0

ধারাবাহিক - নন্দিনী সেনগুপ্ত

Posted in


ধারাবাহিক


জলরেখা 
নন্দিনী সেনগুপ্ত


বারো

‘মেঘেরা আসে; ফিরে যায়। কথা দিলে, মোটামুটি সময়মত আসে তারা। আষাঢ় এলে, তারা আসেই। হ্যাঁ, কখনও কখনও হয়ত সেরকম দাপট থাকেনা, কিন্তু আসে! কথা দিয়ে কথা না রাখার মতন মানুষ তো আর তারা নয়। তারা মেঘ। জল ঝরাতে আসে বর্ষায়। ঋতু শেষ হয়ে গেলে ভেসে ভেসে হাল্কা হয়ে কি খেলা তাদের শরতের আকাশে! সেই সময় মানুষও ঘরে ফেরে মেঘেদের এই ফিরে যাওয়া দেখে।’ ... 

এই অবধি লিখে কলম কামড়িয়ে ভাবছিল নীরদা। সেই যে দাদুর হাসপাতালে ভর্তি হবার দিনে বাবার সঙ্গে তার ফোনে কথা হয়েছিল; বাবা তো বলেছিল যে আসবে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আসবে। কিন্তু তার পরে তো প্রায় দশদিন হতে চলল; বাবা আসেনি। দাদু এমনিতে এখন ভালই আছে। কিন্তু বাবা এল না কেন? কিছু হয়নি তো বাবার? সব ঠিক আছে তো? নীরদা কি ঠাম্মাকে আরেকবার বলবে বাবার অফিসে একবার ফোন করতে? যেদিন ছোটদাদু ফিরে গেল, সেদিন একবার বলেছিল। ঠাম্মা হঠাৎ চুপ করে গিয়েছিল। ঠাম্মার নরম টকটকে ফর্সা মুখটা কেমন যেন লালচে হয়ে গম্ভীর হয়ে গিয়েছিল। ঠাম্মা রেগে গিয়েছিল, না কি- ঠাম্মার ভিতরে কোনও কষ্ট হচ্ছিল, সেটা নীরদা ঠিক বুঝতে পারছিল না। তার একটু একটু ভয় করছিল সেই সময়। থাক, থাক না হয়। ফোন করার দরকার নেই। বাবা যখন বলেছে আসবে, ঠিকই আসবে। হয়তো কোনও কাজে আটকে গেছে। ঠিক মেঘেদের মতন। আবার লিখতে শুরু করে নীরদা। 

... ‘যখন ঝড় হয়, মেঘেরা দল বেঁধে সেইখানে পাড়ি জমায়। প্রাণপণে ঢেকে রাখার চেষ্টা করে হাওয়াদের ব্যস্ততা। সেটাই তখন তাদের কাজ। হাওয়ারা ছোটাছুটি করে মজা দেখে। সবকিছু উড়িয়ে নিতে চায়। এমনকি মেঘেদেরও উড়িয়ে দেয় মাঝেমধ্যে। সব ঝড়ের শেষে কি আর বৃষ্টি নামে?’ 

‘নীরু, নীরি, নুরী, একটা পাকা বুড়ি’... কে যেন আচমকা চীৎকার করে পেছন থেকে চোখ টিপে ধরল। দাদাই। দাদাই এসেছে। এটা দাদাইয়ের গলা। দাদাই ছাড়া আর কেউ এভাবে ছড়া কেটে তাকে ডাকে না। নীরদা খুশির গলায় বলে ওঠে, ‘দাদাই! কখন এলি? বউদি আসেনি? কতদিন পরে এলি!’ অনেক বড় হলেও বয়সে, নীরদা বরাবরই নয়নকে তুইতোকারি করে। নয়ন একরাশ খুশি ছড়িয়ে হাসে। ‘তোর বউদির পচা শরীর। উল্টে পড়েছে একদম। আমি বলেছি এত পচা বউ আমার পক্ষে সামলানো সম্ভব নয়। এক্কেবারে বাপের বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছি’... বলতে বলতে হেসে ওঠে নয়ন। নীরদা রেগে ওঠে, ‘এর মানে কি? বউদি অসুস্থ, এটা বুঝলাম। কিন্তু তুই ওঁকে বাপের বাড়ি পাঠিয়ে দিলি কেন? তার থেকে তো এখানেই নিয়ে আসতে পারতিস। এখানে জল-হাওয়া কত ভাল। বউদি দু দিনে ফিট হয়ে যেত’ 

নীরদার কথার পিঠেই এসে সায় দেন এষা... ‘দেখ, দেখ নয়ন। এইটুকুনি বাচ্চা মেয়েরও কি বুদ্ধি! তুই সোনাকে এখানেই নিয়ে আসতে পারতিস’। নয়ন হাসির গলায় বলে, ‘হুঃ, আরও কিছু! এসে তো দেখি, তুমি নিজেই এক পেশেন্‌ট নিয়ে জেরবার। তার উপরে সোনা। যে কিনা এখন পচা শরীরে আর সোনা নেই, পিতল হয়ে গেছে।’--‘বালাই ষাট, আমার সোনা নাত-বউ সোনাই থাকবে। এত ভাল একটা খবর নিয়ে এলি, আর বলছিস পিতল! তবে এই সময়, প্রথম বার, মেয়েরা বাপের বাড়ি থাকাই অবশ্যি ভাল। আমার তো এখুনি ছুটে গিয়ে নাতবউকে একটিবার দেখতে ইচ্ছে করছে। বলিস ওকে, আমি খুব চিন্তায় থাকবো। সাবধানে থাকতে বলিস। হ্যাঁ রে, ঠিকমত ডাক্তার দেখাচ্ছিস তো? সব ঠিকঠাক আছে তো?’ এষার গলা আনন্দে, উত্তেজনায় কেঁপে ওঠে। 

নয়ন মাথা ঝাঁকায়, ‘আরে না, না, অত চিন্তার কিছু নেই। সব ঠিক আছে। মাঝে কিছুদিন খুব মাথা ঘুরছিল বলে ডক্টর একদম রেস্ট নিতে বলেছে। তবে ঠাম্মা, আমি কিন্তু তোমার উপরে খুব রাগ করেছি। আমি নাহয় কাজে ব্যস্ত থাকি, সবসময় খোঁজ-খবর নিতে পারিনা। দাদুর ব্যাপারটা তুমি একাহাতে সব সামলালে, আমাকে একটা ফোন তো করতে পারতে! বাড়িতে করতে চাওনি, ঠিক আছে। আমার অফিসে, বা সোনার বাপের বাড়িতে যদি করতে তাহলেও তো ঠিকই খবর পেতাম। কি যে কর না! খুব রেগে গেছি। কথা বলব না যাও তোমার সঙ্গে।’ নয়ন চোখ কুঁচকে নাকের পাটা ফোলায়। 

এষা অরূপের মুখের আদল স্পষ্ট দেখতে পান নয়নের মুখের প্রতিটি রেখায়। ঠিক এইরকম ছদ্ম গাম্ভীর্য নিয়ে কিছুক্ষণ বসে থাকার পরেই হাসিতে ফেটে পড়ত অরূপ। এষা বসেন সোফায় নয়নের পাশে। পিঠে হাত বোলান, ‘না দাদুভাই!’ কণ্ঠস্বর এখনও কাঁপছে তাঁর... ‘তুমি রাগ করে থেকো না। তুমি রাগ করলে আমরা কোথায় যাই বল? তুমিই যে এই বুড়োবুড়ির সব। তুমি যে নয়ন, নয়নের মণি।’

...নয়ন হাসিতে ফেটে পড়তে চায়, পারে না। হঠাৎ কেন যেন তার মায়ের কথা মনে পড়ে। জানতে ইচ্ছে করে, আজ মা থাকলে কতটা খুশি হতো। সে যে কয়েকমাসের মধ্যেই বাবা হতে চলেছে, এটা জেনে মা কতটা আহ্লাদিত হতো, সেটা কল্পনা করার চেষ্টা করে নয়ন ঠাম্মার দিকে তাকিয়ে। ঠাম্মার শরীর আর আগের মত নেই, এটা পরিষ্কার। গত কয়েক মাসে যেন আরও ঝুঁকে গেছে সামনে। শুধুমাত্র মনের জোরে সমস্ত প্রতিকুলতা অতিক্রম করে বেঁচে থাকা, প্রচণ্ড শোকের মাঝখান থেকেও কিভাবে ঘুরে দাঁড়াতে হয়, তা হয়ত এই নারীর পায়ের নিচে বসে থাকলে শেখা সম্ভব। ভাবছিল নয়ন। 

এষা উঠে দাঁড়ান। নয়নকে বলেন, ‘আয়, খাবি চল। বলছিস, তাড়া আছে। আমার রান্না সব রেডি। খেয়ে নিবি চল। অ নীরু, যা চট করে চানটা সেরে এসে দাদাইয়ের সঙ্গে বসে যা’। নীরু দুদ্দাড় করে ছুট লাগায়। উফফফ, কদ্দিন পরে দাদাই এল। দাদাইয়ের সঙ্গে একসাথে বসে ভাত খাবে নীরু। কি জানি, আজ আবার ঠাম্মা লাউয়ের ঘণ্ট রাঁধে নি তো? তাহলেই চিত্তির। যদি দাদাইয়ের পাতে একটাও লাউয়ের দানা পড়েছে, তাহলে আর রক্ষে নেই। সঙ্গে সঙ্গে দাদাই টিপ করে নীরুর নাকে ঠিক রকেটের মত ছুঁড়বে ওই দানা। ছুঁড়েই ঘর ফাটিয়ে হাসবে। স্নান সেরে চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নাকে হাত বোলাতে বোলাতে নিজের মনেই হাসতে থাকে নীরদা। 





0 comments: