0

প্রবন্ধ - দিলীপ মজুমদার

Posted in




















১৯৪৮ সালের ৩০ জানু্য়ারি দিল্লির আলবুকার্ক রোডের ঘনশ্যাম দাস বিড়লার বাড়ির বাগানে বিকালের প্রার্থনাসভায় গান্ধীজিকে গুলি করে হত্যা করেন নাথুরাম গডসে । হত্যার পরে তিনি পালিয়ে যাবার চেষ্টা করেন নি । হত্যার ব্যাপারকে অস্বীকারও করেন নি । নেথুরাম গ্রেপ্তার হন । তারপরে গ্রেপ্তার করা হয় তাঁর ভাই গোপাল গডসে ,নারায়ণ আপ্তে ও বিষ্ণু কারকারেকে ।

১৮৪৮ সালের ৮ নভেম্বর বিচারালয়ে নাথুরাম এক দীর্ঘ জবানবন্দি দেন । চিফ পাবলিক প্রসিকিউটার জবানবন্দি দেবার ব্যাপারে আপত্তি করলেও বিচারপতি জবানবন্দি দেবার সম্মতি দেন । নাথুরামের জবানবন্দিটি দীর্ঘ , মোট ১৫০ টি অনুচ্ছেদে বিভক্ত । তখন বহু প্রকাশক পুস্তিকাকারে জবানবন্দিটি প্রকাশ করতে আগ্রহী ছিলেন । কিন্তু ভারত সরকার সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট হবার আশঙ্কায় এটি নিষিদ্ধ করেন । ৫০ বছর নিষিদ্ধ থাকার করে ১৯৮৩ সালে মুম্বাই হাইকোর্ট রায় দেন , ‘ঐতিহাসিক গবেষণার কোনও বিষয়কে ভারতীয় আইনের ১৫৩ ধারার অপব্যবহার করে আটকে রাখা যায় না । ’ এই রায়ের পরে ১৯৯২ সালে জবানবন্দিটি বুকলেটের আকারে প্রথম প্রকাশিত হয় ।

গান্ধীজির মতো এক লোকমান্য নেতাকে হত্যা করা অতীব নিন্দনীয় বিষয় । কিন্তু শুধু এই হত্যাকে সামনে রেখে নাথুরাম সম্বন্ধে যে সমালোচনা করা হয় , জবানবন্দির আলোকে তার পুনর্বিচার প্রয়োজন । আবার এই জবানবন্দির আলোকে বিচার করা দরকার নাথুরামকে শহিদ বানানোর যে চেষ্টা হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলি করে চলেছে , তার যৌক্তিকতা । প্রথমে গান্ধী সম্পর্কে নাথুরামের মনোভাব বিচার করা যাক । নাথুরাম বলেছেন , ‘ব্যক্তিগতভাবে গান্ধীজির সঙ্গে আমার কোন শত্রুতা ছিল না ’ ( অনু. ১১৮) । গান্ধীজি যে দেশের জন্য কষ্ট স্বীকার করেছেন , সে কথা বেশ স্পষ্টভাবে বলেছেন গডসে , ‘দেশের জন্য গান্ধীজি যা করেছেন , তার প্রতি সম্মান জানিয়ে আমি তাঁর কাছে প্রণত হই , প্রণত হই ব্যক্তি গান্ধীজির জন্য এবং তাঁর দেশসেবার জন্য ’ (অনু. ১৩৯ ) । তিনি বলেছেন , ‘ তাঁকে গুলি করার আগে আমি তাঁর মঙ্গল কামনা করেছি , শ্রদ্ধায় মাথা নত করেছি ’( অনু. ১৩৯ ) । ‘প্রিয় রামদাসভাই’ সম্বোধন করে তিনি গান্ধীপুত্রকে চিঠিতে লেখেন , ‘আমার হাতে আপনার শ্রদ্ধেয় পিতার মর্মান্তিক মৃত্যুর জন্য আপনি এবং আপনার আত্মীয় পরিজন যে কষ্ট পেয়েছেন, একজন মানুষ হিসেবে বলতে পারি , তা আমি ভাষায় প্রকাশ করতে পারব না । ’

গান্ধীহত্যা চোরাগোপ্তা কোন আক্রমণ নয় । তার পরিণাম সম্বন্ধে সচেতন ছিলেন নাথুরাম । ১৩৫ নং অনুচ্ছেদে তিনি বলেছেন , ‘মানুষের কাছ থেকে ঘৃণা ছাড়া আমার আর কিছুই প্রাপ্য থাকবে না এবং আমার প্রাণের চেয়ে বেশি মূল্যবান সম্মান আমি হারাব । ’ নাথুরামের এই বক্তব্যে প্রকাশ পেয়েছে যে পুলিশ বা বিচারব্যবস্থার শাস্তির চেয়ে বড় শাস্তির কথা , যার নাম জনবিচ্ছিন্নতা , যার ফলে প্রাণের চেয়ে মূল্যবান সম্মান হারাতে হবে । যিনি বলেছেন গান্ধীর প্রতি তাঁর কোন ব্যক্তিবিদ্বেষ ছিল না , তিনি কেন হত্যা করলেন তাহলে ? সে কথা নাথুরাম তাঁর জবানবন্দিতে একাধিকবার অত্যন্ত সুস্পষ্টভাষায় বলেছেন , “তাঁর কর্মপদ্ধতি ও অনুসৃত নীতির প্রসঙ্গে আমার যে তীব্র অনীহা এবং অসম্মতি রয়েছে তা গোপন করতে চাই না । ‘বিভেদ আনো-শাসন করো’র যে নীতি ব্রিটিশ শক্তি অনুসরণ করত , গান্ধীজি সেই নীতিকেই সাফল্যের সঙ্গে সম্পাদন করেছেন । ভারতবর্ষের বিভাজন প্রক্রিয়ায় গান্ধীজি সাহায্য করেছেন ” ( অনু. ৬৮ ) । নাথুরামের দৃষ্টিতে এটা গান্ধীর ‘আদর্শের অধঃপতন’ । ‘অধঃপতন’ শব্দটি কেন প্রয়োগ করলেন নাথুরাম ? তাহলে কি তিনি বলতে চেয়েছেন যে আদর্শ গান্ধীর ছিল , তা থেকে বিচ্যুত হয়েছেন তিনি ? নাথুরাম বলেছেন গান্ধীজি তাঁর কর্মপন্থা কার্যকর করতে গিয়ে হাতুড়ে ডাক্তারের সর্বরোগহর ওষুধের মতো যে সব নীতি ও আদর্শের কথা বলতেন , তা সমূহ ক্ষতিসাধন করেছে দেশের ও দশের । এর উদাহরণ দিতে গিয়ে তিনি মোপলা বিদ্রোহ , খিলাফৎ , আফগান-আমির চক্রান্ত , আর্যসমাজের উপর আক্রমণ , সিন্ধুর বিযুক্তিকরণ, কংগ্রেস থেকে লিগের বিদা্য় , ভারত বিভাজনের জন্য ক্রিপস প্রস্তাব গ্রহণ , সুরাবর্দীর পৃষ্ঠপোষকতা , দেশাই-লিয়াকৎ চুক্তি , ক্যাবিনেট মিশন প্ল্যান, পাকিস্তান সম্বন্ধে দ্ব্যর্থবোধক বিবৃতি ইত্যাদি ঘটনার উল্লেখ করেছেন । গান্ধী সম্পর্কে তাঁর আরেকটি মারাত্মক অভিযোগ , ‘ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসকে খিলাফতের সঙ্গে যুক্ত করে তিনি স্বেচ্ছায় ধর্মকে রাজনীতির সঙ্গে মিশিয়ে দিলেন ’ ( অনু. ৭০ক ) । গান্ধীকে তিনি হত্যা করেন এই ভাবনায় যে গান্ধীর অবর্তমানে ‘ভারতীয় রাজনীতি হয়ে উঠবে অনেক বাস্তববোধসম্পন্ন , প্রতিরোধী , সামরিক শক্তিতে বলবান ’ ( অনু. ১৩৫) ।

হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলি যে নাথুরামকে শহিদ বানাতে চায় এ কথা আমরা সংবাদ মাধ্যম থেকে জানতে পারি । হিন্দুত্ববাদী সংগঠনের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক জবানবন্দির আলোকে বিচার করা যাক । ২৬ নং অনিচ্ছেদে তিনি পরিষ্কারভাবে বলেছেন তাঁর জন্ম এক হিন্দুধর্মনিষ্ঠ পরিবারে । হিন্দুধর্ম , হিন্দু ইতিহাস তিনি ভালোবেসেছিলেন । কিন্তু পরবর্তীকালে ‘বেদে সব আছে’ বলে হিন্দুত্বের যে আস্ফালন , তা তাঁর জবানবন্দিতে আমরা দেখতে পাই না । হিন্দু সংগঠনে যোগ দেবার কথা স্বীকার করেছেন তিনি । কিন্তু সেই সঙ্গে বীর সাভারকর ও শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জীর সঙ্গে তাঁর মতভেদের কথাও তিনি পরিষ্কারভাবেই বলেছেন । প্রমাণ ৩৪, ৩৫ , ৩৭ , ৪১ , ৪২, ৪৭ নং অনুচ্ছেদ । তিনি যে সাভারকরের ‘হাতের পুতুল’ নন সে কথা তুলে ধরেছেন বাদীপক্ষের কাছে ; আবার বলেছেন শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জী হিন্দু মহাসভার সভাপতি হবার পরে ‘তাঁর কংগ্রেসের হাতের পুতুলে পরিণত হতে দেরি হল না । ’ তিনি গান্ধীজির ও মুসলিম লিগের কার্যকলাপের প্রতিরোধ করার জন্য যে কর্মপন্থা গ্রহণ করেছিলেন ‘তার নেতৃত্ব দেওয়াতো দূরের কথা , শুধুমাত্র সমর্থনের জন্য ওদের ( সাভারকর ও শ্যামাপ্রসাদ ) আমন্ত্রণ জানানো সম্ভব নয় ’ ( অনু. ৩৫ ) । দিল্লিতে গান্ধীর প্রার্থনাসভায় বিক্ষোভ দেখানোর জন্য সাভারকর নাথুরামকে তিরস্কার করেছিলেন বলে তিনি উল্লেখ করেছেন । ভারতভাগের সিদ্ধান্তচূড়ান্ত হবার পর সাভারকর ও হিন্দু মহাসভার প্রথম সারির নেতারা পরিষ্কার ভাষায় জানিয়ে দিয়েছিলেন , ‘ একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের শাসনযন্ত্র যে সরকারের হাতে যাক না কেন , তাকে আমরা কখনও কোন দলের সরকার বা কংগ্রেস সরকার হিসেবে গণ্য করব না । পাকিস্তান সৃষ্টি হওয়ার জন্য আমরা দুঃখ প্রকাশ করব ঠিকই , কিন্তু নবজাত স্বাধীন ভারতবর্ষের সরকার হিসেবে ওই সরকারকে মান্য করাই হবে আমাদের কর্তব্য । …. হিন্দু মহাসভার সভ্যরা যদি ভারত রাষ্ট্রের প্রতি কোন ধ্বংসাত্মক মনোভাব নেয় , তাহলে দেশের মধ্যে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়ে যাবে , আর তার ফলে গোটা ভারতবর্ষকে পাকিস্তানে পরিণত করার নীতিহীন গোপন অভিসন্ধিই সাফল্য পাবে ’ (অনু. ৩৮)

তাহলে নাথুরাম কি ধর্মোন্মাদ মানুষ ? ২৬ নং অনুচ্ছেদে তিনি বলেছেন যে হিন্দুত্ব বিষয়ে গর্বিত হলেও ‘বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমি নিজেকে কোন রাজনৈতিক বা ধর্মীয় গোঁড়ামির শৃঙ্খলে আবদ্ধ না রেখে স্বাধীন চিন্তার প্রবণতা গড়ে তুলে শুরু করলাম । সেইজন্য আমি আমার জন্মসূত্রে প্রাপ্ত জাতিভেদপ্রথা ও অস্পৃশ্যতা বিলোপের জন্য সক্রিয়ভাবে কাজ করেছি ’ ( অনু. ২৬ ) । ‘রাজনৈতিক বা ধর্মীয় গোঁড়ামির শৃঙ্খল’ এবং ‘স্বাধীন চিন্তার প্রবণতা’ শব্দগুলি লক্ষ্য করার মতো । শুধু তাই নয় , ৫১ নং অনুচ্ছেদে তিনি বলেছেন যে দেশের জনজীবনে ধর্মীয় ও সাম্প্রদায়িক প্রভাব পরিহার করা দরকার , বলেছেন ‘নির্বাচনের ক্ষেত্রে , তা আইনসভার ভিতরে কিংবা বাহিরে এবং মন্ত্রীসভা ভাঙা কিংবা গড়ার ক্ষেত্রেও এই একই নীতি অনুসরণ করা হবে । যৌথ নির্বাচনরীতি এবং ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রনীতিকে তাই বরাবর যুক্তিসিদ্ধ হিসেবে মেনে এসেছি । ’

নাথুরামের জবানবন্দিতে মুসলমানদের প্রতি কোন জাতিবিদ্বেষ প্রকাশ পায় নি । হিন্দুদের প্রতি অত্যাচারের কথা আছে , হায়দ্রাবাদ ও কলকাতায় দাঙ্গায় হিন্দুদের প্রাণহানির কথা আছে ; কিন্তু এ সবের জন্য তিনি জাতি হিসেবে মুসলমানদের দায়ী করেন নি , দায়ী করেছেন নিজাম ও তাঁর মন্ত্রীদের, মুসলমান রাজাদের , সুরাবর্দী ও জিন্নার মতো রাজনৈতিক নেতাদের । ৫৪ নং অনুচ্ছেদে তাঁর তাৎপর্যপূর্ণ উক্তি : ‘ মুসলিম লিগ মুসলমান সমাজের গোঁড়ামি ও অশিক্ষাকে ভালোভাবেই কাজে লাগাতে পেরেছে । ’

গান্ধীহত্যা যে সুপরিকল্পিত কোন ষড়যন্ত্র নয় সে কথা বলতে গিয়ে নাথুরাম বলেছেন , ‘ এই মামলায় আমার সঙ্গে আরও কয়েকজনকে ষড়যন্ত্রকারী সাব্যস্ত করে অভিযুক্ত করা হয়েছে । আমি আগেই বলেছি , আমি যা করে্ছি তাতে আমার কোন সহযোগী ছিল না এবং এ কাজের দায়িত্ব সম্পূর্ণভাবে আমার । আমার সঙ্গে যদি এঁদের অভিযুক্ত না করা হত , তাহলে আমি হয়তো কোন আইনজীবী নিয়োগ করতাম না । ’ তাহলে , প্রকাশ্য দিবালোকে গান্ধীকে হত্যা করে এবং আত্মরক্ষার চেষ্টা না করে নাথুরাম আসলে কি করতে চেয়েছিলেন ? ১৪৯ নং অনুচ্ছেদে সে প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন তিনি , ‘এটাই সত্য যে আমি প্রকাশ্য দিবালোকে তিন-চারশো মানুষের সামনে গান্ধীজিকে গুলি করেছি ( বোমা নয় , গুলি ) । আমি পালিয়ে যাবার কোন চেষ্টা করি নি । আসলে আমার মনে পালিয়ে যাবার কোন চিন্তাই ছিল না । আমি নিজেকে গুলি করার চেষ্টাও করি নি । সে ইচ্ছা আমার ছিল না । কারণ আমি চেয়েছিলাম খোলা আদালতে সর্বসমক্ষে আমার চিন্তা-ভাবনা মানুষকে জানাতে । ’ নাথুরাম গডসের ‘চিন্তা-ভাবনা’র ধর্মনিরপেক্ষ ,ঐতিহাসিক পর্যালোচনা এখনও অপেক্ষিত ।

মতামত লেখকের নিজস্ব । লেখক সিনিয়র ফেলোশিপপ্রাপ্ত গবেষক ।

0 comments: