0

গল্প - সুজিত নারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

Posted in





শেষ পর্যন্ত, আমায় বলতেই হলো, আমার ভুল হয়েছিল। অথবা,স্বীকার করে নিতেই হলো, ওর ব্যাপারে, আমি ছাড়া, আর কেউ ভুল করতেই পারে না। সবাই ঠিক করে। আমাদের দাম্পত্য জীবনে অনাবশ্যক হস্তক্ষেপ করে, আমায় আড়ালে রেখে, তোমার সাথে দীর্ঘ ফোনালাপ--এ'সব কিছুই "ঠিক" করা। আর তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা, সবকিছু সরাসরি বলে দেওয়াটাই "ভুল" করা! তুমি ত' জানই এ'সব কিছুর জন্যেই আমি ভুল স্বীকার করেছি, ক্ষমা চেয়েছি। তুমিই বল, আর কিই বা আমি করতে পারতাম?

এ'সব কিছুর কি দরকার ছিল? অবশ্য এনিয়ে তোমায় কিছুই বলা যাবে না। কারণ আমার খোলা মনের কথা, তোমায় হয়ত আবার 'অবসাদগ্রস্থ' করে তুলবে। তোমার মা বাবার তর্জনী আবার আমার দিকে উঠে আসবে। আমার বাবা, সব শুনে, ঘরের মধ্যে আমায় একা ডেকে নেবে। বোঝাবে, আলতো করে বকবে। দরজাটা অর্ধেক খুলে, মা মুখ বাড়িয়ে দেখার চেষ্টা করবে, বাবা আমায় কি বলছে! আমায় বকছে কি'না! তারপর বাইরে সোফার ওপর বসে, কিছুক্ষণ একা চোখের জল মুছবে। তারপর আর বাইরে থাকতে না পেরে, ঘরে ঢুকে, বেশ জোরের সঙ্গে বাবাকে বলবে,"কেন তুমি দেখে দিলে না?" বাবা মৃদুভাবে শুধু হাসবে। বৌদি একটা কানে মোবাইলের কর্ড গুঁজে, এক কানে ইউটিউব শুনবে অন্য কানে আলগোছে ঘরের ভিতরের কথা আন্দাজ করার চেষ্টা করবে। আর আমার দাদা, হঠাৎ ঘরে ঢুকে গোঁয়ারের মত, প্রচন্ড রেগে, তোমায় immature বলে বসবে, তারপর বাবার কাছে বকুনি খাবে।

কারণ বাবাই একমাত্র জানে, তোমার কোন সমালোচনা আমি অন্য কারুর মুখে শুনতে পছন্দ করি না। তাই তোমার নামে এই ধরনের কথায়, আমার অনুভূতিগুলো ছ্যাঁত করে ওঠে। আসলে আমি ছাড়া, আর কেউ তোমার নামে কিছু বললে, আমি সহ্য করতে পারি না। স্বীকার করতে লজ্জা নেই, এই অনুভূতিটা আমি বাবার কাছেই শিখেছি। তুমি আমার-- ভালো হলেও আমার, আর খারাপ হলেও আমার। কিন্তু তোমার এই অবসাদ, এই বিষণ্ণতা, জীবনের প্রতি এই হতাশা-- এ'গুলো ত' আমার নয়! আমার কাছে এ'গুলো অপরিচিত, আমি চিনতেও চাই না। তবুও সবাই বলছে, এগুলো নাকি আমি তোমায় দিয়েছি!! আমার জন্যেই নাকি, এগুলো তোমার মধ্যে বাসা বেঁধেছে। আমি ওদের কথা শুনি, কিন্তু কোন মান্যতা দিই না। বিশ্বাস করি না। আমি জানি, ওরা এটা জানে, যে কথাগুলো আদৌ সত্যি নয়। ওরা ওদের নিজেদেরকে, বা, ওদের কতৃত্বকে তোমার ওপর প্রতিষ্ঠা করার জন্যে, এবং তোমার comfortable বৃত্ত থেকে আমায় দূরে সরিয়ে দেওয়ার জন্যেই, এসব কথা বলে।

কিন্তু আমি অবাক হয়ে গেলাম, যখন শুনলাম, তুমিই নাকি এসব কথা বলেছ। তুমিই নাকি বলেছ, আমি বেশ জোরের সাথে যখন কিছু বলি, তুমি তখন তার মুখোমুখি হতে ভয় পাও। আমি এখনও তা বিশ্বাস করি না। এটা হতেই পারে না, কেননা, তুমিই ত' আমায় বলেছিলে,

"আমি জানি তোমার এ'বাড়িতে অসুবিধা হয়। মা, ইদানীং বাবাও, তোমার কোন ইচ্ছারই খেয়াল রাখে না, উপযুক্ত মর্যাদা দেয় না। বাড়ির সদস্যের উপযুক্ত মর্যাদা দেয় না।"

আমি তোমায় জিজ্ঞাসা করেছিলাম, "শুধু কি তাই? আর কিছুই----"

তুমি, আমায় থামিয়ে, বলেছিলে,"হ্যাঁ, আমি দেখেছি, নিজেদের ইচ্ছাগুলো তোমার ওপর চাপিয়ে দেয়।"

বাড়িতে যাওয়ার ঠিক আগেই এ'সব কথা আমাদের মধ্যে নিভৃতে হয়েছিল। তোমার মনে আছে? সবকিছু বলে, শেষে আমায় বলেছিলে, "আমার ওপর ভরসা রাখ। এবার আমি সব দেখব। তোমার যা বলার, তা' তুমি আমায় বলবে আর কাউকে নয়" তারপর তুমি আমায়--------।

আমি ত' তাই-ই করেছিলাম। তোমায় বলেছিলাম। আমার প্রতি তোমার বাড়ির ওদাসীন্য, আমায় তোমাদের বাড়ির অতিথি হিসাবে দেখা-- বিশ্বাস করো, আমি কিছুতেই মেনে নিতে পারছি না। তুমি বলেছিলে,

"ঠিক আছে, একটু মানিয়ে নাও। আমরা ত' এখানে থাকবো না। তাছাড়া মা ত' তোমার ভালোই চায়।"
আসলে তুমি আমার যন্ত্রণাটা বোঝইনি। মা (শ্বাশুড়ি) যে আমার ভালো চায়, এটাই ত' আমি বিশ্বাস করতে চাই। এটাই ত' স্বাভাবিক। কিন্তু আমার সাংসারিক অবস্থানটা কি তাই? আমি যে অসম্মানিত হচ্ছি, সেটা তুমি দেখতে পাওনি? নাকি আমার মানসিক অসম্মান বোধটাকেই বুঝতে চাওনি! তোমার সাথে বিয়ের প্রথম দিন থেকে আমি চেয়েছিলাম তোমাদের বাড়ির অপরিহার্য্য সদস্য হতে। তোমারা আমায় তা হতে দাওনি। তোমরা চেয়েছিলে, তোমাদের নিজস্ব বাড়ির ছাঁচে ঢেলে, আমায় একটা ছাঁচেঢালা পুতুল করতে তৈরী করতে। আমি কোনদিনই, কারুর ছাঁচে পড়তে চাইনি। এমনকি ঠিক বিয়ের পর পরই, তোমার প্রাথমিক ভয়জনিত দূরত্ব বজায় রাখার মানসিকতাকে আমি আমার যুক্তি আর বোধ দিয়ে, মেনে নিয়েছিলাম। কারণ আমি জানতাম, এটা সাময়িক, তুমি এর থেকে বেরিয়ে আসবেই। এবং দ্যাখ, সেটাই হয়েছে। এসমস্যা, আমার কাছে কোন সমস্যাই ছিল না। আমার সমস্যা ছিল অন্যকিছু। আমি মানতে পারিনি, দিনের প্রতিটি কাজে, প্রতিটি ক্ষণে, তোমার বাড়ির বড়দের হস্তক্ষেপের অদমিত চেষ্টা। এমনকি সেটা 'বিশেষভাবে' ব্যক্তিগত হলেও। কিছুতেই মানতে পারছিলাম না, তোমার সাথে আমার একান্ত ব্যক্তিগত জীবনে, সকলের অবাঞ্ছিত হস্তক্ষেপ। এরচেয়ে বিরক্তিকর মূহূর্ত আমার কাছে আর কিছুই ছিল না। তাই তখন আমি সত্যিই ক্ষিপ্ত হয়ে যেতাম। কিছুতেই মানতে পারতাম না। তোমার শিক্ষিত স্বত্বা কি বলে? আমি জানি, বা বিশ্বাস করতে চাই, তুমিও এজিনিস উপলব্ধি করেছ, কিন্তু প্রতিবাদ করনি, যেটা আমি করেছি। তুমি আমায় কখনও সরাসরি, কখনও ইঙ্গিতে, আমায় বিষয়গুলো অগ্রাহ্য করতে বলেছ। বলেছ,

"ছাড় না, ওদের কথা। আমরা ত' ওদের সঙ্গে থাকি না"

কিন্তু আমি তা মনে করিনি। কেন করব? থাকি না বলেই কি অগ্রাহ্য করতে হবে! তা'ছাড়া কেন, আমি ওদের সঙ্গে থাকব না? আমি ত' তোমাদেরই একজন। আজ নেই, বলে কি কোনদিনই থাকব না? তবু কেন আড়াল? আর আজ সেই আড়ালের জন্যেই আমায় ক্ষমা চাইতে হলো। তবে একটা কথা কি জানত, আমার বাবা বলে, "যারা সম্মান দিতে পারে না, তারা কি অসম্মানিত করার ক্ষমতা রাখে? সম্মান থাকলে, "মান" সমভাবে বন্টিত হলেই ত' সম্মান বা অসম্মানের কথা আসে। বন্দুকের নলের সামনে আত্মসমর্পণ, কি সত্যিই আত্মসমর্পণ? যেখানে জোর করে মান্যতা আদায়ের আকাঙ্ক্ষা থাকে, সেখানে আর যাই থাক, সম্মান-অসম্মানের প্রশ্ন থাকে না।"

আসলে তোমাদের বাড়ির বড়রা আমার সাথে প্রথম আলাপ করতে এসে, বুঝতে পারেননি, 'আমি বুদ্ধিমতি'। ভেবেছিলেন পড়াশুনা নিয়ে থাকতে চায়, পড়াশুনা নিয়েই থাকবে। স্বামীর ওপর প্রশ্নাতীত নির্ভরশীলতাই হবে সংসারের অস্তিত্বের একমাত্র ভিত্তি। আর ধীরলয়ে চলা গবেষণার অন্যতম রসদ। তোমারা বুঝতে পারনি, আমার মধ্যে একটা তীব্র উচ্চাকাঙ্ক্ষা কাজ করে। তোমাদের প্রচলিত ধারণার বৃত্তের বাইরে থাকা, একটা অন্যরকম জীবন বোধ। যা আমায় 'বারবার বিশ্লেষিত করে। তাড়িয়ে নিয়ে যায়, অন্যকিছুর জন্যে। আমি আমার কেরিয়ারের মাঝখানে এসেই বুঝতে পারছিলাম, 'আমার এই উচ্চাকাঙ্ক্ষা শুধু গবেষণায় সন্তুষ্ট হবে না। আমায় অর্থনীতির বিশ্লেষক হতে হবে। আমায় সিদ্ধান্ত গ্রহণের অংশ হতে হবে। এটা একমাত্র অনুমান করতো আমার বাবা। এবং জানতো পশ্চিমবঙ্গে এই উচ্চাকাঙ্ক্ষা বেপথে হারিয়ে যাবে। নাহলে তুমিই বল, এম-ফিল করার পর কেউ, অর্থনীতির সাথে যুক্ত প্রোগ্রামিং শেখাতে টাকা খরচা করে! এরপর কলকাতাতেই একটা চাকরিটা পেয়েছিলাম, সেটা ছিল, আমার "হাতেখড়ি" পর্ব। ওখানেই বুঝতে শুরু করেছিলাম, "ভবিষ্যৎ অনুমানের" মধ্যে একটা রোমাঞ্চ আছে। তখনই বাবার কাছে শুনেছিলাম, এখানে সেই রোমাঞ্চ পূর্ণভাবে পাওয়া যাবে না। আমার এখন মনে হয়, তোমাদের বাড়ির প্রাজ্ঞরা যদি এটা বুঝতেন, তা'হলে আমার সাথে তোমার বিয়ে কিছুতেই হতো না। তোমার মা ত’ ভেবেছিলেন আমি ওখানে গিয়ে স্কুল মাস্টারি করবো। তুমি নিজেই করতে রাজী হতে না। কেন জান? তুমি উচ্চাকাঙ্ক্ষাকে ভয় পাও। তুমি বল না, "কোনকিছুর পরিবর্তনে আমার ভয় করে।" কিন্তু আমার ঠিক উল্টো। পরিবর্তন মানে, আমার কাছে এগিয়ে যাওয়া।

জান, বাবাকে একান্তে, নিভৃতে সব কথা বলতাম, এবারও সব কথাই বলেছিলাম। বাবা আমায় বোঝাত। আমি কষ্ট হলেও, বুঝে নিতাম। নিজেকে শান্ত করতাম। নিজের অগোছাল চিন্তাগুলোকে ঝাড়াই-বাছাই করে নিতাম। এ'বারেও তা-ই করেছি। তোমার বাড়ির প্রতি আমার নীরব বিরোধিতাকে, তুমি মেনে নিতে পারনি। কারণ আমায় যে কথা তুমি দিয়েছিলে, তা রাখতে পারনি। তা রাখার ক্ষমতাই তোমার নেই। আবার আমায়, সবকিছু মেনে নেওয়াতেও পারনি। তার জন্যেই মানসিকভাবে ধ্বস্ত হয়েছ। আমার কাছে, বাড়ির সকলের উদাসীনতা আর আমার সাথে অতিথিসূলভ ব্যবহারের বিষয় শুনে এবং নিজে দেখেও তুমি কোন প্রতিকার করতে পারনি। প্রতিকারের কোন পথ না পেয়ে, নিরুপায় হয়ে, তুমি ডিপ্রেশনের আশ্রয়ে, নিজেকে ভাসিয়ে দিয়েছ, কিংবা লুকোতে চেয়েছ।। অথবা তাকে ঢাল হিসাবে ব্যবহার করে নিজেকে এ'সবের মধ্যে থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে চেয়েছ। এখন আমি বুঝে গেছি, তোমার পক্ষে প্রতিকার করা সম্ভব নয়। তুমি পারবে না। বাবার কাছেই এই যুক্তির সূত্রটা আমি পেয়েছি।

তবে খারাপ লেগেছে কোথায় জান? এর দায়বদ্ধতা স্বীকার করে নিতে হয়েছে আমাকে। ক্ষমা চেয়ে নিতে হয়েছে আমাকে। আর আমার সেই মৌখিক ক্ষমা চাওয়ার সময়, তোমার অসহায় মুখটাও আমার নজর এড়ায়নি। তুমি, হয়ত, অসহায়ভাবে তোমার চারপাশের উল্লাসের মৌনতাকে দেখিয়ে, আমায় বোঝাতে চেয়েছ, 'আমার কি করা উচিৎ, আর কি করা উচিৎ নয়। আমার কি বলা উচিৎ, আর কি বলা উচিৎ নয়। তোমার এই অসহায় ধৈর্য্যকে আমি প্রশংসা না করে পারছি না।

জান, আমাদের এই সময়টাকে বলে, 'ব্যক্তিস্বাধীনিতার' যুগ। নারী আজ তার ক্ষমতায়নের জন্যে লড়াই করে চলছে। বলতে পার, ক্ষমতায়ন মানে কি শুধু অর্থনৈতিক স্বাধীনতা? তা'ও নাকি ভোগ করা যায়, স্বামীর দৃশ্যমান বা অদৃশ্য ছত্রছায়ার মধ্যে থেকে! কিন্তু ক্ষমতায়নের কোন রেশ, তোমার বাড়ির ক্ষমতায়িত সদস্যাগণ, কেন অন্দর মহলে নিয়ে যেতে অনিচ্ছুক? মৃণালের বয়ানে লেখা, কবিগুরুর চিঠি ত' আজ বহু পঠিত। আধুনিক ভাষায় "ভাইরাল"!! কিন্তু সংসারের মাত্র কয়েকজনের (এখন ত' আর যৌথ পরিবার নেই, তাই সেই পুরানো মৃণালও নেই) তৈরী করা 'ঘন বৃত্তের গোলকধাঁধা'' ভেদ করে, আমরা সত্যিই কি বেরোতে পেরেছি? না'কি, এ যুগের মৃণাল হয়ে, আমাদেরও বেরিয়ে পড়তে হবে, চেনা বৃত্তের গোলকধাঁধা ভেঙ্গে, অচেনার সন্ধানে? যদি যাই, তবে জেনো অচেনার সন্ধানে আমি যাব একা। ঠিক রবি ঠাকুরের মৃণালের মতো। কারুর সঙ্গে নয়, কারুর জন্যে নয়। সব কিছু ভেঙ্গে। মৃণালের মতো, কিছু না ভেঙ্গে চলে যাব না। আমরা হয়ত রবি ঠাকুরের দয়ায়, "ভাইরাল" হব না, বা "ভাইরাল" হওয়ার জন্যে বেরোব না। আমরা বেরোব, ক্ষমতার সন্ধানে। ক্ষমতা প্রতিষ্ঠা করার অদম্য জেদ নিয়ে।

ইতি,

মৃণাল

0 comments: