1

প্রবন্ধ - প্রদোষ ভট্টাচার্য্য

Posted in





















১৮৯৪ খ্রিস্টাব্দে এইচ জি ওয়েলস সাহেব Pall Mall Budget নামক পত্রিকায় ‘The Flowering of the Strange Orchid’ নামে একটি বিচিত্র ছোট গল্প প্রকাশ করেন। গল্পের কেন্দ্রে ছাপ্পান্ন বছরের অকৃতদার Winter Wedderburn, যাঁর আক্ষেপ হলো যে তাঁর জীবনে কৌতূহলোদ্দীপক কিছু কখনো ঘটেনিঃ তিনি শৈশবে কখনও দুর্ঘটনায় পড়েন নি, তিনি কখনও প্রেমে পড়েন নি, তাঁর বিয়েও হয়নি। অথচ, তাঁর পরিচিত – এবং অপরিচিত – সবারই জীবন কত বৈচিত্রপূর্ণ! যেমন, ছত্রিশ বছরের অর্কিড-সংগ্রাহক Batten, যার সংগ্রহ ওয়েডারবার্ন কিনতে সেদিন লন্ডন যাচ্ছেন। ব্যাটেন ছিল দুবার বিবাহিত, একবার তার বিবাহবিচ্ছেদও হয়েছিল, চারবার ম্যালেরিয়া হয়েছিল, একবার তার ঠ্যাং ভেঙেছিল, সে এক মালয়দেশের অধিবাসীকে মেরে ফেলেছিল, একবার সে বিষাক্ত তীরের শিকার হয়েছিল। অবশেষে জোঁকেদের পাল্লায় পড়ে তার মৃত্যু হয় – এই একটি ঘটনাই যা ওয়েডেরবার্নের কাছে তেমন interesting নয়!

একগুচ্ছ বিভিন্ন রকমের ফুলের সঙ্গে একটি, ওয়েডেরবার্নের জ্ঞাতি বোন এবং তাঁর বাড়ির তত্ত্বাবধায়িকার ভাষায় ‘মাকড়সার মতো দেখতে’, অর্কিড, কিনে ওয়েডেরবার্ন বাড়ি ফেরেন, এবং তাঁর উৎফুল্ল মন বলতে থাকে যে তাঁর কেনা ফুলগুলির মধ্যে অন্তত কয়েকটি অসাধারণ কিছু হবে। বেচারী ব্যাটেনকে নাকি মৃত পাওয়া গিয়েছিল তার আন্দামান আর ‘Indies’ থেকে আমদানি অর্কিডগুলোর একটির ওপরে । তার কয়েকদিন ধরে শরীর খারাপ যাচ্ছিল, এবং আন্দাজ করা হয় যে সে অজ্ঞান হয়ে পড়ে গিয়েছিল। তার দেহে ছিল না এক ফোঁটা রক্ত – মনে করা হয়েছিল জোঁকেরা সব শুষে নিয়েছিল!

ওয়েডেরবার্নের কেনা বেশীর ভাগ ফুলগুলোই শুকিয়ে গেল, শুধু অর্কিডটা বড় হতে লাগলো। তার কুঁড়িগুলো, ওয়েডেরবার্নের বোনের ভাষায়, কেমন যেন সাদা-সাদা আঙুলের মতো দেখতে – যেন ফুলটা দর্শককে ধরতে চাইছে! ওয়েডেরবার্ন স্বীকার করে যে অন্য কোন অর্কিডে সে এই আঙুলের মতো বায়বীয় মূলিকা দেখে নি।

অর্কিডের পাতাগুলো সবুজ আর এই সবুজের মাঝে লাল লাল ফোঁটা! একদিন সে প্রস্ফুটিত হলো, আর অর্কিড-হাউস ভরে গেল খুব মিষ্টি একটা গন্ধে। গন্ধের জোরে জ্ঞান হারালেন ওয়েডেরবার্ন!

বিকেল সাড়ে-চারটেয় চায়ের টেবিলে তাঁর অনুপস্থিতিতে বিরক্ত হয়ে তাঁর বোন অর্কিড-হাউসে গিয়ে দেখেন চিত হয়ে অর্কিডটির নিচে পড়ে আছেন তাঁর ভাই। অর্কিডের মূলিকাগুলো লেগে রয়েছে তাঁর থুতনি, ঘাড় আর হাতে! তাঁর মুখে লাগা রক্ত!

মিষ্টি গন্ধে বোনের শরীর টলতে লাগল। তিনি কোনমতে একটা ফুলের টব দিয়ে অর্কিড-হাউসের একটা জানলা ভেঙে ভাইয়ের দেহ টেনে হিঁচড়ে বাইরে নিয়ে এলেন। অর্কিডের শুঁড়গুলো তখনও ওয়েডেরবার্নের দেহে আটকে। বোন এক এক করে সেগুলো টেনে ওয়েডেরবার্নের শরীর থেকে ছাড়ালেন। তাঁদের মালী জানলা ভাঙার আওয়াজ শুনে সেখানে এসে পড়ায় বোন তাঁকে বললেন জল আনতে আর পারিবারিক চিকিৎসককে খবর দিতে।

ওয়েডেরবার্নের অনেকটা রক্তক্ষয় হয়েছিল, কিন্তু আর গুরুতর কিছু হয় নি।

পরের দিন খোলা, ঠাণ্ডা হাওয়ায় অর্কিডটা কালো হয়ে শুকিয়ে যেতে লাগল।

ওয়েডেরবার্ন কিন্তু বেশ উৎফুল্ল। অবশেষে তাঁর জীবনে এক বিচিত্র অ্যাডভেঞ্চার ঘটে গেছে!


১৮৯৪-এর পর ১৯৬২ সাল। ইংরেজী পল মল বাজেট পত্রিকার জায়গায় বাংলা সন্দেশ। অর্কিডের মালিক ব্যাটেন তার সংগ্রহের ‘হাতে’ পটল তুলেছিলেন। উদ্ভিদবিজ্ঞানী কান্তিবাবু বহাল তবিয়তে আছেন। তিনি যে কীটখোর গাছপালা সংগ্রহ করেন এটাও গল্পের কথক পরিমল তার বন্ধু অভিজিতের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে জানিয়েছে। কান্তিবাবু তাঁর গ্রীন হাউস সমেত বাস করেন কলকাতার উপকণ্ঠে বারাসাতে। ওয়েডেরবার্নও লন্ডনে গিয়ে বিভিন্ন রকম ফুলের গাছ ইত্যাদি কিনতেন, অতএব তাঁর অর্কিড-হাউসও মূল শহরের মধ্যে নয়। কান্তিবাবু পরিমলকে তার বন্দুক নিয়ে বারাসাতে আসতে বলছেন। কারণ তাঁর সংগ্রহে Venus Fly Trap ছাড়া প্রায় বিশ রকম মাংসাশী উদ্ভিদ আছে – যাদের মধ্যে রয়েছে গল্পটি যার নামে, সেটিঃ মধ্য আমেরিকার নিকারাগুয়া হ্রদের কাছে জঙ্গল থেকে আনা ‘সপ্তপাশ’ বা ‘সেপ্টোপাস’। এই গাছ খায় পোকা নয়, অনেক বড় বড় প্রাণী, যেমন বাঁদর, আর্মাডিলো প্রভৃতি। বারাসাতে আসার পর প্রথমে ইঁদুর, তারপর চাপা পড়া কুকুর-বেড়াল, তারপর মুরগী, পাঁঠা খেয়ে সেপ্টোপাস একদিন তার শুঁড় দিয়ে জাপটে ধরে কান্তিবাবুর চাকর প্রয়াগের একটা হাত! কান্তিবাবু শুঁড়ে সজোরে লাঠি মেরে প্রয়াগকে ছাড়িয়ে আনেন, কিন্তু ততক্ষণে সেপ্টোপাস তার হাতের খানিকটা মাংস খুবলে খেয়ে নিয়েছে। এরপর কান্তিবাবু গাছটাকে বিষ মেশানো খাবার দিয়ে মারবার চেষ্টা করেন। সে খাবার শুঁড়ে নিয়েই সেপ্টোপাস তা ফেলে দেয়। অতএব কান্তিবাবু পরিমলকে ডেকেছেন, তার বন্দুকের গুলি দিয়ে গাছটা মারাবেন বলে। আর যেহেতু পরিমলের গাড়ি নেই তাই তার সঙ্গে এসেছে তার গাড়িওয়ালা বন্ধু অভিজিৎ, যে আবার সঙ্গে করে এনেছে তার কুকুর বাদশাকে।

গল্পের শীর্ষবিন্দুতে মারণ গাছ শিকারকে আকর্ষণ করতে উগ্র গন্ধ ছড়ায়, যা পরিমলকে মনে করায় টনসিল অপারেশনের সময় ব্যবহৃত চেতনানাশক ক্লোরোফর্মের কথা (ওয়েডেরবার্ন তাঁর অর্কিডের ছাড়া গন্ধে সংজ্ঞা হারিয়েছিলেন, এবং তাঁর বোনের প্রায় সেই একই অবস্থা হতে যাচ্ছিল!) বাদশা তাঁর বগলস ছিঁড়ে ছুটে যায় সেপ্টোপাসের ঘরে এবং সঙ্গে সঙ্গে আক্রান্ত হয়। তাঁকে বাঁচাতে গিয়ে গাছের শুঁড়ের শিকার হয় বাদশার মালিক অভিজিৎও। শেষে পরিমলের বন্দুকের গুলিতে গাছের ‘মাথা’ থেকে ফিনকি দিয়ে রক্ত ছোটে আর গাছ অভিজিৎকে ছেড়ে দিয়ে নেতিয়ে পড়ে।

বাদশাকে বাঁচানো যায় নি। অভিজিতের পাঁজরের দুটি হাড় ভেঙেছিল।

আলোচনা

বোঝাই যাচ্ছে যে ওয়েলসের ছোট্ট গল্পটির বিন্যাস ঘটিয়েছেন সত্যজিৎ রায়, তাঁদের পত্রিকার কলেবরের কথা মনে রেখে।

এখানে প্রশ্ন হলো, এই যে বাড়তি উপাদানগুলিঃ গাছ মারতে দুজন মানুষের উপস্থিতি, তাদের একজনের সঙ্গে আবার কুকুর, প্রথমে পশু এবং তারপর মানুষের ওপর গাছের আক্রমণ, কুকুরের মৃত্যু – এসব কি এর আগে ওয়েলসের গল্পটির বাংলা রূপান্তরে কখনও আসে নি?


সুমিত গঙ্গোপাধ্যায় ও দীপ্তজিৎ মিশ্র প্রদত্ত তথ্য অনুযায়ী, ১৯২৫ সালে কোন এক পত্রিকায় এবং ১৯৪০ সালে শংকর সাহিত্য সংসদ প্রকাশিত কোন এক সংকলনে, প্রকাশিত হয় হেমেন্দ্রকুমার রায়ের ‘পিশাচ’ গল্পটি।

[১ মেন্দ্রকুমার রায়, বিমল-কুমার সমগ্র (৩) (দেব সাহিত্য কুটীর প্রাঃ লিঃ, কলকাতাঃ ২০২৩), ‘পরিশিষ্ট ২ – বিমল-কুমার গ্রন্থপঞ্জী’, পৃঃ ৩১০। ‘পিশাচ’ পাওয়া যাবে সমগ্রে-র ২য় খণ্ডে, ২৪৩-২৪৮ পৃষ্ঠায়, এবং এশিয়া পাবলিশিং-এর হেমেন্দ্রকুমার রায় রচনাবলী-র ১৪শ খণ্ডে (কলকাতাঃ ১৯৯৬)। ৯৭-১২৮ পৃষ্ঠায় ছায়াকায়ার মায়াপুরে সংকলনের ১০৫-১১০ পাতায়।]

এবার পাশাপাশি রাখব হেমেন্দ্রকুমারের গল্পটি আর ১৯৬২ সালে সন্দেশ-এ প্রকাশিত সত্যজিৎ রায়ের ‘সেপ্টোপাসের খিদে’। দুটি গল্পের কেন্দ্রেই আছে দক্ষিণ আমেরিকা থেকে কলকাতার উপকণ্ঠে আনা – ‘পিশাচ’-এ টালিগঞ্জ-রিজেন্ট পার্ক অঞ্চলে, আর ‘সেপ্টোপাসের খিদে’-তে বারাসাতে – আমিষভুক অর্কিড। এবার আসি চরিত্রগুলির প্রসঙ্গেঃ

‘পিশাচ’                                                                                         ‘সেপ্টোপাসের খিদে’

উদ্ভিদবিজ্ঞানী রামময়বাবু                                                             উদ্ভিদবিজ্ঞানী কান্তিবাবু

বিমল                                                                                              গল্পের কথক পরিমল

কুমার                                                                                              পরিমলের সহপাঠী অভিজিৎ


‘পিশাচ’-এ বিমল-কুমারের দুই ছায়াসঙ্গী রামহরি, এবং বিশেষ করে বাঘা, অনুপস্থিত। ‘সেপ্টোপাসের খিদে’তে অভিজিতের কুকুরপ্রীতি এবং বারাসাতে যাবার সময় সঙ্গে সঙ্গে করে তার ‘বেজায় তেজিয়ান’ রামপুর হাউন্ড বাদশাকে নিয়ে আসা কাকে মনে করায়? ‘পিশাচ’-এ রামময়বাবুর বাগানে কীটপতঙ্গ, মানুষ, এবং, বিমল-কুমার সেই বাড়ীতে আস্তানা গাড়ার পর, একটি বেড়ালের অপমৃত্যু ঘটেছে। বেড়ালের জায়গায় সেপ্টোপাসের মারণ আক্রমণে প্রাণ দিয়েছে বাদশা। হেমেন্দ্রকুমার রায় রচিত মান্ধাতার মুল্লুকে-র কথা মনে পড়ছে কি? সেখানে বিচিত্র আততায়ীর হাতে প্রাণ দিয়েছিল বাঘা। বাদশাকে রক্ষা করতে গিয়ে আক্রান্ত হচ্ছে অভিজিৎ । কুমারও আক্রান্ত হচ্ছে রামময়বাবুর অর্কিডের শুঁড়ের দ্বারা, যদিও কুমার মারাত্মকভাবে আহত হবার আগেই বিমলের গুলিবৃষ্টিতে ফুলসমেত অর্কিডটি দু-খানা হয়ে ভেঙে পড়ছে। পরিমলের গুলিতে সেপ্টোপাসের মাথা থেকে লাল রক্তের ফোয়ারা উঠছে আর তার শুঁড়গুলি অভিজিতকে মুক্তি দিচ্ছে, অবশ্য তার পাঁজরের দুটি হাড় ভেঙে দেবার পর। কুমারের সর্বাঙ্গ শুধু ফোড়ার মতো টাটিয়ে উঠেছিল।



গল্পগুলির পার্থক্য তাদের ‘রস’-এ।


মূল কাহিনিতে দুটি প্রধান চরিত্র একে অপরের বিপরীত লিঙ্গের, এবং রক্ষাকর্ত্রীর ভূমিকায় অবতীর্ণ যিনি হচ্ছেন তিনি Wedderburn-এর উদ্ভিদ নিয়ে সখের প্রতি খুব একটা সহানুভূতিশীল নন। শেষ অবধি মারাত্মক ভাবে আহত হবার আগেই তিনি Wedderburn-কে রক্ষা করতে সক্ষম হচ্ছেন। কাহিনিটির রস প্রধানত black comedy-র। Wedderburn-এর আক্ষেপ ছিল যে তাঁর জীবনে চমকপ্রদ কিছু ঘটে না। গল্পের শেষে রক্তশোষক অর্কিডের ‘হাত’ থেকে মুক্তি পেয়ে তিনি তৃপ্ত এবং খুশী। অবশেষে তাঁর ভাগ্যে জুটেছে এক বিচিত্র অ্যাডভেঞ্চার!


হেমেন্দ্রকুমার গল্পের নামকরণে ইচ্ছাকৃতভাবেই পাঠককে বিভ্রান্ত করার জন্য অতিপ্রাকৃতের ইঙ্গিত রেখেছেন। রামময়বাবুর অকস্মাৎ হৃদরোগে মৃত্যুর আগে তাঁর বাগানে প্রথম অপঘাত মৃত্যু ঘটে তাঁর উড়ে বেয়ারার। তার দেহকে যেন অনেকগুলি শক্ত দড়ি দিয়ে বেঁধে ফেলা হয়েছিল, এবং তার গলাতেও ছিল ফাঁসের দাগ। সর্বোপরি, তার শরীর থেকে কেউ যেন সমস্ত রস ও রক্ত নিংড়ে বার করে নিয়েছিল। প্রসঙ্গত, কান্তিবাবুর চাকর প্রয়াগকেও সেপ্টোপাস আক্রমণ করে তার ডান হাতের খানিকটা মাংস খুবলে খেয়ে নেবে। রামময়বাবুর বাগানে দ্বিতীয় যে মানুষের মৃত্যু ঘটে সে ছিল এক দাগী চোর, সে রাতে চুরির উদ্দেশ্যেই বাগানে ঢুকেছিল, এবং তার শরীরও ছিল রস বা রক্ত শূন্য। এরপর ঐ বাগানে পাওয়া যেত মরা ইঁদুর, ছুঁচো, প্যাঁচা, বাদুড়, আর চামচিকে। লক্ষ্যণীয় যে তাদের শরীরেও রক্ত বা রস থাকত না, এবং তারা সকলেই নিশাচর প্রাণী! এরপর স্বাভাবিকভাবেই রামময়বাবুর হৃদরোগে মৃত্যুকেও অলৌকিক বলে রটনা করা হয়। রহস্যের সমাধান ঘটে গল্পের একেবারে শেষে, যেখানে কুমারকে অর্কিডের শুঁয়ো থেকে মুক্ত করার পর বিমল জীবজন্তুর রক্তপায়ী অর্কিডের কথা তোলে। তখন অবধি পাঠকের মনে হবে কোন নিশাচরী অতিপ্রাকৃত বিভীষিকার কথা!

[২ রচনাবলী ১৩শ খণ্ড (এশিয়া পাবলিশিং কোম্পানি, কলকাতাঃ ১৯৯২) ১৬১-২৫৯।]

সেপ্টোপাস এবং তার সগোত্রীয় উদ্ভিদদের স্বভাব আরম্ভ থেকেই পরিমল এবং পাঠকদের জানিয়ে রাখা হয়েছে। এখানে কোন element of surprise বা বিস্ময়ের উপাদান নেই, যা আছে তা হলো নির্ভেজাল horror বা ভয়াবহতা। পাঠকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করি প্রয়াগের ওপর সেপ্টোপাসের আক্রমণ বা কাহিনির শীর্ষবিন্দুতে বাদশা এবং অভিজিতের যে দশা হচ্ছে, সেদিকে। হেমেন্দ্রকুমারের সময়ে যেহেতু আমিষাশী উদ্ভিদের কথা ছিল অপেক্ষাকৃত অল্পশ্রুত, তাই তিনি তাঁর ‘পিশাচ’-কে রহস্যের আবরণেই প্রথমে উপস্থাপিত করেছেন।


এবং শেষ কথা, ওয়েলস সাহেবের উৎস-কাহিনিতে কিন্তু আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন মাত্র একজন – অর্কিডের প্রথম মালিক। দ্বিতীয় জন মারাত্মক কিছু হবার আগেই রক্ষা পেয়েছেন এবং পুরো ব্যাপারটা নিয়ে বেশ তৃপ্তি অনুভব করেছেন। কেন তা আগেই আলোচিত হয়েছে। ‘পিশাচ’ এবং ‘সেপ্টোপাসের খিদে’-তে মালিক উদ্ভিদটির দ্বারা আক্রান্ত হন নি। হেমেন্দ্রকুমারের রামময়বাবু মারা গেছেন হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে, আর কান্তিবাবু আক্রান্তই হন নি। আক্রান্তের সংখ্যা, মানুষ, কীটপতঙ্গ আর বেড়াল মিলে হেমেন্দ্রকুমারে অনেকজন, সতজিতের গল্পে মোট তিনজন – দুজন মানুষ ও একটি কুকুর। দুটি বাংলা রূপান্তরেই কোন নারী চরিত্র নেই, মূল কাহিনিতে কিন্তু আছে, এবং তাঁর ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ, কারণ তিনিই মূল চরিত্রকে আমিষাশী উদ্ভিদের ফলার হওয়া থেকে রক্ষা করছেন। মানে, বিমল বা পরিমলের উৎস চরিত্র একজন অনাম্নী মহিলা, যিনি সম্পর্কে কেন্দ্রীয় চরিত্রের জ্ঞাতি বোন!




উপসংহার


কল্পবিশ্ব ওয়েবপত্রিকার ৬ষ্ঠ বর্ষ ২য় সংখ্যায় (শারদীয়া ১৪২৮) এবং তাঁর আগে উক্ত পত্রিকার ৬ষ্ঠ বর্ষ ১ম সংখ্যায় ওয়েলস সাহেবের বাংলা সাহিত্য ও চলচ্চিত্র জগতে উপস্থিতি নিয়ে বিস্তৃত আলোচনা করেছিলাম। সে দুটি প্রবন্ধই পরে কল্পবিশ্ব প্রকাশনা সংস্থা সংকলিত করেছেন আমার হেমেন্দ্রকুমার রায়ঃ এক পথিকৃতের কীর্তিকাহিনি (কল্পবিশ্ব পাবলিকেশন্স, কলকাতাঃ ২০২২) বইটিতে। তখন ওয়েলসের এই ছোট গল্পটির কথা জানা ছিল না। এটি গোচরে আনার জন্য আমি শ্রীমতী প্রধন্যা মিত্রের কাছে ঋণী। এবার ওয়েলসের বাংলায় আরো একটি উপস্থিতি পাওয়া গেল, দু’জন লেখকের মাধ্যমে।


দুজনের কেউই সরাসরি অনুবাদ বা অনুকরণ করেন নি। এবং দুটি রূপান্তরের প্রধান সাহিত্যরস ওয়েলসের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। ইংরাজী পরিভাষা ব্যবহার করে বলা যায়, ওয়েলস লিখেছেন একাধারে whimsical এবং black comedy। হেমেন্দ্রকুমারের ‘পিশাচ’ আসবে ‘supernatural explained’-এর আওতায়, যেখানে আপাত অতিপ্রাকৃত ঘটনাসমূহ শেষ অবধি দেখা গেছে হয় মনুষ্যসৃষ্ট – ইংরেজী সাহিত্যে যার দুটি বিখ্যাত উদাহরণ Mrs Ann Radcliffe-এর The Mysteries of Udolpho (১৭৯৪) এবং শার্লক হোমস-স্রষ্টা কোনান ডয়েলের The Hound of the Baskervilles (ধারাবাহিক ১৯০১-১৯০২, বই আকারে ১৯০২) – অথবা বিজ্ঞানভিত্তিক, যেমন ‘পিশাচ’। সত্যজিৎ রায় কোন রহস্যের আবরণ রাখার প্রয়াসই করেন নি, আগেই বলা হয়েছে, তাঁর লক্ষ্য ছিল horror বা ভয়াবহতা উৎপাদন, যা তিনি এরপর করবেন পুরোপুরি অতিপ্রাকৃত ঘটনার মাধ্যমে ‘খগম’ গল্পটিতে।


তাই, বাংলা রূপান্তরদুটিকে, বিদেশী অনুপ্রেরণা সত্ত্বেও, সফল সাহিত্যকর্মের অভিধা দিতে অন্তত বর্তমান প্রবন্ধকারের কোন দ্বিধা নেই। আর ‘পিশাচ’ থেকে ‘সেপ্টোপাসের খিদে’-র মধ্যে যে বিভিন্ন motif-এর ধারাবাহিকতা দেখা গেছে, তাতে বাংলা শিশু ও কিশোর সাহিত্যের পরম্পরারও একটা রেখাচিত্র পাওয়া যায়।

1 comment:

  1. অতি চমৎকার বিশ্লেষণ।

    ReplyDelete