0

স্মৃতির সরণী - সঞ্চয়িতা বিশ্বাস

Posted in


স্মৃতির সরণী


বাবা
সঞ্চয়িতা বিশ্বাস


কতগুলো বছর হয়ে গেল বাবা চলে গেছে। তারও কতগুলো বছর আগে আমরা ভাড়াবাড়ি ছেড়ে নিজেদের বাড়িতে চলে এসেছি। কিন্তু বাবার কথা মনে এলেই প্রথমে নাকে আসে কয়লার উনুনের ধোঁয়া… ভোরের আকাশবাণীতে "বিশেষ বিশেষ সংবাদ" …ঘুম ঘুম চোখে কয়লার ধোঁয়ায় বসে মায়ের খুন্তি থেকে ভেসে আসা ছ্যাঁকছোঁক শব্দ… সদ্য স্নাত বাবার চুল থেকে ঝরে পড়া টুপটুপ জল। 

অনেকদূরে অফিস বাবার …সেই গার্ডেনরীচ। সাতটার ইছামতী লোকাল ধরতে হবে। তাই ভোরবেলা থেকে শুরু হয় ব্যস্ততা।

বাবার নির্দেশে আমাদের দুই ভাইবোনকেও উঠে পড়তে হয় ভোর ভোর… নয়তো পড়া মুখস্থ হবে না। জীবনে নিয়মানুবর্তিতা আসবে না। ঘুম তাড়াতে তাড়াতে দাঁত মেজে আসি যখন, তখন চলটা ওঠা মেঝেতে সুন্দর আসন পেতে বাবা খেতে বসে… সামনে চুড়োকরা ধোঁয়া ওঠা ভাত, দু'তিন রকম তরকারি। মা তখন বাবার টিফিনবাক্স গোছাচ্ছে পাশে বসে। মা'কে জাদুকরের মতো লাগে। অফিস যেতে ইচ্ছে করে গরম ভাত আর টিফিনবাক্সের লোভে! লোভটা নিশ্চয় চোখ অব্দি পৌঁছে যায়। তা না হলে রোজ বাবার বাম হাঁটুতে বসে দু'গাল ভাত কেন জোটে!

বাবা সেই পৌনে সাতটায় বেরোয়, আর রাত সাড়ে আটটায় ঘরে ঢোকে। বাবা বেরোলে দুই ভাইবোনের যে দৌরাত্ম্য শুরু হয়, সেটা থামে রাতে আটটা পনেরোর ইছামতীর হুইসেলে। বাবাকে আমরা যমের মতো ভয় করি। বাবা সুপুরুষ এক মানুষ, যার প্রশস্ত কপালে, উন্নত নাসিকায়, থুতনির গভীর খাঁজে জ্ঞান আর গাম্ভীর্য পাশাপাশি বসবাস করে। বাবা গুরুজন... তার সাথে ইয়ার্কি, ঠাট্টা করা যায় না। তাকে শ্রদ্ধা আর সম্ভ্রম করতে হয়। মুশকিল হলো, শিশুদের কাছে শ্রদ্ধা বা সম্ভ্রম হলো ভয়েরই নামান্তর। অতএব বাবাকে আমরা ভয় করি। আমাদের সাপ্তাহিক দুষ্টুমি সোম থেকে শুক্রবার অব্দি চলে। বাবার অফিস শনি-রবিবার বন্ধ। সুতরাং শনি আর রবিবার আমাদের শান্ত-শিষ্ট হয়ে থাকার দিন। এই দুইদিন দাঁত মাজাবেন বাবা(মুখের মধ্যে ভূমিকম্প হয়ে যায়)…স্নান করাবেন বাবা (ভয় হয়, ছোবড়ার ঘষায় গায়ের চামড়া না উঠে আসে)… খাওয়াবেন বাবা(উচ্ছে আর শাকও খেতেই হবে)… এবং পড়াবেনও বাবা(ভুল করা যাবে না, অন্যমনস্ক হওয়া যাবে না, মার খেলেও কাঁদা যাবে না)।

শনি-রবিবার আমাদের দুরবস্থা দেখেও মায়ের কষ্ট হয় না, কারণ ঐ দুটোমাত্র দিনই তো বাবাকে বাড়ির আরাম আর পঞ্চ ব্যাঞ্জন পরিবেশনের সুযোগ মেলে। অবশ্য আমাদের দুরবস্থাতেও প্রলেপ লাগে, যখন বাবা পাত থেকে মুরগীর হাড় বা কচকচি তুলে দেন আমাদের পাতে।

আজও শনি-রবিবারের দুপুরগুলো আমার খালি খালি লাগে। শনিবারের দুপুরে বাবা হাতের কাজ সারতে সারতে রেডিও চালিয়েছেন… "শনিবারের বারবেলা" …ঘোষকের গা ছমছমে স্বর…।

রবিবার দুপুরবেলা আমাদের গল্প বা কবিতা শোনার দিন। বাবার দুই পাশে দুই ভাইবোন… বাবা বেতালের গল্প শোনাচ্ছেন… অথবা ঘুমের মধ্যে ডুব দিতে দিতে বাবার কন্ঠস্বর কানে বাজছে- "দিনের আলো নিবে এলো, সুয্যি ডোবে ডোবে/ আকাশ ঘিরে মেঘ জমেছে চাঁদের লোভে লোভে/ মেঘের উপর মেঘ জমেছে, রঙের উপর রং/ মন্দিরেতে কাঁসর ঘন্টা বাজলো ঢং ঢং…"

ব্যারিটোন ভয়েস… তার মাঝে একটু ফরিদপুরী টান… 'চ'-এর উচ্চারণে 'স'-এর ছায়া…সমস্ত চেতন অবচেতন জুড়ে আজও বাবার সেই মেঘমন্দ্রস্বর…


0 comments: