0

সম্পাদকীয়

Posted in







অশনি সংকেত সেদিনই ছিল। যেদিন কোনও অজ্ঞাত এক কারণে বদলে গিয়েছিল মুঘল সরাই জংশনের নাম। এর আগে পরে ঘটেছিল এমন কিছু ঘটনা, যাদের মধ্যে কোনও আপাত যোগসূত্র না থাকলেও, তাদের মধ্যে ছিল এক অদৃশ্য বন্ধনসূত্র। 

সম্প্রতি আমরা আলোড়িত দ্বাদশ শ্রেণীর জাতীয় পাঠক্রম থেকে ভারতবর্ষের মুঘল ইতিহাস সংক্রান্ত অধ্যায়গুলি অকস্মাৎ কোনও অদৃশ্য অঙ্গুলি হেলনে বাদ পড়ায়। পাঠ্য পুস্তকের ওই অংশগুলো নাকি 'অপ্রাসঙ্গিক' হয়ে পড়েছিল। তাই এই পরিমার্জন। 

অপ্রাসঙ্গিক? নাকি কোনও এক নির্দিষ্ট নীতিকে প্রাসঙ্গিক করে তোলার মরিয়া চেষ্টা? যার পূতি গন্ধময় উপস্থিতি আজ শুধু সিলেবাস বদলে নয়, আমাদের প্রাত্যহিক যাপনের প্রায় সর্বত্র। 

এভাবেও কি হয়? মানুষের মগজে, মজ্জায়, রক্তস্রোত আর অস্তিত্বের গভীরে যা কিছু, তাকে আমরা ইতিহাস বলতে পারি বা নাও বলতে পারি, কিন্তু উত্তরাধিকারের যে বীজ প্রজন্ম ব্যাপী বিস্তৃত, তাকে কি এইভাবে উপড়ে ফেলা যায়? তাহলে তো ইসলামের পদার্পণের বহু আগে আফগানিস্তানের বামিয়ান প্রদেশে নির্মিত অতিকায় বুদ্ধ মূর্তিগুলি বহু কাঠখড় পুড়িয়ে দীর্ঘদিনের অপচেষ্টায় গুঁড়িয়ে দেওয়ার পরও তো সেই প্রত্ন-রত্নগুলি আমাদের চেতনাকে আলোকিত করে রাখতো না। 

স্মৃতিকে তো মুছে দেওয়া যায় না! এমনকি প্রকৃতিও কখনও কখনও ব্যতিক্রমী হয় ঐতিহ্য রক্ষায়। তাই তো আজও আলতামিরার গুহামানবদের প্রাগৈতিহাসিক যুগের অঙ্কনশিল্প হাজার হাজার বছরের প্রাকৃতিক সব রোষানল মোকাবিলা করে বেঁচে রয়েছে আপন গরিমায়। 

তাই মানুষ নিজেই যখন নিজের হেঁটে আসা পথের মানচিত্র বদলে দিতে চায়, বিকৃত করতে চায়, সে ভুলে যায় সময়ের পাথরে লিপিবদ্ধ কাহিনী আসলে অপরিবর্তনীয়। অনেক অনেক জলস্রোত তার ওপর দিয়ে বয়ে গেলেও তার বুনিয়াদ রয়ে যায় অটুট।

সুস্থ থাকুন। সৃজনে থাকুন।

শুভেচ্ছা অফুরান!

0 comments:

1

প্রচ্ছদ নিবন্ধ - অনিন্দিতা মণ্ডল

Posted in







পৃথিবীতে সকল সময়ে যখন সমাজে কোনো বড় সড় পরিবর্তন ঘটে তখন সেই পরিবর্তনের কম্পন সাহিত্য ও শিল্পের আঙিনাতেও ধরা দেয়। প্রাচীন ইতিহাস বলে, রাজতন্ত্র যেমন অভিজাত শ্রেণীর আমোদ প্রমোদের উপকরণ হিসেবে হাজির করেছে কাব্য ও শিল্পকলা, তেমনই মেহনতী মানুষও আপন অবসরে সৃষ্টি করেছে মনের খাদ্য। সেসবের উৎকর্ষ কিছু কম নয়। সমস্ত যুগসন্ধিকালে মানুষ নবলব্ধ বিপ্লবচেতনা দিয়ে গড়ে তুলেছে তার রচনা। সে রচনা ব্যক্তিগত সুখদুঃখের গণ্ডি ছাড়িয়ে যখন সামগ্রিক চেতনায় ঘা দিয়েছে তখনই তা হয়েছে কালোত্তীর্ণ।

ছোটোগল্পের আবির্ভাবও এরকমই এক সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় সংঘাতের মধ্যে দিয়ে। উনিশ শতকীয় ফরাসী ও রুশ গল্পকারদের আবির্ভাবে যে তাদের সমসাময়িক বিপর্যয় দায়ী ছিল এ কথা সাহিত্যের পণ্ডিত মাত্রই বলে থাকেন। বাংলা ছোটো গল্পের ক্ষেত্রও বলতে গেলে একরকম প্রস্তুত ছিলই। ধরা পড়ল রবীন্দ্রনাথের হাত দিয়ে। ১৮৯১ সালে হিতবাদী পত্রিকায় ক্রমান্বয়ে প্রকাশ হতে থাকল তাঁর ছোটো গল্প। সেসময়ে উগ্র জাতীয়তাবাদ বনাম নরমপন্থী রাজনীতির করুনাকর ভিক্ষানীতির মধ্যে তিনি অসহায় বোধ করেছেন পলে পলে। তাঁর চেতনায় দেশ বলতে দেশের সাধারণ মানুষ। এ দেশের অতি সাধারণ মানুষের সুখদুঃখ তাঁর গল্পে গভীর ছাপ রেখেছে। তিনি অন্তর থেকে চিরায়ত সেই দেশজ জীবনকেই মেনেছেন নিজের করে। এক রবীন্দ্রনাথের হাত ধরেই উনিশ শতক থেকে বিশ শতকের দরজায় এসে দাঁড়িয়েছে সাবালক ছোটো গল্প।

বাংলা সাহিত্য ছোটোগল্পের আঙিনায় কোনো নারীর রচনা ঠিক কতটা উল্লেখযোগ্য তাই ফিরে দেখতে গিয়ে মনে হল আশাপূর্ণা দেবীর কথা। তাঁর প্রায় হাজার খানেক ছোটোগল্প আছে। প্রথাগত শিক্ষার বাইরে থেকেও তিনি কীভাবে যে এমন গূঢ় কথা লিখেছেন ভাবলে আশ্চর্য হতে হয়। তাঁর সঙ্গে আর একজন লেখকের তুলনামূলক আলোচনাই এই নিবন্ধের বিষয়। দ্বিতীয় জন ক্যাথরিন ম্যান্সফিল্ড। নিউজিল্যান্ডে জন্মে যিনি শেষ নিঃশ্বাস ফেলেছেন ফ্রান্সে। আশাপূর্ণা একটি দীর্ঘ জীবন ও সুস্থিত পারিবারিক কাঠামোর মধ্যে দিনপাত করেছেন। সামাজিক কোনো ক্রাইসিস যাকে প্রত্যক্ষ ভাবে ছুঁতে পারেনি বলে আমরা মনে করেছি। অন্যপক্ষে, ক্যাথরিন প্রথম বিশ্বযুদ্ধের অনতিকাল পরেই মারা যান। স্বল্পায়ু। তাঁর জীবনের কয়েকটি ট্র্যাজেডি সরাসরি সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় ক্রাইসিসের সঙ্গে যুক্ত ছিল। আমরা অগ্রসর হই।

“অন্ধের সমস্ত মন যেমন চাক্ষুষ

তেমন নিমগ্ন, বন্দী, মুক্তিভরপুর

এই দেশে”১



যাদের চাক্ষুষ করিনি, সৃষ্টির প্রেক্ষাপট জানতে পারিনি, তাদেরকে নিয়ে লিখতে বসে অন্ধের মতন মন হাতড়াতে হয়। আর তখনই ওপরের ওই অমোঘ পঙক্তি সাহস দেয়। চেতনা ডানা মেলে। এ নিবন্ধে দুই নারীর সৃষ্টির আলোয় তাঁদের মানসভুবন খুঁজে দেখার প্রয়াস। দুজনে পৃথিবীর দুই প্রান্তের মানুষ। কোনোভাবেই একে অপরের সঙ্গে পরিচিত নন। অথচ একটি মৌলিক সাদৃশ্য তাঁদের লেখায়। প্রতিপাদ্য ছোটো গল্প অবশ্যই।



বিশ শতকের কথা বলি। সেসময়ের সমাজে স্বাধীনতার আন্দোলন যা হয়েছিল তার মধ্যে দেশের স্বাধীনতার দিকে যতটা নজর ছিল, সামাজিক বৈষম্য থেকে মুক্তির দিকে তত নজর পড়েনি। উনিশ শতকের সমাজ সংস্কারকেরা আর নেই। যাবতীয় দমন পীড়ন ফিরে এসেছে স্বমহিমায়। এরকম একটা সময়ে আশাপূর্ণা দেবী লিখতে এসেছেন। তাঁর গল্পেরা পাখা মেলেছে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ উত্তর পরাধীন ভারতবর্ষে। তাঁর পরিবেশ, শিক্ষা দীক্ষা, এবং নিয়মনীতির নিগড়ে বাঁধা জীবনকে সহজভাবে গ্রহণ করার মধ্যেই বিপ্লবের বীজ নিহিত ছিল। তিনি যা জীবনে করে উঠতে পারেননি তাই ঘটিয়েছেন তাঁর গল্পে।

ক্যাথরিন ম্যান্সফিলড। নিউজিল্যান্ডে জন্মানো এই গল্পকার তাঁর জীবনের প্রথমার্ধ কাটিয়েছেন ইংল্যান্ডে। দ্বিতীয় অর্ধ ফ্রান্সে। আশাপূর্ণার থেকে অন্তত একুশ বছরের বড়। সেসময়ের ইংল্যান্ডের গোঁড়া ধর্মনীতি, নারীর সামাজিক অবস্থান, যুদ্ধের নিষ্ঠুরতা, এসবই তাঁর মননে গভীর ছাপ ফেলেছিল। অথচ তিনিও ছিলেন নিতান্তই ঘরবন্দি। তাঁর মৃত্যুর পর স্বামী স্বীকার করেছিলেন যে লেখিকাকে গার্হস্থ্য হিংসার শিকার হতে হয়েছে অনেক সময়ই। এই দুই নারী পৃথিবীর দুই প্রান্তে থেকেও কী ভীষণভাবে তাঁদের চেতনার সাদৃশ্য দেখা যায় ভাবলে অবাক লাগে।

বলা বাহুল্য, এই লেখায় ছোটো গল্পের নানান আকার ও প্রকরণ নিয়ে আলোচনার কোনো উদ্দেশ্যই নেই। তবু এই তুলনামূলক আলোচনায় উল্লেখ করতেই হবে যে, উত্তর আধুনিক ছোটো গল্পে না-কাহিনীর যে বৈশিষ্ট্য সকলে তুলে ধরতে চেষ্টা করেন ক্যাথরিনের গল্পে বহু আগেই সেই লক্ষণ দেখতে পাওয়া যায়। সেই অর্থে তিনি এরকম কিছু লেখা রেখে গেছেন যা ভীষণভাবে মনস্তাত্বিক, অথচ কাহিনীর ভাগ তেমনভাবে পাওয়া যায় না। কিন্তু সার্থক ছোটো গল্পের মতোই যার অভিঘাত গল্প শেষের পরেও পাঠকের মনে গভীর ছাপ রেখে যায়। আশাপূর্ণা অবশ্য নিটোল গল্পই লিখেছেন। সেসব গল্পের মধ্যেও কখনও জটিল মনস্তত্বের চকিত বিদ্যুৎ খেলে গেছে। আমরা অবাক হয়েছি ভেবে যে, যে মানুষ স্বামী সংসার নিয়ে পুরোদস্তুর গৃহিণী এবং বাইরের জগতে সেভাবে পা রাখেননি তিনি এমন জটিল মনস্তত্ব লিখলেন কী করে? ঠিক যেমন ক্যাথরিন লিখেছেন! অথচ ক্যাথরিনও স্বাধীন বিচরণে সমাজকে দেখতে পাননি! তবে কি অন্তরের আলোয় তাঁরা এমনই আলোকিত ছিলেন যে সাহিত্যে চিরকালীন ছাপ রাখা সম্ভব হয়েছে?

দুটি গল্পের আলোচনায় আসি। আশাপূর্ণা লিখেছেন ‘অজানিত’।

বিশ শতকের মাঝামাঝি সময়। অধ্যাপক পুরন্দর মল্লিক স্বেচ্ছাবসর নিয়েছেন একটি মহৎ উদ্দেশ্যে। তিনি মানুষের সভ্যতার ইতিহাস লিখবেন। সে এক বিশাল কর্মযজ্ঞ। তাঁর সহধর্মিণী, মধ্যবয়সী নীরজা তাই সংসারের শত ঝামেলা থেকে তাঁকে সযত্নে সরিয়ে রেখেছেন। তিন ছেলে ও তিন মেয়ে নিয়ে সুখের সংসার। মেয়েদের বিয়ে হয়ে গেছে। স্বাভাবিক কারনেই সন্তানেরা মায়ের কাছাকাছি। ছন্দে তালে যখন নিখুঁত চলছে সব কিছু তখন একদিন গভীর রাতে নীরজা পুরন্দরের তেতলার ঘরের সামনে থেকে সিঁড়ি দিয়ে গড়িয়ে পড়লেন একতলায়। এই পতনের অনিবার্য পরিণতিতে তিনি পাগল হলেন। পাগলামির ফলে তিনি স্বামীকে লক্ষ করে নানা কটু কথা বলতে থাকতেন। সকলেই বুঝত, এ তাঁর বিকার মাত্র। পুরন্দর যে কী ভীষণ ধৈর্য ধরেন তা দেখে ছেলেমেয়েরা অপরাধবোধে ভোগে। বাবার প্রতি আর একটু পক্ষপাত থাকা উচিত ছিল। ছ বছর পর হঠাৎ একদিন নীরজা ছাদ থেকে মধ্যরাত্রে লাফ দিয়ে আত্মহত্যা করেন। কতিপয় মানুষের সংশয় উড়িয়ে সিদ্ধান্ত হয় যে পাগলামির বশে তিনি এই কাজ করেছেন। মায়ের মৃত্যুর পর বাবা আলো জ্বেলে তেতলার ঘরে অনেক রাত অবধি জেগে থাকেন। স্বাভাবিক মমতায় তাই কনিষ্ঠ কন্যা করবী বাবার কাছে মিষ্টি জল নিয়ে যায়। তখন রাত তিনটে। আচমকা একটি বিকট শব্দে সকলে ঘর থেকে বেরিয়ে এসে দেখতে পায়, ছ বছর আগে নীরজা যেভাবে সিঁড়ির নীচে তালগোল পাকিয়ে পড়ে ছিল, আজ সেইভাবে করবী পড়ে আছে। সিঁড়ির মাথায় ক্ষিপ্ত পুরন্দর। চিৎকার করছেন – আমার কাজে যে ব্যাঘাত দেবে তাকে আমি সহ্য করব না। যে বাধা দিতে আসবে তাকেই ফুটবলের মতো স্যুট করব, টুটি ধরে রাস্তায় ফেলে দেবো। এক লহমায় আমাদের কাছে পরিষ্কার হয়ে যায়। নীরজার দুর্ভাগ্যের যে কাহিনী আমরা তাঁর মুখ থেকে শুনেও বিশ্বাস করিনি, পাগলের প্রলাপ ভেবে অবহেলা করেছি, তা আসলে সত্য। গল্পের বুনন বর্তমান কালের হলে এটি হয়তো কলেবরে ছোটো হতো। সেই তর্কে না গিয়ে বরং দেখব, আশাপূর্ণা আসলে কী বলতে চেয়েছেন। আমাদের সমাজে নারী মহীয়সী হয়ে চিরকাল পরিবারকে রক্ষা করবে। সমস্ত অবিচারকে হাসিমুখে সহ্য করে স্বার্থত্যাগ করবে। তার সেই ত্যাগের ওপরে পুরুষ যশের ইমারত গড়বে কেবল। আবার, কোনো বিচ্যুতি ছাড়াই পুরুষ তাকে শাস্তি দিতে পারে। অপরাধের নির্দিষ্ট সংজ্ঞা যেন পুরুষই তৈরি করবে! আশাপূর্ণা দেবীর এই মনস্তাত্বিক গল্পের পেছনে তাঁর গড়ে ওঠার পরিবেশ একবার দেখা যেতে পারে। তিনি একটি রক্ষণশীল পরিবারের মেয়ে এবং আর একটি সেরকম পরিবারেরই বধূ। স্বামী তাঁকে যথেষ্ট সহায়তা করলেও তিনি সহসা ঘরের গণ্ডি ছেড়ে বাইরে আসতে পারেননি। বেশ বেশি বয়সে তাঁকে প্রকাশ্য সমাবেশে দেখা যায়। সুতরাং, পরিবেশের এমন দমবন্ধ অবস্থা তাঁকে ক্লান্ত করেছে নিশ্চয়। ছোটো গল্পে যেমন হয়, এতেও আশাপূর্ণা একটি এমন সমাপ্তি রচনা করেছেন যার অভিঘাত তীব্র। একমুখী সেই অভিঘাত খানিকক্ষণের জন্য আমাদের চেতনাকে অবশ করে। আমরা তাঁর মনোরাজ্যে প্রবেশ করতে পারি। গল্পের মধ্যে বুনে দেওয়া তাঁর যন্ত্রণা, রাগ ও প্রতিবাদ আমাদেরকে বিচলিত করে। সঠিকভাবেই তিনি পাঠককে জাগিয়ে তোলেন।

দ্বিতীয় জন ক্যাথরিন মাত্র পঁয়ত্রিশ বছর বেঁচেছেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে তাঁর ভাই মারা যান। সমবয়সী ভাইটির সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ছিল ছায়ার মতো। তখন ১৯১৫ সাল। এই ঘটনার ফলে ক্যাথরিন চিরবিষাদে আচ্ছন্ন হন। একধরণের অপরাধবোধ কাজ করতে থাকে তাঁর মধ্যে। তিনি বেঁচে অথচ ভাই মারা গেলেন? এরপর ১৯১৯ এ তাঁর মা মারা গেলেন। তিনি স্তব্ধ হয়ে দেখলেন, বাবা কী ভীষণ আত্মমগ্ন হয়ে রইলেন! মাকে ও ভাইকে হারিয়ে ক্যাথরিনেরও যে কিছু সান্ত্বনার প্রয়োজন ছিল সেকথা তিনি ভুলে গেলেন। পরবর্তীতে ক্যাথরিনের দুরারোগ্য ক্ষয়রোগ ও তার অবশ্যম্ভাবী পরিণতি সম্পর্কে ক্যাথরিন যখন ওয়াকিবহাল হলেন তখন তিনি নিজের মনের মধ্যে একধরণের সান্ত্বনা খুঁজে পেলেন। যে ভাই পুরুষ হবার কারণে যুদ্ধে যেতে বাধ্য হয়েছিল ও সেখানেই প্রাণ দেয়, তার মৃত্যুর জন্য নিজেকে দায়ী ভাবার দিন ক্রমে শেষ হয়ে আসছে। তিনিও যুদ্ধ ও ব্যাধির একটির দ্বারা আক্রান্ত। এবং খুব শিগগির তাঁর প্রাণও যাবে। হয়ত তাঁর মনে এ প্রশ্ন জেগে থাকতে পারে যে তখনও তাঁর বাবা কি একই রকম নির্লিপ্ত থাকবেন? এই অবরুদ্ধ আবেগের যে অদ্ভুত প্রকাশ তিনি একটি গল্পে দেখিয়েছেন, সেটি বিখ্যাত। গল্পের নাম “দ্য ফ্লাই”। গল্পে একটি পুরুষ চরিত্র আছে যে নিজের ক্ষমতায় নিঃসন্দেহ। ক্যাথরিন তাঁকে বলছেন ‘দ্য বস’। স্পষ্টতই তিনি চরিত্রের নিরঙ্কুশ ক্ষমতার কথা বলছেন। প্রতিবেশী মানুষটিকে দেখে তার মনে হয়, লোকটা বুড়ো হয়ে গেছে। নানাভাবে নিজের সম্পদ প্রদর্শন করতে থাকে সে। কথায় কথায় সেই মানুষটি তাকের ওপরে রাখা একটি সৈনিকের পোশাকে সজ্জিত তরুণের ছবির দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে, সেদিন তার মেয়েরা শহরে গিয়েছিল। নিজের ভাইয়ের সঙ্গে এই তরুণের কবরেও গিয়েছিল। কবরে দুজনেই পাশাপাশি শুয়ে আছে। আমরা জানতে পারছি, ক্যাথরিন আফটারলাইফে বিশ্বাসী। যে জীবন এখানে আনন্দ দিচ্ছেনা তা হয়ত মৃত্যুপরবর্তী সময়ে শান্তি দিতে পারে। সেই অতি প্রসিদ্ধ জার্মান কবিতাটি মনে পড়ে –

পাহাড়ের ওপর/ আছে শান্তি/গাছের ওপর/ তুমি শুনবে/ নিঃশ্বাসহীনতা/ বনের পাখিরা আছে শান্ত/ অপেক্ষা করো, এখানেই/ তুমিও থাকবে বিশ্রামে।

মনে হয়, ক্যাথরিন যেন বীতশ্রদ্ধ হয়ে এই জন্ম থেকে মৃত্যুকে বেশি আপন ভেবেছেন। যেখানে আছে শান্তি, আছে বিশ্রাম। এরপরের অংশে আমরা সেই মূল পুরুষ চরিত্রটিকে দেখতে পাচ্ছি, যে ক্ষমতাবান হয়েও আসলে একপ্রকার ডিনাইয়াল বা অস্বীকারের প্রবণতার মধ্যে নিজেকে সমর্পণ করেছে। কিন্তু অবরুদ্ধ আবেগ তাকে যেন ফাঁদে ফেলেছে। সেই ফাঁদ থেকে বেরিয়ে আসার পথ খোলা নেই। কালির দোয়াতে একটি মাছি পড়েছে। বেরিয়ে আসতে চাইছে। মাছিটির প্রতিবারের সার্থক প্রয়াসের পরেপরেই লোকটি তাকে আবার কালিতে ডুবিয়ে দেয়। শেষে মাছিটি আর বেরোতে পারে না। ঠিক যেমন আমরাও পারিনা। খণ্ড খণ্ড মুক্তির প্রয়াস আসলে আমাদের আরও বেশি বদ্ধ করে। আমরা হেরে যাই।

ক্যাথরিন তাঁর একটি চিঠিতে উল্লেখ করেছেন - my pen – it’s as though the ink flows through its veins again. কালির দোয়াতের কালি, জন্মে পাওয়া দুধের স্বাদ আর যুদ্ধে অপচয়িত রক্ত তাঁর কাছে সমার্থক। নিবিড় ভাবে তিনি উপলব্ধি করেছেন, কালি যেন তাঁর জীবনে রক্তের মতোই জীবনদায়ী। যেমন জন্মেই শিশু মাতৃদুগ্ধের অধিকার পায় তেমনই কালি তাঁকে একটি সারস্বত অধিকার দিয়েছে। আর যুদ্ধ কেড়ে নিয়েছে বেঁচে থাকার অধিকার। যুদ্ধ ও ব্যাধি তাঁর কাছে সমার্থক। দুটিই রক্তপাত করায়। দুটিই ঘাতক।

আমরা আশাপূর্ণার গল্পে যেমন অনিবার্য মৃত্যুপরিণতির আভাসে স্তব্ধ হই তেমনই ক্যাথরিনের গল্পে তাঁর মৃত্যুযন্ত্রণা উপলব্ধি করি। যেমন আশাপূর্ণার গল্পে আমরা কামনা করতে থাকি এক চরম সত্য উদ্ঘাটনের তেমন ক্যাথরিনের গল্পে আমরা একটি আরোগ্য কামনা করতে থাকি। যে আরোগ্য এই সমাজকে যুদ্ধ আর ব্যাধি থেকে মুক্তি দেবে। আশাপূর্ণার গল্পেও তো অনুরূপ ব্যাধি দেখতে পাই! উন্মাদের প্রলাপ যখন শুধু একটি নারীর জন্যই সঞ্চিত থাকে তখন কি আমরা আরও বড় ধরণের, আরও গভীরে যার মূল, এমন সামাজিক ব্যাধির রূপ দেখি না?

দুই লেখিকাই কিন্তু নিষ্ঠুরভাবে কাহিনী বুনেছেন। দুটি গল্পেই আমরা দেখতে পাচ্ছি মনোবিকারের ফলে একটি মূল চরিত্র হত্যা করছে। আশাপূর্ণার গল্পে হত্যা করা হচ্ছে যে চরিত্রটিকে সে আসলে মমতায় জারিত। সংসার যে তাঁর ওপরেই নির্ভরশীল সেই কথা ভেবে জীবনের অধিকাংশ সময় নিঃস্বার্থভাবে ব্যয় করেছে। অন্যদিকে ক্যাথরিনের গল্পের মূল চরিত্রটি একটি মাছিকে হত্যা করছে। মাছিটির হত্যাদৃশ্যর যে বর্ণনা তিনি দিয়েছেন তা বেশ ভয়ংকর। পড়ে মনে হয়না যে সামান্য একটি মাছি মারা হচ্ছে। এই নিষ্ঠুর দৃশ্যগুলি রচনার পেছনে আশাপূর্ণা এবং ক্যাথরিনের নিশ্চয় যুক্তি ছিল। যুক্তি ছিল এই যে যা গল্পে ঘটেছে বাস্তব তার চেয়েও নিষ্ঠুর।

আমরা দেখতে পাই আশাপূর্ণা তাঁর গল্পে যেমন নিখুঁত গার্হস্থ্য এঁকেছেন ক্যাথরিনের গল্পে সেরকম বর্ণনা পাওয়া যায় না। এ থেকে ধারণা করা যায় ক্যাথরিনের জীবনযাপনে গার্হস্থ্য সেভাবে উপস্থিত ছিলনা নিশ্চয়। কিন্তু আশাপূর্ণার গল্পের নিতান্ত গার্হস্থ্য যাপন ও হিংসার মধ্য থেকে যে গল্প উঠে আসে তা সমসময়ের ভারতীয় নারীর বিষাদগাথা। অন্যদিকে ক্যাথরিনের গল্পে উঠে আসে মানবিক দুঃখ বেদনা নিষ্ঠুরতার সাতকাহন। তিনি একজন নারীর দৃষ্টি নিয়ে গল্পটি লেখেননি। একজন মানুষের দৃষ্টি থেকেই লিখেছেন। যে গল্পে যুদ্ধের ভয়াবহতা আছে। তাঁর গল্পটি যুদ্ধবিরোধী সমাজচেতনার কথা বলে। যা আশাপূর্ণার গল্পের চেয়ে প্রেক্ষাপটের বিচারে অনেক ব্যপক। আমাদের কোনো বিশ্বযুদ্ধের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়নি। আমাদের চেতনায় যুদ্ধের চেয়েও মারাত্মক সামাজিক মারণব্যাধি। তাই হয়তো আশাপূর্ণা সেই ব্যাধির কথাই লিখেছেন।

আরও একবার ক্যাথরিনের কাছে ফিরে যাই। তাঁর গল্পের চরিত্র, বস, মাছিটিকে বারবার কালিতে ডুবিয়ে দিচ্ছে। যে কালি আসলে মুক্তির পরিচায়ক, অন্তরে আবদ্ধ আবেগের নির্ঝর বইয়ে দিতে পারে সাদা পাতায়, সেই কালি এখানে ব্যবহার হচ্ছে হত্যার উদ্দেশ্যে। কালির কি নিদারুন অপচয়! আমাদের মনে পড়া উচিত, ক্যাথরিন কালি দুধ আর রক্তকে জীবনীশক্তি বলেছেন। ঠিক যেমন রক্ত একটি তাজা তরুন প্রাণকে শক্তিতে ভরপুর করতে পারে, তাকে জীবন দিতে পারে। কিন্তু কার্যত তা হয়না। যে তরুণ যুদ্ধে যায় তার প্রাণ যায় যুদ্ধে, প্রভুত রক্তপাত হয়ে। ক্যাথরিনের ক্ষেত্রে তিনি আর তাঁর মৃত ভাই আসলে একই ব্যাধিতে আক্রান্ত। যুদ্ধ ও ক্ষয়রোগ, দুটিই রক্তপাত করে। প্রাণ নেয়।

আশাপূর্ণার গল্পে সরাসরি কোনো রক্তপাতের কথা নেই। অন্তরে রক্তক্ষরণ আছে। এখানে যুদ্ধ বা ব্যাধি প্রত্যক্ষভাবে উপস্থিত নয়। কিন্তু সামাজিক একটি ব্যাধিতে আক্রান্ত আমরা। যুদ্ধও চলে, কারণ যুযুধান দুটি পক্ষকে আমরা দেখতে পাচ্ছি। এক পক্ষ সমাজের চোখে ওপরতলার। অপর পক্ষ নীচের তলার। উঁচুতলার মানুষ আবার পণ্ডিতও বটে। অর্থাৎ শুধু অর্থ নয়, শিক্ষা বা জ্ঞানের অধিকারও তার হস্তগত। অন্যপক্ষ তো অর্থনৈতিক ভাবে উঁচুতলার ওপরে নির্ভরশীল বটেই, উপরন্তু জ্ঞানের অধিকার থেকেও বঞ্চিত। সে শুধু আদিষ্ট কর্মের ভার বহন করবে। এভাবেই সে বন্দি থাকে একটি কাঠামোর মধ্যে।

ক্যাথরিন ম্যান্সফিল্ড আর আশাপূর্ণা তাই পৃথিবীর দুই প্রান্তের অধিবাসী হয়েও মানসভুবনে একে অপরের প্রতিবেশী। দুজনের বিষয়ভাবনার পার্থক্য সত্ত্বেও, গল্পের আঙ্গিকে তফাত থাকলেও তাঁরা একটি বিষয়ে এক। দুজনেই সমাজের নিষ্ঠুর চেহারাটি ধরে দিয়েছেন। দুজনেই জীবনের দমবন্ধ করা পরিস্থিতির নিখুঁত ছবি তুলে ধরেছেন। ছোটো গল্পের পাঠকদের কাছে দুজনেই তাই বিস্ময়ের।



তথ্যসূত্র

১ শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা থেকে উদ্ধৃত
২ আশাপূর্ণা দেবীর ছোটো গল্প, ‘অজানিত’
৩ দ্য ফ্লাই, ক্যাথরিন ম্যান্সফিল্ড
৪ Journal of New Zealand Literature, Milk Blood Ink: Mansfield’s Liquids and the Abject, Author Diana R Haris. pp 52-67

[কালি ও কলম এপ্রিল ২০২১]

1 comments:

1

প্রবন্ধ - ঝর্ণা চট্টোপাধ্যায়

Posted in






ওহ্‌ তুমহারী নজর নহী খঞ্জর থী
শায়দ যো মেরে জিসম্‌ মেঁ সমায়ী
অউর লহুকে ধব্বে লিয়ে
বাহর নিকল আই থী
---মখ্‌ফী ( Makhfi )
তোমার চোখের ইশারা যেন ছুরির কিনারা
যার আঘাতে আমার শরীরে বয় রক্তের ধারা
@Jharna (অনুবাদ)
.
উপরোক্ত শায়রীটির রচয়িতা অনেকের কাছেই এক অজানা- অচেনা কবির, যিনি কবি সমাজে পরিচিত ছিলেন মখ্‌ফী নামে, যার অর্থ রহস্যময় ( অথবা রহস্যময়ী, Mysterious)। এই কবি ছিলেন এক নারী এবং সেই নারীও আবার এমন একজন, যিনি ছিলেন শাহজাদী, সম্রাট আউরঙ্গজেবের কন্যা জেবউন্নিসা।
জেবউন্নিসার জন্ম ১৬৩৯ খ্রিস্টাব্দে, তিনি ছিলেন দিল্লীর সম্রাট পিতা আউরঙ্গজেব ও তাঁর প্রথমা পত্নী রাবিয়ার কন্যা। যদিও কারো কারো মতে মায়ের নাম ছিল দিলরস বানু বেগম। পিতার অত্যন্ত প্রিয় সন্তান ছিলেন, কিন্তু সম্রাটের জীবনে কাব্য-সঙ্গীতের স্থান ছিল না। পিতার জ্যেষ্ঠ্য ভ্রাতা দারাশিকোর সংস্পর্শে জেবউন্নিসার কাব্যপ্রতিভা স্ফুরিত হয়। জেবুন্নিসার জীবনী সম্বন্ধে খুব বেশি কিছু জানা যায় না। যদিও এটুকু জানা যায় যে জেবুন্নিসা সাত বছর বয়সে সমস্ত কোরান কন্ঠস্থ করে হাফিজ হয়েছিলেন এবং সেই উপলক্ষে সম্রাট আউরঙ্গজেব এক বিশাল দাওয়াতের ব্যবস্থা করেন। তাতে সম্রাটের সমস্ত সেনাধ্যক্ষ্য ও সেনারা দিল্লীর ময়দানে উপস্থিত ছিলেন। তিরিশ হাজার স্বর্ণমুদ্রা বিতরণ করা হয়েছিল গরীব-দুঃখীদের মধ্যে। শাহজাদী জেবুন্নিসা চারবছর আরবী,গণিত ও জ্যোতির্বিদ্যা অধ্যয়ন করেছিলেন এবং তাঁকে মহিলা-অধ্যাপক এই মর্মে ’মিয়াবাই’ (Miyabai) উপাধি দেওয়া হয়েছিল। শাহজাদী জেবুন্নিসা কোরানের টিকা ও ব্যাখ্যা করতেও পারদর্শিনী ছিলেন কিন্তু সম্রাট নিজে কাব্য ও সাহিত্যে কোন রুচি না রাখার জন্য অকস্মাৎ তাঁর সকল রকম অধ্যয়ন বন্ধ করে দেন। এমন কি অন্দরমহলেও এই সকল পাঠ বন্ধের নির্দেশ দেন।
শাহজাদী জেবউন্নিসা অল্পবয়সে আরবীতে এবং পরে পার্সী বা ফারসীতে লিখতে শুরু করেন। তাঁর শিক্ষক শাহ্‌ রুস্তম গাজী তাঁর কাব্য ও সাহিত্যের প্রতি অনুরাগ ও শাহজাদীর কবিতা (শায়রী) রচনা দেখে মুগ্ধ হন এবং সম্রাট আউরঙ্গজেবকে অনুরোধ করেন দেশের সমস্ত বড় বড় কবিদের আহ্বান করে কবি-সম্মেলন প্রস্তুত করার জন্য। কবি সম্মেলনে জেবউন্নিসা অংশগ্রহণ করলে নিজ কাব্যপ্রতিভার প্রকাশ করতে পারবেন। সম্রাট কাব্য-সাহিত্যে রুচি না রাখলেও, অন্দরমহলে সাহিত্যচর্চা বন্ধের নির্দেশ দিলেও আশচর্যজনক ভাবে তাঁর প্রিয়তমা কন্যার জন্য এই কবি-সম্মেলনের অনুমোদন দেন। সে যুগের বিখ্যাত কবি ও শায়েরগণ তাতে অংশগ্রহণ করেন। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন— কবি নাসির আলি,শায়াব, শামস্‌ আলি উল্লাহ, ব্রাহ্মিন এবং বেহ্‌রাজ। কথিত আছে, সিরহিন্দ এর কবি নাসির আলি ছিলেন কবি মক্‌ফির প্রতিদ্বন্দ্বী । নাসির আলি দিনে দিনে শাহজাদীর একজন গুরুত্বপূর্ণ প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে ওঠেন।
রূপসী শাহজাদী বড় হয়ে উঠলে তাঁর বিবাহের প্রস্তাব আসে নানা স্থান থেকে। আউরঙ্গজেবের পিতা সম্রাট সাজাহানের ইচ্ছা ছিল জ্যেষ্ঠ্য সন্তান দাদা শিকোর পুত্র সুলেমান শিকোর সঙ্গে (যে কিনা জেবুউন্নিসার সম্পর্কে বড় ভাই, জ্যাঠার ছেলে), শাহজাদী জেবুন্নিসার বিবাহের। কিন্তু পিতা আউরঙ্গজেব দারার প্রতি ঈর্ষা এবং হয়ত দারা তাঁকে বধ করে সিংহাসন দখল করবেন এমনই ভীতি থেকে এই বিবাহ প্রস্তাব নামঞ্জুর করেন।
ইরানের সম্রাট দ্বিতীয় শাহ্‌ আব্বাসের পুত্র মির্জা ফারুকের কাছ থেকেও বিবাহ প্রস্তাব আসে। শাহজাদী পিতাকে অনুরোধ করেন তিনি যেন মির্জা ফারুক কে দিল্লী আসার অনুরোধ করেন, শাহজাদী তাঁর বিদ্যা-বুদ্ধির পরীক্ষা নিতে চান। এবারেও আশ্চর্যভাবে সম্রাট আউরঙ্গজেব তাঁর প্রিয় কন্যার অনুরোধ রক্ষা করেন এবং মির্জা ফারুক সম্রাটের অনুরোধে দিল্লিতে আসেন। দুজনের সাক্ষাতের ব্যবস্থা করা হয়। শাহজাদী জিজ্ঞাসা করেন তিনি কি চান?’
উত্তরে একটি শায়রীর মাধ্যমে মির্জা ফারুক তাঁর অভিলাষ ব্যক্ত করেন--
চাঁদও যার কাছে ম্লান
করতে চাই সেই সুধাপান
তুলে দাও আড়াল তোমার
অনুরোধ রাখো আমার।
(অনুবাদ-ঝর্ণা চট্টোপাধ্যায়)
স্পষ্ট ইঙ্গিত। শাহজাদী মির্জা ফারুকের ব্যবহারে সৌজন্য ও সম্ভ্রমের অভাব দেখে রুষ্ট হন এবং পিতাকে বলেন –মির্জা ফারুক বাবুর্চিখানা থেকে কি খাদ্য-পানীয় পেতে চান, তাঁকে যেন জিজ্ঞাসা করা হয়। ভেঙ্গে যায় বিবাহপ্রস্তাব। শাহজাদী কাব্যজগতে মনোনিবেশ করেন।
যদিও রূপসী শাহজাদী ওরফে কবি মখ্‌ফী ব্যঙ্গ করে তার উত্তর দিয়েছিলেন ---
.
আড়াল আমি তুলব না
হয়ত আমার রূপের ছটায়
বুলবুলও আর গাইবে না!
দেবী লক্ষ্মীর ভক্ত যারা
আমার রূপে কাঙ্গাল হয়ে
সেই পুরোহিতও স্তব করবে না!
তাই ঘোমটা আমি খুলব না।
(অনুবাদ-ঝর্ণা চট্টোপাধ্যায়)
.
পিতার অলক্ষ্যে বিভিন্ন কবিতার আসরে (মুশায়েরা ), কবি-সম্মেলনে শাহজাদী তাঁর যাতায়াত শুরু করেন এবং তাঁর যাতায়াত ছিল। কিন্তু সেই আসরে তাঁর পরিচয় ছিল কবি ‘মখ্‌ফী’ নামে। তিনি যে শাহজাদী জেবউন্নিসা এই পরিচয়ে তাঁকে কেউ জানত না। জানা যায় মির্জা গালিবের পূর্বে একমাত্র তাঁরই শের-শায়রী, গজল ইত্যাদি ইংরাজি, ফরাসী, আরবী ও অন্যান্য ভাষায় অনূদিত হয়।
চোদ্দ বছর বয়স থেকেই তিনি গজল ও শের রচনা করেন। শের-শায়রী আসরে যাতায়াতের ফলে কয়েকবারই প্রেমে পড়েছেন কবি মখ্‌ফী। এমনই একবার এক আসরে বুন্দেলের ছত্রশাল মহারাজকে দেখেন জেবউন্নিসা। এই দেখা ভালোলাগায় পরিণত হয়। শের-শায়রী ভরা এক প্রেমপত্র পাঠান গোপনে এক সহচরীর হাত দিয়ে কিন্তু সেই গোপনীয়তা রক্ষিত হয়না, সহচরী ধরা পড়েন ও সম্রাটের কাছে তিরস্কৃত হন জেবউন্নিসা। এই ক্রোধের আরো একটি বড় কারণ ছিল ছত্রশালের সঙ্গে আউরঙ্গজেবের দীর্ঘদিনের শত্রুতা। এ যাত্রায় পিতার ক্রোধের সম্মুখীন হয়ে মখ্‌ফী নিজেকে সংবরণ করতে বাধ্য হন।
কিন্তু দ্বিতীয়বারের প্রেমও তাঁর সফল হয়না। এই দ্বিতীয় প্রেমিক ছিলেন স্বয়ং ছত্রপতি শিবাজী মহারাজ। শিবাজীর শৌর্য, বীর্য, পৌরুষ, রাজ্য ও দেশের প্রতি দায়বদ্ধতা এবং একজন তুখোড় যুদ্ধবাজ সৈনিক হওয়ার কারণে শিবাজীর প্রতি জেবউন্নিসার মুগ্ধতার শুরু। একসময় তিনি সংবাদ পান শিবাজী আগ্রায় আসবেন তাঁর পিতার সঙ্গে সাক্ষাৎ করার জন্য। শিবাজী আগ্রা আসার পথে বিভিন্ন স্থানে তুমুল সম্বর্ধনা লাভ করেন। আউরঙ্গজেব শিবাজীর এই জনপ্রিয়তায় ক্ষুব্ধ ও ক্রুদ্ধ হন। শিবাজী তাঁর রাজসভায় এসে আউরঙ্গজেবকে রীতিমত প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আহ্বান করেন। শিবাজীকে দেখে জেবউন্নিসার আরো একবার প্রেমে পড়েন ও আগের মত আবার এক শের-শায়রী পূর্ণ পত্র প্রেরণ করেন শিবাজীর নিকট, কিন্তু এবারের দূত ছিলেন এক বিশ্বস্ত অনুচর। পত্র পৌঁছে যায় কিন্তু বলা বাহুল্য, শিবাজী তাঁর এই প্রেম প্রত্যাখ্যান করেন। শিবাজীর প্রেম প্রত্যাখ্যানে জেবউন্নিসা ভেঙ্গে পড়েন। সম্পূর্ণরূপে কাব্য ও সঙ্গীত রচনায় নিজেকে নিয়োজিত করেন।
পিতার অজ্ঞাতেই নানা মুশায়েরা ও কবি-সম্মেলনে শাহজাদী জেবউন্নিসা ওরফে কবি মখ্‌ফী কবিতার আনন্দ লাভ করতে থাকেন।
.
কিছুদিন পর কবিতা ও সঙ্গীতের আসরেই তাঁর সঙ্গে পরিচয় হয় আর এক কবির, যাঁর নাম ওকিল খাঁ রাজী। তাঁরা একে অপরের সঙ্গে পরিচিত হন ও পরস্পর পরস্পরের প্রতি আকৃষ্ট হন। কিন্তু সম্রাট তা জানতে পেরে দিল্লীর সেলিমগড় দুর্গের পথে ওকিল খাঁকে হাতীর পদতলে পিষে মেরে ফেলার হুকুম দেন এবং ওকিল খাঁয়ের শব লাহোরের কোন এক স্থানে কবর দেওয়া হয়। ওকিল খাঁয়ের মৃত্যুর পর কবিতার পুজারী প্রিয়তমা কন্যা জেবউন্নিসাকে সেলিমগড় দুর্গেই বন্দী করেন পিতা আউরঙ্গজেব। বাকি জীবন তাঁর কাটে সেলিমগড় দুর্গের কারাগারে।
শাহজাদী জেবউন্নিসা কারাগারে বহু শের-শায়রী ও গজল রচনা করেন। রচনার সংখ্যা প্রায় পাঁচহাজারের মত। তাঁর এইসব গজল, শের-শায়রী, রুবাইয়া একত্রিত হয়ে ‘দিওয়ানেঁ মখ্‌ফী’ নামে সংকলিত। জেবউন্নিসা আরো একটি কারণে স্মরণীয়, বিধর্মী হলেও তিনি এইসময় কৃষ্ণভক্ত হয়ে পড়েন। তাঁর কারাগারের রচনাগুলি অধিকাংশই কৃষ্ণ সংক্রান্ত অথবা কৃষ্ণকে উৎসর্গীকৃত। বহু রচনাতেই কৃষ্ণের উল্লেখ পাওয়া যায়।
একটি শায়রীতে তিনি লিখছেন--
.
থাকতে চাই এই মন্দিরেই
আমি এখানেই থাকতে চাই।
যেখানে আমি নত হই,
সেখানে আমি শায়িত হব
আমার সুখ, আমার শান্তি লব।
(অনুবাদ—ঝর্না চট্টোপাধ্যায়)
.
শাহজাদী জেবউন্নিসা সেলিমগড় কারাগারেই মৃতুবরণ করেন ইংরাজি ১৭০১ সালের ২০শে মে।
কবি মক্‌ফি ছিলেন প্রেমের পূজারী। আজীবন তার সপক্ষে তিনি রচনা করেছেন তাঁর শায়রী। অত্যন্ত ধার্মিক ছিলেন। কিন্তু তিনি ছিলেন সুফীবাদে বিশ্বাসী। তাই পিতার মত ধর্মীয় গোঁড়ামি ও সঙ্কীর্ণতা কবি মখ্‌ফীর ছিল না। ধর্মের চেয়েও তাঁর কাছে বড় ছিল প্রেম তথা মানবপ্রেম। তাই তিনিই বলে যেতে পেরেছেন---
.
আমি মুসলমান নই
আমি শুধু প্রেমের পুজারী
তাঁরই কাছে নত হই
তাঁকেই আমি পূজা করি।
আমি ব্রাহ্মণও নই আর
উপবীতকে ভাসিয়ে দিয়ে
প্রেম-কুন্তলে বেঁধেছি কন্ঠহার।
(অনুবাদ—ঝর্ণা চট্টোপাধ্যায়)
.
কাব্যপ্রেমিক জেবউন্নিসা ওরফে কবি মখ্‌ফীর মৃত্যু হয়, কিন্তু তাঁর রচনার মৃত্যু হয়না। তাই বহুযুগ পরেও তিনি স্থান পান শিল্পী অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শিল্পী-হৃদয়ে। শাহজাদী-কবির একটি প্রতিকৃতি তিনি অঙ্কন করেন যা আমাদের কাছে এক পরম প্রাপ্তি।


*** রচনায় ব্যবহৃত শাহজাদী-কবি জেবউন্নিসা ওরফে মখ্‌ফীর প্রতিকৃতিটির শিল্পী— অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর ।

1 comments:

0

প্রবন্ধ - ইন্দ্রনীল মজুমদার

Posted in




















ইতালি এমনকি সারা বিশ্বের অন্যতম নামজাদা বিশ্ববিদ্যালয় হল পাদুয়া বিশ্ববিদ্যালয়। বিশ্বের অন্যতম প্রাচীন বিশ্ববিদ্যালয় ও বটে কেননা ২০২২ এ এই বিশ্ববিদ্যালয় তার ৮০০ বছর অতিক্রম করেছে। অনেক উল্লেখযোগ্য ইতিহাসের সাক্ষী এই বিশ্ববিদ্যালয় তা বলাই বাহুল্য। জগৎবিখ্যাত জ্যোতির্বিদ, গণিতজ্ঞ তথা ‘আধুনিক বিজ্ঞানের জনক’ গ্যালিলিও গ্যালিলি পাদুয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ছিলেন। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনাকালীন তিনি অনেক যুগান্তকারী বৈজ্ঞানিক গবেষণা করেছিলেন। ‘সেক্টর’ নামে একটি গণনাকারী যন্ত্র আবিষ্কার করেছেন। একটি অতিশক্তিশালী টেলিস্কোপ বা দূরবীন তৈরি করেছেন এবং তা চোখে লাগিয়ে রাতের পর রাত আকাশ পর্যবেক্ষণ করতে লাগলেন। আর তাঁর ওইসব পর্যবেক্ষণই উন্মোচন হতে শুরু করল আকাশের একের পর এক রহস্য, আসতে লাগলো একের পর এক নিত্য নতুন চিন্তাভাবনা। যখন গ্যালিলিও বিজ্ঞানের অন্যতম প্রাচীনতম শাস্ত্র জ্যোতির্বিদ্যার নানা অন্ধকারময় বিষয়ে আলোকপাত করে চলেছেন তখন চিকিৎসাবিজ্ঞানের এক নতুন দিক উন্মোচন হতে চলেছে ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসাবিদ্যার এক ইংরেজ ছাত্রের হাত ধরে। যার সূত্রপাত ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের শব-ব্যবচ্ছেদ ঘর (Anatomy dissection room)।


সেই শব-ব্যবচ্ছেদ ঘরের গ্যালারিতে ডাক্তারিবিদ্যার অনেক পড়ুয়ার সাথে বসে শব-ব্যবচ্ছেদ দেখছেন এক ইংরেজ ছাত্র৷ তাঁর কৌতূহলী তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রয়েছে অপারেশন টেবিলে অর্থাৎ যেখানে শব-ব্যবচ্ছেদ হচ্ছে। আর শব-ব্যবচ্ছেদ করছেন উক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের শারীরস্থান বা অ্যানাটমি বিষয়ের অধ্যাপক ফ্যাব্রিসিয়াস‌‌। এই ফ্যাব্রিসিয়াস সাহেব অসাধারণ বোঝান। তিনি শারীরবিদ্যার নামজাদা অধ্যাপক আবার বিখ্যাত শল্যচিকিৎসক। তাঁর পড়ানোর বিশেষত্ব হল এই যে তিনি বই দেখে অ্যানাটমি পড়াতেন না গতানুতিকভাবে‌। তিনি বহু বছর ধরে শব-ব্যবচ্ছেদ করছেন তাই দীর্ঘদিনের শব-ব্যবচ্ছেদ সম্পর্কিত যে পরীক্ষালব্ধ জ্ঞান তিনি অর্জন করেছেন তা দিয়েই তিনি অ্যানাটমির অধ্যাপনা করতেন। তিনি তখন সবেমাত্র আবিষ্কার করেছিলেন যে, মানবদেহের শিরার মধ্যে একদিক-বন্ধ দরজা যাকে বলা হয় ভালভ তা আছে। কিন্তু সেই ভালভের কাজ কি বা তা কেমন করে কাজ করে তা অধ্যাপক ফ্যাব্রিসিয়াস জানাতে পারেননি। অধ্যাপক মহাশয়ের এই অসম্পূর্ণ কাজটি সম্পন্ন করেছিলেন তাঁরই সেই সুযোগ্য ইংরেজ ছাত্রটি সেদিন যিনি অধ্যাপক ফ্যাব্রিসিয়াসের ক্লাসে শারীরতত্ত্ব অধ্যয়ন করছিলেন। হয়তো, অধ্যাপক ফ্যাব্রিসিয়াসের কাছে সেই সুদূর লন্ডন থেকে আসার কারণ হচ্ছে অ্যানাটমি শেখার প্রবল ইচ্ছা। তাই হবে, নয়তো নিজের দেশ ইংল্যান্ডের একাধিক নামজাদা বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে সুদূর ইতালির পাদুয়াতে কে যায়? তো, সেই ছাত্রটি হলেন উইলিয়াম হার্ভে। যিনি জন্মেছিলেন ১৫৭৮ সালের ১লা এপ্রিল। তাঁর পিতা ছিলেন একজন ব্যবসাদার। ১৫৯৭ সালে মাত্র উনিশ বছর বয়স বয়সে মেধাবী ছাত্র উইলিয়াম হার্ভে বিখ্যাত কেম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক হন। স্নাতক ডিগ্রি লাভ করার পর তিনি ইতালির পাদুয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে আসেন ডাক্তারী পড়তে।


১৬০২ সালে চব্বিশ বছর বয়সে ডাক্তারী পাশ করেন এবং তাঁর মাতৃভূমি ইংল্যান্ডে ফিরে আসেন। তিনি একটি চিকিৎসাকেন্দ্র খোলেন লন্ডনে। বহু রোগী তাঁর চিকিৎসার জন্য আসত। এইবার তিনি তাঁর জিজ্ঞাসা অর্থাৎ অর্থাৎ অধ্যাপক ফ্যাব্রিসিয়াসের অমীমাংসীত, রহস্যাবৃত প্রশ্নের উন্মোচনের কাজে মন দেন। অর্থাৎ, ভালভ কিভাবে কাজ করে? এই প্রশ্নের উত্তরের জন্য তিনি রোগীদের হৃদযন্ত্র ও রক্তপ্রবাহ পর্যবেক্ষণ করার এক সুবর্ণ সুযোগ পেয়ে যান। তিনি রোগীদের যা পরীক্ষা করে দেখতেন তার সবই খুব যত্নসহকারে ভালো করে একটি নোট বইতে লিখে রাখতেন। শুধু তাই নয়, অবসর সময়ে বিভিন্ন জীবজন্তুদের নিয়ে তিনি নানান পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাতেন। পাখি, ব্যাঙ, ইঁদুর সহ নানান প্রাণীর দেহ ব্যবচ্ছেদ করে সেগুলোর রক্তনালী পরীক্ষা করে রক্ত চলাচলের ব্যাপারটা পর্যবেক্ষণ করতেন। আসলে, যে সময়ের কথা বলছি সেই সময় মানুষের দেহের গঠনকৌশল খুব একটা ভালো জানা ছিল না। অনেক কিছুই ছিল অধরা। এমনকি হৃদযন্ত্রের কাজ ও রক্ত-সংবহন তন্ত্র (blood circulatory system) সম্পর্কে মানুষের তো দূর অস্ত খোদ চিকিৎসকদের ধারণাও ছিল না। কেউ কেউ চিকিৎসকেরা বলতেন যে, একমাত্র ঈশ্বরই জানেন হৃদযন্ত্রের ক্রিয়াকলাপ সম্বন্ধে। আবার কেউ কেউ বলতেন যে রক্ত দুই রকমের রয়েছে। একরকম রক্ত ধমনী দিয়ে যাতায়াত করে, আর একরকম রক্ত শিরা দিয়ে।আবার রক্তের উৎস সম্পর্কে কেউ কেউ বলতেন যে, রক্ত উৎপাদিত হয় আমাদের লিভারে। আবার কারুর মতে রক্তের উৎসস্থল হল পেট। কি আর বলা যাবে? অবশ্য বলাই বাহুল্য যে, এইসব কথা শুনে আজকালকার চিকিৎসকেরা হেসে উঠলেও তখন ব্যাপারটা মোটেও হাস্যকর ছিল না। যে হৃদপিণ্ড নিয়ে আমাদের বাঁচা তার কার্যকলাপ এবং যে রক্তের সম্পর্ক নিয়ে আমাদের এত্ত মাতামাতি তার সঞ্চালন কোনও জ্ঞান ছিল না সাধারণ মানুষদের থেকে শুরু করে খোদ চিকিৎসকদের। আর যিনি এই রক্তের বয়ে চলা বা সঞ্চালন ক্রিয়ার নির্ভুল ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন ও হৃদপিণ্ডের কাজ সম্পর্কে সক্ষমতার সাথে জানিয়েছিলেন তিনি আমাদের এই প্রবন্ধের নায়ক উইলিয়াম হারভে।


যাইহোক, যে কথাটা বলছিলাম, সেই পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে উইলিয়াম হার্ভে পর্যবেক্ষণ করে দেখলেন যে, শিরাতে যে ভালবগুলো আছে সেগুলো হৃদযন্ত্রের দিকে খোলা এবং ধমনীতে যে ভালভগুলো আছে সেগুলি হৃদযন্ত্র থেকে বাইরে যাবার দিকে খোলা রয়েছে। অর্থাৎ শিরার রক্ত সর্বদা হৃদযন্ত্রের দিকে চলে যায় এবং ধমনীর রক্ত সব সময় হৃদযন্ত্র থেকে বেরিয়ে আসে। আচ্ছা, এই হৃদযন্ত্রটি কেমন? ডাক্তার হার্ভে পর্যবেক্ষণ করে দেখলেন যে, হৃদযন্ত্র এক ফাঁপা মাংসপেশী বিশেষ এবং এটির প্রধান কাজ হল রক্তকে পাম্প করা। আমাদের হৃদযন্ত্র বা হার্ট পাম্প করে ধমনীর মাধ্যমে দেহের বিভিন্ন অংশে রক্ত পাঠিয়ে থাকে। হৃদযন্ত্র থেকে রক্ত ধমনীতে যায় ও তার শাখা প্রশাখার মধ্যে দিয়ে গিয়ে কৌশিকনালী বা ক্যাপিলারিতে পৌঁছায়। এরপর আবার দূষিত রক্ত বা অক্সিজেনহীন রক্ত শিরার মাধ্যমে হৃদপিণ্ডে ফিরে আসে। তিনি গণনা করেছেন যে, যখন হৃদযন্ত্রের পুরো সংকোচন হয় তখন তার থেকে প্রায় দুই আউন্স (প্রায় ০.০৫৯ লিটার) রক্ত ধমনী বেয়ে শরীরে ছড়িয়ে পড়ে। সংকোচনের পরেই স্বাভাবিক নিয়মে হৃদযন্ত্রের প্রসারণ ঘটে। প্রসারণের সময় শিরা বেয়ে রক্ত ধাবিত হয় বা চলে যায় হৃদযন্ত্রের দিকে। প্রসারণের পর হৃদযন্ত্রের আবার সংকোচন ঘটে। এই নিরন্তর সংকোচন ও প্রসারণের মাধ্যমেই হৃদযন্ত্র অবিরাম পাম্পের মত কাজ করে চলেছে। আমাদের দেহে রক্ত সঞ্চালনের যে প্রক্রিয়া তা চক্রাকারে হয়ে থাকে। পাম্প যেমন গোটা বাড়ি বা ফ্ল্যাটের কলে জল ছড়িয়ে দেয় একইভাবে হৃদযন্ত্র ও রক্ত শরীরে ছড়িয়ে দেয়। হৃদযন্ত্রের যে সংকোচন হচ্ছে তার ফলে পাম্প করা রক্তের বর্ধিত চাপ তৈরি হচ্ছে। আর সেই চাপ বোঝা যায় আমাদের নাড়ী টিপে। ডাক্তার হার্ভে নাড়ী টিপে ধরে প্রতি মিনিটে ওই নাড়ীর স্পন্দন কত তা গুণে ছিলেন। এইভাবে হৃদযন্ত্রের স্পন্দন তিনি নির্ণয় করতে পেরেছিলেন। এই স্পন্দনের সংখ্যা কম বা বেশি হলে বুঝতে হবে যে হৃদযন্ত্রের অবস্থা বা শরীরের অবস্থা ভালো নয়। ঠিক এই কারণে, ডাক্তার হার্ভে এই নাড়ীর স্পন্দন অনুভব করে রোগ নির্ণয় করার ক্ষেত্রেও পথিকৃৎ হয়ে রইলেন।


তিনি দেখেছিলেন যে, একজন পূর্ণবয়স্ক মানুষের স্বাভাবিক হৃদস্পন্দন মিনিটে ৬০ থেকে ৯০ বার হয়। তিনি নির্ণয় করে পেয়েছিলেন যে, আমাদের হৃদযন্ত্র প্রতিঘণ্টায় ৬৫ গ্যালন (প্রায় ২৯৫.৫ লিটার) রক্তকে পাম্প করতে পারে। কিন্তু এই হিসেবটা এখানে থেমে নেই। আমাদের দেহে রক্তের পরিমাণ ওই পাওয়া হিসেবের চেয়ে চার কি পাঁচ কোয়ার্ট (প্রায় ৩.৭৮৫ লিটার কি ৪.৭৩২ লিটার) কম। তাহলে, হৃদযন্ত্র অবিরামভাবে যে রক্ত পাম্প করে চলেছে তার কি হল? সেটাই বা কোথায় গেল?




উইলিয়াম হার্ভে ও তাঁর সই



ডাক্তার হার্ভের মতে, আমাদের শরীরের মধ্যেই ওই চার বা পাঁচ কোয়ার্ট রক্ত চক্রাকারে আবর্তিত হচ্ছে। তারা হৃদযন্ত্র থেকে বেরিয়ে ধমনীর ভেতর দিয়ে সঞ্চরণ করছে ও শিরা বেয়ে আবার হৃদযন্ত্রেই ফিরে আসছে। ধমনীর ভালব রক্তকে হৃদযন্ত্র থেকে বের করে দিচ্ছে এবং শিরার ভালভ রক্তকে হৃদযন্ত্রের দিকে সঞ্চালিত করছে। বারংবার পরীক্ষা করে হার্ভে নিশ্চিত হয়েছিলেন রক্তের এই সঞ্চালন বা বয়ে যাওয়া সম্পর্কে। তিনি হার্টের সংকোচন ও প্রসারণের ব্যাপারটা খুব ভালোমতোনভাবে লক্ষ্য করেছিলেন। তিনি এও জানিয়েছিলেন যে শুধু হার্টের মধ্যেই নয়, হার্টের বাইরে শরীরের সর্বত্র ও সবসময়ই রক্ত একইদিকে প্রবাহিত হয়। আর তিনি আগের হিসেব অনুযায়ী এও জানাতে পেরেছিলেন যে নির্দিষ্ট পরিমাণ রক্ত দেহের মধ্যে নিরন্তর চক্রাকারে প্রবাহিত হচ্ছে। তিনি দেখলেন যে তাঁর সিদ্ধান্তই নির্ভুল ও যথার্থ। আর এই বিষয়টি চিকিৎসক মহল সহ সকলকে জানাতে তিনি একটি বই লিখলেন যার নাম ‘ট্রিটিজ অন দি মোশান অফ দি হার্ট অ্যাণ্ড ব্লাড’ যা ব্যাপকভাবে সাড়া ফেলে গোটা চিকিৎসাজগতে‌। তবে, হার্ভের হৃদযন্ত্র ও রক্ত সঞ্চালন সম্পর্কে এই নতুন আবিষ্কার বা ধ্যান-দারণা বহু চিকিৎসকই প্রথমে মেনে নেননি তাঁদের পুরাতন চিন্তাভাবনার দরুণ। তাঁদের কাছে ডাক্তার হার্ভের ধারণা ভ্রান্ত মনে হলেও শেষ পর্যন্ত দেখা যায় হার্ভের সিদ্ধান্তই সঠিক ও অভ্রান্ত। ডাক্তার উইলিয়াম হার্ভের অসামান্য অবদান তখনই বুঝি যখনই দেখি যে, আজকাল যে সুস্থ মানুষের শিরা থেকে রক্ত নিয়ে তা বিশেষ প্রয়োজনে রুগ্ন মানুষের দেহে দিয়ে তাকে বাঁচাচ্ছে। আজকাল ব্লাড ডোনেশন প্রায়শই হচ্ছে। অনেক রক্তের চাহিদাসম্পন্ন মানুষকে রক্ত দিয়ে সেই চাহিদা পূরণ করার চেষ্টা চলছে কোনও জাতি-ধর্ম সহ সমস্ত ভেদাভেদ না দেখেই‌। এমনকি হার্ট অপারেশনের ক্ষেত্রেও অত্যাধুনিক যন্ত্রের সাহায্যে রোগীর দেহের রক্ত চলাচল স্বাভাবিক রাখা যাচ্ছে। পাদুয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে বসে গ্যালিলিও যেমন জ্যোতির্বিদ্যার নবদিক উন্মোচন করেছিলেন ঠিক তেমনি চিকিৎসাবিদ্যারও নবদিক উন্মোচনের সলতেটা ওই পাদুয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শব-ব্যবচ্ছেদ ঘরে বসে পাকিয়েছিলেন বা ধরেছিলেন উইলিয়াম হার্ভে।


১৬৫৭ সালের ৩রা জুন উইলিয়াম হার্ভের হৃদযন্ত্র থেমে গেলেও তাঁর রক্তসঞ্চালন সম্পর্কে অভ্রান্ত ও বৈজ্ঞানিক ধারণাগুলো বা সিদ্ধান্তগুলো হৃদযন্ত্র বা হার্টের মতো পাম্পের কাজ করেছে। কেননা সেগুলোই চিকিৎসাবিজ্ঞানকে মধ্যযুগের অন্ধকার থেকে এক অসামান্য অগ্রগতির দিকে ধাবিত করে নিয়ে গেছে।


রক্ত যে বয়ে যায় নব জীবনের দিকে ঠিক তেমনি চিকিৎসাবিজ্ঞানও হৃদযন্ত্র ও রক্ত ধরেই বয়ে যায় অগ্রগতির দিকে।



তথ্যসূত্রঃ-
দেশ বিদেশের বিজ্ঞানী– অমরনাথ রায়, আনন্দ পাবলিশার্স
আবিষ্কারের গল্প– পার্থসারথি চক্রবর্তী, আনন্দ পাবলিশার্স
উইকিপিডিয়া

0 comments: