0

প্রচ্ছদ নিবন্ধ - অনিন্দিতা মণ্ডল

Posted in





ভারসাম্যই সৃষ্টির প্রাথমিক শর্ত। বিশ্বের প্রতিটি কণা ও শক্তি সেই নির্দিষ্ট ভারসাম্যে বাঁধা। তার এতটুকু চ্যুতি হলে সৃষ্টি থাকেনা। ভারসাম্য এবং পরিপূর্ণতা। প্রকৃষ্টরূপে প্রস্ফুটিত প্রকৃতি সৃষ্টিরসের ধারক ও বাহক। অন্তর্জগত ও বহির্জগৎ একই। শুধু প্রকাশের তারতম্য। আর অনুভূতির তারতম্য। কারণ অন্তর্জগতে এক বিশুদ্ধ অস্তিত্ব, মধুঋতুর যে প্রেমজ অস্তিত্ব তা ধরা পড়ে অনির্বচনীয় ভাবে। সেই রসের পথিক যাঁরা তাঁরা আমাদের চোখে সহজে ধরা দেন না। ‘মনের মানুষ’ এর প্রেমে নিজের মধ্যে নিজেই ডুবে থাকেন। এই দুর্লভ প্রেম আমাদের অনুভূতির বাইরে। কারণ আমাদের রসের পথে আর একজনকে চাই। এক নয়, দুই থাকলে তবে আস্বাদন। আর এমন হবেনাই বা কেন? এই বিশ্বপ্রকৃতিই যে সেই মায়া সৃষ্টি করে। সে এমন মায়া সৃষ্টি করে যে বসন্ত নামের এই ঋতুতে মানবমনের গহীন ভালোলাগা আর ভালোবাসার উৎসমুখ থেকে নির্ঝরিণীর মতো প্রবাহিত হয় মধুর ফল্গুধারা। পৃথিবীর মানব মানবী অন্তহীন কাল ধরে এই ঋতুর আগমনের প্রতীক্ষা করে। মনে পড়ে জ্যোৎস্নারাতে কুঞ্জবনে এক বিখ্যাত কবি তাঁর নাট্যকাব্যে নরনারীর এমন প্রেমকাব্যে পরীদের দিয়ে জাদু রসের ফোঁটা ছুঁইয়েছিলেন ঘুমন্ত নায়ক নায়িকাদের চোখে। ফলস্বরূপ, গাধার মুখোশে ঢাকা যুবকের প্রতিও নারীটি প্রবল প্রেম অনুভব করেছেন। পরীর জাদুই হোক, বা অন্তরের প্রেমের বাসনাই হোক, প্রেমে পড়েছিলেন তিনি। মিডসামার নাইট’স ড্রিম এর বহুতর রূপকার্থ থাকতে পারে, কিন্তু একথা সত্য যে বসন্তের মলয়ানিল, জ্যোৎস্নার মধুর স্পর্শ, প্রেমিক প্রেমিকাকে বাহ্য রূপের আড়ালে এমন অন্য অনুভবে পৌঁছে দিয়েছিল। ওই জাদু রস আসলে প্রকৃতির মধু। মধু ঋতুর মধু। বসন্ত এমনই অঘটন ঘটাতে পারে।

প্রাচীনকালে ভারতবর্ষে রাজারা দুটি ঋতুকে দিগবিজয় মৃগয়া ও প্রমোদের জন্য নির্বাচন করেছেন। একটি শরৎ অন্যটি বসন্ত। তবে যুদ্ধ পরিকল্পনা চলত শরতেই। বসন্ত প্রমোদের কাল। তখন যুদ্ধ নয়, সন্ধি। কেতুন হতে ভুনাগ রাজার রানি হোরি খেলতে ডেকেছিলেন পাঠান রাজাকে। রাজা সেই প্রস্তাবে কোনো লড়াইয়ের পূর্বাভাস পাননি। কারণ এদেশে তখন উৎসবের কাল। প্রেমের ঋতু। চারিদিকে প্রকৃতির মধ্যে মিলনের আহবান, সৃষ্টির আহবান। প্রস্ফুটিত পুষ্পে ভ্রমরের গুনগুনানি। পরাগমিলনের জন্য উৎসুক প্রতিটি ফুল।

এত আয়োজন সত্ত্বেও আমরা রবীন্দ্রনাথের কণ্ঠে অন্য সুর শুনতে পাই।

“বসন্তকালে আমরা বহির্জগৎ উপভোগ করি। উপভোগের সমস্ত উপাদান আছে, কেবল একটি পাইতেছি না। উপভোগের একটা মহা অসম্পূর্ণতা দেখিতে পাইতেছি। সেইজন্য আর কিছুই ভালো লাগিতেছে না। এতদিন আমার সুখ ঘুমাইয়াছিল। আমার প্রিয়তম ছিলনা। আমার আর কোনো সুখের উপকরণও ছিলনা। কিন্তু জ্যোৎস্না বাতাস ও সুগন্ধে মিলিয়া ষড়যন্ত্র করিয়া আমার সুখকে জাগাইয়া তুলিল। সে জাগিয়া দেখিল তাহার দারুণ অভাব বিদ্যমান। সে কাঁদিতে লাগিল। এই রোদনই বসন্তের বিরহ”।

এই যে অজানা এক কারণে বিরহ, এত সুখের উপাদানের মধ্যেও কী যেন নেই, এই প্রকৃতপক্ষে বসন্তের আগমনের গূঢ় উদ্দেশ্য।

একটু গভীরে যাওয়া যাক। প্রকৃতির এমন সজ্জা কেন?

একটি চিরন্তন কাহিনীর কথা হোক। রাজ্য জুড়ে বসন্তোৎসব। ফুলের আভরণে সজ্জিত নরনারী কুঙ্কুম চন্দন হিঙ্গুলের আল্পনায় সজ্জিত হয়ে চলেছেন উৎসবকুঞ্জে। এমনই তো ছবি আঁকা আছে কালিদাসের কাব্যে, বৈষ্ণব কবির কল্পনার পদাবলীতে! সেখানে নৃত্য গীতে আসবে আসঙ্গে পৃথিবীর প্রাচীন লীলাখেলায় মেতে উঠবে যুবক যুবতী। বন্ধনহীন প্রেমের উৎসব। প্রমোদের আনন্দ কোলাহলে মুখর হয়ে উঠেছে উৎসব প্রাঙ্গণ। কিন্তু এই কূলপ্লাবী মধুধারার মধ্যে নিঃশব্দ পদচারনায় এসে পড়েছে বসন্ত মহামারী। নগরীর বাইরে, প্রাকারের একধারে, অন্ধকারে ফেলে রেখে আসা হয়েছে এককালের নগরশ্রেষ্ঠা নটীকে। রাজনর্তকী বাসবদত্তা। সারা অঙ্গে রোগের কালিমা। মারণ রোগ। সেও তো বসন্ত! দেখতে পাই, ধীর পায়ে কাছে এসে রোগসন্তপ্ত মাথাটি কোলে তুলে নিচ্ছেন এক নবীন সন্ন্যাসী। সেই সন্ন্যাসী, যার রূপে মুগ্ধ নটী মাত্র কয়েকটি বসন্ত আগে নিজের কুঞ্জে তাঁকে আহবান করেছিলেন। সন্ন্যাসী তাকে প্রকৃত কালের জন্য অপেক্ষা করতে বলেছিলেন। এখন করুণায় সিক্ত তাঁর দুটি আয়ত নয়ন রোগিণীর ব্যাধির গ্লানি যেন দেহ থেকে মুছে নিচ্ছে। দুটি অতি আকাঙ্ক্ষিত প্রিয় হাতের সেবায় সুস্থ বোধ করছেন বাসবদত্তা। মনে ভাবছেন কোনটি সত্য? কোনটি তাঁর পরম প্রাপ্তি? ইন্দ্রিয়ের উৎসবে মেতে ওঠা? নাকি অতীন্দ্রিয় এই প্রেম যা তাঁকে আপ্লুত করেছে অন্তরে বাইরে? একি অদ্ভুত দোলাচল! প্রিয়তম পরমাকাঙ্খিত জনকে পেয়েছেন মনের আলোয় অরূপের ঘরে। অবশেষে এক প্রভাতে ব্যাধিমুক্ত নটী অনুভব করেন, বসন্ত কোনও প্রমোদঋতু নয়, বসন্ত মহামারী নয়, বসন্ত সেই কাল, যখন উৎসবকে ছাপিয়ে দেহকে ছাপিয়ে দেহাতীত অনির্বচনীয় আনন্দে স্থিত হওয়া যায়। বেদ যাকে বলছে মধুবিদ্যা।

অরূপরতনেও এমন দেহাতীত প্রেমের কথাই বলেছেন কবি। বাইরের আলো নিভে গেলে অন্তরের আলোয় পরম প্রেমাস্পদকে দেখে নিতে হবে। রূপের ঘরে তালা পড়বে। অরূপে মিলবে ‘মনের মানুষ’।

প্রাচীন সাহিত্যে বসন্তের একটি সুন্দর চিত্র আঁকা আছে।

ওঁ মধু বাতা ঋতায়তে মধু ক্ষরন্তি সিন্ধবঃ।
মাধ্বীর্নঃ সন্তোষধীঃ।
মধু নক্তম উতোষসো মধুমৎ পার্থিব রজঃ।
মধুমান্নো বনস্পতির্মধুমাং অস্তু সূর্যঃ। ওঁ।

(ঋকবেদ, নবম-মণ্ডল, মধুমতী সুক্ত)

বাতাসে মধু, নদী জলাশয় সাগরে মধুর ধারা, ঊষা ও রাত্রি মধুময়, পৃথিবীর ধূলিকণা মধুময়, বনস্পতিসকল মধুমান, সূর্যের কিরণসকল মধুবর্ষী। আর এই মধুময় পরিবেশ আমাদের পরম সন্তোষ দান করে। এটিকে বেদবর্ণিত মধুবিদ্যার বাহ্যপ্রভাব বলা চলে। অন্তরে মধুবিদ্যা যার লাভ হবে তিনিই প্রকৃতিকে বা বহির্জগতকে এমন মধুময় দেখবেন। তাঁর অন্তরের মধু বাইরে লিপ্ত হয়েছে। এই রহস্যের কারণেই উপনিষদকে রহস্যবিদ্যা বলা হয়েছে। আর একটু এগিয়ে দেখা যাক।

এই মধুময় সন্তোষের অনুভব একমাত্র মানুষেরই হয়। কারণ মানুষ প্রকৃতির অপূর্ব সৃষ্টি। মানুষের মাথা নাকি তার সর্বশ্রেষ্ঠ রত্নাগার। সোনার খনি। আর তাই, হাজার হাজার বছর ধরে মানুষ বাহ্য জগতে ও অন্তর জগতেও সেই সোনার খনি থেকে সমানে সোনা উৎপন্ন করতে চেয়েছে। এই যে নানা শাস্ত্র নানা বিদ্যা শিল্পকলা সঙ্গীত সব কিছুর মূখ্য উদ্দেশ্য সেই সোনা, বা সেই বিশুদ্ধ অস্তিত্বকে ধারণা করা। মানব ইতিহাসে যত জ্ঞান বিজ্ঞান চর্চার ইতিহাস আমরা দেখতে পাই সে সবই সেই পরম ধনের সন্ধান। অক্ষয় অব্যয় এক নিত্য চেতন অস্তিত্বের সন্ধান। বেদে একে বলেছে হিরণ্ময় কোষস্থ ব্রহ্ম। ব্রহ্ম সেই নিত্য চেতনা। হিরণ্ময় কোষ সেই কোষ যা সেই পরম চেতনাকে ধারণ করতে পারে।

এ নিয়ে মানুষের গবেষণার অন্ত নেই। কোন সে শর্ত যা পূরণ হলে হিরণ্ময় কোষ বিকশিত হয়? ঋষি বলছেন, যখন একটি মানুষ তাঁর পূর্ণ যৌবনে উপনীত হন (চব্বিশ বছর আট মাস সেই সঠিক বয়স), তাঁর দেহের একটি মাত্র কোষও ক্ষয়প্রাপ্ত হয়না, ঠিক তখনই তাঁর দেহস্থ প্রাণশক্তি, যা দেহকে আলেখ লতার মতন জড়িয়ে থাকে, তা দেহ থেকে নিঃসৃত হয়ে সহস্রার পদ্মে (মস্তিষ্কে) সংকলিত হয়, তখন তাঁর হিরণ্ময় কোষ পূর্ণ বিকশিত হয়।

উপনিষদ বলছে, সত্যের মুখ হিরণ্ময় পাত্রের দ্বারা আবৃত। সেই হিরণ্ময় পাত্রের অপসারণ হলেই পরম জ্ঞান। সত্য সূর্যের আলোয় সেই আবরণ অপসারিত হয়। নতুন কোষের জন্ম হয়। এই যে একটিমাত্র শর্তের উল্লেখ করছেন উপনিষদ, একটি পূর্ণ যৌবনপ্রাপ্ত মানবদেহ, যার একটি কোষও নষ্ট হয়নি, সেটিই প্রকৃতির দান। বাহ্য প্রকৃতিতে এই দান আমরা প্রত্যক্ষ করি একটি বিশেষ সময়। সেটি বসন্ত কাল। বসন্তের প্রধান বৈশিষ্ট্য সূর্যের অধিক সময়ের উপস্থিতি। সূর্যের কিরণপাতে প্রকৃতির ভাঁড়ারে উদ্ভিদ বেশি সময় ধরে খাদ্য প্রস্তুত করতে পারে। সেই বর্ধিত চাহিদার কথা মাথায় রেখে নতুন নতুন পাতা গজিয়ে ওঠে। নানা ফুলে গাছ ভরে ওঠে। ফুলে ফুলে পাখি প্রজাপতি ও মৌমাছি ভিড় করে। কারণ, এক অজ্ঞাত রহস্যে ফুলের রেণু মধুতে পরিণত হয়। এই যে প্রকৃতি নামক রসায়নাগারে জীবনদায়ী মাধুর্যের সৃষ্টি হয় তাইই বসন্তের দান।

এ নিবন্ধে আমরা অন্তরপ্রকৃতিতে বসন্তের আগমন নিয়ে বরং দু’চার কথা লিখি। কারণ, এই যে জগত, তা আসলে আমাদের অন্তরজগতেরই প্রতিফলন মাত্র। আয়নায় মুখ দেখার মতো। তাই দেখা যাক, অন্তরজগতে যৌবনদূত বসন্ত কিসের দ্যোতক।

যে বিশেষ বয়সের কথা উল্লেখ হয়েছে সেই বয়সে একটি তরুণ শরীর সমস্ত দেহ দিয়ে আনন্দ আস্বাদন করার ক্ষমতা রাখে। সেই মধু সে কিভাবে আস্বাদন করে? সংসারে নরনারীর মিলনজনিত যে আনন্দ অত্যন্ত প্রাকৃতজনও জানে, সেও যৌবনের ধর্ম, বার্ধক্যের নয়, কারণ শরীর জীর্ণ, আবার কৈশোরেরও নয়, কারণ শরীর পূর্ণত্বপ্রাপ্ত নয়। মহামানব বলছেন, পাঁচ বছরের বালক রমণের আনন্দ কি, জানে না। (শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত)। তাহলে এই যে প্রাণশক্তির সংকলন একটি আনন্দের জন্ম দেয়, তা ধারণা ও অনুভব করতে একটি পূর্ণবিকশিত দেহ চাই। নতমুখী কমল যেমন সূর্যের প্রথম কিরণের স্পর্শেই উর্দ্ধমুখী হয়, ঠিক তেমনই অন্তরসূর্য উদিত হলে হৃৎকমল প্রস্ফুটিত হয়।

ছান্দোগ্য উপনিষদে মধুবিদ্যা নামক অধ্যায়ে এই শ্লোকটি পাই।

ওঁ অসৌ বা আদিত্যো দেবমধু তস্য দ্যৌরেব তিরশ্চীনবংশ’ন্তরিক্ষমপূপো মরীচয়ঃ পুত্রাঃ।

শ্লোকটির শব্দার্থঃ ওই আদিত্য দেবগণের মধু। বক্র বংশদণ্ডের মতো দ্যুলোক ওই মধুর অবলম্বন। অন্তরিক্ষ তার মধুচক্র। আর সূর্যকিরণ সমূহ থেকে জাত জলই মক্ষিকাশাবক।

অদ্ভুত শ্লোকটির মধ্যে একটি রূপক নিহিত। উপনিষদ যেহেতু রহস্যবিদ্যা, তাই এর দুটি দিক থাকে। জগত বা ম্যাক্রোকজম এবং অন্তর বা মাইক্রোকজম। প্রথমে জাগতিক অর্থ বিচার করা যাক।

অসৌ বৈ আদিত্যঃ – সূর্য। বাইরের সূর্য, যা আকাশে দেখি, যা আমাদের সকল শক্তির উৎস, প্রাণের কারণ। আকাশের ওই সূর্য সকলকার বাইরের চৈতন্য স্বরূপ – “তমসো মা জ্যোতির্গময়”।

দেবমধু – সর্বজনপ্রিয়। মানুষ। মানুষই দেব।

তস্য – তার, অর্থাৎ আকাশের সূর্যের অবলম্বন কি? বক্র বংশদণ্ডের চিত্রকল্প অপরূপ! দিকচক্রবালকে কি এমনই দেখায়না? যেন একটি নরম বাঁশকে নোয়ানো হয়েছে। এটিই দ্যৌঃ।

অন্তরিক্ষ – সেই দ্যৌ-এর অবলম্বন।

মরীচয়ঃ – সূর্যের রশ্মিসমূহ।

অপূপঃ – এটি উপমা। মানসচক্ষে কেমন দেখতে লাগবে তার আভাস।

পুত্রাঃ – সূর্যকিরণসম্ভূত জল।

ব্রহ্মাণ্ডতত্ত্বে বা বাইরে এর অর্থ এই, যে, আকাশের সূর্য মানবজগতের মধু বা চৈতন্যস্বরূপ। কারণ সূর্যের উদয়ে তমোনাশ হয়ে জ্ঞানের উদয় হয়। অন্তরিক্ষ মধুচক্র বা মৌচাক। অর্থাৎ সূর্যের রশ্মি অন্তরিক্ষরূপ মধুচক্রে সঞ্চিত হয়। তারপর সেই রশ্মিসমূহ যেন মধুর ধারার মতোই পৃথিবীতে বর্ষিত হয়।

দেহতত্ত্বে এর অর্থ কি? দেখে নিই—

মস্তিষ্কে সেরিব্রামে যে গ্লায়াল কোষগুলি আছে সেগুলিকে সম্মিলিতভাবে একটি ফুলের মতো দেখা যায়। মানুষের প্রাণের মোট চারটি অবস্থা। জাগ্রত স্বপ্ন সুষুপ্তি ও তুরীয়। এই চার অবস্থার যে কোনো দুটিতে সেরিব্রাম বা সহস্রারে সূর্য দেখতে পাওয়া যায়। সে অন্তর সূর্যের দহন নেই, আছে স্নিগ্ধ জ্যোতি। “রামচন্দ্র যখন সভায় এলেন তখন সভাস্থ সকলের হৃৎপদ্ম প্রস্ফুটিত হল” – কথামৃত। এখানে রামচন্দ্র সেই অন্তর সূর্যের প্রতীক। মহামানব বলছেন – রামের জ্যোতিতে সভাস্থ লোকের হৃৎপদ্ম প্রস্ফুটিত হল, কিন্তু তারা পুড়ে গেলনা কেন? কারণ এ জ্যোতি স্নিগ্ধ। এ জ্যোতি চেতনাকে প্রেমে লিপ্ত করে, তাই এর মাধুর্য।

অন্তর সূর্যের অবলম্বন মানুষের চতুর্থ প্রাণচৈতন্য, তথা তুরীয়। যাকে নির্গুণ বলা হয়। নির্গুণ, কারণ তা আমাদের জ্ঞানের আলোয় নেই। এই নির্গুণ, যা আমাদের দেহেই, তা থেকে অবতরণ হচ্ছে অন্তরিক্ষে। সূর্যের কিরণসমূহ এখানে চৈতন্যের আলো। তাকে মধু বলা হয়েছে। কেন? কারণ এই চৈতন্য শুধু জ্ঞান নয়, প্রেমও দান করে। “যাকে দেখবিনি তাকে ভালোবাসবি কি করে?”

এই যে নিজেকে জানা, এর মধ্যে মধুর কী? কেনই বা এর ফলে জগত মধুমতী মনে হবে? কারণ, ‘আপনাকে এই জানা আমার ফুরাবে না’। এই শাশ্বত নিত্যকার যে স্বরূপ, যে ‘বৃহৎ আমি’ তাকেই আমি ‘মনের মানুষ’ বলি। ইন্দ্রিয়ের দ্বার রুদ্ধ হলে সকল রস ‘মধু’তে পরিণত হয়ে আমাকে সেই ‘বৃহৎ আমি’র প্রেমে আবদ্ধ করে। এই স্বর্গীয় প্রেমের আভাস দেখা যায় মহামানবের জীবনে। নিরালম্ব সেই প্রেমে মত্ত শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য। শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংস। তাঁরা চিরবসন্তের দেশের মানুষ। তাঁদের প্রেমাস্পদ তাঁদের অন্তরে সদা বিরাজিত।

বৃহদারণ্যক উপনিষদের প্রথম অধ্যায়ের পঞ্চম ব্রাহ্মণে দেখছি পৃথিবী, জল, অগ্নি, বায়ু, আদিত্য, দিকসকল, চন্দ্র, বিদ্যুৎ, মেঘ, ধর্ম, সত্য, আদি প্রত্যেককেই ‘মধু’ বলা হয়েছে। অবশেষে মানুষকেই ‘মধু’ বলা হয়েছে। সত্যিই ‘সবার উপরে মানুষ সত্য’।

উপনিষদ ব্রহ্মাণ্ডতত্ত্ব ও দেহতত্ত্ব দুটি দিক থেকেই ‘মধু’ অর্থে চৈতন্য ও প্রাণকে নির্দেশ করেছেন।

মধুর স্বাদ মিষ্টি। মধু বলবর্ধক সর্বরোগহর। ঠিক তেমনই অন্তরে ‘চৈতন্য’রূপ ‘মধু’পাত হলে, আত্মজ্ঞান লাভ হলে, জগত মধুময় মনে হয়। আকাশ বাতাস বৃক্ষ নদী সব মধুময় মনে হয়।

এই যে মধুময় অনুভব, এ যেকালে হয় সেটিই বসন্ত। উন্মুখ পুষ্প প্রস্ফুটিত ও বিকশিত হবার অপেক্ষায়। সূর্যের অমল কিরণ স্নিগ্ধ। গ্রীষ্মের দাবদাহ নেই, নেই শীতের হিমপ্রবাহ। আছে সুন্দর আবহাওয়া। আছে অমল কিরণে উদ্ভাসিত প্রাণের উৎসব। আছে নিজেকে জানার মধ্যে দিয়ে জগতকে নতুন চোখে দেখার অভূতপূর্ব অনুভব। নব নব প্রেমে এ জীবনকে ভালো লাগার, ভালোবাসার উৎসব। নবীন সন্ন্যাসীর অপরূপ মুখখানি তখন ইন্দ্রিয়ের অতীত এক প্রেমের অনুভব আনে। তা ক্রমে তাঁকে ছাপিয়ে জগতে ছড়িয়ে পড়ে। হরিণশিশুর চঞ্চলতাও তখন মধুর লাগে। আসলে ছোঁয়া লেগেছে অন্তরে। পরম এক পুরুষের ছোঁয়া। যিনি সূর্যের মতন সদা বিরাজমান। যার অমল কিরণ আমাকে অন্তর থেকে দীপ্ত করেছে। দেহ থাক আর নাই থাক, অস্তিত্ব জুড়ে তিনি আছেন, এই অনুভব। এই মধু ঋতুতে অন্তরের বীণায় যার সুর বাজে

“ওহে সুন্দর মম গৃহে আজি পরমোৎসব রাতি
রেখেছি কনক মন্দিরে কমলাসন পাতি।”

তিনিই অনুভব করেন, হৃৎকমলে সোনার আসন পাতা। দেহ থেকে উত্থিত হয়ে আমার পরমাস্পদ, আমার প্রাণ আজ আসবেন মিলনোৎসবে। এইই প্রকৃত মিলন।

মধু হোক পৃথ্বী মধু হোক সাগর, মধুময় হোক মানবহৃদয়।

[মার্চ ২০২১, জাগ্রত বিবেক]

0 comments: