0

প্রবন্ধ- সুমিতা দাসমজুমদার

Posted in





                                                                                                                                                                ছবি - পল্লব বরন পাল

প্রবন্ধ



ব্রাহ্মধর্ম ও রবীন্দ্রনাথ : রবীন্দ্র-ধর্ম 
সুমিতা দাসমজুমদার

মেক্সিকো বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন ছাত্র, যাঁদের মাতৃভাষা স্প্যানিশ, তাঁরা একবার রবীন্দ্র—প্রসঙ্গে আচার্য সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের কাছে বলেছিলেন, রবীন্দ্রনাথের মধ্যে অতীন্দ্রিয় জগতের একটা আভাস পান তাঁরা, একটা আধ্যাত্মিকতার সুর তাঁর লেখার মধ্যে আছে, যেটা মানুষকে উঁচুতে তুলে নিয়ে যায়, আর মানুষকে আকুল করে! রবীন্দ্রনাথের স্বাতন্ত্র্য ঠিক এখানে, এই জায়গাটাতে। তাই তাঁর গান, সুরের ভাষায় অনায়াসে আলোড়ন তোলে এই বলে যে: 

আগুনের পরশমণি ছোঁয়াও প্রাণে...
ব্যথা মোর উঠবে জ্বলে ঊর্ধ—পানে।।

কিন্তু এই বীক্ষণ রবীন্দ্রনাথ পেলেন কোথায়? জন্মসূত্রে পাওয়া ব্রাহ্মিকতার মধ্যেই কী উপ্ত হয়েছিলে এর বীজ? নাকি, ব্যাপ্ত হ’য়েছিল নিজের অন্তরশায়ী ক্রিস্টালাইজড্‌ ধর্ম—চেতনায়?

ব্রাহ্মধর্মের প্রচারক মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের কনিষ্ঠ পুত্র রবীন্দ্রনাথ; অতএব, জন্মসূত্রে ব্রাহ্ম। কর্মসূত্রেও ব্রাহ্মসমাজের সঙ্গে যোগ ছিল তাঁর। একদা আদি ব্রাহ্মসমাজের সম্পাদক হয়েছিলেন তিনি; এমন কি, বৃত হয়েছিলেন তত্ত্ববোধিনী পত্রিকার সম্পাদকের পদে। অথচ, পরবর্ত্তীকালে, ব্রাহ্মসমাজের সঙ্গে ক্রমশঃ দূরত্ব বাড়তে থাকে তাঁর। কট্টরপন্থী ব্রাহ্মসমাজের সঙ্গে সংঘাত ও বিরোধে জড়িয়ে পড়েন তিনি; এমন কি পিতা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের সঙ্গেও তৈরি হয় দূরত্বের অক্ষরেখা। অথচ, গোড়ায় রবীন্দ্রনাথ ছিলেন তাঁর পিতার পার্শ্বচর। সাহিত্য-সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্রের সঙ্গে সেই সময় তুমুল সংঘাতে জরিয়ে পড়েছিলেন পিতৃঅনুগত রবীন্দ্রনাথ। সরলাদেবীর লেখা ‘জীবনের ঝরাপাতা’ গ্রন্থে এর পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ মেলে।

তবে কি, রবীন্দ্রনাথ, ব্যক্তিগত ধর্মবোধের ক্ষেত্রে, ভেতর থেকে ক্রমশ পাল্টে যাচ্ছিলেন? অথবা, পাল্টে ফেলছিলেন নিজেকে? প্রথাগত ধর্মের নির্মোক ছিঁড়ে বেরিয়ে আসতে চাইছিল এক নতুন মুখ – যা কিনা নতুনতর বোধে, চেতনায় উদ্বুদ্ধ? এমনকি, নাস্তিকতারও সহচর? তাই, ঋজু-কন্ঠে উচ্চারণ করতে পারেন ‘আমি ব্রাত্য আমি মন্ত্রহীন’ – এমন কথাও! লক্ষণীয়, সাধারণ ব্রাহ্মসমাজের radical প্রগতিমূলক চিন্তাভাবনা – ব্রাহ্মসমাজের সঙ্গে মানবহিতের ধারণা – গণ্ডীমুক্তিও ঘটেছিল সেই সময়। ব্রাহ্মসমাজে আমন্ত্রিত সদস্য হিসাবে রবীন্দ্রনাথকে চাইছিলেন প্রশান্ত মহলানবিশ, সুকুমার সেন প্রমুখ তরুণদের দল।

ব্রাহ্মসমাজেও ক্রমশঃ পরিবর্তনের সূত্রপাত হয়। ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান থেকে বেরিয়ে এসে সর্বজনীন ধর্ম universal religion এর দিকে যাত্রা শুরু হয় তার। দেখা দেয় রবীন্দ্রনাথের ধর্মভাবনার, চিন্তাচেতনার ক্ষেত্রে ক্রমবিবর্তন। অনলস, অনর্গল সৃষ্টির মধ্যে দিয়ে শুরু হয় মুক্তধর্ম তথা সত্যধর্মের অনুসন্ধান-প্রয়াস। 

রোমাঁ রোলাঁ একবার রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘যাঁর গ্যেটের মতো প্রতিভা ভারতের সব নদীর মিলন স্থলে এসে দাঁড়িয়েছিল, সেই রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে একথা ধরে নেওয়া চলে যে, তাঁর মধ্যে ব্রাহ্মসমাজের (এটা তাঁর পিতা মহর্ষি কর্তৃক সঞ্চারিত হয়েছিল) এবং রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দের নব-বেদান্তবাদের দুটি ধারা মিলিত ও সমন্বিত হয়েছিল। উভয়ের দ্বারা সমৃদ্ধ হ’য়ে অথচ উভয় থেকেই মুক্ত থেকে তিনি তাঁর মানসলোকে প্রাচ্য ও প্রতীচ্যের সার্থক মিলন ঘটিয়ে ছিলেন। সমাজ ও জাতির দিক থেকে বিচার করলে রবীন্দ্রনাথ তাঁর নিজস্ব চিন্তাগুলোকে প্রকাশ্যভাবে সর্ব প্রথম ঘোষণা করেছিলেন ১৯০৬ খ্রীষ্টাব্দে স্বদেশী আন্দোলনের সূচনাকালে, অর্থাৎ বিবেকানন্দের দেহ রক্ষার চার বছর পরে। বিবেকানন্দের মতন একজন অগ্রদূতের প্রভাব যে তাঁর চিন্তাজগতের ক্রমবিকাশের ক্ষেত্রে কিছুটা প্রভাব বিস্তার করেছিল, তা নিঃসন্দেহ।’ (দ্র. স্বামী বিবেকানন্দ : মনীষীদের চোখে, প্রকাশ – স্বামী সর্বভূতানন্দ, রামকৃষ্ণ মিশন ইন্সটিটিউট অফ্‌ কালচার, পৃঃ ৪১)।

বিবেকানন্দ প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ একবার রোমাঁ রোলাঁ কে বলেছিলেন, যদি তুমি ভারতকে জানতে চাও, বিবেকানন্দকে জান। তাঁর মধ্যে সবকিছুই ইতিবাচক, নেতিবাচক কিছু নেই।’

‘বঙ্গদর্শন’ পত্রিকায় রবীন্দ্রনাথ একবার ‘প্রাচ্য ও প্রতীচ্য’ নামে একটি প্রবন্ধে লিখেছিলেন : ‘ভারতের সর্বশ্রেষ্ঠ মনীষীগণ ... প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যকে মিলাইয়া কার্য করিয়া গিয়াছেন। দৃষ্টান্তস্বরূপ রামমোহন রায়, রানাডে এবং বিবেকানন্দের নাম করিতে পারি। ইঁহারা প্রত্যেকেই প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের সাধনাকে একীভূত করিতে চাহিয়াছেন; ইঁহারা বুঝাইয়াছেন যে, জ্ঞান শুধু এক দেশে বা জাতির মধ্যে আবদ্ধ নহে, পৃথিবীতে যে দেশেই যে কেহ জ্ঞানকে মুক্ত করিয়াছেন, জড়ত্বের শৃঙ্খলমোচন করিয়া মানুষের অন্তর্নিহিত শক্তিকে উন্মুখ করিয়া দিয়াছেন তিনিই আমাদের আপন – তিনি ভারতের ঋষি হোন বা প্রতীচ্যের মনীষী হউন – তাঁহাকে লিয়া আমরা মানব মাত্রেই ধন্য।’

কবির এই বীক্ষণেই কী ধরা পড়েনা যে ধর্ম সম্পর্কে তাঁর চেতনা কোনও বিধিবদ্ধ লক্ষ্মণরেখা মানেনি? ক্রমশঃ এই ধর্মবোধ ব্যাপ্ত হ’তে হ’তে চলেছে দিগন্তের অভিসারে! যে কবি একদা উচ্চৈঃস্বরে ঘোষণা করে দিয়েছেন, ‘বৈরাগ্য সাধনে মুক্তি সে আমার নয় / অসংখ্য বন্ধন মাঝে মহানন্দময় / লভিব মুক্তির স্বাদ’ – আসলে, তাঁর নিজের ধর্ম কী? অর্থাৎ রবীন্দ্রনাথের নিজের ধর্ম কী? একবার কথাচ্ছলে বলেলছিলেন, বৈষ্ণবধর্ম তাঁর খুব ভাল লাগে – কেননা, তা’ অহেতুকি। সেখানে ভালবাসার জন্যেই ভালবাসা। ‘তাই তোমার আনন্দ আমার ‘পর।’ ভালবাসাই ভালবাসার শেষ কথা। কবির ব্যক্তিগত ধর্মবোধ, বাইরে থেকে আহৃত বা আরোপিত নয়, সেই ধর্মীয় চেতনা তাঁর অন্তরের কবিসত্তা থেকেই উৎসারিত, মনের মানুষে কবির অন্তরতম আনন্দেই তার চূড়ান্ত বিকাশ। বাইরে থেকে পাওয়া ধর্মচেতনা যে মানুষের সত্যকার ধর্মচেতনা নয়, সে কথাই কবি বলেছেন ‘Rabindranath Tagore : A Centenary Volume’ গ্রন্থে, ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো লিখিত টTagore on the Bank of the River plate’ নামক প্রবন্ধে ; কবি বলেছিলেন, ‘The religion that only comes to us from external scriptures never becomes our own; our only tie with it is that of habit. To gain religion within is man’s lifelong adventure. In the extremity of suffering must it be born, on his life-blood it must live; and then, whether or not it brings him happiness, the man’s journey shall end in the joy of fulfillment.

‘ছিন্নপত্রাবলী’র ২৩৮ সংখ্যক পত্রে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন : ‘ঠিক যাকে সাধারণতঃ ধর্ম বলে, সেটা এ আমি আমার নিজের মধ্যে সুস্পষ্ট দৃঢ় রূপে লাভ করতে পেরেছি তা বলতে পারিনে, কিন্তু মনের ভিতরে ভিতরে ক্রমশঃ যে একটা সজীব পদার্থ সৃষ্ট হ’ইয়ে উঠছে তা অনেক সময় অনুভব করতে পারি। শাস্ত্রে যা লেখে, তা সত্য কি মিথ্যা বলতে পারিনে, কিন্তু সে সমস্ত সত্য অনেক সময় আমার পক্ষে সম্পূর্ণ অনুপযোগী – বস্তুত আমার পক্ষে তার অস্তিত্ব নাই বললেই হয়।’ ২৩৬ সংখ্যক পত্রে এই বক্তব্যকেই বিশদ আকারে পাওয়া যায়। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন - ‘আমরা বাইরের শাস্ত্র থেকে যে ধর্ম পাই, সে কখনো আমার হ’য়ে ওঠে না, তার সঙ্গে কেবল একটা অভ্যাসের যোগ দৃঢ় হ’য়ে আসে। যে ধর্ম আমার জীবনের ভিতরে সংসারের দুঃসহ তাপে ক্রিস্টালাইজড্‌ হ’ইয়ে ওঠে সেই আমার যথার্থ। ... সেই জিনিসটাকে নিজের মধ্যে উদ্ভূত করে তোলাই মানুষের পক্ষে মনুষ্যত্বের চরম ফল। চরম বেদনায় তাকে জন্মদান করতে হয়।’ স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে যে, ‘অভ্যাসের ধর্ম’ থেকে ‘প্রাণের ধর্মকে সম্পূর্ণ পৃথক করে দেখেছেন রবীন্দ্রনাথ। ‘মানুষের ধর্ম’ গ্রন্থেও নিজের এই ধর্মবোধের কথা বলতে গিয়ে বলেছেন, ‘যে অভ্যাস বাইরে থেকে চাপানো, তা আমি গ্রহণ করতে অক্ষম।’

রবীন্দ্রনাথের প্রাণের ধর্ম – মানবধর্ম এবং তা একান্তভাবেই প্রেমের ধর্ম। কবিমানসে তাঁর জীবন দেবতার লীলার মধ্যেই সে ধর্ম আস্বাদনীয়। ‘Personality’ গ্রন্থে ‘Woman’ প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন : ‘With the growth of man’s spiritual life, our worship has become the worship of love.’ অর্থাৎ প্রেমের উপাসনাই ক্রমোন্নত অধ্যাত্ম-জীবনের সত্যকার উপাসনা। তাঁর যাবতীয় সাহিত্য-শিল্প রচনায় এই উপলব্ধির বিচিত্র রূপ ধরা পড়ে।

রবীন্দ্রনাথ মানুষের কাছে মুক্তি, মানবতা ও সত্যের দিশারী। মানবধর্ম, মুক্তধর্ম তথা সত্যধর্মের উপাসক রবীন্দ্রনাথ বৃহত্তর জীবন-সত্যের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেন আমাদের। রবীন্দ্রনাথই মানব-সভ্যতাকে নতুন ক’রে মনে করিয়ে দেন ‘সৃষ্টির প্রথম রহস্য : আলোকের প্রকাশ’ ; আর, ‘সৃষ্টির শেষ রহস্য : ভালোবাসার অমৃত।



0 comments: