1

প্রবন্ধ - রঞ্জন রায়

Posted in




















যদি কোনও বইয়ের পাতা ওল্টালেই চোখে পড়ে বইটিকে রেকো করেছেন আমাদের দেশের বিভিন্ন ক্ষেত্রের নামকরা উজ্বল সব জ্যোতিষ্কের দল তাহলে আমার মত হরিদাস পাল পাঠকের হাল যে কী হয়!

যেমন ধরুন, দেশের প্রধান বিচারপতি রমন্না, দলিত তাত্ত্বিক কাঞ্চা ইলাইয়া, অভিনেতা সুহাসিনী মুলে ও নাসিরুদ্দিন শাহ, গায়ক এবং প্রতিবাদী চরিত্র টি এম কৃষ্ণ, জনস্বাস্থ্য কর্মী ডঃ শ্রীনাথ রেড্ডি, সম্পাদক রামমনোহর রেড্ডি, কংগ্রেসের সাংসদ জয়রাম রমেশ, সাফাই কর্মচারি আন্দোলনের সর্বপরিচিত মুখ বেজওয়াড়া উইলসন, এবং মনমোহন সিংয়ের প্রাক্তন মিডিয়া উপদেষ্টা ও অর্থনীতিবিদ সঞ্জয় বারু।

এই তারকা মণ্ডলীর মাঝে চোখে পড়বে দুটো নাম শংকরাইয়া ও বচাম্মা—অন্ধ্রের ছোট্ট গাঁয়ের দুই কৃষিশ্রমিক ও সংগঠক ,যাদের সাদা কালো ছবি বইয়ের মাঝে রয়েছে।

বইয়ের নাম “ল্যান্ড গানস্‌ কাস্ট ওম্যান”—ঘোষিত ভাবে জনৈক পথ হারানো বিপ্লবীর স্মৃতিচারণ। লেখিকা গীতা রামস্বামী।

এইটুকু দেখে যদি বইটি বন্ধ করে তাকে তুলে রাখেন তো মস্ত ভুল করবেন। এটি একেবারেই নানা প্রাক্তন বিপ্লবীর দাম্ভিক আত্মগর্বী ফাঁপানো ফোলানো কাহিনী নয়, যেখানে তিনি কোন ভুল করেন নি। শুধু জনগণ তাঁকে বুঝতে ভুল করে ছেড়ে গেছে।

বরং এটি এক বিনম্র নারীর অন্তরঙ্গ আলাপন, যিনি হাতড়ে হাতড়ে পথ খুঁজে নেন। যাঁর কাহিনীতে সাফল্যের চেয়ে বিফলতার খতিয়ান বেশি। যিনি অকপটে নিজের ভুল স্বীকার করেন এবং জীবনের একটি বাঁকে এসে মনে করেন এবার ঘরে ফেরার সময়।

না, এটা ঠিক পরাজয়ের সালতামামি নয়। কারণ, এঁর মূল সংগ্রাম রাষ্ট্রশক্তির বিরুদ্ধে নয়। বরং নিজের ভেতরের সংস্কারের এবং চারপাশের পিতৃতন্ত্রের বিরুদ্ধে। এছাড়া জাতপাতের বিরুদ্ধে, উনি টের পান যে পিতৃতন্ত্র এবং জাতপাতের মূল দর্শন একই।

বোধহয় একটু ভুল বললাম। ওই লড়াই তাঁকে টেনে নিয়ে গেল ভুমিহীন দলিত মানুষদের আঙিনায় এবং দেখলেন যে সবচেয়ে অবহেলিত এবং পীড়িত মানুষেরা অধিকাংশই দলিত সম্প্রদায়ের। আবার তাদের জমির অধিকারের জন্য মাথা উঁচু করে কথা বলতে গিয়ে মুখোমুখি হতে হল ল্যান্ড রেভিনিউ বিভাগ, পুলিশ এবং আদালতের। অর্থাৎ রাষ্ট্রশক্তির।

কিন্তু ওঁর পথচলার ভূগোল অসাধারণ। নারীবাদ, নক্সালবাদ, আম্বেদকরপন্থা এবং ভূমিহীনদের জমির অধিকারের জন্য আইনি এবং অহিংস পথে আন্দোলন। ছোট ছোট সাফল্যের উদাহরণ কম নয়। গোড়ার দিকে এমার্জেন্সির সময় আত্মগোপন করেছেন, ধরা পড়েছেন।

নকশালদের সর্বভারতীয় নেতাকে খুব কাছ থেকে দেখে, তাঁর নারীদের প্রতি তাচ্ছিল্য এবং সাধারণ ক্যাডারদের প্রতি একনায়কসুলভ আচরণে গীতার মোহমুক্তি ঘটে।

এরপর দিল্লির কাছে গাজিয়াবাদের দলিত বস্তিতে থেকে ওদের লেখাপড়া শেখানোর দায়িত্ব নেওয়া, কয়েক বছর পরে অন্ধ্রে ফিরে গিয়ে শহরের শান্ত অ্যাকাডেমিক জীবনের হাতছানি এড়িয়ে জীবনসঙ্গীর সঙ্গে অন্ধ্রের প্রান্তিক গাঁয়ে গিয়ে কৃষিশ্রমিকদের মজুরি আন্দোলনের সংগঠন গড়া, জমিদারদের সরকারি ও দেবোত্তর জমি গাপ করার তথ্য বের করে সরকারি আইন অনুযায়ী তা ভূমিহীনদের মধ্যে বিলিয়ে দেওয়ার লড়াই। বছরের পর বছর। একটা কাগজের টুকরো নিয়ে রোদ্দুরে গাছের তলায় দাঁড়িয়ে থাকা, পুলিশের ভয় দেখানো, বারবার গ্রেফতার, সম্মানহানির ও প্রাণনাশের বাস্তবিক ভয়।

একটা সময় ক্লান্তি, ঘরে ফিরে আসা। তারপর হায়দ্রাবাদ বুক ট্রাস্ট খুলে সুলভ মূল্যে তেলুগুতে বিশ্বসাহিত্য এবং দলিত সাহিত্যের প্রায় চারশ’ বই প্রকাশ । এর মধ্যে জীবনসাথী সিরিল রেড্ডিকে দুরারোগ্য অসুখে হারিয়ে ফেলা।

ওঁদের অনুবাদের তালিকায় আছেন অ্যালেক্স হ্যালে থেকে মহাশ্বেতা দেবী। নিজে বেশ কিছু বই তেলুগু থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন।

সবমিলিয়ে এই বই পড়া একটি ফ্যাসিনেটিং এক্সপিরিয়েন্স।

লেখালেখি এবং অধ্যাপনার জগতে ফিরে এসে উনি আরও বই আগে লিখেছিলেন।

উনি যুক্তভাবে লিখেছেন “টেকিং চার্জ অফ আওয়ার বডিজ”(২০০৫), সম্পাদনা করেছেন “দ্য অক্সফোর্ড ইন্ডিয়া অফ তেলুগু দলিত রাইটিং” (২০১৬)।


একটু গোড়ায় আসি।

জন্মেছিলেন তামিল ব্রাহ্মণ পরিবারে। বাবা সরকারি আধিকারিক। তিন মেয়ে, চাইছিলেন ছোট মেয়েকে ছেলের মত করে মানুষ করতে। চেয়েছিলেন উচ্চশিক্ষা দিতে। তাই ওকে পড়তে পাঠালেন ওসমানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়। এখানেই ভুল হল।

সত্তরের দশকের হায়দ্রাবাদের ওসমানিয়া আর আজকের দিল্লির জে এন ইউ একেবারে তুল্যমূল্য।

ছোটবেলা থেকে কী এবং কেন প্রশ্ন করা গীতার গোঁড়া ব্রাহ্মণ পরিবারের অন্ধকূপে দম আটকিয়ে আসছিল। অকপটে লিখেছেন যে তখন পাশ্চাত্ত্যে ব্রা জ্বালিয়ে দেওয়া ছিল বিদ্রোহের পরিচায়ক, আমাদের বাড়ির সংস্কৃতিতে ব্রা পরাই ছিল বিদ্রোহ।

কারণ মা এবং ঠাকুমা ওদের তিনবোনকে শিক্ষা দিতেন –ব্রা পরে ছেনালরা। বুক ঢাকতে হয় ঘরে সেলাই করা কাপড়ের টুকরো দিয়ে। চোদ্দ বছরের মেয়েটি এ নিয়ে প্রশ্ন করত, বিদ্রোহ করত। আর মজেছিল অংকের দুনিয়ায়।

ওসমানিয়া ইউনিভার্সিটির ক্যাম্পাসে তার আত্মার মুক্তি হল। মেয়ে বলে নিজেকে গুটিয়ে রাখার বদলে সে গর্বিত হতে শিখল। পড়াশুনায় মেরিট লিস্টে ছিল। বন্ধুবান্ধব এবং ক্যাম্পাসের বিতর্ক এবং সাহিত্য তাকে ধীরে ধীরে চেনাল বর্ণব্যবস্থাকে, তার বর্বর রূপকে। বাড়ির শিক্ষার বা সংস্কারের থেকে একেবারে আলাদা।

ইউনিভার্সিটির প্রগতিবাদী আন্দোলনের প্রাণপুরুষ ছিলেন জর্জ রেড্ডি, ছাত্র নেতা। বিজেপি গুণ্ডার আক্রমণে নিহত হলেন। তার ফলশ্রুতিতে ক্যাম্পাসে আন্দোলন আরও মজবুত হল। জর্জের ভাই সিরিল (পরে নামকরা মানবাধিকার আইনজীবি) এবং কয়েকজন মিলে গড়ে তুললেন নতুন সংগঠন।

অন্ধ্রে তখন নকশাল আন্দোলনের জোয়ার এসেছে। এঁরা সবাই যুক্ত হলেন চারু মজুমদারের মূল এম-এল পার্টিতে নয়, বরং অন্ধ্রের সিপিএম থেকে সদ্য বেরিয়ে আসা চন্দ্রপুল্লা রেড্ডির দলে। পার্টি সেলে বিয়ে করলেন সিরিল রেড্ডিকে, খুব একটা কিছু নয়া ভেবেই।

বাড়িতে খবর যাওয়ায় মায়ের অসুখের মিথ্যে খবর দিয়ে গীতাকে ডেকে এনে ঘরে বন্দী করে তালা লাগিয়ে দেওয়া হল। দিনে দু’বার খাবারের থালা ভেতরে যেত।

দিদিরা কোন সাহায্য করল না। বাবা-মা ডাক্তারকে বল্লেন—নকশালরা ওর ব্রেন ওয়াশ করেছে।

ফলে মানসিক হাসপাতালে অনেকবার ইলেক্ট্রিক শক দেওয়া হল। এর ক্ষতিকর ফল পরবর্তী জীবনে টের পেয়েছেন। পরে পরিণত বয়সে বাবা-মা এবং বিবাহিত দিদিদের সঙ্গে যোগাযোগ পারিবারিক অনুষ্ঠানে যাওয়া সব হল, কিন্তু ভাঙা সম্পর্ক আর জোড়া লাগল না।

কমরেডদের সহায়তায় শঠে শাঠ্যং করে বাড়ির জেলখানা থেকে মুক্ত হলেন। গীতাকে আর পায় কে!

কিন্তু তখন ইন্দিরা গান্ধীর এমার্জেন্সি! এনকাউন্টারে মারা যাচ্ছে সাথীরা। চারদিকে পালাও ! পালাও!

আর স্পয়লার দেব না।

তবু কয়েকটা কথা।

তাঁর প্রথম জীবনে গ্রামে কৃষিশ্রমিক ও দলিতদের মধ্যে থাকার অভিজ্ঞতা দিয়ে বুঝেছিলেন যে অন্ধ্রের গ্রামাঞ্চলে সবচেয়ে বড় জমির মালিক ও বর্বর অত্যাচারী হলো রেড্ডিরা। কিন্তু কয়েক দশক ধরে ওখানকার ক্ষমতা দখল করে মসনদে বসে থাকা সবাই রেড্ডি, কংগ্রেস হোক কি বিজেপি।

পুলিশ, রেভিনিউ, আদালত সর্বত্র রেড্ডিদের প্রতাপ এবং এঁরা অধিকাংশই বৈবাহিক সূত্রে আত্মীয়।

এই জাল ভেদ করে গরীবের জন্যে লড়াই কত কঠিন। অনায়াসে লুকোছাপা না করে নাম নিয়ে বলেন ইউনিভার্সিটি দিনের আর এস এসের এক আদর্শাবাদী তরুণের কথা, যে পরিণত বয়সে ক্ষমতাশালী জমিদার হল। তিনিও এক রেড্ডি বটেন। এবং বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকারের ডাকসাইটে মন্ত্রী।

হঠাৎ তিনি খেয়াল করলেন যে তাঁর জীবনসঙ্গী এবং লড়াইয়ের সাথী সিরিলও রেড্ডি! অনেক বন্ধুবান্ধব এবং ঘনিষ্ঠরাও তাই।

দ্বিতীয়, বাইরের থেকে গরীবের লড়াই লড়তে যাওয়া গীতা রামস্বামীর মত আদর্শবাদীরা অনেক সময় বিশুদ্ধ বইয়ের ফর্মূলা থেকে অনেক ভুল নির্দেশ দেয়—মেরে ফেল, কেটে ফেল গোছের। কিন্তু গরীবেরা জানে, ওদের ওখানে থাকতে হবে। পুরনো বন্ধন এমন ভাবে ছিঁড়ে ফেলা যায় না।

তারা প্রশ্রয়ের দৃষ্টিতে এই মেয়েটির কথা শোনে। কিন্তু দূরগামী সিদ্ধান্ত নেয় প্র্যাক্টিক্যাল অভিজ্ঞতা থেকে, যা অনেক সময় মধ্যপন্থার মত দেখায়।

পরে বোঝা যায় ওরাই ঠিক ছিল।

বইটি পড়লে বুঝতে পারি জীবন ঠিক জয়-পরাজয়ের ব্যালান্স শীট নয়, বরং পথ চলাটাই আসল। পথের বাঁকে যে কত বিস্ময় লুকিয়ে থাকে, কত নাম না জানা ফুল গোপনে ফোটে। এই পথের পাঁচালীর শেষ বাক্যটিতে ভৈরবীর সুর বাজে—“ After all this time, after a quarter of a century, there was still so much love. Only love”.


গীতা রামস্বামী আমার বয়েসী। এই ৪২৬ পাতার বইটি ওঁর নিজেকে আয়নায় দেখার মতন।

বইটি প্রকাশ করেছেন হায়দ্রাবাদের নবায়ন , পাওয়া যাচ্ছে হার্ড কভার এডিশনে, দাম ৫৯৯ টাকা।

1 comment:

  1. বইটি আগ্রহ জাগিয়ে তুলল

    ReplyDelete