0

ধারাবাহিক - নন্দিনী সেনগুপ্ত

Posted in




















২৭

ইলোনার কপাল ভালো যে তাকে প্রথমে ডাকা হয়েছে। সে জানে যে এখানে স্নানঘর বলতে আসলে ঠিক কী বোঝানো হয়। বড় জোর দশ মিনিটের ছটফটানি সহ্য করতে হয়। তবে সেই সময়ের এত কাছাকাছি দাঁড়িয়েও তার এতটুকু ভয় করছে না। এখানে আসবার পথে গাড়িতে তাকে অনেককিছু সহ্য করতে হয়েছে। সেইসব ব্যাপারগুলো নিঃসন্দেহে তাকে ব্যক্তিগতভাবে ধাক্কা দিয়েছে, কিন্তু অন্তরের অন্তস্থল অবধি পৌঁছাতে পারেনি। গাড়ির ভেতরে অন্ধকারে কেউ একজন তাকে ধর্ষণ করবার চেষ্টা করছিল। তার লালসার গন্ধ সে অন্ধকারেও বুঝতে পেরেছিল, অথচ এখন এই আলোর মধ্যে এসে সেই লোকটাকে চিনবার সমস্ত চেষ্টা বৃথা হল। কেউ একজন আবার তাকে ওই লোকটার হাত থেকে বাঁচিয়েছিল। একটা বুড়ো লোক বাঁচিয়েছে তাকে। সেই বুড়ো পরে তাকে অন্ধকারে ফিসফিস করে বলছিল যে শুধুমাত্র একটা ট্রাউজারের জন্য বুড়োকে গ্রেফতার করা হয়েছে, যেটা সে এক অফিসারের কাছ থেকে কিনেছিল। অন্ধকার থেকে আলোতে এসে ইলোনা তার এই রক্ষাকর্তা বুড়োকেও চিনতে পারেনি।

একটা লোক তার বুকে হাত দিচ্ছিল, পোশাক ছিঁড়ে দিয়েছিল, পেছনে ঘাড়ের কাছে কামড়ে দিচ্ছিল--- কিন্তু সৌভাগ্যবশত আরেকটা লোক তাকে সরিয়ে এনেছিল ওই লোকটার কাছ থেকে। ইলোনার হাতে যে কেকের টুকরোর প্যাকেটটা ছিল, সেটা কোথায় যেন ছিটকে গিয়েছিল। ইলোনার হাতে তো ওই একটা জিনিসই ছিল। আর কোনো মালপত্র কিচ্ছুটি ছিল না তার সঙ্গে। অন্ধকারে গাড়ির মেঝেতে হাতড়ে হাতড়ে ওই কেকের টুকরোটা ধুলোয় আর ক্রিমে মাখামাখি একটা পিণ্ড হিসেবে খুঁজে পেয়েছিল সে। সে মারিয়ার সঙ্গে ভাগাভাগি করে ওই কেকটা খেয়েছিল। কিছুটা কেক তার কোটের পকেটের মধ্যে চাপে গুঁড়িয়ে গিয়েছিল। কয়েক ঘণ্টা পরে তার মনে হয়েছিল যে কেকটার স্বাদ অসামান্য। নিজের পকেট থেকে চেঁছে নোংরা কেকের দলা বের করে সে নিজে আর বাচ্চা মেয়েটা ভাগাভাগি করে খেয়েছিল।

ট্রাকের ভিতরে নিঃশব্দে কেউ কেউ হাতের শিরা কেটে আত্মহত্যা করেছিল। অদ্ভুত ভাবে হাঁপাচ্ছিল, গোঙাচ্ছিল ওরা জীবন বেরিয়ে যাবার মুহূর্তে। ওদের পাশে বসে থাকা লোকজন রক্তের মধ্যে পিছলে গিয়ে পাগলের মত আর্তনাদ করে উঠেছিল। কিন্তু প্রহরী এসে গাড়ির দরজায়, দেওয়ালে ধাক্কা দেবার পরে সবাই চুপ করে গিয়েছিল। ওই ধাক্কার শব্দটা ভয়ঙ্কর ছিল। মনে হচ্ছিল প্রহরীরা কেউ মানুষ নয়। অনেকক্ষণ ধরে ওরা কোনো মানুষের সংসর্গ পায়নি। মনে হচ্ছিল যেন অনন্তকাল ধরে ওরা যে অপেক্ষার মধ্যে রয়েছে, সেটা এখনই শেষ হবে। ইলোনাও অপেক্ষা করছিল। ভয়ের জন্য, মৃত্যুর জন্য। অর্থহীন মনে হচ্ছিল তার তখন সবকিছু। এক সৈন্যের সঙ্গে কিছুটা সুন্দর সময় কাটাচ্ছিল, কেন তার থেকে বিচ্ছিন্ন হল সে? সেই সৈন্যকে খুব ভালো লাগছিল তার, অথচ তার পুরো নামটাও ঠিকঠাক জানা হল না। কতগুলো সম্পূর্ণ অর্থহীন ঘটনা ঘটে চলেছে তাকে ঘিরে। সেই সৈন্যের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে বাবা মায়ের ফ্ল্যাটে দৌড়ে গেল সে তখন, অথচ গিয়ে দেখল ঘরগুলো ফাঁকা। ফাঁকা ঘরে একা মারিয়া, বাচ্চা মেয়েটা, তার বোনের মেয়ে রয়েছে। একা বাচ্চাটা ভীত সন্ত্রস্ত, উদ্ভ্রান্ত বসে আছে। স্কুল থেকে ফিরে বাচ্চাটা দেখছে যে ঘরে কেউ নেই। ঘরে বাবা মা, দাদু, দিদা কেউ নেই… কেউ না। প্রতিবেশীরা বলছে যে ওদের দুপুরবেলায় তুলে নিয়ে গেছে। এখন ঘেটোতে গিয়ে ওদের খোঁজাখুঁজি করা সম্পূর্ণ অর্থহীন। ওরা তবুও ঘেটোতে গিয়েছিল চুল কাটার দোকানটার পেছনের দরজা দিয়ে ঢুকে। ফাঁকা রাস্তার মধ্যে ঘোরাঘুরি করতে করতে ওরা দেখেছিল ওই ট্রাকটা দাঁড়িয়ে আছে। ট্রাকটা তখনই ছাড়বে। ট্রাকটা ওদের ছাড়েনি। ওরাও ভাবছিল যে যদি ওই গাড়িতে ওদের কোনো আত্মীয় থাকে! কিন্তু ওই গাড়িতে একটাও চেনা লোক ছিলনা। ইলোনার অদ্ভুত লাগছিল এটা ভেবে যে প্রতিবেশীরা কেউ ওকে স্কুলে গিয়ে সতর্ক করেনি! মারিয়াকেও কেউ কিছু বলেনি। তবে বলেও বা কী লাভ হত? ধরা পড়তেই হত… আজ অথবা কাল। গাড়িতে কেউ একজন ওর ঠোঁটে একটা জ্বলন্ত সিগারেট বসিয়ে দিয়েছিল। পরে খেয়াল করেছিল সে যে ওই বুড়োটাই, যাকে ট্রাউজারের জন্য গ্রেফতার করা হয়েছে, সে ওকে সিগারেট দিয়েছিল। ইলোনা জীবনে এই প্রথম সিগারেট খেল। তার বেশ ভালো লাগছিল। শরীরটা অনেকটা ঝরঝরে লাগছিল।

সে তার উপকারী লোকটির নাম জানে না। কেউ তাদের নিজেদের পরিচয় দেয়নি। এমনকি হাঁপাতে থাকা, লালসার আক্রান্ত লোকটি, যে তাকে ধর্ষণ করতে উদ্যত হয়েছিল, সেও নয়। দেশলাই কাঠি জ্বালাবার পরে ওই একটুখানি আলোতে সবগুলো মুখ একই রকম দেখাচ্ছিল। সবগুলো মুখ ভয়ে, ঘৃণায় বিকৃত হয়ে ছিল। কিন্তু এক কোণে বসে ইলোনা অনেকটা সময় পেয়েছিল প্রার্থনার জন্য। কনভেন্ট থেকেই তার সমস্ত ধর্মীয় স্তোত্র, সব প্রার্থনার গান একেবারে ঠোঁটস্থ ছিল। গাড়ির মধ্যে অন্ধকারে বসে এটা ভেবেই ইলোনার ভালো লাগছিল যে এসব গান তার জানা। প্রার্থনার ফলে তার মন এক শান্ত স্থির আনন্দে পরিপূর্ণ ছিল। সে বিশেষ কোনো ইচ্ছাপূরণের জন্য প্রার্থনা করছিল না। কোনো বিপদ থেকে বেঁচে যাবার জন্য, কিম্বা অতি শীঘ্র যন্ত্রণাবিহীন মৃত্যুর জন্য, কিম্বা নিজের প্রাণভিক্ষার জন্য সে প্রার্থনা করছিল না। সে সম্পূর্ণ অহেতুকী ভক্তিতে হয়তো স্মরণ করছিল ঈশ্বরের নাম। এক কোণে ট্রাকের গদি আঁটা দরজাটাতে ঠেসান দিয়ে বসে সে প্রার্থনা করছিল। সে খুশি ছিল এটা ভেবে যে তার পেছনে আর কেউ নেই। পেছনের দিকে শুধুই গদি আঁটা দরজা। এই ট্রাকগুলোর দরজায় গদি আঁটা থাকে যাতে পথে যানের ঝাঁকুনিতে গুঁতো লেগে আসবাবপত্রের কোনো ক্ষতি না হয়। এই ফার্নিচার ট্রাকে প্রধানত আসবাব বহন করা হয়। সে প্রথমে বাকি লোকজনের দিকে পিছন ফিরে দাঁড়িয়ে ছিল। হয়ত সে ক্লান্ত হয়ে ঝিমিয়ে পড়ে যাচ্ছিল। হয়ত তার শরীরের স্পর্শে কারো মনে, শরীরে লালসা জেগে উঠেছিল। প্রথমে সে ভয় পেয়ে গিয়েছিল ওই লোকটির স্পর্শে, ধর্ষণের চেষ্টায়। তার মনে হচ্ছিল যে এসব অর্থহীন কাণ্ড কেন ঘটছে তাকে ঘিরে? অবশ্য পরে উপকারী লোকটি তাকে ছাড়িয়ে আনবার পরে সে আশ্বস্ত হয়েছিল। সে হাঁপ ছেড়ে বেঁচেছিল। গদি আঁটা দরজায় পিঠ দিয়ে বসে প্রার্থনা করতে শুরু করেছিল সে।

মারিয়াকে শক্ত করে ধরে বসেছিল সে। একটু আশ্বস্ত হয়েছিল সে বাচ্চাটা ঘুমিয়ে পড়বার পরে। যথাযথ ভক্তির সঙ্গে প্রার্থনা করতে বসেছিল সে। কিন্তু সফল হল না; অদ্ভুতভাবে ভক্তির বদলে সম্পূর্ণ নিরাসক্ত এক ধ্যানে নিমগ্ন হয়ে যেতে থাকল সে। তার জীবনটা এমন হবে সে ভাবেনি কোনো দিন। তেইশ বছরের জীবনে এতকিছু ঘটে গেল? রাজ্যের স্নাতক পরীক্ষায় পাশ করে সে সন্ন্যাসিনী হবার জন্য ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের আশ্রমে যোগদান করে। আত্মীয় স্বজন, বন্ধু বান্ধব সবাই খুব হতাশ হলেও তার এই সিদ্ধান্ত মেনে নিয়েছিল। সে এক বছর ছিল কনভেন্টে। সেই সময়টা ভারি সুন্দর ছিল। যদি সে সেখানেই থেকে যেত, এতদিনে নিঃসন্দেহে আর্জেন্টিনার কোনো কনভেন্ট স্কুলের সিস্টার হয়ে যেতে পারত। কিন্তু আশ্রমজীবনে এক বছর থাকবার পরেও সংসার করবার ইচ্ছেটা থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনি; নিজের স্বামী, সন্তান এসব নিয়ে একটা সুখের সংসার চেয়েছিল সে। ফলে আবার কনভেন্ট ছেড়ে ফিরে এসেছিল সে বাইরের জগতে।

সে এক সফল শিক্ষিকা হতে পেরেছিল। এই ব্যাপারটা সে খুব উপভোগ করত। জার্মান ভাষা এবং সঙ্গীত, এই দুই বিষয় নিয়ে বাচ্চাদের পঠনপাঠন বিষয়ে তার ভারি আগ্রহ ছিল। বাচ্চাদের সমবেত সঙ্গীতের কয়ার নিয়ে তার অনেকখানি আবেগ কাজ করত। এই ব্যাপারটা তাকে বিশেষ আনন্দ দিত। স্কুলে বাচ্চাদের নিয়ে একটা গানের দল তৈরি করে ফেলেছিল সে। উৎসব অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করত এই দলটা। ল্যাটিন ভাষার স্তোত্রগান, যেগুলো শিশুরা গাইত, অর্থ না বুঝেই গাইত। অথচ একটা অদ্ভুত আধ্যাত্মিক স্বর্গীয় পরিবেশ সৃষ্টি হত, কারণ শিশুরা নিজেদের মনের বিশুদ্ধ আনন্দ প্রকাশ করত সঙ্গীতের মাধ্যমে। জীবন সবসময় ভারি সুন্দর ছিল তার কাছে। শুধু মাঝেমধ্যে সংসার এবং সন্তানের কামনায় তার মনে কিছু খেদ জেগে উঠত। তার খেদ ছিল, কারণ সংসার পাতবার যোগ্য কোনো পুরুষ সে খুঁজে পায়নি। তার কাছাকাছি অনেক পুরুষ এসেছিল, কেউ কেউ তাকে চুম্বনও করেছিল। কিন্তু ভালবাসা, প্রেম এরকম ধরণের বেশ একটা অদ্ভুত চমক, অনন্য অনুভূতির জন্য তার যে অপেক্ষা ছিল, সেটা পূর্ণ হয়নি। তবে সেই যে সৈন্যটির সঙ্গে আলাপ হয়েছিল তার, যার নামটা অবধি ঠিকঠাক জানা হল না, তার সঙ্গে বেশ একটা ব্যাপার তৈরি হচ্ছিল। কী হত তার সঙ্গে? প্রেম? হ্যাঁ, হতেই পারত। সেই সৈন্যটা যখন ম্যাপের সামনে দাঁড়িয়ে ছোট ছোট পতাকা লাগানো পিনগুলো গেঁথে দিচ্ছিল, তার পাশে দাঁড়িয়ে ভারি ভালো লাগছিল তার। সে বুঝতে পেরেছিল যে সৈন্যটিও তার প্রেমে পড়েছে। দু দিন ধরে বেশ কয়েক ঘণ্টা করে আলাপ করতে, আড্ডা দিতে আসছিল সে তার ঘরে। তার ভালই লাগছিল। যদিও সৈন্যের ইউনিফর্ম দেখে একটু ভীতিও ছিল তার। তবে হঠাৎ সেদিন, যখন সৈন্যটি গম্ভীর আর ব্যথাকাতর মুখে দাঁড়িয়ে ছিল ম্যাপটার সামনে, হাতড়ে হাতড়ে দেখছিল যুদ্ধের জমি, তখন সে বুঝতে পেরেছিল যে সৈন্যটিও আসলে এই যুদ্ধটা একেবারে পছন্দ করে না। আনন্দে তার গান গেয়ে উঠতে ইচ্ছে করছিল। হয়ত সেই সৈন্যটির এখন মনেও নেই তার কথা, তবে সেই সৈন্যটিই একমাত্র পুরুষ, যাকে সে চুম্বনের উত্তরে প্রতিচুম্বন দিয়েছিল।

ব্যারাকে ধীরে ধীরে উঠে যায় ইলোনা, মারিয়াকে সঙ্গে নিয়ে। সে চমকে ওঠে যখন এক সৈন্য বন্দুকের নল দিয়ে তার পাঁজরে খোঁচা দিয়ে বলে ওঠে, ‘জলদি চলো! জলদি!’ সে চলার গতি বাড়ায়। ঘরের ভিতরে তিনজন লোক বসে আছে তিনটে টেবিলে। ওদের সামনে গোছা গোছা কার্ড সাজানো আছে। সিগারেট বাক্সের ঢাকনার মত সাইজ হবে কার্ডগুলোর।

ওকে প্রথম টেবিলের সামনে দাঁড় করানো হল, মারিয়াকে দ্বিতীয় টেবিলের সামনে আর তৃতীয় টেবিলের সামনে ছেঁড়াখোঁড়া পোশাক পরা একটা বুড়ো লোককে দাঁড় করানো হল। বুড়োটা ওর দিকে চেয়ে হালকা হাসল। সেও হাসল। হয়তো এই লোকটাই তার উপকারী মানুষ ছিল গাড়িতে। নাম, পেশা, বয়স সব জানাতে হল ওদের। বয়সের জবাবে সে বলে উঠল ‘তেইশ বছর’; মনে মনে ভাবল সে, ‘কত আর? বড়জোর আধ ঘণ্টা… তার পরেই চিরমুক্তি!’ সে অবাক হয়ে যাচ্ছিল এটা দেখে যে এই মৃত্যুর কারবারি লোকজন কী নিশ্চিন্তে, কত আরামে এখানে বসে রয়েছে। সব কাজ যান্ত্রিকভাবে, ঘড়ির কাঁটা ধরে হয়ে চলেছে। তবে লোকজন একটু বিরক্ত, অধৈর্য। তবে যে কোনো কেরানির কাজ যতটা বিরক্তির সঙ্গে মানুষ করে, ততটাই বিরক্তি এদের। বেশিও না, কমও না। নিরাসক্ত যান্ত্রিক ভঙ্গিতে এরা এদের দায়িত্ব পালন করে চলেছে।

এই ঘরে সেরকম কিছুই ঘটল না তার সঙ্গে। সে এখনও ভয়ের জন্য অপেক্ষা করছে। সে যেদিন কনভেন্ট থেকে বাইরের জগতে ফিরে এসেছিল, সেদিনও তার মনে এক অদ্ভুত ভয় ছিল। যখন সে নিজের স্যুটকেস আর টাকার বটুয়াটা ঘামে ভেজা আঙুলে আঁকড়ে কনভেন্ট থেকে বেরিয়ে রাস্তায় গাড়িতে উঠেছিল, বাইরের জগতটাকে দেখে ভয় পাচ্ছিল সে। যে জগতে সে ফিরতে চায়… সংসার, স্বামী, সন্তান সবকিছু চায় এই জগতটার কাছে, সেই জগতটাকে তার সেদিন ভারি অদ্ভুত, বিশ্রী মনে হয়েছিল। যদিও তার চাহিদাগুলো কনভেন্টে থাকলে পূর্ণ হওয়া সম্ভব নয়, তবুও এই জগতে ফিরে এসে রাস্তায় গাড়িতে উঠবার মুহূর্তেও সে অত্যন্ত ভীত এবং নিজের এই ভীতির কারণে একইসঙ্গে লজ্জিত বোধ করছিল।

দ্বিতীয় ব্যারাকে লাইনে গিয়ে সে খুঁজছিল যে চেনা পরিচিত কেউ আছে কি না! কাউকে পেল না সে। ব্যারাকের সিঁড়িতে উঠবার সময় প্রহরী আবার অধৈর্যভাবে তাকে তাড়া দিতে লাগল। সে সিঁড়ি দিয়ে উঠে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ইতস্তত করছিল ভেতরে ঢুকবার আগে। সে ঢুকবার সময় মারিয়াকে সঙ্গে নিয়েই ঢুকতে যাচ্ছিল। সেটাই ভুল হল। সে দ্বিতীয়বার চমকে উঠল যখন প্রহরী এসে মারিয়াকে তার হাত ছাড়িয়ে নিয়ে গেল। মারিয়া ছাড়তে চাইছিল না। মারিয়ার চুল ধরে টেনে দিল। ইলোনা মারিয়ার চিৎকার শুনতে পেল। সে নিজের কার্ড হাতে নিয়ে ব্যরাকের ঘরে ঢুকল। সেখানে একটাই লোক বসে আছে। পরনে অফিসারের ইউনিফর্ম। লোকটার বুকে খুব সুন্দর একটা রূপোলী ক্রুশ আকৃতির মেডেল আঁটা আছে। মুখটা যেন ব্যথায় কাতর, ফ্যাকাসে। লোকটা যখন মুখ তুলে তার দিকে তাকাল, ভারি চোয়াল দেখে সে চমকে উঠল। মুখের আকারটাই অদ্ভুত হয়ে গিয়েছে ওরকম ভারি চোয়ালের জন্য। লোকটা নিঃশব্দে তার কার্ডটা নেবার জন্য হাত বাড়াল। সে কার্ড দিল। তার এখনও ভয় করছে না। লোকটা কার্ডটা দেখল। তারপর ঠাণ্ডা স্বরে বলে উঠল, ‘একটা গান শোনান!’

‘যা খুশি’… একটু অধৈর্য হয়ে বলে উঠল লোকটা… ‘যা মনে হয় গেয়ে ফেলুন!’ ইলোনা তার দিকে তাকিয়ে মুখ খুললো। সে সন্তদের প্রার্থনা গাইতে শুরু করল, যেটা সে কিছুদিন আগেই তুলেছে বাচ্চাদের শেখাবে বলে। সে লোকটির দিকে তাকাল একবার গাইতে গাইতে। হঠাৎ সে বুঝতে পারল যে ভয়ের স্বরূপ কেমন হতে পারে। তার গান শুনতে শুনতে লোকটার মুখ অদ্ভুতভাবে বেঁকে উঠছিল। বদলে যাচ্ছিল লোকটার মুখের রেখাগুলো যেন এক বিচিত্র তাড়সে। সে সুন্দর ভাবে গেয়ে যাচ্ছিল। সে বুঝতেও পারেনি যে গাইতে গাইতে তার মুখে এক প্রশান্তির হাসি খেলে যাচ্ছে। যদিও অদ্ভুত একটা ভয় পাক খেয়ে যাচ্ছে তার শরীরে। তার কণ্ঠ রুদ্ধ করে দিতে চাইছে ভয়ের দমক, কিন্তু সে হার মানছে না। গেয়ে যাচ্ছে। ব্যারাকের বাইরে মানুষের কথাবার্তা, গুঞ্জন সব থেমে গেছে তার গান শুরু হবার পরে।

ফিলসকাইট অপলক চেয়ে আছে। সুন্দরী এক মহিলা, কী অপূর্ব গাইছে! ফিলসকাইটের জীবনে কোনো দিন কোনো মেয়ে আসেনি। কঠোর ব্রহ্মচর্যে তার জীবন কেটে গেল প্রায়। সে যখন একা থাকে, আয়নার সামনে একা দাঁড়িয়ে রেওয়াজ করে সে। যে গুণ তার চিরকালের জন্য অধরা থেকে গেল, সেই সব বিরল গুণের সমাহার সে আজ চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছে। মহান সৌন্দর্য, জাতিগত উৎকর্ষ, এসবের সঙ্গে আরও একটা জিনিস আছে এই মহিলার মধ্যে, যেটা তাকে প্রস্তরবৎ স্থাণু করে দিয়েছে। কী সেই গুণ? ধর্মবিশ্বাস? ভক্তিভাব? সে বুঝতে পারছে না কী একটা অদ্ভুত দরদ আছে কণ্ঠস্বরে, যেটা আর পাঁচটা স্তোত্রগায়নের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। এই গান যে গাইছে মহিলা, এই মুহূর্ত কি সত্য? নাকি সে স্বপ্ন দেখছে? অথচ মহিলা ভয়ে কাঁপছে, সেটা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। ওই মহিলার দু চোখে ঠিক কোন অনুভূতি দেখতে পাওয়া যাচ্ছে? ভালবাসা? নাকি ভালবাসার মত কিছু একটা?

‘ফিলি… রিডেমপ্‌টর মুনডি, ডিউস১…’ গাইছে ওই মহিলা। সে কোনোদিন কোনো মহিলাকে এই গান এত সুন্দরভাবে গাইতে শোনেনি। ‘স্পিরিটুস সাংক্‌টে, ডিউস২…’ মহিলার কণ্ঠস্বর বলিষ্ঠ, উষ্ণ এবং অদ্ভুত পরিষ্কার। এখন নিশ্চয়ই গাইবে ‘সাংক্‌টা ট্রিনিটুস, ইউনুস ডিউস৩’… হ্যাঁ গেয়ে উঠল… ‘‘সাংক্টা ট্রিনিটুস…’ তাজ্জব ব্যাপার! ইহুদীদের মধ্যে ক্যাথলিক হয়? ফিলসকাইটের মনে হল সে এখনই উন্মাদ হয়ে যাবে!

ফিলসকাইট দৌড়ে গেল জানালার কাছে। এক ধাক্কায় পুরো জানালাটা খুলে দিল। বাইরে দাঁড়িয়ে সবাই গান শুনছে। কেউ এক চুল নড়ছে না। ফিলসকাইট বুঝতে পারল তার শরীরে একটা অদ্ভুত ঝাঁকুনি খেলে যাচ্ছে। সে এখনই বেঁকে যাবে কষ্টে। চিৎকার করতে ইচ্ছে করল তার, কিন্তু গলা দিয়ে কোনো শব্দ বের হল না। কর্কশ, প্রায় নিঃশব্দ একটা ফিসফিসে শব্দ বেরচ্ছে তার কণ্ঠ থেকে। সে একটাও কথা বলতে পারছে না। বাইরে কারো নিঃশ্বাসের শব্দটুকুও পাওয়া যাচ্ছে না। মহিলা গেয়ে যাচ্ছে… ‘সাংক্‌টা ডেই জেনিট্রিক্স৪…’

ফিলসকাইটের হাত কাঁপতে লাগল… কাঁপা হাতে সে তুলে নিল পিস্তলটা। ঘুরে দাঁড়াল একবার। অন্ধের মত সে গুলি করল মহিলাকে। মহিলা পড়ে গিয়ে আর্তনাদ করছে। থেমে গেছে তার গান। থেমে গেছে সেই সংগীতময় কণ্ঠ। হ্যাঁ, আবার ফিলসকাইট নিজের কণ্ঠস্বর ফিরে পেয়েছে ওই মহিলার গান থেমে যাবার পরে। ‘মেরে ফেলো সবাইকে’… চেঁচিয়ে ওঠে সে… ‘ব্যারাকের বাইরে যারা আছে, কয়ারে যারা আছে… সব্বাই… সব্বাইকে শেষ করো’… বলতে বলতে পিস্তলের পুরো ম্যাগাজিন সে খালি করে দেয় ওই মহিলার শরীরে।

ইলোনার শরীর মাটিতে লুটিয়ে পড়ে আছে। সব ভয় শেষ হয়েছে তার। ব্যারাকের বাইরে শুরু হয়েছে হত্যালীলা।

(চলবে)

-------------------------------------------

১. লাতিন স্তোত্র, পদের অর্থ… হে ঈশ্বরের পুত্র, জগতের পরিত্রাতা।
২. লাতিন স্তোত্র, পদের অর্থ… হে ঈশ্বর, পবিত্র আত্মা।
৩. লাতিন স্তোত্র, পদের অর্থ… পবিত্র ত্রয়ী সন্ত মিলে গিয়ে এক ঈশ্বর।
৪. লাতিন স্তোত্র, পদের অর্থ… ঈশ্বরের মাতা, পবিত্র দেবী।

0 comments: