0

ধারাবাহিক - শ্যামাপ্রসাদ সরকার

Posted in




















( ২)

হাঁটতে হাঁটতে গোলকপতি একটু হাঁপিয়ে যাওয়ায় একটি অতিপ্রাচীন ঘোড়ানিমগাছের তলায় এসে দু'দন্ড বসল। এখানকার শীতলমাতৃময়ী ছায়াচরাচরটি আজ ওকে মনে পড়িয়ে দিচ্ছিল যে মহামহোপাধ‍্যায় শ্রী সর্বজ্ঞ শাস্ত্রীর কাছে ছেলেবেলায় ও একটি বর্ণবহুল প্রাচীন সংস্কৃত পুঁথিতে দেখেছিল যেখানে ওদের পূর্বপুরুষ পরম ভট্টারক মহারাজাধিরাজ পরম সৌগত "মধুসেন” ১১৯৪ শকাব্দে (১২৭২ খ্ৰী: ) এই বিক্রমপুরে এসে আধিপত্য করতেন বলে উল্লেখ আছে। সেখানে এও কথিত আছে যে উনি তুরস্ক দস‍্যুদের বারংবার পরাজিত করেছিলেন।

যে কুলীনকূলতিলক লক্ষ্মণ সেন একদা মুসলমান দস‍্যুদের ছলনায় পরাজিত ও ভগ্নহৃদয়ে অতিবৃদ্ধ বয়সে লক্ষ্মণাবতী থেকে পূর্বদেশে পালিয়ে আসেন সেই তূরস্কবাসী দস‍্যুদের প্রতাপকে যে ওঁর পরবর্তী প্রজন্ম ক্রমাগত পরাজিত করে নিজেদের পদতলে রাখতে সমর্থ হয়েছিল, সে তো আর কম গৌরব নয়। বহুদিনের পরে উত্তরকালে এই সেন রাজবংশের রাজা হিসেবে যে সুর সেন, সূর্য সেন,নারায়ণ সেন প্রমুখের রাজকীয় উপস্থিতি কালের গর্ভে আজ বিলুপ্ত হলেও তা আজ এত দূর্ভাগ‍্যের দিনেও ওর রক্তধারায় এখনও বইছে।

....

এতদিন যে বিজয় গর্বে গোলকপতি এই কূলগৌরবের বহুকথিত শ্রুতাখ‍্যানসমূহ এবং মাতার কাছে সে পিতৃদত্ত একটি রক্তমুখী নীলকান্ত মণি শোভিত মণিবন্ধ দেখেছে শৈশবকাল থেকে তা একদা ওর পিতৃদেব মন্মহারাজ স্বয়ং কোনও এক মধুক্ষরা মুহূর্তে ওর মাতাকে একদা উপহার দিয়েছিলেন বলে সেটা আজও দরিদ্রের সংসারে রয়ে গেছে। এইটুকুই তো ওর পিতৃধন। একটি মাস পূর্বে নদীতীরে মাতার চিতাগ্নির সাথে সাথে বংশমর্যাদার সামান‍্য স্বীকৃতিটিও কালের দরবারে ইদানীং অসহায়ের মত হারিয়ে গেছে বলে ও এসব ভুলতেই চাইছে।

....

আসলে ওর মনের ভিতর মহল থেকে ক্রমাগত একটি ডাক থেকে থেকেই বেজে উঠছে যা এই অনর্থক অপমানের কূলগৌরবটিকে পরিত‍্যাগ করে এক অন‍্য ভবিষ‍্যনিধির আহ্বানে পা বাড়াতে ওকে ক্রমাগত প্ররোচিত করছে।

...

তাই এসব বিষয় সংক্রান্ত সমস্ত দ্বিধা আজ গোলকপতি স্বয়ং একটু একটু করে ফেলে দিয়ে একটি নতুন এবং অন‍্য সমারোহের পথে সে হাঁটতে চলেছে তা স্থিরকরণের অনিশ্চয়তা আর তার মনোজগতে আর নেই।

....

গোলকপতি অবশ‍্য অনেক পরে জেনেছে যে ওদের পূর্বপুরুষ রাজাধিরাজ লক্ষ্মণ সেন ছিলেন আসলে বৈষ্ণব মতবাদের কঠোর অনুসারী। তিনি সেসময় 'পরমবৈষ্ণব' বা 'পরম নরসিংহ' উপাধি ধারণ করেন। যদিও তাঁর ধর্মমতের পরিবর্তনটি সম্পর্কে সঠিক কিছু জানা যায় না। মূলতঃ তাঁর শাসনকালের শেষ দিকে অবশ্য নিজেই রাজকার্য পরিচালনায় অশক্ত হয়ে পড়েন বলে আসল জনশ্রুতি। পরবর্তীকালে বিক্রমপুরে তাঁর পলায়ন ও রাজধানী স্থানান্তরের ইতিহাসটি লোকমুখে আজকাল বহুল প্রচলিত। ' দানসাগর' আর ' অদ্ভূতসাগর' এর স্রষ্টার এ এক মর্মান্তিক পরিণতি! যদিও এটাও অনস্বীকার্য যে তাঁর মৃত‍্যু সেদিন পাঠান সুলতান ইলতুৎমিসের শাহী ফৌজকেই গৌড়ের অবিসংবাদিত রক্ষাকর্তা হিসাবে বঙ্গদেশের ইতিহাস মেনে নিয়েছে।

....

ইতিহাসের পালাবদল প্রতিটি প্রজন্মান্তরে একবার বদলে গেলেও তার শিকড়ের টানটি অন্তত চিরকালীন। সেন রাজাদের রাজবংশ ভারতীয় উপমহাদেশের প্রথম দিকের মধ্যযুগীয় একটি হিন্দু রাজবংশ হিসাবেই বিখ‍্যাত ছিল, যার সুনাম বঙ্গদেশের মাটীতেও একাদশ ও দ্বাদশ শতাব্দী পর্যন্ত একদা বজায় ছিল।

আজ সে সব প্রাচীন ইতিহাস গৌড়-বঙ্গের আকাশে বাতাসে কান পাতলে শোনা যাবেনা। এমনকি ৯০০ শতকেরও পূর্বে তখন বৌদ্ধধর্মের পৃষ্ঠপোষক পাল রাজাদের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে করতেই একদিন গোলকপতির এই বীরাচারী পূর্বজরা মিলে প্রতিষ্ঠিত পাল রাজাদেরকে পরাজিত করে প্রখ‍্যাত শশাঙ্কদেব শাসিত গৌড়ের মাটিতে সেদিন সেন বংশের তরবারিকে প্রোথিত করেন।

সেন বংশের জয়পতাকা সেদিন বঙ্গোপসাগরের উপকুল থেকে উত্তরভারত(কনৌজ) পর্যন্ত উড্ডীয়মান ছিল। তবে পরস্পরবিরোধীতা ও গোপন ষড়যন্ত্রের বীজটিও তাঁরা আবার নতুন করে গৌড়ের মাটীতে বপন করে গেলেন।

সেন রাজাদের আদি বাসস্থান যা উৎসগতভাবে ছিল দক্ষিণ ভারতের বাকাটক সাম্রাজ্যের কর্ণাটকে তার প্রচ্ছায়া এবার এসে পড়ল নদীমাতৃক পূর্ব ভারতের এই দেশাঞ্চলটিতেও।

....

ব্রাহ্মণ‍্য গৌরবের পরে কয়েকটি প্রজন্ম সেদিন ক্ষত্রিয়বাচক পেশা রাজধর্মকে সেদিন বেছে নেওয়ায় নিজেদেরকে " ব্রহ্মক্ষত্রিয় " নামে তাদের আত্মপরিচয়দানের কথা সেসময়ের বহু শিলালিপিতে উল্লেখিত আছে বলে গোলকপতি তা শুনে উল্লসিত হয়ে উঠত। যে অধার্মিক পাল বংশীয় নৃপতি মদনপালকে সমূলে সরিয়ে দিয়ে সেন বংশের বঙ্গালে পদার্পণ ও প্রতিষ্ঠার কাহিনিটি যেন তার রক্তধারায় আলোড়ন তুলত।

সে বুঝতে পারত যে তার ধমনীতেও বইছে কূলীনকূলসর্বস্ব রাজাধিরাজ খ‍্যাতনামা স্বয়ং বল্লাল সেনের রক্তধারা।

0 comments: