গল্প - দীপারুণ ভট্টাচার্য
Posted in গল্প[১]
নয় তলার ওয়েটিং রুমে সৌরভ অনেকক্ষণ ধরে অপেক্ষা করছে চিফ ইঞ্জিনিয়ার জয়ন্ত দত্তের সঙ্গে দেখা করবে বলে। আজ দেখা করাটা খুব জরুরী। একটা ফাইল এই মুহূর্তে জয়ন্ত দত্তের টেবিলে পড়ে আছে। ঐ ফাইলটার উপর ঝুলে আছে সৌরভের ভবিষ্যৎ। বিষয়টা কি দত্ত সাহেব বুঝবেন! এই অফিসে কোনদিন এতক্ষণ ওয়েটিং রুমে বসে থাকেনি সৌরভ। ইলেক্ট্রিক্যাল কাজের নানান জটিল সমস্যার সমাধান খুঁজতে এই অফিসের বড় বাবুরা বিভিন্ন সময় তাকে ডেকে পাঠায়। বিষয়ের উপর এমন দখল ইন্ডাস্ট্রির বহু লোকের নেই। সেই জন্যেই সৌরভের এত কদর। তবে শুখনো কথায় তো আর চিঁড়ে ভেজে না। গত কয়েক বছরের মধ্যে কয়েকটা খুচরো অর্ডার ছাড়া সেভাবে কিছুই পাওয়া যায়নি। কোভিডের দোহাই দিয়ে দুটো বছর তো চলল। কিন্তু আর কতদিন! তার কোম্পানি এক কথা, তোমাকে এতই যদি সবাই পছন্দ করে তাহলে কাজ দেয়না কেন? উত্তর দিতে পারে না সৌরভ। দিল্লি থেকে বড় সাহেব সেদিনও ফোন করেছিলেন, ‘কোলকাতায় বসে বসে নিজের ভবিষ্যৎ নষ্ট করে দিও না। কোম্পানির প্রস্তাবে রাজি হয়ে যাও। এত কম কাজের জন্যে কোম্পানি তোমার মতো একটা লোককে কোলকাতায় কেন রাখবে, বলতে পারো?’
একজন চিফ ইঞ্জিনিয়ারের ঘর থেকে বেরিয়ে যেতেই সৌরভ উঠে দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়াল। আর ঠিক সঙ্গে সঙ্গেই পিয়ন বলল, ‘আপনি একটু বসুন। হাত খালি হলে স্যার নিজেই আপনাকে ডেকে নেবেন, বলেছেন। বসতে আর ভালো লাগছে না। সৌরভ ডেপুটি চিপের ঘরের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। চঞ্চল মল্লিক ছোটখাটো চেহারার মানুষ। তিনি সৌরভের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘আরে, আপনি আজকে, কি মনে করে?’ ঘরে আর একজন বসে আছেন। সবার সামনে সব কথা বলা যায় না। সৌরভ কোন উত্তর না দিয়ে একটা চেয়ারে বসে বলল, ‘ভালো আছেন স্যার?’ চঞ্চল মল্লিক দাঁড়িতে হাত বোলাতে বোলাতে বললেন, ‘খুব চাপে আছি’। সৌরভ খানিকটা অবাক হয়ে বলল, ‘আপনারা যদি চাপে থাকেন, তাহলে আমরা কাজ কর্ম পাচ্ছি না কেন?’ এই প্রশ্নে খানিকটা শুখনো হাসি দিয়ে মল্লিক বললেন, ‘এই চাপটা যে কাজের সেটা তো বলিনি!’ এরপর অন্য লোকটার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘আপনি তাহলে আজ আসুন। আগামী সপ্তাহে একবার ফোন করে আসবেন’। ভদ্রলোক বেরিয়ে যেতেই মল্লিক খুব নিচু গলায় বললেন, ‘কি জন্যে এসেছেন বলুন তো?’ টেবিলের উপরে খানিকটা ঝুঁকে চঞ্চল মল্লিকের কানের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে সৌরভ বলল, ‘শুনলাম রঘুনাথগঞ্জের টেন্ডার থেকে আমাদের নাম বাদ দেওয়ার সুপারিশ এসেছে দত্ত সাহেবের কাছে’। নিজের মনভাব গোপন করার ভঙ্গিতে মল্লিক বললেন, ‘তাই নাকি; কেন?’ ‘সেটাই তো বুঝতে পারছি না। টেন্ডারে যা যা কাগজ চাওয়া হয়েছিল আমরা প্রতিটা কাগজই সঠিক ভাবেই দিয়েছি’ একটু নড়ে বসলো সৌরভ। মল্লিক হাসি হাসি মুখে জানলা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে রইলেন কিছুক্ষণ। তারপর বললেন, ‘টেন্ডার জমা দেওয়ার সময় একটা কথা বলেছিলাম, মনে আছে?’ সৌরভ মাথা নিচু করে রইল। তার মনে পড়ে গেল সেই দিনের কথাটা। মল্লিক বাবু বলেছিলেন, ‘পাওয়ার ইচ্ছা থাকলেই সবকিছু পাওয়া যায় না। যে দেবে তারও দেওয়ার ইচ্ছা থাকা দরকার’।
বেয়ারা এসে চা জল দিয়ে গেল। কাপে একটা লম্বা চুমুক দিয়ে মল্লিক বললেন, ‘অসময়ে কোন কিছু পেতে চাইলে অনেক বেশি মূল্য দিতে হয়। গরমকালের আম যিনি অনেক দাম দিয়ে শীত কালে কিনেছেন তিনি সেটা যাকে তাকে বিলিয়ে দেবেন… তা হয় না’। কোন উত্তর আসছে না সৌরভের মাথায়। এমন একটা ইঙ্গিত চঞ্চল মল্লিক আগেও অনেকবার দিয়েছেন। চিফ ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার জন্যে বিভিন্ন জায়গায় কাঠ খড় পুড়িয়েছেন জয়ন্ত দত্ত। এখন রঘুনাথগঞ্জের মতো টেন্ডারের সাহায্যে তিনি সেই কাঠ খড় পুনরুদ্ধারের কাজে নেমেছেন। বিষয়টা তার কোম্পানিকে বলেনি সৌরভ। তাহলে কোম্পানি এই টেন্ডারে উৎসাহ দেখাতো না। কোম্পানির কাছে অনেক কাজ আছে। কোলকাতায় কাজ পাওয়াটা সৌরভের ব্যক্তিগত টার্গেট। যাতে পরিবারকে ছেড়ে তাকে বাইরে কোথাও চলে যেতে না হয়। কোম্পানি অনেকদিন থেকেই তাকে বড় দায়িত্ব দিয়ে আফ্রিকায় পাঠাতে চাইছে। সৌরভ রাজি হচ্ছে না। ঐসব দেশে বউ ছেলেকে নিয়ে থাকা যাবে না। টাকাটাই কি জীবনের সব! প্রতিদিন বাড়ি ফেরার পর ছেলেটা যখন ‘বাবা বাবা’ বলে ছুটে আসে তখন সৌরভ দেওয়ালে টাঙানো গুরুদেবের ফটোটার দিকে তাকিয়ে বলে, দুধ ভাত চাইনা ঠাকুর; নুন ভাতটা যেন জুটে যায়!
চা শেষ। হঠাৎ মনে হল, চঞ্চল মল্লিকের কেবিনে কি সে অনেকক্ষণ চুপচাপ বসে আছে। সিগারেটের প্যাকেটটা দেখিয়ে চঞ্চল বললেন, ‘চলুন একটা সিগারেট খেয়ে আসি। আজ আপনাকে একটু অন্য রকম লাগছে’। উঠে দাঁড়াল সৌরভ। তারপর বলল, ‘আপনি সিগারেট খেয়ে আসুন। আমি দেখি জয়ন্ত বাবুর সময় হল কিনা’। করিডরের দিকে যেতে যেতে মল্লিক সান্ত্বনা দেওয়ার ভঙ্গিতে বললেন, ‘বেশি চিন্তা করবেন না। যা হবে ঠিকই হবে’। সমুদ্র স্নানের পর বালি ঝাড়ার মতো করে চঞ্চল মল্লিকের কথাগুলো ঝেড়ে ফেলার চেষ্টা করতে করতে সৌরভ জয়ন্ত দত্তের কেবিনের সামনে এসে দাঁড়াল। পিয়ন, নির্মল সিটে নেই। সুযোগটা কাজে লাগিয়ে দরজা ঠেলে একটু মুখ বাড়িয়ে সৌরভ বলল, ‘আসবো স্যার?’ টেবিলের উপর রাখা একটা সবুজ রঙের ফাইলে গভীর ভাবে ডুবে ছিলেন চিফ ইঞ্জিনিয়ার। তিনি মুখ তুলে তাকিয়ে বললেন, ‘আসবেন… আচ্ছা, আসুন’। চেয়ার টেনে বসে সৌরভ কোনরকম ভণিতা না করে বলল, ‘স্যার রঘুনাথগঞ্জের টেন্ডার থেকে আমাদের কি বাদ দেওয়া হচ্ছে?’ বিষয়টা যেন কিছুই জানেন না এই ভাবে জয়ন্ত দত্ত বললেন, ‘তাই নাকি; আপনি কিভাবে জানলেন?’ সেকথার কোন উত্তর না দিয়ে সৌরভ বলল, ‘স্যার, আমাদের কিন্তু কাগজে কোন ভুল নেই। আর কাজ পেলে আমরাই যে সব থেকে ভালো কাজ করবো সেটাও নতুন করে আপনাকে বোঝানোর কিছু নেই’। জয়ন্ত দত্ত হ্যাঁ সুচাক মাথা নাড়তে নাড়তে কথা গুলো শুনলেন। কিন্তু কোন উত্তর দিলেন না। সামনের জন কথা না বললে, কথা চালিয়ে যাওয়া মুশকিল। কিন্তু সৌরভ নিরুপায়। বছর খানেক আগে রঘুনাথগঞ্জের কাজটা যখন চিন্তা ভাবনার স্তরে ছিল তখন অনেকবার জয়ন্ত দত্ত তার থেকে সাহায্য নিয়েছিল। তখন তিনি ডেপুটি চিপ ছিলেন।
‘আপনি কিন্তু আমার কথার উত্তর দিলেন না স্যার’, বলল সৌরভ। ‘কি উত্তর দেবো?’ জয়ন্ত দত্ত নিজের মোবাইলের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘দেখুন স্কুটিনি চলছে। এখন এসব বিষয়ে কথা বলার নিয়ম নেই; বুঝতেই তো পারছেন!’ সৌরভ লক্ষ করলো লোকটা তার চোখে চোখ রাখতে পারছে না। কথা বলছে অন্যদিকে তাকিয়ে। নিজের দৃষ্টি একটু কঠিন করে সে বলল, ‘সব কাগজ ঠিক থাকার পরও একটা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিকে বাদ দেওয়া আপনাদের নিয়মের মধ্যে আছে?’ মোবাইল থেকে মুখ তুলে জয়ন্ত দত্ত কঠিন কণ্ঠে বললেন, ‘আপনি কি আমাকে জেরা করতে এসেছেন?’ নরম অথচ দৃঢ় গলায় সৌরভ বলল, ‘জেরা কেন করবো, আমি বিষয়টা বুঝতে এসেছি’। একটুও ধাক্কা না খেয়ে জয়ন্ত দত্ত বললেন, ‘আপনাকে সব কিছু বুঝিয়ে দেওয়ার দায় আমার নেই’। সৌরভ জানে বিষয়টাকে কোর্ট পর্যন্ত টেনে নিয়ে গেলে জয় নিশ্চিত। তবে তার কোম্পানি সে সব কিছুই করতে রাজি হবে না। তবুও একটা শেষ মোচড় দেওয়ার মতো করে সে বলল, ‘বিষয়টা নিয়ে আমার কোম্পানি যদি এগোয় তাহলে আপনার কোন আপত্তি নেই তো?’ ভদ্রলোক কিছু একটা যেন বলতে যাচ্ছিলেন। হঠাৎ সেই কথা গিলে নিয়ে বললেন, ‘আপনি আপনার মতো এগলে আমাকেও আমার মতো এগোতে হবে!’ এরপর কয়েকটা মুহূর্ত কেটে গেল নীরবে। তারপর জয়ন্ত দত্ত একটু নরম সুরে বললেন, ‘আহা, টেকনিক্যাল রাউন্ডে টিকে গেলেই যে আপনারা কাজ পাবেন এমন কি কোন নিশ্চয়তা আছে? তার চেয়ে বরং অপেক্ষা করুন না কিছু দিন। যে কোম্পানি কাজ পাবে সেখানে না হয় আপনার একটা সুপারিশ করে দেওয়া যাবে। সব সময় বেশি দূর ভাবতে নেই’। উঠে দাঁড়ালো সৌরভ; ‘মনে হচ্ছে আপনি স্যার, আমার থেকেও বেশি ভাবছেন’। কোন কথা না বলে একটু হাসলেন জয়ন্ত দত্ত। পাশের চেয়ার থেকে তার ব্যাগটা তুলে নিলো সৌরভ। তারপর আবার সেই দৃঢ় ও মার্জিত গলায় বলল, ‘আপনার বিষয়ে অনেকের আছে অনেক কিছু শুনতাম আর ভাবতাম তারা আপনার দ্রুত উন্নতিকে ঈর্ষা করে। আজ মনে হচ্ছে ঈর্ষা শব্দটা ঠিক নয়। উপযুক্ত শব্দ হয়তো ঘৃণা’। দরজার দিকে হাঁটা দিলো সৌরভ। সে আড়চোখে দেখল চিড়িয়াখানার বাঘের মতো হিংস্র দৃষ্টিতে চিফ ইঞ্জিনিয়ার সাহেব তার দিকে তাকিয়ে আছে।
মেন গেট পেরিয়ে সিআইটি রোডের উপর এসে দাঁড়াল সৌরভ। এতদিন এই সাদা রঙের বাড়িটার প্রতি একটা ভালোলাগা ছিল। এই মুহূর্তে এই বাড়ির সবাইকে পর মনে হচ্ছে। একটু দূরে রাস্তার উল্টোদিকে বিধান রায়ের মূর্তি। একটা সিগারেট ধরিয়ে কয়েকটা টান দিয়ে সেটাকে ছুঁড়ে ফেলে দিলো সৌরভ। আফ্রিকায় তার ট্রান্সফারটা আটকানোর কোনও কৌশল এখন মাথায় আসছে না। হাত তুলে একটা ট্যাক্সিকে ডাকল সৌরভ। অফিসে নয়, সে এখন বাড়ি যাবে। তার ঘুম পাচ্ছে।
[২]
গলির মধ্যে ঢুকতেই হঠাৎ একজন চিৎকার করে বলল, ‘থামাও থামাও’। থেমে গেল ট্যাক্সি। জানলা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে সৌরভ দেখল অস্থির মুখে দাঁড়িয়ে আছেন কাকামণি। তাকে দেখে ভরসা পাওয়ার সুরে ভদ্রলোক বললেন, ‘আরে তুই; ভালোই হয়েছে। আয়, তাড়াতাড়ি নেমে আয়’। বিষয়টা বুঝতে না পেরে সৌরভ বলল, ‘আমি বাড়িতে ব্যাগটা রেখে এখুনি আসছি’। একসময় সৌরভের বাবা আর কাকা ঠিক করেছিলেন তারা এক পাড়ায় তবে আলাদা আলাদা বাড়িতে থাকবেন। কাকার ছেলে রজতের আজ বিয়ে। সৌরভের আসার কথা ছিল গতকাল বিকেলে। আফ্রিকা থেকে দুবাই, সেখান থেকে দিল্লি হয়ে কলকাতা। বিমানের গোলমালে দেরি হয়ে গেছে। রাতে ঘুমও হয়নি। কাকামণি হাত নেড়ে বললেন, ‘আমাদের ট্যাক্সিটা চাই। গায়ে হলুদের তত্ত্বে মাছ মাস্ট। এই হতচ্ছাড়া নেপাল কি করেছে দেখেছিস!’ বলে বারান্দার উপর রাখা একটা মরা কাতলা মাছের দিকে আঙুল দেখালেন কাকামণি। ট্যাক্সি থেকে নামতে নামতে সৌরভ বলল, ‘কেন এই মাছটার আবার কি হল?’ কাকামণি ধমক দিয়ে বলল, ‘বেয়াই বাড়িতে এই পুচকি মাছ পাঠালে আমাদের মান ইজ্জত কিছু থাকবে?’ নেপাল মিউ মিউ করে বলল, ‘মাছটা দুই কিলো কাকা’। কাকামণি নেপালকে একটা ধাক্কা দিয়ে বলল, ‘তাড়াতাড়ি ট্যাক্সিটা নিয়ে যা, আর যেখান থেকে পারিস চার থেকে পাঁচ কিলোর একটা মাছ নিয়ে আয়’। ট্যাক্সি নিয়ে নেপাল চলে যেতেই কাকামণি বললেন, ‘মেয়ের বাবা যা করছে তার সামনে আমি কিছুই না। তবুও চেষ্টাতো করতে হবে। কি বলিস?’ উত্তর দিলো না সৌরভ।
বাড়ি ফিরে ছেলের সঙ্গে কিছুক্ষণ ধস্তাধস্তি করার পর স্নান খাওয়া সেরে ঘুম দিলো সৌরভ। বাড়ির সবাই বিয়ে বাড়িতে ব্যস্ত। বিয়ে হবে গোধূলি লগ্নে। বিকেলের মধ্যেই পৌঁছবে বরযাত্রী। সৌরভের ঘুম তখনো কাটেনি। বউ আর ছেলেকে নিয়ে সে যখন বিবাহ বাসরে গিয়ে পৌঁছাল ততক্ষণে বিয়ে শেষ হয়ে গেছে। বর বউ এখন এক মঞ্চের উপর বসে আছে। দলে দলে লোক যাচ্ছে আর ছবি তুলছে। সৌরভকে একটু ঠ্যালা দিয়ে স্ত্রী সোহিনী বলল, ‘তুমি এই মেয়েটাকে আগে থেকে চিনতে না?’ সৌরভ মাথা নেড়ে বলল, ‘হ্যাঁ বছর তিনেক আগে রজত একদিন দেখিয়েছিল। তখন ওদের সবে সবে প্রেম হয়েছে। তারপর দুই বছর চলল কোভিড। আর এই এক বছর তো আমি বাইরে’। স্টেডিয়ামের ভিতরে বিলাস বহুল এক হোটেলের লনে বসেছে এই বিবাহ বাসর। এখানে আসা থেকে সৌরভের মনে হচ্ছে, ভাইয়ের বিয়েতে নয় সে কোন ফিল্ম আর্টিস্টের বিয়েতে এসে পড়েছে। সোহিনী বলল, ‘মেয়ের বাবার প্রচুর পয়সা আছে বলো?’ সৌরভ বলল, ‘শুনেছিলাম সরকারি চাকরি করে। তবে আয়োজন দেখে তা মনে হচ্ছে না’। ‘মামিমা আমাকে ডাকছেন’ বলে চলে গেল সোহিনী। সৌরভ একটা চেয়ার টেনে বসলো। ভিড়ের মধ্যে তার যেতে ইচ্ছে করছে না’।
একটু পরে কাকামণির গলা শোনা গেল, ‘আরে সৌরভ ওখানে একা একা কি করছিস। তাড়াতাড়ি এদিকে আয়। সবার সঙ্গে আলাপ কর’। আর উপায় নেই। উঠে গেল সৌরভ। আজ বুধবার। আটটা বাজে। বাইরের লোক একে একে আসতে শুরু করেছে। মেয়ের মায়ের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিলেন কাকিমা। কাকামণির বললেন, ‘তোকে অপর্ণার বাবার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিচ্ছি’। তারপর ভিড়ের মধ্যে কোর্ট প্যান্ট পরে ঘুরে বেড়ানো একজনকে হাত নেড়ে বললেন, ‘বেয়াই মশাই আসুন, আমার দাদার ছেলের সঙ্গে আলাপ করুন’। ভদ্রলোক সামনে এলেন কিন্তু এদিকে তাকানোর আগেই অন্যে কয়েক জনের সঙ্গে ব্যস্ত হয়ে গেলেন। তার দিকে কয়েক পলক তাকিয়ে মনটা কেমন হয়ে গেল সৌরভের। এই লোকটা অপর্ণার বাবা! রজত এই মানুষটার মেয়েকে ভালোবেসেছে! আগে তার মুখে গোঁফ দাঁড়ি ছিল না। এখন আফ্রিকায় যাওয়ার পর সে গোঁফ দাঁড়ি রেখেছে। এই জন্যে অপর্ণার বাবা যদি তাকে না চেনে তবে ভালো হয়! কাকামণি একরকম হাত ধরে মানুষটাকে টেনে এনে বললেন, ‘আসুন আমার দাদার ছেলে, সৌরভের সঙ্গে আলাপ করুন’। আলাপ করে ভদ্রলোক বললেন, ‘আপনাকে কোথাও দেখেছি মনে হচ্ছে। তবে ঠিক মনে করতে পারছি না’। কাকামণি বললেন, ‘সৌরভ তো আপনাদের লাইনের ছেলে। আগে কোলকাতায় ছিল এখন আফ্রিকায় বদলি হয়ে গেছে’। সৌরভ বুঝল ভদ্রলোক তাকে এখানে আশা করেননি। কাজেই সে নিজেই পরিচয় দিতে বলল, ‘আপনার রঘুনাথগঞ্জের প্রোজেক্টটা কি শেষ হয়ে গেছে?’ জোঁকের মুখে নুন পড়লে যেমন হয়। কথাটা শুনে ঠিক তেমন ভাবেই জয়ন্ত দত্তের উজ্জ্বল মুখটা মুহূর্তে নিভে গেল। বাকি সময়টা তিনি সচেতন ভাবে এড়িয়ে চললেন সৌরভকে। বউ ভাতের অনুষ্ঠানেও চলল একই রকম লুকোচুরির খেলা।
রজত ডাক্তার। সে মেদিনীপুর সরকারি হাসপাতালে কাজ করে। বিয়ে মিটে যেতেই সৌরভ আফ্রিকায় ফেরার প্ল্যান করলো। যাওয়ার দিন রজত বলল, ‘একটা বিষয়ে তোর মতামত চাই দাদা’। সৌরভ হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়তেই সে বলল, ‘বিয়ের পর জানলাম, অপর্ণার মায়ের নামে দক্ষিণ কোলকাতার একটা নার্সিং হোমের অর্ধেক মালিকানা আছে। ওর বাবা আমাকে সরকারি চাকরি ছেড়ে নার্সিং হোমের দায়িত্ব নিতে চাপ দিচ্ছেন। কথাটা সেদিন বাবাকে বললাম, বাবা আমাকে মানা করছেন। কি করবো ঠিক বুঝতে পারছি না’। সৌরভ মনে মনে হাসল। জয়ন্ত দত্ত কি জানতেন তার মেয়ে ডাক্তার ছেলের প্রেমে পড়বে! সেই জন্যেই কি তিনি স্ত্রীর নামে নার্সিং হোম খুলেছিলেন! এসব কথা জানার কোনও উপায় নেই। রজতের কাঁধে হাত রাখল সৌরভ। বলল, ‘জয়ন্ত দত্ত আমার অনেকদিনের পরিচিত মানুষ। তার মধ্যে অনেক গুণ আমি দেখেছি। শুধু একটা জিনিস দেখিনি!’ রজত প্রশ্ন করলো, ‘কি?’ সৌরভ ঘড়ি দেখল। তার বিমানের সময় হয়ে এসেছে। ভাইয়ের চোখের দিকে তাকিয়ে নরম অথচ দৃঢ় গলায় সে বলল, ‘সততা’।
0 comments: