুবিধা কী?

বিজয় সিনেমায় ঢোকার আগে ঘটিগরম দিয়ে বিয়ার খাওয়ার ডেফারড ঢেঁকুর তুলে বলেছিল - ধুঃ শ্লা, হিরোইনের সাথে ভ্যাম্পের তুলনা। কিসে আর কিসে? তুই পারিস মাইরি। 

পর্দায় তখন লাল রঙের ধুতি আর কাঁচুলি পরে করিনা, অশোকার সামনে উদ্দন্ড নাচে ব্যস্ত। পর্দা থেকে চোখ ফেরান কষ্টকর ব্যাপার। তার মধ্যেই আমি অবাক হয়ে বিজয়ের দিকে তাকিয়েছিলাম। 

তখন নব্বইয়ের দশক চলছে। ভ্যাম্পদের যুগ শেষ হয়ে আসছে। দ্রুত উঠে আসছে আইটেম গার্লরা। সেই আইটেম গার্লদের সিনেমার সাথে দূরদূরাস্তের কোন সম্পর্ক থাকে না। তারা একটি দুষ্টু গানের সাথে দুষ্টু নাচের মেহমান হয় । এর কিছুদিন পরে অবস্থা আরও শোচনীয় হয় গেল। হিরোইনরা নিজেরাই আইটেম নাম্বার করে নিতে লাগল। বিজয়ের ভ্যাম্পরা রূপোলি পর্দার থিন সিলভার লাইনের অন্যদিকে চলে গেল। ছবিতে খলনায়িকারা হয়তো থাকল, কিন্তু ভ্যাম্পরা উধাও হয়ে গেল।

কথাটা অনেকটা সোনার পাথরবাটি ধাঁচের শোনাবে। একটু উদাহরণ দিলেও ঘটনাটা আরও ভালো বোঝান যাবে। ধরুন বাংলা সিনেমার গীতা দে বা হিন্দির মনোরমা। খিটখিটে ধরনের মা, মাসি, পিসি, বৌদি বা প্রতিবেশী। যারা আবার চরিত্রের প্রয়োজনে কখনও স্নেহশীলা হয়ে উঠছেন। এরা খলনায়িকা, অথবা স্ক্রিপ্টের ডিমান্ডে পার্শ্বচরিত্র। কিন্তু এরা ভ্যাম্প নন। 

ভ্যাম্প বলতে আমি সেই বিদ্রোহী, ডোন্ট কেয়ার চরিত্রকে বোঝাতে চাইছি, যে ছোটখাটো পোষাক পরত, খুব স্বাভাবিকভাবে মদ গাঁজা টানত, যাবতীয় আমোদ – আল্হাদ করত, শখ টখ মেটাত, আবার হয়তো তা মেটাতে গিয়ে সিনেমার শেষে মারাও পড়ত । তারা কখনও ক্যাবারে ডান্সার, কখনও ভিলেনের বাহুলগ্না রক্ষিতা, কখনও ছলাকলায় ভুলিয়ে হিরোকে ফাঁদে ফেলে পরপুরুষের সাথে রাত কাটাচ্ছে, । 

ভ্যাম্প বলতে আমি সেই বিশেষ ক্যারেকটারদের বোঝাচ্ছি যার দিকে তাকিয়ে আপনি উন্মুখ হতেন, অথচ মুখে কখনও ডাকতেন সিডাক্ট্রেস আবার কখনও সেক্সি বলতেন । কখনও সে বাইজি হয়ে নাচত, কখনও সে ক্লাবে ডান্স করত, আর সব জায়গায় সে ছিল সমানভাবে সাবলীল। 

হে পাঠক, ভ্যাম্প বলতে আমি সেই মেয়েটির কথা বলছি, যার নাম হতো লিল্লি, রোজি, কিটি, সাবিনা, সুজি, রিটা। যারা খুব সহজেই বিছানায় যেতে রাজি হতো, যাকে আপনি প্রকাশ্যে ঘৃণা করতেন, গোপনে ভালবাসতেন, সোজা চোখে তাকানোর চাইতে অপাঙ্গে দেখতে পছন্দ করতেন । হে সুধী, সিনেমায় যে চরিত্রের মধ্যে এই এক বা একাধিক গুণাবলী থাকত, এই লেখায় তিনিই ভ্যাম্প বলে বিবেচিতা হবেন। 

সিনেমার খলনায়কদের নিয়ে প্রচুর লেখালেখি হয়েছে। যে কোন কারণেই ভ্যাম্পরা কিন্তু খুব বেশি সেখানে নেই। শুধু সেখানে নয়, বেশিরভাগ সময়েই সাধারণ মানুষের কাছে তারা একটু ব্রাত্য বা পর্দার রূপ নিয়েই থেকে গিয়েছেন। ভারতীয়দের স্বাভাবিক মানসিকতায় নারীদের দেবী হিসাবে দেখার স্বভাবকে এর কারণ হিসাবে ধরা যেতে পারে।(সে যতই ভারত মেয়েদের জন্যে ৪র্থ মোস্ট ডেঞ্জারাস প্লেস হোক না কেন বা বিভিন্ন শহরে সোনাগাছি বা কামাঠিপুরা বা জি বি রোড থাকুক না কেন!)

এর মধ্যে একমাত্র ব্যতিক্রম বোধহয় হেলেন। সাংবাদিক জেরি পিন্টো তাকে নিয়ে লিখেছেন এইচ বম্ব। তাতে হেলেনের জীবনের বিস্তৃত বিবরণ আছে। তাকে নিয়ে মার্চেন্ট আইভরির ডকুমেন্টারি আছে। কিন্তু সেসব কথা পরে। আগে আসবে ভ্যাম্প হিসেবে দক্ষিণ ভারতীয় এক রমণীর কথা।

তাঁর নাম সিল্ক স্মিতা। সিল্ক স্মিতার একসময় ছবি বেরোত আনন্দবাজারে। সিনেমার পেজে। তার অভিনীত দক্ষিণ ভারতীয় সিনেমার হিন্দি ডাবিং। সিনেমার নাম রেশমা কী জওয়ানি, জওয়ানি সোলা সাল কী, পেট কা পাপ ইত্যাদি ইত্যাদি। সিল্ক স্মিতা সম্পর্কে একটা ছোট্ট ট্রিভিয়া। লায়ানম, যা পরে হিন্দিতে রিলিজ হয় রেশমা কী জওয়ানি নামে, উইকি জানাচ্ছে, অ্যাডাল্ট ফিল্ম ইন্ডাষ্ট্রিতে তা একটি কাল্ট ফিল্ম হিসেবে পরিচিত হয়েছে। সফটকোর পর্ণ সিনেমার মার্কেটে রেশমা কী জওয়ানি এখনও ভারতের একটি সবচেয়ে বেশি রোজগার করা সিনেমা।

তাঁকে আমার প্রথম দেখা সদমায়। কমল হাসন উটির এক স্কুলের শিক্ষক। স্মৃতি হারানো শ্রীদেবী তাঁর কাছে আশ্রয় পেয়েছেন। সিল্ক স্মিতা কমলের স্কুলের বয়স্ক হেডমাস্টারের স্ত্রী। কমলকে আসতে যেতে দেখেন। একটু মোটা ঠোঁট। হালকা ফাঁক করা। সামনের দিকের দাঁত দেখা যাচ্ছে সেখান দিয়ে। মোটা উরু। ততোধিক স্থূল নিতম্ব। তলপেটে হালকা ভুঁড়ির আভাষ। দু চোখে অন্তত আকাঙ্খা নিয়ে তাকিয়ে থাকেন কমলের দিকে। 

মেনষ্ট্রিম সিনেমায় তাকে খুবই কম ব্যবহার করা হয়েছে। হলেও বেশিরভাগ সময়ে ভ্যাম্প হিসেবে। কিছুদিন আগে একটি বিদ্যা বালনের একটি সিনেমা মুক্তি পেয়েছিল। বিতর্ক এড়াতে প্রযোজক, পরিচালক জানিয়েছিলেন সেটি শুধু সিল্ক স্মিতার জীবনী নয়। সিল্ক স্মিতা, ডিস্কো শান্তির মতো অনেক ভ্যাম্পদের জীবন নিয়ে একটি মিলিজুলি কাহিনি। 

সিল্ক স্মিতার সম্পর্কে কিছু কাহিনি এখনও দক্ষিণ ভারতীয় সিনেমা জগতে মিথের মতো চলে। সেসব অবশ্যই সোশ্যাল মিডিয়ায় পাওয়া যায়। কিছু ঘটনা আমি শুনেছিলাম আমার এক বাঙালি বন্ধুর মুখে, যে কিনা আবার কিছুদিন ডাউন সাউথে গিয়েছিল নিজের ভাগ্যপরীক্ষা করতে। আমি আর আমার সেই বন্ধু দুজনেই স্ক্রিপ্ট লেখা শিখেছিলাম বিনয় রঙ্গনাথন আর অঞ্জুম রাজাবলি নামে দুই অত্যন্ত জনপ্রিয় চিত্রনাট্যকারের কাছে। 

একটা ঘটনা হলো অনেকটা এরকম। শিবাজি গনেশণ সেটে ঢুকছেন। শিবাজি সেসময়ে দক্ষিণ ভারতে ইন্ডাষ্ট্রির বেতাজ বাদশা। অনেকটা আমাদের উত্তমকুমার বা তখন তাঁর চেয়েও আর একটু বড় মাপের। 

তা ব্যাপার হলো, তিনি সেটে ঢুকলেই সকলে উঠে দাঁড়াত। সন্মান জানাতে। সেটাই অলিখিত নিয়ম হয়ে গিয়েছিল সিনিয়র জুনিয়র সবার কাছে। সিল্ক বসে রইলেন। শিবাজি সেটা দেখলেন, অথচ সিল্কের কোন হেলদোল নেই। সকলেই সেটা খেয়াল করছে। বসে রইলেন ক্রশলেগ ভঙ্গিমায়। এক উরু আরেক উরুর উপর তোলা। কেউ তাকে পাশ থেকে বলল - কী করছ কী?

তিনি উত্তর দিলেন – আমার থাই, আমার থাইয়ের উপর দিয়ে বসে আছি। শিবাজি স্যারের উপর তো দিইনি। ওঁনার কিসের অসুবিধা?

অ্যাটিটিউড। একটি শব্দ, যে কোন ভ্যাম্পের ডিকশনারির সবচেয়ে প্রয়োজনীয় কথা, তা প্রচুর পরিমাণে ছিল অন্ধ্রপ্রদেশের হদ্দ গ্রামের একটি প্রায় অনাহারে থাকা একটি মেয়ের। এদিকে দুবেলা খাওয়া জোটে না, ওদিকে শরীর তার নিজের নিয়মে বেড়ে যাচ্ছে। আপনা মাংসে হরিণা বৈরি ইত্যাদি ফর্মূলা মেনে তার মা বিয়ে দিল এক গরুর গাড়ির চালকের সাথে। সেখানেও সেই একই পেটের জ্বালা, নিত্যদিনের অশান্তি। একদিন বাড়ি থেকে পালিয়ে মেয়েটি মাদ্রাজের ট্রেণ ধরে কলিউডে আসার জন্যে। 

এরপর কাজের লোক, নায়িকার টাচ আপ গার্ল হয়ে সফট পর্ণ সিনেমার নায়িকা ও মেনষ্ট্রিমের ভ্যাম্প হওয়া। দুশো সিনেমায় অভিনয় আর প্রায় পাঁচশো সিনেমায় নাচ বা অ্যাপিয়ারেন্স। অবস্থা একসময় এমন যে, প্রযোজকেরা লাইন দিয়ে বসে থাকতেন ডেট পাবার জন্যে। তাদের সিনেমার হিরো কমল হাসন থেকে রজনীকান্ত যেই হোক না কেন, সিল্ক স্মিতার নাচের একটা দৃশ্য চাইই চাই। নইলে সিনেমা বাজারে কাটবে না। প্রতি নাচের দৃশ্যে পঞ্চাশ হাজার। সেই সময়কার। নিজের প্রোডাকশন খুলে লোকসান দু কোটি টাকা। সেই সময়কার হিসাবে। অ্যাটিটিউড না থাকলে এসব হয় না।

মানুষ কেমন ছিলেন সিল্ক? লেখাপড়া না জানলেও গড়গড়িয়ে ইংরেজি বলতেন। সেটে আসার ব্যাপারে অসম্ভব পাংচুয়াল ছিলেন। মারা যান অ্যালকোহলের সমস্যায়। ১৯৯৬ য়ে মৃত্যুর সময় অবধি করেছিলেন সতেরো বছরে পাঁচটি ভাষায় প্রায় পাঁচশো সিনেমা। যার মধ্যে বেশির ভাগই ছিল সফটকোর। মাত্র কয়েকটি সিনেমায় সুযোগ পেয়েছিলেন মেনষ্ট্রিমে অভিনয় করার। যার মধ্যে একটি অবশ্যই সদমা। দ্বিতীয় চরিত্রটি আরও জটিল। আলাইগাল ওইভাথিল্লাই , সেখানে তিনি তাঁর স্বামীকে সাহায্য করছেন তাদের কাজের লোকের শ্লীলতাহানি করতে, দরজায় পাহারা দিচ্ছেন যাতে লোকে কিছু জানতে না পারে। আবার একই সাথে স্বামীর এই নোংরামোতে তিনি ব্যথিত ও দুঃখিত। কমপ্লেক্স ক্যারেকটাইজেশন। আর প্রতিটিতেই ছিলেন অসম্ভব সাবলীল এই অভিনেত্রী। 

নাসরিন মুন্নি কবিরের - হেলেন অলওয়েজ আ স্টেপে দেখা দেখা যায় হাজার জাঁকজমকের পরেও হেলেন ক্যামেরার সামনে নাচাকে কখনই খুব একটা উপভোগ করেননি। যদিও ক্যামেরার সামনে তার লাস্যময়ী ভঙ্গিমা, উচ্ছল আনন্দের প্রকাশ, মোহময়ী নিস্পৃহতা দর্শককে কখনই এই বিরক্তি বুঝতে দেয়নি। কি অসাধারণ অভিনয় দক্ষতা! সারাজীবন ধরে! 

একটি ফ্রানকো - বার্মিজ ছোট্ট মেয়ে তার মা এবং অন্য ভাইবোনদের সাথে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় আশ্রয় নেয় আসামে। আসাম থেকে কলকাতা হয়ে বোম্বে। ১৯৫১ তে রাজ কাপুরের আওয়ারা ছবিতে নাচেন দলের আর সকলের সাথে। রাজেশ খান্না থেকে শর্মিলা ঠাকুর, বলিউডে এঁদের হাত ধরে স্টারডমে পৌঁছে দিয়েছিলেন বর্ধমানের যে মানুষটি, সেই শক্তি সামন্ত ১৯৫৮ তে প্রথম বিগব্রেক দেন হেলেনকে তাঁর হাওড়া ব্রিজ ছবিতে।

কিন্তু বলিউডের ভ্যাম্পের সবচেয়ে বিখ্যাত নাম হেলেন হলেও ভ্যাম্পদের ইতিহাস অনেক বিস্তৃত। এবং শ্রীমতি হেলেন রিচার্ডসন খান সেই ইতিহাসের সবচেয়ে উজ্জ্বল তারকা। 

বলিউডে ভ্যাম্প হিসেবে মোটামুটি হেলেন ছাড়া আর মাত্র চারজনকে চিহ্নিত করা যায়। যার মধ্যে অবশ্যই ললিতা পাওয়ার ও মনোরমাকে রাখা যাবে না সঙ্গত কারণেই। যা এর মধ্যেই বলা হয়েছে। তাঁদের বাদ দিয়ে যারা বাকি থাকলেন তাঁরা হলেন নাদিরা, অরুণা ইরানি, বিন্দু ও শশীকলা। 

নাদিরা জন্মেছিলেন দক্ষিণ মুম্বইয়ের নাগপাড়া অঞ্চলের এক বাগদাদি ইহুদী পরিবারে। নাদিরার আসল নাম ফ্লোরেন্স (ফরহাট) এজকিয়েল।

তাঁর প্রথম ছবি দিলীপ কুমারের বিপরীতে আন, ১৯৫২তে। ১৯৫৫ তে আসে শ্রী ৪২০। এবং সেই বিখ্যাত গান। মুড় মুড় কে না দেখ। হাতে সিগার। ১৯৬০য়ে আরেক বিখ্যাত গান আজীব দাস্তান হ্যায় ইয়ে। যেখানে গানে একটিবারও লিপ না দিয়ে শুধু চোখ দিয়ে, তাকানোর বিভঙ্গে রাজকুমার আর মীনাকুমারীর সাথে পাল্লা দিয়ে গিয়েছেন তিনি। ১৯৫০ এবং ১৯৬০ ছিল নাদিরার সময় ভ্যাম্প হিসেবে। যার মধ্যে একটি চরিত্র ছিল জুলির সেই মা, যাঁর জন্যে তিনি বেস্ট সার্পোটিং অ্যাকট্রেস হিসেবে পুরস্কার পাবেন।

নাদিরা মারা যান বিভিন্ন অসুখে ভুগে। যার মধ্যে ছিল টিউবারকুলার মেনিন জাইটিস, প্যারালাইসিস এবং অত্যাধিক মদ্যপানজনিত কারণে লিভার ডিসঅর্ডার। দুবার বিবাহবিচ্ছেদের পরে একাই থাকতেন। দুই ভাইয়ের একজন থাকত আমেরিকায়, অন্যজন ইসরায়েলে। কোন সন্তানাদিও ছিল না। ফেব্রুয়ারীর এক বিষণ্ণ দিনে মুম্বইয়ের ভাটিয়া হসপিটালের কোন এক বেডে শুয়ে চলে যান একসময়ের মোহময়ী।

আবার একটা ছোট্ট ট্রিভিয়া, নাদিরা ছিলেন প্রথম অভিনেত্রী যাঁর ছিল একটি রোলস রয়েস গাড়ি।

২০০৭ এর পদ্মশ্রী সন্মানে ভূষিতা এবং ২০০৯ এর ভি শান্তারাম পুরস্কার পাওয়া শশীকলা যখন সিনেমায় আসেন তখন অন্য অনেক অভিনেত্রীর মতোই তাঁরও একটি মাত্র উদ্দেশ্য ছিল। যত বেশি সম্ভব সিনেমায় অভিনয় করতে হবে এবং যত বেশি সম্ভব টাকা রোজগার করতে হবে। ১৯৩২ এ শশীকলা জন্ম নেন সোলাপুরের এক হিন্দু মহারাষ্ট্রিয়ান ধনী এক পরিবারে। 

ছোটবেলায় তিনি ছিলেন বড়লোকের এক আদুরে মেয়ে। ছোট থেকেই নাচ গান অভিনয়ে পারদর্শী। অথচ একটু বড় হতেই তাঁর অবস্থা সম্পূর্ণ বদলে গেল। ভাইয়ের বিশ্বাসঘাতকতায় তাঁর বাবা নিঃস্ব হয়ে গেলেন। বোম্বেতে আসলেন এই আশায় যে, তাঁর ভাল নাচ গান জানা মেয়ে সেখানে ফিল্ম ইন্ডাষ্ট্রিতে যদি কিছু কাজকর্ম পায়। কিন্তু ইয়ে হ্যায় বোম্বে মেরি জাঁ। বরাবরই ভারতের সবচেয়ে প্রফেশন্যাল, সবচেয়ে নিষ্ঠুর এবং সবচেয়ে মায়াময় একটা শহর। যে শহর তাঁর অধিবাসীদের প্রতি মুহুর্তে টেস্ট করতে থাকে। বোম্বের পরীক্ষায় শশীকলার পরিবার ডাহা ফেল করল। তাঁদের অবস্থা আরও খারাপ হয়ে গেল। শশীকলা বাধ্য হলেন লোকের বাড়িতে কাজ করতে। এখানে তিনি লোকের বাড়িতে বাসন মাজেন, কাপড় ধোন, ঘর ঝাঁট দেন।

১৯৪৫ য়ে অভিনেত্রী নূরজাহানের সাথে তাঁর কোনভাবে আলাপ হয়। সেসময় জিনাত নামে একটি ছবির শুটিং চলছিল। যাঁর হিরোইন ছিলেন নূরজাহান। নূরজাহান তাঁর সোহর পরিচালক শওকত হুসেন রিজভিকে বলে টলে জিনাত ছবিতে কাওয়ালির দলে শশীকলাকে নামিয়ে দেন। শশীকলা সেই অভিনয় করে ২৫ টাকা রোজগার করেন। 

শশীকলার প্রথম বড় ব্রেক আসে জুগনু থেকে। শওকত সাহেব চারশো টাকা মাসমাইনেতে শশীকলাকে নিজের স্টুডিওতে চাকরি দেন। ঠিক যেসময় শশীকলা হিরোইন হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করছিলেন, সে সময় ভারত ভাগ হয়ে যায় । শশীকলার মেন্টর নূরজাহান ও শওকত হ হুসেন চলে যান পাকিস্তানে। শশীকলার আর হিরোইন হওয়া হয় না। আবার ফিরে যান স্ট্রাগলের রাস্তায়। পি. এন অরোরা, অমিয় চক্রবর্ত্তীর সিনেমায় ছোটখাট রোল করা শুরু করেন। একটু একটু করে রোল বাড়তে থাকে। ভি শান্তারাম সুযোগ দেন তিন বাত্তি চার রাস্তায়।

১৯৫৯ তে করেন সুজাতা বিমল রায়ের সাথে। ১৯৬২ তে করেন আরতি। মীনা কুমারী, অশোক কুমার এবং প্রদীপ কুমার। শশীকলার প্রথম নেগেটিভ রোল এবং ফিল্ম ফেয়ার জেতা। এরপর একের এক ভ্যাম্পের রোল। কখনও হিরোর হাতে হাসতে হাসতে গান গাইতে গাইতে মদের গ্লাস তুলে দেওয়া আবার কখনও ক্রুর, বাবলি, হার না মানা খলনায়িকা, যার চোখে সবসময় অমোঘ আহ্বাণ। যাকে চাইলেই সহজে পাওয়া যায়। প্রথমে তিনি হন ভ্যাম্প এবং তারপর চরিত্রাভিনেতা। ঠিক এসময়েই শশীকলার বিয়ে হয় ওমপ্রকাশ সায়গলের সাথে। 

বিয়ের পর দুটি মেয়ে হয়। আর তারপর শুরু হয় স্বামীর সাথে ঝগড়া ঝামেলা। জীবনে শান্তি পেতে শশীকলা সবকিছু ছেড়ে দেন। নিজের ঘর, সংসার, মেয়েদের, সবকিছু ছেড়েছুড়ে তিনি ঘর থেকে বার হয়ে আসেন।

অশীতিপর এই অভিনেত্রী জীবনের একটা বড় অংশ কাটিয়েছেন কলকাতায় মিশনারিজ অফ চ্যারিটিজের এবং বিভিন্ন সেবামূলক কাজে। বর্তমানে বড় মেয়ে ক্যান্সারে মারা যাবার পর, ছোট মেয়ে আর জামাইয়ের সাথে থাকেন। 

বলিউডি ভ্যাম্পদের দুনিয়ায় ৬০ - ৭০ এর দশকে উঠে আসে আর এক নাম। বিন্দু। পুরো নাম বিন্দু নানুভাই দেশাই। বিন্দুর বাবা নানুভাই ছিলেন একজন ছোটখাট ফিল্ম প্রোডিউসার। মা জোৎস্না একজন মঞ্চাভিনেত্রী। ১৯৬২ তে আনপড় ছবিতে অশিক্ষিত মালা সিনহার শিক্ষিত মেয়ের রোলে তার অভিনয় শুরু।

বিন্দু একজন সফল ভ্যাম্প হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হন দো রাস্তে থেকে। এবং কাটি পতঙ্গের সেই বিখ্যাত লাইন - মেরা নাম হ্যায় শবনম, প্যার সে লোগ মুঝে শব্বো কঁহতে হ্যায় - বলে আশা পারেখকে ব্ল্যাকমেল করে তিনি সেই প্রতিষ্ঠাকে আরও দৃঢ় করেন। ইমতিহান, হওস এইসব সিনেমায় একটানা অভিনয় করে, আসে জঞ্জিরের সেই ঐতিহাসিক মোনা ডার্লিং।

অদ্ভূতভাবে বিন্দুর সিনেমায় আসা যেরকম সহজভাবে হয়েছিল তার জীবন কিন্তু তত সহজে কাটেনি। মাত্র তেরো বছর বয়সে তাঁর বাবা নানুভাই দেশাই মারা যান। ছয় বোন ও এক ভাইয়ের সংসারের যাবতীয় দায়দায়িত্ব তার উপর এসে পড়ে। সৌভাগ্যক্রমে বিন্দু তার জীবনে পেয়েছেন চম্পকলাল জাভেরীকে। তার ছোটবেলা থেকে দুজনের প্রেম। চম্পকলালকে পরিবারের অমতে বিন্দুকে বিয়ে করায় তার পারিবারিক ব্যবসাপাতি থেকে বার করে দেওয়া হয়। ফিল্মের নাচ করতে গিয়ে বিন্দুর গর্ভস্থ শিশু মারা যাওয়ার পর বিন্দু মা হতে পারেননি। তিনি এবং তার স্বামী বর্তমানে পুণেতে থাকেন।

৭০ এর দশকে বিন্দু, অরুণা ইরানি এবং হেলেন, এই তিনজনকে বলিউডের আইটেম নাম্বার থেকে ক্যাবারে, ক্লাব ডান্স থেকে ভিলেনের ডেরার লাস্যনৃত্য করার সাবলীলতা বলিউডে ভ্যাম্পদের হোলি ট্রিনিটির পরিচিতি দেয়। 

বিন্দুকে অন্যভাবে ব্যবহার করার পিছনে অবদান আর এক বাঙালি পরিচালকের। রামগোপাল ভার্মা আর অনুরাগ কাশ্যপের বহু আগে লো বাজেটের সুপারহিট সিনেমা বানাতে যাঁর কোন জুড়ি ছিল না। হৃষীকেশ মুখার্জী। যাঁর অর্জুন পন্ডিত এবং অভিমানে বিন্দু প্রথম দেখান তার অভিনয় প্রতিভা। এর পরেই চৈতালিতে করেন একটি সম্পূর্ণ অন্যধরনের চরিত্র। অশোক কুমারের পঙ্গু স্ত্রীর ভূমিকায়। এবং সবগুলিতেই দেখান নন - সেক্সিটাইজড রোল বা যৌনতার সুড়সুড়ি না দেওয়া অভিনয়েও তিনি সমানভাবে দক্ষ।

অরুণা ইরানির বাবা ফেরুদিন ইরানির ছিল ছোট্ট একটা ড্রামা কোম্পানি। কষ্টেসৃষ্টে দিন কাটত। তাঁর মাও ছিলেন একজন অভিনেত্রী । আট ভাইবোনের সংসার। গঙ্গা যমুনায় প্রথম শিশুশিল্পী হিসেবে অভিনয়। মুখের মধ্যে প্রচুর পটেটো চিপস আর হাতে কোল্ডড্রিংকস নিয়ে সবে গুছিয়ে বসেছেন হঠাৎ দিলীপ কুমার বলে উঠলেন - এই মেয়ে, নিজের ডায়লগ বল। অরুণা ইরানি ডায়লগ বললেন। সিলেকশান হয়ে হয়ে গেল। 

কিন্তু এরপর আর তেমন কিছু হল না। পরের পর ফিল্মে ছোট ছোট রোল, মেয়েদের ভিড়ে নাচ করা। এরকমই একসময় মেহমুদের সাথে তাঁর কমেডি জোড়ি গড়ে ওঠে। আর সেখান থেকেই মেহমুদের পরিচালনায় বোম্বে টু গোয়াতে হিরোইনের রোল। বিপরীতে ঢ্যাঙা এক হিরো। নাম অমিতাভ বচ্চন। বোম্বে টু গোয়া সেসময় কতটা হিট হয়েছিল সেটা আলাদা ব্যাপার। তবে দুজন অভিনেতার জীবন এই ফিল্ম অন্যভাবে প্রভাবিত করেছিল। অরুনা ইরানি এই সিনেমার জন্যে নাচ শিখে হয়ে উঠলেন এক দক্ষ ডান্সার। এবং ভবিষ্যতে হেলেন, বিন্দু, ইরানি - সেই ট্রিনিটির সদস্য। 

আর ঢ্যাঙা হিরোটিকে নিজের ফিল্মে চান্স দেওয়ার আগে একটু দোনামোনা করছিলেন পরিচালক প্রকাশ মেহতা। তার ফিল্মের হিরোইন জয়া ভাদুড়ি এই অভিনেতাটিকে রেফার করেছেন। তবে প্রকাশ মেহতার প্রথম পছন্দ দেব আনন্দ বা রাজেশ খান্না। তাঁরা না হলে নিদেন পক্ষে শত্রুঘ্ন সিনহা। জঞ্জিরে প্রচুর ঝাড়পিট আছে। এই লম্বা ছেলেটি তা করতে পারবে কি না প্রকাশ মেহতার সন্দেহ ছিল। জয়া ভাদুড়ি এসময়েই পরিচালককে বলেন বোম্বে টু গোয়ায ছেলেটির করা মারপিটের দৃশ্যগুলো দেখতে। প্রকাশ দেখেন। এবং অমিতাভ বচ্চনকে হিরো হিসেবে জঞ্জিরে মনোনীত করেন। বাকিটা ইতিহাস।

ফিরে আসি অরুণা ইরানির কথায়। অরুণা ইরানির কেরিয়ার যখন ঠিক পাখা মেলবে মেলবে করছে, ঠিক তখনই ইন্ডাষ্ট্রিতে তাঁকে নিয়ে কিছু রটনা হয়। ব্যস ইরানির কেরিয়ার প্রায় শেষের মুখে পৌঁছে যায়। আস্তে আস্তে আবার তিনি ফিরে আসেন। প্রথমে পার্শ্বচরিত্রে। তারপর ভ্যাম্প হিসেবে। ববি, ক্যারাভ্যান, সরগম, ফকিরা, লাভ স্টোরি। ১৯৯০ এর দিকে তিনি মায়ের ভূমিকা করা শুরু করেন।

এবার আসবে ভ্যাম্পদের সেই সাম্রাজ্ঞীর কথা, যাঁর সময়কে আলাদাভাবে বলিউডে চিহ্নিত করা হয়। যে বিরল সন্মান বহু নায়ক নায়িকাও পান না। লতা মঙ্গেশকর যাঁর লিপে গান গেয়েছিলেন শুধুমাত্র এই কারণে যে তিনি বলিউডের একটা সময়কে মিস করতে চান নি। অথচ এই মহিলাই তাঁর ছোটোবেলায় একটা সময় পার করে এসেছেন যখন একটা দিনে জানতেন না, পরের দিন বেঁচে থাকবেন কি না! 

সাইরেন শুনে ছোটোবেলায় ব্যাঙ্কারে যেতে যেতে এমন অবস্থায় হয়েছে যে এই বয়েসেও সাইরেন শুনলে প্যানিক হয়। রেঙ্গুন থেকে আরও অনেকের সাথে মা আর ভাইয়ের সাথে বেরিয়েছিলেন ভারতে আসবেন বলে। খাওয়া দাওয়ার ঠিক নেই। হাঁটতে হাঁটতে পা ফুলে ঢোল। সময় লেগেছিল ছ থেকে সাতমাস। জঙ্গুলে রাস্তায় খেতেন ফুল, ঘাস, পোকামাকড়। যখন যা পাওয়া যায়। সেই অবস্থায় পৌঁছলেন ডিব্রুগড়। অপুষ্টি, অতিরিক্ত পরিশ্রম, অনাহারে, ডেঙ্গু, বেরিবেরিতে পেট ফুলে গেল। অসুস্থ হয়ে ভর্তি হলেন হাসপাতালে। ভাই মারা গেল। মাকে নিয়ে প্রথমে কলকাতায় তারপর এলেন মুম্বইতে।

কুক্কু মোরে ছিলেন একজন অ্যাংলো ইন্ডিয়ান ডান্সার এবং হেলেনের মায়ের পরিচিতা। তিনিই হেলেনকে ১৯৪৭- এ ৯ -১০ বছর বয়সে আওয়ারা, সাবিস্তান এইসব সিনেমায় কোরাস ডান্সারের সুযোগ করে দেন। 

৬০ এবং ৭০ এর দশকে প্রায় ৭০০ সিনেমায় হেলেন নেচেছেন। বিভিন্ন ভাষাভাষী চরিত্র পর্দায় ফুটিয়ে তোলেন। জনপ্রিয়তার অন্যতম রহস্য ছিল তাঁর সাজগোজ। বিভিন্নরকমের পরচুলা, কনট্যাক্ট লেন্স, পোষাক আশাকের অভিনব ব্যবহার। গুমনামে হয়েছিলেন অ্যাংলো ইন্ডিয়ান, এক সে বড়কর এক এ জার্মান স্পাই, হাওড়া ব্রিজে নাইট ক্লাব ডান্সার, ইনকারে গোয়ানিজ মেছেনী।

বলা হয়, যে কোন পেশায় কেউ যদি তাঁর সবটুকু ঢেলে দেয় তবে সে কোন পর্যায়ে যেতে পারে, হেলেন অবশ্যই তাঁর উদাহরণ। হেলেনই হলেন সেই আর্টিস্ট যিনি ক্যাবারে এবং বেলি ডান্সিং দুই ই হিন্দি সিনেমার জগতে ব্যাপকভাবে নিয়ে আসেন। ৮০ র দশকের দিকে বয়সের জন্য তার চাহিদা পড়তে থাকে। পদ্মা খান্না, জয়শ্রী টি, বিন্দু, অরুনা ইরানিরা অতি দ্রুত তার জায়গা নিয়ে নিতে থাকে। প্রথম বিয়ে প্রেম নারায়ন অরোরাকে। স্বামী পি এন অরোরা তাঁর টাকাপয়সা নিয়ে উড়িয়ে দেন, একটা সময়ে হেলেন বেশ অর্থকষ্টে পড়েন।

বর্তমানে তাঁর স্বামী সেলিম খান, তখন তাঁকে বিভিন্ন পরিচালকের কাছে রেফার করতে থাকেন, কিছু অন্যরকম রোল দেওয়ার জন্যে। ১৯৮১ তে তাঁরা বিয়ে করেন। তার মধ্যে ১৯৬৫, ৬৮ এবং ৭১ এ বেস্ট সাপোর্টিং রোলের জন্য নমিনেশন পান। তিনবারই ব্যর্থ হন। ১৯৭৯ তে লহু কে দো রঙ এর জন্যে ওই পুরস্কার পান। ২০০৯য়ে তিনি পান পদ্মশ্রী ।

নব্বইয়ের দশকের শেষের দিকে এই ভ্যাম্পরা উধাও হয়ে গেলেন। আইটেম গার্লরা এসে খাল্লাস ধরনের নাচা গানা করতে লাগল। মুন্নির ঝন্ডু বামের সাথে সিনেমার কোন সম্পর্ক রইল না। মুন্নিদের দেখে শীলারাও বেশিদিন বসে রইল না। সিনেমার হিরোইনরা নিজেরাই জারা জারা কিস মি আর শীলা কি জোয়ানি দেখাতে শুরু করে দিল। ভ্যাম্প, আইটেম গার্ল আর হিরোইন মিলে অদ্ভূত এক খিচুড়ি শুরু হয়ে গেল। আর পাবলিকে হাতা নিয়ে পাতা পেড়ে সেই খিচুড়ি খেতে শুরু করে দিল। মাঝখান থেকে বেচারা বিজয়ের মতো পাবলিকেরা কাকে দেখে হাতের বুড়ো আঙুল চুষবে ঠিক করতে পারল না। এমনকি সাইজ জিরোর ধাক্কায় শেষ অবধি বুড়ো আঙুল না কড়ে আঙুল কোনটা চুষবে সেই ডিসিশন নিতেই কনফিউজড হয়ে গেল।

হিব্রু উপকথায় লিলিথের কথা আছে। আদমকে একা একা দেখে ঈশ্বর তৈরি করলেন এক নারীকে। তার নাম লিলিথ। ভালবাসার সময় আদম বলল - আমি তোমার উপরে থাকব। লিলিথ বলল - তা কেন? আমি তোমার সমান। আমাকেও ঈশ্বর সৃষ্টি করেছেন। আমি তোমার উপরে থাকব। 

আদম লিলিথের উপর জোর করতে গেল। লিলিথ নিজের অধিকার জানে। নিজের শর্তে বাঁচে। লিভস উইথ হার ওন টার্মস। সে আদমকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিল। আদম বেচারা অবোধ। ঈশ্বর পিতার বাধ্য সন্তান। পিতার কাছে গেল নালিশ জানাতে। ঈশ্বর সব শুনে লিলিথকে ডাকলেন। বললেন - লিলিথ আদমের কথা শোন।

লিলিথ বলল - আমি আদমের সমান সমান। আমি যদি ওর কথা শুনি, তবে ওকেও আমার কথা শুনতে হবে। 

ঈশ্বর বললেন - তা কী করে হয়? ও তো পুরুষ। শক্তিমান। ওর কথা তোমায় শুনতে হবে সারাজীবন।

লিলিথ বলল - আমি নারী। আমিও শক্তিমান। আমি কারোর কথা শুনব না। 

এই বলে লিলিথ স্বর্গোদ্যান ছেড়ে চলে গেল। ঈশ্বর তখন আর এক দেবী সৃষ্টি করলেন। ইভ। ঈশ্বরের মনের মতো। আদমের বুকের হাড় দিয়ে তৈরি। তার বাধ্য। নম্র ভদ্র। গল্পের নায়িকা। 

আর লিলিথ সেই বিদ্রোহিনী হয়েই থাকল। দেবী হয়েও সে দেবী নয়। মিথ্যে মিথ্যে দেবী। 

এই ভ্যাম্পদের আমার অনেকটা লিলিথের মতো লাগে। সিল্ক স্মিতা, হেলেনরা যে সময় অভিনয় করেছেন, সে সময় মহিলাদের একটা নজরেই দেখা হতো। সাদা অথবা কালো। স্ক্রীনে তারা যদি ভাল হন তবে মানুষের ধারণা ছিল বাস্তবেও নিশ্চয়ই সকলে বাড়িতে পুজো করেন, লক্ষী ধরনের মহিলা। আর পর্দায় যদি খারাপ হয় তাহলে এ নিশ্চয়ই বাস্তবেও খারাপ মেয়ে। যদি ওঁরা এই সময়ে অভিনয় করতেন, তবে হয়তো এখনকার পরিণত দর্শক বা পরিচালক প্রযোজকদের কাছ থেকে আরও একটু সন্মান, আর একটু গ্রহনযোগ্যতা, আর একটু সুযোগ পেতেন ইন্ডাষ্ট্রির ভিতরে ও বাইরে। 

শশীকলা এক ইন্টারভিউয়ে একটা দামি কথা বলেছিলেন। কথাটা হল, একজন ভ্যাম্পকে সবসময় হিরোইনের থেকে বেশি সুন্দরী, সপ্রতিভ এবং অল্পবয়স্ক লাগতে হবে, তবেই না দর্শক থেকে হিরো সকলেই সেই ভ্যাম্পের দিকে ঝুঁকবে। 

তাই ভ্যাম্পের দক্ষতা অনেক সময়েই হিরোইনের চেয়ে একটু বেশি হলেও তারা কোনদিন দেবী হননি। তারা ছিলেন লিলিথের মতো। নিজের মতো করে বাঁচা এক নারী, লিভড উইথ হার ওন টার্মস। একজন মিথ্যাদেবী।


Refernces: 
Helen: The Life and Times of Bollywood H – Bomb: Jerry Pinto
Bollywood Baddies: Villains, Vamps and Henchman: Tapan K Ghosh
Silk Smitha: Saul Eadweard Helias
Wikipedia

0 comments: