0

গল্প - সনাতন সিংহ

Posted in

গল্প


যবনিকা পতন
সনাতন সিংহ



(১)
অন্ধকারের পোশাক খুলে ফেলেছে মৌরিগ্রাম... আধুনিকতার রূপসী বৈদ্যুতিক আলো,তার অন্ধকারী স্বপ্নে থাবা বসিয়েছে। ঝলমল করছে তার রাতের শরীর।
দিনে-রাতে পাড়ায় পাড়ায় হোম থিয়েটারের আওয়াজে কান পাতা দায়।

এ বছর পুজোর আগে থেকেই এ গ্রামের হাবভাব কেমন পাল্টে গেলো। রাতের আকাশে ভাসমান আলোক বস্তুর মতো এখন মৌরিগ্রামও ভাসছে। তার রাস্তাঘাট,  খেলার মাঠ, এ বাড়ি থেকে সে বাড়ি... বলতে গেলে সবেরই ভূতুড়ে রূপ ঘুচে গেছে বিজলি বাতির রূপে। পলতে দেওয়া কেরোসিনের ল্যাম্প, হ্যারিকেন, ব্যাটারি লাগানো টর্চ সেঁধিয়ে গেছে ঘরের অকেজো জায়গায়। এই মায়াবী আলোর প্রতাপে এক প্রকারে তাদের অব্যবহারিক-সমাধি ঘটেছে পুজোর ঠিক আগে।

এবার পুজোর মরসুম বেশ গরমাগরম। গ্রামে তাই একটু বেশি বেশি উন্মাদনা। তবে পুজো বলতে দুর্গা পুজো নয়। সে এ গ্রামে কল্পনাতীত। অত টাকা কোথায় এ গ্রামের? তবে হ্যাঁ, এ গ্রামে জমাটি পুজো হলো ঐ লক্ষ্মীপুজো আর কালী পুজো। সে এখানে না এলে বলে বোঝানো খুবই শক্ত।

এবার লক্ষ্মীপুজোর পর বাড়ি বাড়ি 'তালের কড়ম' শেষ হয়ে এসেছে। দ্বিধাবিভক্ত হয়ে তালের আঁটির কোনওটা উপরের দিকে তাকিয়ে, কোনওটা বা পাশ ফিরে রয়েছে, কোনওটা বা আছে মাটিতে মুখ গুঁজে।

দেখতে দেখতে কালীপুজো ঘাড়ের কাছে নিঃশ্বাস ফেলছে। ক'দিনই বা বাকি! সেজন্য ক্লাবে এবার বেশ তোড়জোড়। নতুন ক্লাব। নতুন উদ্দিপনা। পটুয়া এনে দিন রাত কাজ করছে। সঙ তৈরি থেকে ঠাকুর… সবেতেই পাড়ার লোক বা ক্লাবের সদস্যদের যেন হিড়িক লেগে গেছে। পটুয়ার হাতে হাতে দড়ি, মাটি, কাপড়, বাঁশের টুকরো… কে আগে এগিয়ে দিতে পারবে তার একটা প্রচ্ছন্ন প্রতিযোগিতা চলছে অন্তরীক্ষে।

অন্যদের সঙ্গে সজলও আছে।

সন্ধ্যার দিকে টিউশন পড়ানো আর নাওয়া-খাওয়া ছাড়া দিনে-রাতে, সে এক প্রকারে সেখানেই পড়ে আছে। এ বছর সে কলেজে ভর্তি হয়েছে। শহুরে কলেজে বটানি অনার্স। আশেপাশের গ্রামের লোকের কাছেও সে বেশ পরিচিত তার মেধার জন্য। সে সব গ্রাম থেকে ছেলে মেয়েরা তার কাছে পড়তেও আসে। ছবি আঁকা, দেওয়াল লিখন, পোস্টারিং করা ...প্রতিটাতে তার এ অঞ্চলে জুড়ি মেলা ভার।

কিন্তু অভাবের টানাটানি থাবা বসিয়েছে তার পড়াশুনায়, থাবা বসিয়েছে তাদের সংসারে। কেবল অভাব আর অভাব। তবু তাকে ওই অভাবী-দানব দমিয়ে রাখতে পারছে না। উদ্ভিদের মতো অভাবের মাটি ভেদ করে বাঁচার আলোয় উঁকি মেরে উঠেছে আর একটার পর একটা পাতায় ভরিয়ে দিচ্ছে তার লড়াকু জীবনের ডাল।

ব্রাশ হাতে নিয়ে সজল ও তপন সকাল সকাল ক্লাবের মাঠে এসে হাজির। পটুুয়াও উঠে পড়ে লেগেছে আজই যাবতীয় কাজ শেষ করবেই। তার জন্য খুব ব্যস্ত সবাই। আজই পুজো।

খড়ের চালের ছাউনির আর চটের বেড়ার ভেতরে তারা কাজ করছে। এমন সময় তপন সজলকে টোকা দিয়ে চুপিচুপি বলল,
…এই,রাস্তায় থেকে কেউ যেন উঁকি মারছে, দেখ। চটের ফাঁক থেকে দেখা যাচ্ছে। তাকা।
সেই টোকায় হাতে ধরা কাপের রঙ গেলো মাটিতে পড়ে। ছিটকে পড়লো পায়ে, তুলি গেলো গড়িয়ে। একটু বিরক্তি হয়ে চেঁচিয়ে উঠলো সজল
…উঁকি মারছে, তুইও মার না, কেষ্ট কোথাকার।
…আরে দেখখখ না, সেই সেই...
ব্যঙ্গ করে বলতে থাকলো
…কেই কেই।
তবু অনিচ্ছা সত্ত্বেও আড় চোখে তাকিয়ে দেখে। ছেঁড়া ছেঁড়া চটের ওপারে রাস্তায় নীল চুড়িদার পড়ে দাঁড়িয়ে আছে অহনা। হাতে ব্রাশ, এলোচুলের কয়েকটা গোছা লুটিয়ে আছে সামনের দিকে। কান ঢাকা দিয়ে নেমে এসেছে বুকের উপর। মুখে টুথপেস্টের সাদা ফেনা সোহাগে লেপে রয়েছে ঠোঁটে। সকালের নরম আলো এসে পড়ছে তার মুখে। কাঁচা রোদ তার লাবণ্য যেন কয়েক গুণ বাড়িয়ে দিয়েছে।সজল তার দিকে তাকাতেই অহনা মুচকি হেসে চোখের পাতা বার দুয়েক ওপরের দিকে নাচাল। পাশেই টুম্পা।

ওমনি সজলের সেদিনের কথা মনে পড়ে গেলো…
বাড়ি বাড়ি লক্ষ্মীপুজো হচ্ছে। পাড়ায় পাড়ায় কচিকাঁচার সঙ্গে বড়োদের সে কি উল্লাস। বিটভেনের মতো তা ছড়িয়ে পড়ছে দূরে দূরে। জোৎস্না গলে গলে পড়েছে গ্রামের উপর। শুধু কি গ্রামে? তার অমলিন রূপের লাবণ্য মাঠে, পথে, জলে, খেতে খেলে খেলে বেড়াচ্ছে এক প্রান্ত থেকে ওপর প্রান্তে।

পাড়ার সরকারি খেলার মাঠ। তার বিভিন্ন প্রান্তে ছোটো বড়ো দলে দলে ভাগ হয়ে খেলছে… বউ বসান্তি, লুকোচুরি, এলাডিং বেলাডিং।তাদের চিৎকার, হাততালি জ্যোৎস্নার লাবণ্যে মিশে কোথায় যেন মিলিয়ে যাচ্ছে।

এ রাতে এমনভাবে এমন সব খেলা তারা, তাদের পূর্ব পুরুষরা চিরাচরিত ভাবে খেলে আসছে অনন্তকাল থেকে।

সজল গাছের ছায়ায় দূরে মাঠের কোণে দাঁড়িয়ে। পাশেই পুরনো খড়ের গাদা। তারই পিছনে কেউ কেউ নিজেকে লুকাচ্ছে, কখনও বেরিয়ে 'ধাপ্পা' বলে যে খুঁজছে তাকে ছুঁয়ে দিয়ে আবার তাকে চোর করে পাঠাচ্ছে। সজল একটু সরে নারকেল গাছে ঠেস দিয়ে যেই দাঁড়াতে যাবে এমনি আড়ালে থেকে অহনা এসে সজলকে টুম্পা ভেবে না বুঝেই জাপ্টে ধরলো।

দুজনেই হকচকিয়ে গেলো। পড়ে যাওয়ার আশঙ্কায় দুজন দুজনকে জাপ্টে ধরলো। ধাক্কায় গাছের ছায়া থেকে সরে গেছে চাঁদের আলোয়। মায়াবী আলোয় মুখোমুখি দুজন। অহনার বুকের নরমে সজলের বুক মিশে রয়েছে। নিঃশ্বাস পড়ছে ঘনঘন। নারী শরীরের এই প্রথম স্পর্শে শিহরিত হচ্ছে সে। অনস্বাদিত রোমাঞ্চে, উত্তাপহীন জ্যোৎস্নালোকে তারা কেমন যেন আবিষ্ঠ হয়ে রয়েছে। অজানা উত্তাপে, শিহরণে কি করবে খেই হারিয়ে ফেললো দুজন। অহনার চুলের বিনুনি লুটিয়ে পড়েছে সজলের কাঁধে। দুজন দুজনের দিকে অপলকে তাকিয়ে। মায়াবী জ্যোৎস্না তাদের এই যুগলবন্দী মূর্তিকে ডুবিয়ে তার লাবণ্যের টানে টেনে নিয়ে চলেছে দূরে, দূরে কোথায়! কারও তখনও এসব নজরে পড়ছে কিনা কে জানে! সবাই যে যার মতো খেলছে, চেঁচাচ্ছে, দৌড়াচ্ছে। পিছন থেকে হঠাৎ টুম্পা এসে সজলকে বলে
…কিরে আর কতক্ষণ ধরে থাকবি। এবার তো ছাড়! খুব ভালো লাগছে না! নে ছাড়। কেউ দেখে ফেললে কি বলবে?
সম্বিৎ ফিরে পেলো দুজন। নিমেষে লজ্জায় মাথা নিচু হয়ে গেলো তাদের।
…চল।
বলেই টুম্পার হাত ধরে অহনা মাঠ টপকে একটা বাড়ির আড়াল হয়ে গেলো।

সে রাত সজলের জীবনে আর ফিরবে না ঠিকই। কিন্তু তা তার জীবনে প্রথম এবং অবিস্মৃত স্মৃতি হয়ে থাকবে অব্যক্তভাবে। এমন ভাবতে ভাবতে সে বাড়ি ফিরলো।


(২)

পাড়ার একটাই কীর্তনের দল। এক বাড়ি আর এক বাড়িতে হরিনাম করে বেড়াচ্ছে। তাদের সঙ্গে সঙ্গে পাড়ার ছেলে-মেয়ে-বৌ-ঝি-মাঝবয়সীদের ঢল। মেরে কেটে বড়ো জোর পনের-কুড়ি মিনিট গান করেছে এক এক বাড়িতে।

এ গ্রামেও এমন চলে প্রায় সারা রাত। তবে একেবারে অনাহারে নয়।খাওয়া বলতে মাঝে-সাঝে কোনও কোনও বাড়িতে এক কাপ চা, কোথাও লুচি, ছোলার ডাল। সঙ্গে গান শেষে খই-মুড়ি-বাতাসা-প্রসাদ। কেউ খায়, কেউ ঝোলা করে নিয়ে আবার অন্য বাড়ির দিকে রওনা দেয়। বাড়ি বাড়ি লক্ষ্মী আরাধনায় তারাই যেন এই ভক্তিরসের বৈতরণী। করতাল, হারমোনিয়াম আর সুরেলা গলার আওয়াজ প্রায় সারা রাত বাতাসে ভেসে চলে অপার মহিমায়।

এখন সেই কীর্তনের দল সজলদের বাড়িতে। মাঠের ঘটনা তাকে কেমন কুঁকড়ে দিয়েছে। বাড়িতে কেমন আনমনা হয়ে আছে। ঘরের মধ্য সেই যে ঢুকেছে আর বের হয়নি। ঘরের বারান্দায় উচ্চস্বরে গান গাইছে সবাই। খোল, করতাল আর হারমোনিয়ামের আওয়াজে ধূপের গন্ধে ঘর পরিপূর্ণ। দম বন্ধ হয়ে আসছে তার। আর যতই সে ঘটনা মনে পড়ছে ততই তার গা গুলিয়ে উঠছে।

মার ডাক রান্না ঘর থেকে তার কানে আসছে,
…খোকা, চা-বিস্কুট নিয়ে ওনাদের দে তো। সব রেডি করা আছে।আয় একবার। কি ঘরে সেঁধিয়ে আছিস? আয়য়য় না।

সজল যে ঘটনায় নিজেকে ঘরে বন্দী করে রেখেছে তা সে কাকেই বা জানাবে। এ যে অনুভূতির, তা কাউকে বলে বোঝানো সম্ভব নয়!আর তা কাউকে বলার নয়! তা কেবল তার নিজের।

তবুও সে বাইরে এলো। বারান্দায় মাদুর পাতা। সেখানে এই কীর্তনের দল বসে গান গাইছে। সে মাঝখানে ঢুকে চায়ের কাপ ও বিস্কুট ধরে ধরে দিচ্ছে।

হঠাৎ একটা অস্পষ্ঠ ফিসফিসানি মেয়েলি গলা কানে এলো
…আমি কি এক কাপ চা পেতে পারি?

সজল থতমত খেয়ে যায়। আরে এ যে অহনা! কাপটা এগিয়ে দিতে গিয়ে হাতটা কেমন যেন কলঙ্কের অনুভূতিতে নড়ে উঠলো।কাপ গেল ফসকে। পড়ল অহনার হাতে, গায়ে। গরম চায়ের ছেঁকায় চেঁচিয়ে দাঁড়িয়ে উঠলো সে। এমন অবস্থাতেও টুম্পা সজলের কানের কাছে চুপি চুপি বলতে ছাড়লো না,
…কি ব্যাপার চাঁদু! ইচ্ছা করে করলি না তো?
চেঁচানিতে গান গেলো থেমে।শুধু অহনার চেঁচানির আওয়াজ তখন অনুরণিত হচ্ছে। সজলের মা বাইরে বেরিয়ে এলো।
…কি হলো রে ?
টুম্পা অহনাকে দেখিয়ে বললো,
…দেখ না কাকী, সজল ওর গায়ে চা ফেলে দিয়েছে। গরম চা। চেঁচাবে না বলো? হাতটা বোধহয় পুড়েই গেছে।
মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে সজল। মুখে কোনও কথা নেই। একটা অপরাধ তাকে যেন তার ঘাড় নিচু করে ধরে আছে। মা বকছে।অন্যরা অহনাকে নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছে। যে যার মতো শোনাচ্ছে। কোনও কথাই তার কানে ঢুকছে না। শুধু মাঠে সেই নারীদেহের স্পর্শ তাকে কোথায় যেন তলিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।

সজলের মা অহনাকে দেখে চমকে গেলো। আগে তাকে এখানে দেখেছে বলে মনে পড়ল না। তবে বেশ সুন্দর দেখতে। টানা টানা চোখ। বিনুনি করা গোছা চুল মাথা থেকে কোমর ছাপিয়ে নেমে এসেছে। নীল চুড়িদারে নিটোল শরীর খানায় মুখটা বেশ মিস্টি। বেশ দেখাচ্ছে।চোখে ধরার মতো।
…কাকী,ঘরে কিছু আছে। লাল হয়ে গেছে দেখো। কিছু না দিলে ফোঁসকা পড়বে! অহনা কাঁদিস না।
তাকে দেখে সজলের মা কি ভাবছিলো, কে জানে!
…ও হ্যাঁ ওকে ঘরে নিয়ে আয়।
সঙ্গে টুম্পাও গেলো। ঘরে ঢুকতেই কি একটা মলম লাগিয়ে দিয়ে টুম্পাকে জিগ্যেস করলো,
… এটা, কে রে?
…আমার মাসির মেয়ে। বেলুড়ে থাকে।
মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে শোনালো,
…কাল ওকে একবার আনিস। ভারী কষ্ট পেয়েছে মেয়েটা।
আদর করে তার মাথাটা বুকে একটু জড়িয়ে ধরলো। চোখের জল আঁচলে মুছে দিলো।

বেরিয়ে যাওয়ার সময় সজলের মাকে অহনা হঠাৎ প্রণাম করে বেরিয়ে গেলো। সজলের মার কেমন যেন ভালো লেগে গেলো মেয়েটাকে।

তবু পাঠকের উদ্দেশ্যে জানিয়ে রাখা ভালো। তারপর সেই থেকে এই ক'দিন সজলদের বাড়িতে তার যাতায়াত। তার মায়ের সঙ্গে বেশ একটা ভাব গড়ে উঠেছে। অহনাকে তার মা কি চোখে দেখে তা কে জানে! সে এখন টুম্পারদের বাড়ির থেকে এখানে বেশি সময় কাটায়। মাঝে মাঝে সজলের পড়ার টেবিলে বসে বই ঘেঁটে ঘেঁটে পড়ে। এটা ওটা খেয়ে ইচ্ছাকৃতভাবে টেবিলে রেখে আসে। ডাইরিতে শুধু শুধু দাগ কেটে রাখে। সজল এসব দেখে আর ভাবে মাকে সে কিছু বলবে কিন্তু পূর্বকৃত সেই অপরাধ তাকে কিছু বলতে দেয় না… ঠোঁট চেপে রাখে।

এসব নিয়ে এতদিনে পাড়ায় পাড়ায় তাদের নামে বেশ রসালো আলোচনাও কানের কানে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এতে সজল একটু বিরক্তও হয়েছিলো।

কিন্তু আজ সকালে তপনের টোকা আর অহনার চোখের ইশারা তাকে আরও খোঁচা দিতে লাগলো। তাল জ্ঞান হারিয়ে দাঁত খিঁচিয়ে উঠলো। কি বলতে গিয়ে কি বলে ফেললো,
…এই কি চাও বলতো? এখানেও পিছু নিয়েছো? পাড়ার লোকের কথা শুনে লজ্জা করে না?
রেগে হনহনিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। তপন হাত ধরে আটকে রাখতে চাইলো। হ্যাঁচকা টানে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বাইরে বেরিয়ে গেলো সে।
সজলের এমন অপমানে অহনা দাঁড়িয়ে থাকতে পারলো না। টুম্পা কিছু বুঝে ওঠার আগেই অহনা কাঁদতে কাঁদতে দৌড় দিলো বাড়ির দিকে।


(৩)

কালীপুজোর সন্ধ্যের সময় অহনা ক্লাবের দিকে আসতে চাইছিলো না। অথচ সারাদিন উপোস করে আছে। দুপুরে তপন-সজলের সঙ্গে টুম্পা, অহনা আলপনাও দিয়েছে। দিলেও সকালে সজলের অপমান তাকে ভেতরে ভেতরে পিষে মারছিলো। অভিমানী মুখটা ওড়নার আড়ালে ঘুমরে ঘুমরে উঠছিলো। কারও সঙ্গে ঠিক করে কথাও বলেনি।

সন্ধ্যা হতে পাড়ার অন্য মেয়েরা তাকে টানতে টানতে নিয়ে আসে ক্লাবে। ক্লাবের সামনে প্যান্ডেল। আলোয় মায়ের মুখ জ্বলজ্বল করছে।ঠাকুর দেখে তার মনটা ভালো হয়ে ওঠে।সেখানে অন্য মেয়েদের সঙ্গে টুম্পা ও অহনা ফলমূল ধুয়ে ধুয়ে কেটে সাজিয়ে দিল।দিয়ে পাশাপাশি বসে আছে অঞ্জলি দেওয়ার জন্যে।
সজল একবার তার মুখের দিকে তাকিয়ে ভাবছে সকালে ওইভাবে না বললেও হতো।
টুম্পা তাকে ইশারা করে কিছু বলতে চাইলো। কি বুঝে সে মাথা নিচু করে নিলো।

প্যান্ডেলের ভেতরে বাইরে আলো আর আলো। বাইরে মাটির প্রদীপ জ্বলছে রাস্তা জুড়ে। অন্ধকারে সেই আলো এই অন্ধকার মেঠো পথের দুধারে ঘোর অমাবশ্যার কালো রূপকে আরও রমণীয় করে তুলেছে। দূরে ঝোপে ঝাড়ে দু একটা জোনাকি তাদের অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে মাঝে মাঝে। কারও কারও বাড়ির মোমবাতি নিভু নিভু।

এখানে ক্লাবের সদস্য ছাড়াও পাড়ার অনেকেই হাজির। কেউ কেউ বেশ সেজে গুজে একেবারে যেন তৈরি হয়ে এসেছে। পুজো শুরু হতেই ঢাকের আওয়াজ, পুরোহিতের মন্ত্র, ঘন্টা নাড়া মিলেমিশে মোহনীয় আবেশে ভরে উঠেছে পূজা প্রাঙ্গন। ঢাকের তালে বাইরে ছেলে-বুড়ো নাচে উন্মাদ প্রায়। কেউ কেউ তাদের গায়ে টর্চের আলো মারছে। সিটি দিচ্ছে।

এদিকে মণ্ডপের ভেতরে অঞ্জলিও শেষ।

হোম হয়ে গেছে। তার ছাইয়ের কালি পরার জন্য সবাই চেঁচাচ্ছে আমাকে দাও, আমাকে দাও। এ বলছে আমাকে দে, ও বলছে আমাকে দে। একদল সিঁদুরের টিপ চাইছে। পুরোহিত তপনের হাতে সিঁদুর আর তেল দিলো। তপন সজলকে বলল
…ভাই, কলাপাতায় এটা মাখ না।
সজল হাত বাড়িয়ে সেগুলো হাতের তালুতে নিলো।

অঞ্জলি দেওয়ার জন্য মণ্ডপের ভেতরে সব ঠাসাঠাসি করে বসে রয়েছে। কলাপাতা নেওয়ার জন্য লোক দেখে দেখে পা ফেলে এগিয়ে গিয়ে ঝুঁকতেই সিঁদুরের কৌটোর ঢাকনা খুলে সিঁদুর পড়লো অহনার মাথার চুল ঘেঁষে কাঁধের উপর।
টুম্পা দেখেই আঁতকে উঠলো। একটা স্নেহের কিল বসিয়ে দিলো সজলের পিঠে
... আর একটু হলে কি হতো বলতো!
ছিঃ ছিঃ করতো সব। দেখে করতে পারিস না।

ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে সজল তাকিয়ে রইল অহনার দিকে। অহনাও অপলকে তাকিয়ে রয়েছে সজলের দিকে। সেইসময় ঢাক-কাঁঁসি, আর শাঁখের আওয়াজের সঙ্গে পুরোহিতের মন্ত্রোচ্চারণ সারা প্যান্ডেল মুখরিত হয়ে উঠলো। সঙ্গে উলু। এমন অপলক দৃষ্টি যেন শুভদৃষ্টির মুহূর্ত নিয়ে এই মন্ডপে নীরবে উচ্চারণ করছে…
যদিদং হৃদয়ং মম
যদিদং হৃদয়ং তব

পুজো মিটে গেলে যে যার বাড়ি চলে গেলো।

অহনা রাতে ঠিক করে ঘুমতে পারছে না। সকালেই সে বাড়ি ফিরে যাবে ঠিক করে। সজলকে তার ভালো লাগে কিন্তু যদি সিঁদুর তার সিঁথি রাঙিয়ে দিতো!  গ্রামের লোকজনের ব্যঙ্গ বিদ্রূপে লজ্জায় মরে যেতে সে। বাবা মা মেনে নিতো না। তাদের আদরের মেয়ে সে। তাকে নিয়ে কত স্বপ্ন তার বাবা-মার। নামি কলেজে ম্যানেজমেন্ট কোর্সে তাকে এবছর ভর্তি করিয়েছে। উজ্জ্বল ক্যারিয়ার দিকে তাকিয়ে আছে তারা। তারা এখানে পাঠাতে চাইছিলো না।

সে জোর করেই এখানে আসে। আর সত্যিই যদি সিঁদুর তার মাথা রাঙিয়ে দিতো। সে কি বউ হয়ে যেত গ্রামের?

না,না, কি ভাবছে সে এসব। তবে সেই যাই হোক, এ ক'দিনে সজল ছাড়া তার কেমন সব ফাঁকা ফাঁকা লাগে। উসপাশ করছে দেখে টুম্পা বলে,
…ঘুম আসছে না রে? আমারও। আয় আমার কাছে আয়।
মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বলে,
…ঘুমিয়ে পড়। সজলকে তোর ভালো লাগে না রে?
…দিদি, আমি কাল বাড়ি যাবো।
…কাঁদিস না, কত কিছুই ঘটবে জীবনে। তাই বলে হেরে পিছিয়ে যাবি নাকি? নে এবার ঘুমা দেখি, রাত শেষ হয়ে আসছে।

ভবিষ্যতের হাতে না দেখা জীবন ছেড়ে দিয়ে ঘুমিয়ে পড়ল তারা।আগামি,আগামি সূর্যোদয়ের জন্য অপেক্ষা করে রইলো ঘুমের মধ্যে।

(৪)

পাড়ায় পাড়ায় গত রাতের ঘটনাটা নিয়ে এ ও দু এক কথা বলছে। তা দ্রুত গতিতে গাছের পাতায় পাতায় যেন ছড়িয়ে পড়ছে এ পাড়ায় ও পাড়ায়। টিউবওয়েলে মুখ ধুতে গিয়ে দেখে সবাই কেমন কেমন করে তাকাচ্ছে তাদের দিকে।
অহনার প্রতি পাড়ার অন্য অনুরক্ত ছেলেরা তাকিয়ে তাকিয়ে একটু হাপিত্যেস করছে।  তাদের এতদিনের প্রচেষ্টায় মাকালী যেন বাধা হয়ে দাঁড়ালো। কালকের ঘটনা যেন সজলের পাল্লাকে ভারি করে ঝুলিয়ে দিল… যত এসব ভাবছে ততই তাদের মন খারাপ হচ্ছে।মাঝে মাঝে তারা হাতও কামড়াচ্ছে।

মুখ ধুয়ে বাড়ি ফেরে অহনা।কারওর কোনও কথা শুনছে না… আজ সে বাড়ি ফিরবেই। ব্যাগ গোছানো হয়ে গেছে। বেরিয়েও পড়েছে।হটাৎ টুম্পা বললো,
...চলে তো যাবি। সজলের মার সঙ্গে একবার দেখা করবি না?

এমনি চোখটা তার ছলছল করে উঠলো।

টুম্পা এক প্রকারে ঠেলতে ঠেলতে সজলদের বাড়ি নিয়ে গেলো।সজল আর কর্ণ বারান্দায় বসে কাচের স্লাইড কেটে কেটে নাম লিখেছে। আজ রাতেই নাটক হবে। নাটক সুরুর সময় স্লাইডের নামগুলো পর্দায় দেখাবে তারা। যেমন সিনেমায় হয়। একটু তেমন তেমন করতে চাইছে। তাই তার প্রস্তুতি চালাচ্ছে তারা। সজলের মা রান্না ঘরে আনাজ কাটছে। অহনা বাড়ির ভেতরে ঢুকতেই সজলের সঙ্গে একবার চোখাচোখি হলো।পিছনে টুম্পা ছিলো।
…কাকী ঘরে আছো?
…হ্যাঁ, কে টুম্পা? রান্নাঘরে আয়।
এখানে এসে অহনার মনটা যেন আরও খারাপ খারাপ হয়ে গেলো। পা তুলে ভেতরে ঢুকতে চাইছে না।
টুম্পা তাকে ঠেলে রান্না ঘরে ঢুকিয়ে দিলো। যেখানে সে এতদিন বিনা অনুমতিতে সাবলীলভাবে প্রবেশ করতো। আজ কেন এত আড়ষ্টতা তার পায়ে পায়ে জড়িয়ে ধরছে, তা ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না। মুখের ভেতর কথা আটকে আছে। তবু জোর করে বললো,
…মাসিমা আমি চলে যাচ্ছি।
সজলের মা পিছন ফিরে তাকিয়ে চমকে যায়। উঠে দাঁড়াতে অহনা গিয়ে প্রণাম করলো। গালে চুমু খেয়ে বললো,
…সেকি রে মা? যাবি বললেই হলো। আজ দিনটা থেকে যা। রাতে নাটক দেখে তবেই কাল বাড়ি যাস। আয় দেখি, পিঠে খা। তুই আছিস বলেই করলাম। এ ক'দিনে তোকে ভালো তো কিছু করে খাওয়াতে পারলাম না। আয় রে টুম্পা, ওকে নিয়ে ঘরে আয়।

অহনা না করতে পারলো না। অনুগতর মতো ঘরে গিয়ে বসলো।যাওয়া আটকে গেলো তার। সন্ধ্যা গড়াতেই নাটক দেখার জন্য সবাই আগে থেকে মাঠে মাদুর, চট পেতে রেখেছে। সন্ধ্যার আগেই প্রায় বাড়িতে বাড়িতে রান্না শেষ করার তাগিদ লেগে গেছে। কর্ণ একবার এসে সব স্লাইড নিয়ে সজলকে ডেকে গেছে। জোর আন্যাউন্স হচ্ছে। মঞ্চে লাইট লাগানো প্রায় শেষ। এই প্রথম ছেলেদের নাটকে বাইরে থেকে নায়িকা ভাড়া করে এনেছে। উন্মাদনা একদম তুঙ্গে। রাত আটটায় শুরু হবে।

খাওয়া দাওয়া সেরে নিয়ে দলে দলে লোক মাঠের দিকে যাচ্ছে। নায়িকাকে দেখার জন্য গিনরুমের বাইরে ভিড় ঠেলাঠেলি।কর্ণ চঞ্চল হয়ে বারবার পথের দিকে তাকাচ্ছে।মাইকে সজলের নাম আন্যাউন্স করে ডাকছে।আর কিছুক্ষনের মধ্যে নাটক সুরু হবে সে না আসা না পর্যন্ত শুরু করতে পারছে না।যন্ত্র সঙ্গীতে যারা আছে তাদের যন্ত্র মঞ্চের পাশেই দিয়ে দিয়েছে। টুং ট্যাং আওয়াজ করছে তারা।অহনা,টুম্পার সঙ্গে বসে। একবার মঞ্চের দিকে,একবার ভিড়ের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে সজলকে দেখতে না পেয়ে যেন ভেতরে ভেতরে ছটফট করছে।
ওদিকে সজলের বাবাও আসবে। বাড়িতে বসে তাড়াহুড়ো করে পাতা কেটে কেটে বিড়ি বাঁধছে। আসরে বসে বসে খাবে। তার মা তার বাবাকে সমানে তাড়া দিচ্ছে,
…কি গো, তোমার হলো? চলো না। সবাই তো চলে গেছে।
সজলকে চেঁচিয়ে বলছে,
… খোকা কি করছিস? যাবি না? তোকে তো ডাকছে বারবার। চ।
…আসছি। দেখো না চার্জার লাইটের চার্জারটা খুলছে না। এটা না নিয়ে গেলে অন্ধকারে স্লাইডগুলো দেখাবো কি করে?
তার মুখের কথা শেষ না হতে হতে আঁআঁআঁআঁআঁআঁ আওয়াজ ভেসে আসছে ঘর থেকে।
…কিরে অমন করছিস কেন? ওগো খোকার কিছু হয়েছে মনে হয়!
সজলের বাবা পিছন ফিরে দেখে সজলের হাতে চার্জারের তার জড়িয়ে আছে। সে কাঁপছে থরথর করে।তার মুখ থেকে গোঁয়ানির আওয়াজ বেরুচ্ছে। হুড়মুড়িয়ে উঠতে গেলো... বাঁধা বিড়ি, পাতা, মশলা ছিটকে পড়লো উঠোনে। কি করবে ঠিক করে উঠতে পারছে না। সজলের মা হাউ হাউ করে কাঁদছে...
…ওগো কে কোথায় আছো? আমার ছেলেকে বাঁচাও!বাঁচাও!
তখন মাইকের ঘোষণা ছড়িয়ে পড়ছে পাড়ায় পাড়ায়, গ্রামের কোণে কোণে
…সজল যেখানেই থাকো এখনই মঞ্চে এসো। তুমি না এলে আমরা নাটক শুরু করতে পারছি না।
সেই আওয়াজে বেদনাদীর্ন মায়ের আর্তনাদ পরাস্ত হচ্ছে অসহায় ভাবে। কারও কানে গিয়ে পৌঁছাচ্ছে না।
ভয়ে, স্নেহে দৌড়ে ছেলেকে ধরতে গেলো। সজলের বাবা তার মাকে টেনে ধরে রাখলো। একা কাকে ছেড়ে কাকে বাঁচাবে। তবু কাঁদতে কাঁদতে অসহায়ের মতো চেঁচাতে লাগলো,
…ওরে কে কোথায় আছিস ?আমাদের সজলকে 'কারেন' ধরেছে রে!ওকে বাঁচা! সব শেষ করে দিলো রে?
আর কে কোথায়! কোথাও কারো সাড়া নেই। ছেলে গোঁয়াচ্ছে, বউকে টেনে রাখতে পারছে না। কেউ আসছেও না যে! কি করবে ভাবতে ভাবতে চোখের সামনে উঠোনে বাঁশের টুকরোটা চোখে পড়লো। ওমনি সজলের মাকে ঠেলে ফেলে দিয়ে দিগ্বিদিক জ্ঞান হারিয়ে বাঁশের টুকরোটা নিয়ে দৌড়ে গেলো ঘরে। বাঁশের টুকরোটা শক্ত করে ধরে সপাট করে কষিয়ে দিলো সজলের পিঠে। গোঁৎ করে হাত দুয়েক দূরে ছিটকে পড়লো সজল। মুখে কোনও সাড়া নেই।
সজলের মা দৌড়ে এসে তার মাথাটা কোলে তুলে নিলো।হাউ হাউ করে কাঁদছে, 
…কথা বল খোকা।কথা বল।
চোখের জল টপে টপে পড়ছে সজলের মুখে।সজলের বাবা ঘরে মেঝের উপর উবু হয়ে বসে।

দুই হাত মাথায় দিয়ে বারবার মাথা নাড়ছে,
…এ আমি কি করলাম। কি করলাম। কি করলাম রে…

মাঠে কর্ণ থাকতে পারলো না। দৌড়তে দৌড়তে আসছে। ডাকছে আর বলছে,
…সজল, সজল চল রে। টর্চ নিয়ে বেরিয়ে আয়। কি করছিস এখনও?  আয় রে।
উঠনে এসে থমকে যায় সে। কর্ণকে দেখে সজলের মা উন্মাদিনীর তার কাছে ছুটে আসে,
…ওকে 'কারেন' ধরেছে। ওকে বাঁচা, বাবা। বাঁচা।
কর্ণ আর দাঁড়ালো না। ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়াচ্ছে।মাটিতে পা পড়ছে কি না সে হুঁশ নেই তার। দৌড়াচ্ছে আর চিৎকার করছে,
…সজলকে কারেন ধরেছে রে। ওরে, সজলকে কারেন ধরেছে। মেন ফ্যাল, মেন ফ্যাল…

মাইকে ঘোষণা হচ্ছে,
...আর কিছুক্ষণের মধ্যে নাটক। শুরু হবে। সবাইকে ধন্যবাদ ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করার জন্যে। আর কিছু…
সেই আওয়াজে কর্ণর গলার স্বর কোথায় তলিয়ে যাচ্ছে। লোকজন মঞ্চের দিকে তাকিয়ে আছে কখন শুরু হয়, কখন শুরু হয়। ধৈর্য হারিয়ে ফেলছে। কর্ণ হাঁপাতে হাঁপাতে মঞ্চের সামনে এসে তপনকে বলছে। তপনের হাতের মাইকোফোনে ছড়িয়ে পড়লো,
...সজলকে, সজলকে কারেন ধরেছে। মেন ফ্যাল, মেন ফ্যাল…
মাঠের পাশেই ছিলো ট্রান্সফর্মা। মেইন ফেলতে নিমেষে অন্ধকার চেপে বসলো মৌরিগ্রামে। হঠাৎ অন্ধকারে ভয়ে আতঙ্কে যে যেমন করে পারলো হুড়মুড়িয়ে দৌড়তে লাগলো সজলদের বাড়ির দিকে।ভিড়ে বাচ্চাদের কান্নার রোল কঁকিয়ে কঁকিয়ে উঠছে। লোকজনের ঠেলাঠেলি। কে কার গায়ে পা দিয়ে সেদিকে ছুটলো তার হিসেব নেই। টর্চের আলোগুলোও দৌড়াচ্ছে রাস্তা দিয়ে।
অহনা টুম্পাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠলো…দিদি।
টুম্পাও তার হাত ধরে পড়িমরি করে গেলো সেদিকে। গিয়ে দেখে, সজলের মাথাটা তার মায়ের কোলে।তার মায়ের চোখের জলে সজলের মুখটা ভিজে যাচ্ছে। দুই ঠোঁটের ফাঁক থেকে গাজা আর রক্ত বেরিয়ে বেরুচ্ছে। আঁচলে তা মুছে দিচ্ছে তার মা। পাড়ার ছেলেরা, তার কাকিমা তেল গরম করে সারা গায়ে ঘসছে। কিন্তু তার কোনও সাড়া নেই।
পাড়ার হাতুড়ে ডাক্তার এল। কিছুক্ষণ দেখে বারান্দা থেকে নেমে যাওয়ার সময় বলে গেলো,
…আঘাতটা বোধহয় সহ্য করতে পারেনি! আর নেই।
সঙ্গে সঙ্গে কান্নার রোল সেই অন্ধকারের কোণে কোণে ছড়িয়ে পড়লো। অন্ধকারটা আরওঃ ভারি হয়ে উঠলো নিমেষে। বাতাস ঘন বেদনায় ভারাক্রান্ত হয়ে আর সরছে না। কান্না ভেজা সজলের সুখ্যাতি কথা ভেসে ভেসে বেড়াচ্ছে। যত সময় গড়াচ্ছে লোক তত আসছে। সজলকে দেখে তারাও শোকের কিনারায় আছড়ে পড়ছে।
সজলের বাবা বারান্দার খুঁটিতে হেলান দিয়ে বসে মাথা নাড়ছে আর বলছে,
…কি করলাম রে! কি করলাম রে...

মৃতদেহ আগলে বসে রইলো অনেকে। কেউ কেউ হাহুতাশ করতে করতে বাড়ি ফিরছে। এভাবে কত রাত হলো তা কেউ খেয়াল করেনি। অহনা এক কোণে খুঁটি ধরে সজলের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। চোখের জল ঝরে পড়ছে অবিরাম ধারায়। অহনার হাত এতক্ষণ চেপে ধরে ছিলো টুম্পা। কি ভেবে তাকে সে সজলের মায়ের কাছেও যেতে দিলো না।

এখন হাত ধরে টানতে টানতে বললো
… চল, বাড়ি চ।
অহনার পা যেন আর উঠছে না। কেউ যেন পা দুটো জোর করে টেনে ধরে রেখেছে।ছাড়তেই চাইছে না।
টুম্পার টানে উঠনে পা ফেলতেই গাঢ় অন্ধকার তাকে আরও জাপ্টে ধরলো। কান্নায় বুকটা তার ফেটে চৌচির হয়ে যাচ্ছে।

যত এগোচ্ছে, ততই তার কানে ভেসে আসছে সজলের মায়ের হাহাকার করা কান্না,
…খোকা কথা বল।কথা বল খোকা...

অনেকদিন পরে মৌরিগ্রাম আবার নিকষ অন্ধকারে ডুবে গেলো।

0 comments: