বইঘর - সুকন্যা দাস ও শ্রুত্যানন্দ ডাকুয়া
Posted in বইঘর
বইঘর
দেবতার জন্ম - শিবরাম চক্রবর্তী
সুকন্যা দাস ও শ্রুত্যানন্দ ডাকুয়া
বাংলা সাহিত্যে শিবরাম চক্রবর্তী একক এবং বিশিষ্ট। মালদহের চাচল/ চাঁচল/ চাঁচোল জমিদার পরিবারে তাঁর জন্ম। বাড়ির পরিবেশ ভক্তিভাবাপন্ন; বাবা বৈষ্ণব, মা শাক্ত। কিন্তু জন্মগতভাবে তিনি বস্তুবাদী। বস্তুবাদের প্রতি নিষ্ঠা সময়ে তাঁর মধ্যে জন্ম দেয় সাম্যবাদী চেতনার। সাম্যবাদী হওয়ায় জমিদারি চলন বেশিদিন সহ্য হয়নি তাঁর। কেবল বৌদ্ধিক আকর্ষণ নয়, সাম্যবাদের প্রায়োগিক সম্ভবনাকে কেন্দ্র করেই তাঁর বিশিষ্ট জীবনযাপনের সূচনা। প্রথমে ছাত্রজীবনে স্বাধীনতা সংগ্রামে যোগদান এবং পরে পৈত্রিক জমিদারীর বিরুদ্ধেই বিদ্রোহ তাঁকে দেশছাড়া করে। জমিদার পুত্রের গ্রাসাচ্ছাদনের লড়াই তাঁকে নিয়ে যায় বিচিত্র পেশার পথে— কখনও হকারি, কখনও সাংবাদিকতা, কখনও নিছক দিনমজুরী। আশ্চর্য ছিল তাঁর প্রাণশক্তি এবং জীবনরস। জীবনের প্রতি আকর্ষণ যেমন কখনও হারাননি, কখনও হারিয়ে ফেলেননি রসবোধ। বিচিত্র পেশার পথে, বিচিত্র জনসংযোগ— সবই হয়ে উঠেছে পরবর্তী জীবনে তাঁর বিশিষ্ট লেখক হয়ে ওঠার উপকরণ। ঘুরেছেন দেশজুড়ে, মিশেছেন বাছ-বিচার না করে, আর শেষে থিতু হয়েছেন কলেজস্ট্রিট এলাকার মুক্তারাম বাবু স্ট্রিটের মেস বাড়িতে। কলম জন্ম দিয়েছে এমন সব লেখা যা তাঁকে একদিকে করেছে বিশিষ্ট অন্যদিকে উত্তরাধিকারহীন।
একদিকে হর্ষবর্ধন-গোবর্ধন, অন্যদিকে গোয়েন্দা কল্কেকাশি— তাঁর গায়ে হাসির গল্পকারের তকমা এঁটে দিতে ভুলও করেনি, দেরিও করেনি বাঙালি। তাঁর মস্কো থেকে পণ্ডিচেরী বা আত্মজীবনী ঈশ্বর পৃথিবী ভালবাসা সাধারণ পাঠকের বীক্ষার অতীত। কিন্তু সেসব তথাকথিত সিরিয়াস লেখার কথা বাদ দিলেও, হাসি, ঠাট্টা, তামাশা বা নেহাত চুটকির পেছনেও শিবরামের তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণ এবং সামাজিক মন্তব্যগুলি চোখে না পড়ার কোনও কারণ নেই। কিন্তু সেসবও সহজে চোখে পড়ে না আমাদের। স্বভাবতই ক্রমে প্রায় আড়ালে চলে যায় তাঁর ‘দেবতার জন্ম’-র মতো বিশিষ্ট গল্পও। তবে নিবিষ্ট পাঠকের কাছে শিবরামের আবেদন কোনওদিনই কেবল হাসির গল্পকার হিসাবে নয়।
চলার পথে একটি পাথরের ক্রমে দেবতা হয়ে ওঠার গল্প আমাদের খুব অপরিচিত পৃথিবীর কথা নয়। হুবহু এমন না হলেও আমাদের চারপাশে এমন ঘটনা কতই ঘটে রোজ, যেখানে মানুষ তার স্বাভাবিক যুক্তি বুদ্ধি বিসর্জন দিয়ে লোক-প্রচলিত ধ্যানধারণার অন্ধ অনুবর্তন করে মাত্র। ঈশ্বর বিশ্বাস, সাধন পন্থা, শৈব-শাক্ত নিয়ে কোনও জটিল দার্শনিক বিতর্ক নয়, সাধারণ বুদ্ধি দিয়ে বিচার করে কবচ-তাবিচ, তন্ত্র-মন্ত্র, তেলপড়া-জলপড়া, মাদুলি, গ্রহরত্ন নিয়েও আমরা প্রতিদিন যে নির্বিচার অন্ধত্ব দেখিয়ে চলি তা আমাদের বোধেও আসে না। সে নির্বোধ চর্চাই যে ক্রমে ডাইনি, ভূত, বাবাজি-মাতাজিদের সমাজে জাঁকিয়ে বসার সুযোগ করে দেয়, সামান্য প্ররোচনা এমনকি বিনা প্ররোচনাতেই মানবতা বিরোধী হানাহানি, খুনোখুনির জন্ম দেয় সে কথা খেয়াল রাখি না আমরা। আমাদের চারপাশের বিভিন্ন ‘থান’, শনিমন্দির, সন্তোষীমাতাদের নিয়ে গড়ে ওঠা অসামঞ্জস্যের সঙ্গে আপস করে নিয়েছি আমরা। এইসব ঘটনা আমাদের বাঁচার নিয়ত অনুসঙ্গ। আমাদের চোখেই পড়ে না আর।
কিন্তু শিবরামের চোখ সাধারণের চোখ নয়। তিনি কেবল দেখেন আর পাশ কাটিয়ে পথ চলেন, এমন নয়। কথকের মতই তিনি এই সব অসঙ্গতিতে হোঁচট খান। কিন্তু বারে বারে হোঁচট খেয়ে উপেক্ষা করেন না। অসঙ্গতির মর্মমূলে আঘাত করার কথা ভেবে একদিন আক্রমণ করে বসেন অসঙ্গতিকে। জনতা চারপাশে ভিড় করে থাকে তাদের স্বভাব অনুযায়ী, এগিয়ে আসে না। সাম্যবাদে বিশ্বাসী লেখকের তা অসঙ্গত মনে হয় কিনা বোঝা যায় না। কথক কিন্তু হেলাভরে আস্তাকুঁড়ে ছুঁড়ে ফেলেন না পাথর বা নুড়িটিকে। যে পাথরটি কথকের চলার পথের বিঘ্ন, তার মূলোৎপাটন করার মধ্যে কথকের যে চরিত্রের প্রকাশ, পাথরটিকে ছুঁড়ে ফেলাটাই তো সেক্ষেত্রে স্বাভাবিক হতো। তা হয় না। কথক জনতার উদ্দেশে জানতে চায়, কারও পাথরটা দরকার আছে কিনা। কেন কথকের এই জিজ্ঞাসা। কথক কি তবে প্রথম থেকেই পাথরটির কোনও অন্যতর পরিণতি নিয়ে, সম্ভবনা নিয়ে আশাবাদী; নাকি আমজনতার কুসংস্কার নিয়ে আশঙ্কাবান? পাথরটিকে পড়ে থাকে একপাশে। প্রতিদিন তার দিকে চোখ পড়ে কথকের এবং চারপাশে ভিড় করে আসা জনতার। এই জনতার মধ্যে স্পষ্ট চরিত্র একটিই। তার সঙ্গে কথকের কথা হয় মাঝে মাঝে, পাথরটিকে ঘিরেই। পাথরটি কি কথকের মতো একজন নিখাদ যুক্তিবাদীর এতখানি মনোযোগের কারণ হতে পারে? কেন? না কি এ সেই আমাদের মনের অতলে গেঁড়ে বসে থাকা সংস্কারের বেড়ি। লোকসমক্ষে সে সংস্কার উপড়ে ফেলার পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করা যায়, নিজেকে সে সংস্কার থেকে মুক্ত করা যায় কি না সেটাই লেখকের নিরীক্ষা?
গল্পের শুরু থেকেই নুড়িটি যে মনোযোগ পাচ্ছিল তার স্বাভাবিক পরিণতিতেই সে একদিন জোগাড় করে নেয় তার বাঞ্ছিত তেল সিঁদুর। আস্তানা নির্বাচন করে সম্ভাব্য বটতলাতেই। কথকের চলার পথে নিত্য চোখ পড়ে সেদিকে। ক্রমে দেখা যায় ভিড় করা জনতার মধ্যেই একজন সেই পাথরের মাহাত্ম্য প্রতিষ্ঠায় যত্নশীল। সবই তো ঘটতে থাকে কথকের চোখের সামনে। যে শ্রম এবং যুক্তিবাদী মনন ক্রিয়াশীল ছিল পাথরটিকে উপড়ে ফেলার পেছনে, সেই যুক্তিবাদী মন প্রতিবাদ করে না কেন?
স্বাভাবিকক্রমেই সেই থানে ভিড় বাড়ে। বাড়বেই। আমাদের চারপাশের প্রতিষ্ঠানের বাড়বাড়ন্ত শিবরামের যুগেই তো শুরু। বটতলার শনি, মনসা, শিবের আস্তানা দখল করে ঝান্ডা তোলার ইতিহাস তো সমসাময়িকই। সে সব আস্তানার সেবায়েতের যখন অভাব পড়েনি, পথের পাশে পড়ে থাকা পাথরেরই বা হবে কেন? আমাদের ঐতিহ্য তো ‘সত্য’ এবং ‘সর্বশক্তিমান’-এর (মার্কসবাদ সর্বশক্তিমান, কারণ ইহা সত্য) পারস্পরিকতায় আস্থা রাখা। আমরা তো ‘সর্বশক্তিমান’ বিশ্বাস করতে চাই, স্বাওভাবতই তাকে ঘিরে ‘সত্য’ নির্মান করি। আখড়ায় ক্রমে ভক্তের ভিড় বাড়ে, গাঁজার ধোঁয়ায় আবছা হতে থাকে পাথরের স্বরূপ। আফিম নিয়ে সতর্কতার কথা শিবরামের অজানা থাকার কথা নয়। মস্কো থেকে পণ্ডিচেরি যাঁর রচনা দেবালয় জুড়ে গাঁজার ধোঁয়ার স্বরূপ তাঁর কাছে অস্পষ্ট থাকার কথা নয়। হট্টগোল বাড়ে, মেলা জমে। এসবই স্বাভাবিক ক্রমপর্যায়। অস্বাভাবিক তো ছিল পাতাল ফুঁড়ে ওঠা একটা স্বয়ম্ভু পাথরের অভ্রান্ততায় অবিশ্বাস। অবিশ্বাস করতে বিশ্বাসের জোর চাই। কথক তো তাই দিয়েই শুরু করেছিলেন। তারপর?
গল্পের পরিণতির স্বার্থে গ্রামে বসন্ত শুরু হয়। কথকের আরও কিছু ‘বিপ্লব’ দেখা দেয় মাদুলি, কবিরাজি, হোমিওপ্যাথি নিয়ে অবিশ্বাসের বক্রোক্তিতে। হ্যাঁ, বস্তুবাদীর যুক্তির নিরিখে তাই তো হওয়া উচিত। ম্যালেন্ড্রিনাম ২০০ নিয়ে জ্ঞান সীমিত হলেও, তা যে সরল চোখে কুসংস্কার, আর সেখানে যে খোঁচা দেওয়া যায়, এটাই আমাদের সরল যুক্তিবাদ বলে তো। হাসপাতাল থেকে যুক্তিবাদী টিকাও তো পড়ে সময়ে। বৈজ্ঞানিক প্রগতিবাদের সেটাই তো পথ। যে প্রগতিবাদ পথ থেকে পাথর উপড়ে ফেলে, সেই প্রগতি সরল পথ তো হাসপাতালের টিকা। পাঠক কোথাও ঠোক্কর খায় কি? কিন্তু কিন্তু মাদুলি থেকে ম্যালেন্ড্রিনাম সেসবও তো বক্রোক্তির সঙ্গে সঙ্গে চলতে থাকে। পাঠকের কি তাতেও আস্বস্তি বাড়ে? বাড়ার কথা নয়। আমাদের মধ্যবিত্ত মনন দশ আঙুলে পঁচিশ গ্রহরত্ন আর বস্তুবাদী বিপ্লব একই সঙ্গে সামলাতে অভ্যস্ত। সেই একই সরলরেখা একদিন পথ থেকে উপড়ে ফেলা পাথরের দেবতার সামনে যুক্তিবাদীর হাঁটু, কোমর, মেরুদণ্ড, উচ্চশিরকে বক্র করে। স্বতই অনাহত নাদ ধ্বনিত হয় ‘ব্যোম, ব্যোম’।
শুরুর দিকে মনে হয়, নিখাদ বস্তুবাদ গল্পটির অন্তর্গঠন। কথক এই গল্পের প্রবক্তা। আম জনতার মত আম পাঠকের সামনে সে তুলে ধরবে যুক্তিবাদের শানিত দর্পণ। পাঠক গল্পের আয়নায় নিজেদের ভণ্ডামির মুখোশ দেখে চমকে উঠবে। চট করে চারপাশে তাকিয়ে দেখে নেবে কেউ দেখে ফেলেছে কি না। কিন্তু এত সরল রৈখিক নয় এ গল্পের চলন। সমাজ সচেতনতা বা মানব চরিত্রের তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণ বললে গল্পটি সম্বন্ধে কিছুই বলা হয় না। কুসংস্কারের বিরুদ্ধে একটি তীক্ষ্ণ ব্যঙ্গও নয় গল্পটির প্রধান আবেদন। হেনরিক ইবসেনের (Henrik Ibsen) An Enemy of the People নিয়ে সত্যজিতের বিখ্যাত সিনেমা গণশত্রু বা এমন আরো অনেক গল্প সিনেমা আমাদের জানা। শিবরামের গল্প মনে হয় এক করুণ ট্র্যাজেডি। ইবসেনের স্টকম্যান বা সত্যজিতের অশোক গুপ্ত নিজেদের যুক্তিবাদী অবস্থান থেকে হাজার আক্রমণেও নড়েন না। কুসংস্কার এবং কুসংস্কারের বেসাতি করা দালালদের হাতে তাঁদের লাঞ্ছনাই তাঁদের মহান করে। কিন্তু শিবরামের কথকের ক্ষেত্রে ঘটে ঠিক উলটোটাই। বাহ্যত কোনও অবরোধের মুখে না পড়েও সে ক্রমে বদলে ফেলতে থাকে তার অবস্থান। কুসংস্কারের পাথুরে আঁতুড় ঠুকিয়ে নেয় তার উন্নত শির। গল্পের শুরুতে তার লড়াই, তার বিপ্লব সবই হয়ে দাঁড়ায় দেখনদারি। তবে গল্পের নিবিষ্ট পাঠক বোধকরি এই কমিক ভাঁড়ের জন্যও কিছু সমবেদনা অনুভব করবে। আমাদের মর্মমূলে বস্তি করা সংস্কার কীভাবে আমাদের উন্নত শিরকে টেনে নামায় সে-ও কিছু কম ট্র্যাজেডি।
একটি সাধারণ পাথরকে কেন্দ্র করে কেমন গড়ে ওঠে ভক্তি ও বিশ্বাসের আশ্চর্য দেবালয়, সেটিই এ গল্পের একমাত্র পাঠ নয়। কথকের বিশ্বাসের রূপান্তর, অভিসারী শ্লেষে গল্পটিকে অন্য মাত্রা দিয়েছে। এমন বিশ্বাসের জন্মে আশ্চর্য কিছু নেই। বস্তুলাভের জন্য বিশ্বাস স্থাপন প্রাচীন প্রচলন। এখনও যা আশ্চর্য করে শিবরামকে তা হলো কথকের রূপান্তর; তথাকথিত যুক্তিবাদীর হেরে যাওয়া। সম্ভবত কথকের মানসিকতার রূপান্তরই গল্পটির প্রধান পাঠ।
0 comments: