0

অমৃত সদন - শামিম আহমেদ

Posted in





















নির্দিষ্ট সময়ে সভার কাজ আরম্ভ হল। একলব্যের কাকা রজতধনু জঙ্গলের নানা সমস্যার কথা বলতে লাগলেন। দূরে যে নদী বয়ে যায়, সেখানে আর আগের মতো মাছ পাওয়া যায় না। এমনকি জঙ্গলের কোথাও কোথাও বাইরের লোক আসে, নোংরা করে চলে যায়। সামনাসামনি হলে একদিন মুখের উপর জবাব দেবেন, কিন্তু পাচ্ছেন না, তক্কে তক্কে আছেন!

হিরণ্যধনু বললেন, আমাদের সমাজ তো নগরের মতো নয়। এখানে গাছ, পাহাড়, জঙ্গল, পশুপাখি আমাদের নিজস্ব ধন। তাদের ক্ষতি মানে আমাদের কষ্ট। বাইরের লোকের সেই বিবেচনা নেই, বিশেষ করে নগর থেকে যারা আসে। জানি না, কতদূর এই জলাজঙ্গলপর্বত আর পশুদের রক্ষা করতে পারব আমরা! জঙ্গলে মানুষের বাস করাই উচিত নয়, তাতে জানোয়ারদের ভারি অসুবিধা হয়। কিন্তু আমাদের উপায় নেই। এককালে আমাদের পূর্বপুরুষ হস্তিনানগরে ছিল, এক রকম বাধ্য হয়ে চলে এসেছিল তারা। তার পর এই জঙ্গল।

অঙ্গার বাবা এইবার মুখ খোলেন, কেন চলে এসেছিলাম সেই সব কথা ছেলেছোকরাদের বলা দরকার রাজা!

রাজা বলেন, হ্যাঁ, সে সব কথা পরে বলব; আজকের সভায় নয়।

অঙ্গার পিতা কিরিটিভূষণ পুনরায় বলেন, কিন্তু বলতে তোমাকে হবেই। হস্তিনার বাজারে যখন আমরা যাই শুকনো ডালপালা, ফলমূলের বদলে একটু কাপড়, মশলাপাতি আর সুগন্ধ আনতে, ওরা এমন ভাবে আমাদের দিকে তাকিয়ে থাকে যে মনে হয় আমরা বুঝি মানুষ না!

একলব্যের মা জাম্ববতী বলেন, তা মানুষ হবে কী প্রকারে! ওদের মতো যদি আগুনে সেঁকা কাপড় না পরে তুমি বাঘছাল পরো, তবে তো গা থেকে বদবু বের হবে। তোমাকে হয়তো বাঘ ভাবে হস্তিনার লোকেরা!

বলেই খিলখিল করে হাসতে থাকেন জাম্ববতী।

কিরিটিভূষণও হাসতে থাকেন। হাসতে হাসতেই জবাব দেন জাম্ববতীর কথার, বাঘছাল নিয়ে কিছু বোলো না গো দিদি, স্বয়ং বাবা মহাদেবের বসন।

জাম্ববতী দুই হাত তুলে নমস্কার করেন। তাঁর দেখাদেখি সভার প্রত্যেকে বাবা মহাদেবের উদ্দেশে প্রণতি জানায়। একলব্য ভাবে, সে যে হস্তিনায় গিয়ে গুরু দ্রোণের কাছে অস্ত্রশিক্ষা করবে, সে নিয়ে এই বার কথা হওয়া উচিত।

হিরণ্যধনু নিজেই তুললেন সেই প্রসঙ্গ, রাজকুমার একলব্য চাইছিল যে সে হস্তিনায় গিয়ে গুরু দ্রোণের কাছে ধনুর্বিদ্যা শিখতে যাবে। এই ব্যাপারে প্রত্যেকের মতামত শুনে রাখা ভাল।

অঙ্গাগ্রণী এই বার মুখ খোলে, হস্তিনা হল গিয়ে নগর, আর আমরা থাকি বনে। নগরে কি বনবাসীর থাকা শোভা পায়! আমার বাপু এই ব্যাপারে মত নেই।

অঙ্গার এক বন্ধু শ্রী মুখ টিপে হাসছিল। রাজা তাঁকে জিজ্ঞাসা করলেন, তুই কিছু বলবি মা?

শ্রী হাসি থামিয়ে বলে, যাক না! কিন্তু সেখানে গিয়ে ও খাবে কী, থাকবে কোথায়?

রাজা ভেবে দেখলেন, কথাটা মন্দ বলেনি শ্রী। এই সমস্যার কথা তো তাঁর মাথায় আসেনি।

বাঁকা নামের এক ছোকরা নগরে কাঠ দিতে যায়, সে বলে—কেন, আমরা রাত হলে তো নগরের বাইরে একটি ছাউনিতে থাকি, সেখানেই থাকবে একলব্য। এ আর এমনকি!

শ্রী জিজ্ঞাসা করে, খাবে কী?

বাঁকা বলে, ফলমূল। তাছাড়া, হস্তিনায় অনেক শূদ্র বাস করে নগরের বাইরে। তাদের কারও বাড়িতে থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করলেই হল।

রাজা হিরণ্যধনু বলেন, সে ব্যবস্থা হয়ে যাবে। আমাদের আত্মীয়স্বজন কিছু রয়েছেন সেখানে। আমি ভাবছি অন্য কথা।

একলব্য প্রশ্ন করে, কী কথা বাবা?

রাজা বলেন, তোমাকে দ্রোণ শিষ্য হিসাবে গ্রহণ করবেন না।

বাঁকা বলে, না না নেবে। সূত অধিরথের ছেলেকে নিয়েছে আর নিষাদ রাজার ছেলে রাজকুমারকে নেবে না!

গ্রামবুড়ো চাদর থেকে মুখ বের করে বললেন, একলব্য ক্ষত্রিয়সন্তান—ও শূরসেনের তৃতীয় পুত্র দেবশ্রবার জ্যেষ্ঠ পুত্র। একলব্যের পিসির নাম পৃথা ওরফে কুন্তী, তিনি রাজা পাণ্ডুর বিধবা পত্নী। থাকেন হস্তিনায়।

একলব্য বলেন, না। আমার পিতা হিরণ্যধনু, আমরা জাতিতে নিষাদ।

গ্রামবুড়ো বলেন, তাহলে তোকে নেবে না, যাস নে বাপ!

রাজা হিরণ্যধনু রায় দিলেন, একলব্য যাবে হস্তিনানগরে। দেখা যাক, ভীষ্ম তাকে দ্রোণের কাছে অস্ত্রশিক্ষার অনুমতি দেয় কিনা!

পরদিন সব কিছু গোছগাছ করে নিয়ে একলব্য বেরলো হস্তিনানগরের দিকে, প্রথমে যেতে হবে অনেকটা পশ্চিমে, তার পর উত্তরে হপ্তা খানেকের রাস্তা। ঘোড়ার পিঠে চেপে যাওয়াই মনস্থ করল সে। হাতি বেশ মন্থর প্রাণী। অনেকটা খাবার, আর প্রচুর তীর ধনুক সঙ্গে নিল সে। প্রথমে হস্তিনানগরের বাজারে গিয়ে সে তীর ধনুক বেচবে, তার পর খোঁজখবর নিয়ে যাবে আচার্য দ্রোণের কাছে। এই জঙ্গল থেকে বেরিয়ে প্রথমে তাকে মহানদী পার হয়ে যেতে হবে চেদি রাজ্যে। সেই সব পথ জেনে নিয়েছে একলব্য।

মহানদী পার হলেই তার গা ছমছম করে। ঘোড়া সমেত এই নদী পেরনো খুব সহজ নয়। এই জলধারাই নিষাদরাজ্যের প্রাণরেখা। পানের জল থেকে মাছ ধরা সব হয় এই নদীকে কেন্দ্র করে। নদী পার হয়ে অনেকটা পথ এগিয়ে গেল একলব্য, তেজি অশ্বের পিঠে চড়ে। নিজের খাবার, ঘোড়ার খাবার সব নেওয়া সম্ভব নয়। ঘোড়া তবু ঘাস খেয়ে থাকতে পারে, কিন্তু শুধু ঘাসে ঘোড়া তেজিয়ান থাকে না। তাকে ছোলা গুড় খাওয়াতে হয়, দিতে হয় ধেনো মদও। সে সব কোথায় পাবে একলব্য? প্রায় তিন দিন তিন রাত কখনও কখনও চলে, কখনও বিশ্রাম নিয়ে তারা—একলব্য ও ঘোড়াটি পৌঁছলো চেদি রাজ্যে। এখানে রাজত্ব করেন শিশুপাল। তিনি বৃষ্ণিবংশীয় রাজা, পিতা হিরণ্যধনুর বন্ধু মানুষ।

রাজার আতিথ্যে কোনও ত্রুটি ছিল না। কয়েক দিন বেশ আরামে ও আয়াসে কাটিয়ে ঘোড়া বদলে নিয়ে এই বার উত্তরে যাওয়ার পরিকল্পনা করল একলব্য।

শিশুপাল বললেন, কোনও দরকার ছিল না হস্তিনায় যাওয়া। পূর্ব দেশে তীরন্দাজের আকাল পড়েছে নাকি হে যে তুমি ছুটছো উত্তর পানে? আমার রাজ্যেই আছেন অনেক বড় রুস্তম, তারা তোমাকে তীর ধনুক থেকে শুরু করে গদা সব শিখিয়ে দেবে। তাছাড়া, তোমার পিতা হিরণ্যধনু তো মস্ত তীরন্দাজ! রাজা জরাসন্ধ তো এমনি এমনি তাকে সেনানায়ক করেনি!

একলব্য বলে, আমাকে আচার্য দ্রোণের নামখানিই বড্ড টানছে হে পিতৃবন্ধু! শুনেছি তিনি সমগ্র ধনুর্বিদ্যা লাভ করেছেন মহর্ষি পরশুরামের কাছে।

“আমিও শুনেছি। কিন্তু ও সব হল ইন্দ্রজাল। আসল ক্ষমতা হল লাঠি। অতিসামীপ্যের জন্য। অনতিদূর থেকে তীরধনুক। অতিদূরের জন্য আগ্নেয়াস্ত্র। সব শিখতে পারবে এই চেদি রাজ্যে। এ হল লাঠির রাজা উপরিচর বসুর দেশ।”

“সে কাহিনি শুনতে ইচ্ছা করি।”

শিশুপাল বললেন, বলছি সেই উপাখ্যান। তোমার পিতা হিরণ্য নিশ্চয় এতদিনে তোমাকে বলেছেন যে তোমার পিতা ও আমার মাতা ভাইবোন?

“কই না তো! তবে শুনেছি, আমি নাকি শূরসেনের পুত্র দেবশ্রবার ঔরসে জন্মেছি। ব্যস, এইটুকুই!”

“ঠিক শুনেছো বৎস! আমার মাতা শ্রুতশ্রবা দেবশ্রবার দিদি। তুমি আমার বন্ধুপুত্র হলেও আসলে তুমি আমার মামাতো ভাই!”

একলব্য বলে, এসব আমার মাথায় ঢুকছে না পিতৃব্য!

“শোনো। শূরসেনের দশ পুত্র আর পাঁচ কন্যা। পুত্রদের মধ্যে সবার বড় বসুদেব, তার পর দেবভাগ, দেবশ্রবা, আনক, সৃঞ্জয়, শ্যামক, কঙ্ক, শমীক, বৎসক ও বৃক। শূরসেনের পাঁচ কন্যা—পৃথা, শ্রুতদেবা, শ্রুতকীর্তি, শ্রুতশ্রবা ও রাজাধিদেবী। হস্তিনা গেলে পৃথা মানে আমার মাসি আর তোমার পিসির সঙ্গে সাক্ষাৎ কোরো।”

একলব্যের মাথায় ঘুরছে অস্ত্রশিক্ষার কথা। তিনি এই সব আত্মীয়তার কূটকচালি শুনতে চান না। শিশুপালকে একলব্য জানালেন, আগামীকাল ভোরে হস্তিনার উদ্দেশে রওনা দেবেন তিনি। আজ রাতে উপরিচর বসুর লাঠি বা দণ্ডের কাহিনি শুনে নিতে চান।

শিশুপাল শুরু করেন কাহিনি।

0 comments: