প্রবন্ধ - শৌনক ঠাকুর
Posted in প্রবন্ধখ্রিস্টীয় দ্বাদশ-ত্রয়োদশ শতকে বৈষ্ণব পদাবলীর পাশাপাশি সমানভাবে জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল শাক্তপদাবলী। রামপ্রসাদ সেন , কমলাকান্ত ভট্টাচার্য , দাশরথি রায়সহ প্রমুখের লেখা গান লোকের মুখে মুখে ঘুরতে থাকে। তবে এ কথা বলা অত্যুক্তি হবে না যে বিংশ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ শ্যামাসংগীত রচনাকার ছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম। তাঁর রচিত গানের সংখ্যা প্রায় চার হাজার। যার বড় অংশই ছিল শ্যামাসংগীত। তবে রামপ্রসাদ , কমলাকান্ত বা প্রচলিত রীতি থেকে তাঁর শ্যামাগানের শব্দ-সুর-রীতি অনেকটাই আলাদা।
নজরুলের শ্যামাগান ব্যতিক্রমী হওয়ার অন্যতম কারণ হল শ্যামাসংগীতে প্রত্যক্ষ স্বদেশীয়ানার প্রচলন। দেবীকালী তার চোখে দেশমাতৃকা। ‘হিন্দুমেলা’ প্রতিষ্ঠার আগে এই প্রয়াস তেমন দেখা যায় নি। ‘আজই না হয় কালই তোরে কালী কালী বলবে লোকে।’ এই গানটিতে ‘কালী’ যে দেশমাতার রূপক। তারই কৃপাতে পরাধীন ভারতবর্ষের আপামর জনগণের শৃঙ্খলমোচন সম্ভব তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
দ্বিতীয় কারণ হিসেবে বলা যায় সুরের অভিনবত্ব। প্রচলিত শ্যামাসংগীতে একটা সুরগত টাইপ বা রীতি থাকে। কিন্তু নজরুলের শ্যামাসংগীতের মধ্যে রাগসঙ্গীত বা মার্গসংগীতের প্রভাব লক্ষণীয়। তাই তার বেশিরভাগ গানে খোলের পরিবর্তে পাখোরাজ বাজানো হত। (অবশ্য খোলের ব্যবহার যে একেবারেই নেই তা বলা যায় না)
ইংরেজ-বিরোধী আন্দোলন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, পুঁজিবাদীদের রমরমা, মুদ্রাস্ফীতি, ঔপনিবেশিক আগ্রাসন ইত্যাদি জনমানসে ভয় ও হতাশার জন্ম দিয়েছিল। শ্যামাসঙ্গীতকেই প্রতিবাদের ভাষা হিসেবে ব্যবহার করেছেন কাজী নজরুল। ‘কালকে তুমি কাকে মারো?’ ইত্যাদি।
প্রাত্যহিক জীবনের অতিসাধারণ উপাদান তার লেখনি গুণে হয়ে উঠেছে অমূল্য সম্পদ। ভক্তি প্রসঙ্গে একটি গানে তিনি বলেছেন — ‘ভক্তি আমার ধূপের মত / ঊর্ধ্বে ওঠে অবিরত। অথবা
‘তোর রাঙা পায়ে মে মা শ্যামা / আমার প্রথম পূজার ফুল।’ কত সুন্দর দার্শনিকচেতনা ও রূপকের দ্যোতনা।
কাজী কবির চোখে এই নারী কখনও ‘ছিন্নমস্তা’ কখনও বা ‘রক্তখেপী’। এই নারীরাই পারে জগতের যা কিছু অমঙ্গলকে বিনাশ করে শুভ শক্তির জাগরণ ঘটাতে। ‘শিখালি কাঁকন চুড়ি পরিয়াও নারী, / ধরিতে পারে যে উদ্ধত তরবারি।’ তাই কবির চোখে এই নারী মহাকালী করালবদনা। জাগরণের প্রতীক। মুক্তির দূত। ‘আমার মা আছে রে সকল নামে’ ,‘আমি কি তোকে ডাকিতে পারি’ ইত্যাদি নানান গানে কবি নারীর প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন করেছেন। আবার ‘আমার কালো মেয়ের পালিয়ে বেড়ায়’ এই ধরনের গানে কবি নারী-মুক্তি ও সম-অধিকারের বার্তা দিয়েছেন।
উর্ধ্বমুখী কুণ্ডলিনী বা সর্পশক্তিকে জাগরিত করাই হল প্রকৃত সাধনা। গীতিকার নজরুল বিভিন্ন শ্যামাগানে লৌকিক উপমা ব্যবহার করে এই দূরহ বিষয়টিকে সহজভাবে ব্যক্ত করেছেন। উদাহরণস্বরূপ ‘শ্যামা নামের লাগল আগুন আমার দেহ ধূপ-কাঠিতে’, ‘ধূলোয় ভরল ধরণী’ ইত্যাদি গানের কথা বলা যেতে পারে।
রহস্যময় জটিল সৃষ্টিতত্ত্বে পুরুষ সূক্ষ্ম, অব্যক্ত, নিত্য ও চৈতন্যরূপ সত্ত্বা। আর প্রকৃতি তার দোসর। ঋগ্বেদের নাসদীয় সূক্তের ১০ মন্ডলের ১২৯ সূক্তে এই ভাবনারই প্রকাশ রয়েছে। বিদ্রোহী কবির একটি গানে দেখা যায় মহাকাল শিব বুক পেতে গ্রহণ করেছেন মহাকালীর শ্রীচরণ — ‘কালো মেয়ের পায়ের তলায় / দেখে যা আলোর নাচন।’
শুধু মাতৃরূপে নয় কন্যারূপেও মা কালীকে দেখেছেন তিনি। এ কন্যা আমাদের সাধারণ ঘরে। এ কন্যা হেসে খেলে নেচে বেড়ায়। আমাদের আদরের দুলালী। কবিও বলেছেন — ‘আদরিনী মোর শ্যামা মেয়েরে / কেমনে কোথায় রাখি’।
মায়ার আবরণে মানুষ অন্ধ হয়ে থাকে। তাই সংসারের জালে আবদ্ধ হয়ে কলুর বলদের মতই কেবল ঘুরে মরে। এই জীবনবোধ ও চিরন্তন সত্যকে কত খুবই সুন্দরভাবে বর্ণনা করেছেন গীতিকার নজরুল —‘জগৎ জুড়ে জাল ফেলেছিস মা শ্যামা কি তুই জেলের মেয়ে / (তোর) মায়ার জালে মহামায়া বিশ্বভূবন আছে ছেয়ে।’ এখানে ‘জাল’ শব্দটি মায়া ও ‘চতুর মীন’ সাধক অর্থে অর্থে প্রযুক্ত।
লৌকিক জগতকে আশ্রয় করে লোকোত্তর আর জগতের দ্যোতনা সৃষ্টি করায় তার সংগীতের মূল নান্দনিক রূপ। যেখানে থাকে অদ্বৈতবাদের পরমসত্তা এবং অতীন্দ্রিয় স্বপ্ন-সুখ।
শাক্ত ও বৈষ্ণবদের মধ্যে চিরকালীন একটা দ্বন্দ্ব বা মতপার্থক্য দেখা যায়। কিন্তু বিদ্রোহী কবির কলমে শ্যাম ও শ্যামা একাত্মতা হয়ে গেছে। শ্যামকে শ্যামামায়ের কোলে বসিয়ে তিনি দেখিয়েছেন একই অঙ্গে দুটি রূপ। ‘আমার শ্যামা মায়ের কোলে চড়ে / জপি আমি শ্যামের নাম।’ কিংবা ‘আমার মনের দো-তারাতে শ্যাম ও শ্যামা দুটি তার।’ পরমাত্মা কখনই ভিন্ন নয় এক ও অদ্বিতীয়। জীবাত্মার সাথে পরমাত্মার এক নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। এখানেই আধুনিকতা।
মানবতাবাদী কবি কাজী বলিদান প্রথার বিরোধী ছিলেন। তিনি বলেছিলেন বলিদান প্রথায় মনের পশুকে বদলে কেন বনের পশুকে ব্যবহার করা হচ্ছে। মন্দিরের বদ্ধ আবরণীতে দেবীর প্রতিষ্ঠান নয় তিনি সর্বত্র বিরাজিত ভূতের স্থিত।
নজরুলের শ্যামাসংগীত জনপ্রিয়তার আরেকটি প্রধান কারণ হল আবেগধর্মিতা। বাঙালির শান্ত-স্নিগ্ধ-নরম হৃদয় এই গানগুলি তাই চিরকালীন সম্পদ হয়ে উঠেছে। যেমন ‘আমার কালো মেয়ে রাগ করেছে’, ‘আমার কালো মেয়ের পায়ের তলায় দেখে যা আলোর নাচন’, ‘শ্মশানে জাগিছে শ্যামা মা’, ‘জ্বলিয়া মরিবি কে সংসার জ্বালায়’। ‘মোর লেখাপড়া হ'ল না মা, আমি 'ম' দেখিতেই দেখি শ্যামা, আমি 'ক' দেখতেই কালী ব'লে নাচি দিয়ে করতালি’ ইত্যাদি।
আসলে নজরুলের ছিলেন একজন উদারপন্থী মুক্তমনা স্বাধীনচেতা মানুষ। তার কাছে ধর্ম-বর্ণ-বিভেদের উর্দ্ধে ছিল মানবিকতা। তার এই সমন্বয়পন্থী মনোভাবের জন্য বারে বারে মৌলবাদীরা তাকে আঘাত করেছে। অপমান করেছে কট্টর হিন্দুরা। একসময় পূর্ববঙ্গে রেডিওতে নজরুলের শ্যামাসংগীত বাজানো নিষিদ্ধ ছিল। এত কিছুর পরেও নজরুলের ভাবাদর্শকে কেউ বিন্দুমাত্র টলাতে পারে নি।
বাঙালির শ্বাস প্রশ্বাসের আজ ও বাহিত হয় নজরুলের শ্যামা সংগীত। শুধুমাত্র চিত্তবিনোদন বা আনন্দ প্রদান নয়, এর পিছনে রয়েছে এক ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট, সমকালীন সমাজভাবনা রাজনৈতিক চেতনা। তাই সংগীতগুলো হয়ে উঠেছে তৎকালীন কালের বিশ্বস্ত দলিল। একবিংশ শতাব্দীতে এসেও এ গানগুলির জনপ্রিয়তা বিন্দুমাত্র কমে নি। বরং বেড়েছে। এর সুর মূর্ছনা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে বহমান।
আর শ্যামাসংগীতকার নজরুল আপন শ্রেষ্ঠত্ব নিয়ে হয়ে উঠেছেন এক পৃথক পথের যাত্রী।
_____________
ঋণ স্বীকার
১। গানের ভুবন : কাজী নজরুল : ড.মাধুরী সরকার
২। ‘কাব্যগীতির ধারায় কাজী নজরুল ইসলামের স্থান’: করুণাময় গোস্বামীর
৩। ‘পঞ্চোপাসনা’ : শ্রীজিতেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়,
৪। ‘বাংলা সাহিত্য নজরুল’ : আজহারউদ্দীন খান
৫। শক্তি সাধনা ও শাক্ত গান: আঠারো শতকের সমাজ ইতিহাসের দায়বদ্ধতা : অরিন্দম অধিকারী
৬। ‘নজরুল ও বাংলা শাক্ত-সংগীত’ : পল্লব চট্টোপাধ্যায়



0 comments: