2

পথে প্রান্তরে - বিবি বসু

Posted in


পথে প্রান্তরে


ভিতরকণিকার নিভৃতে
বিবি বসু


রুটটা আগাগোড়াই ভুল ছিল। অবশ্য জীবনে কোন রুটটাই বা আজ অবধি ঠিকঠাক নিয়েছি আমি! আরে মশাই, এরে কয় ভাগ্য। প্রভিডেন্স হাতে কাঁটা লাগানো চাবুক নিয়ে বসে আছে---আমি তো পিউনিস্য পিউনি মশাই। মানতে হয়, মানতে হয়। নাকিকান্না জুড়তে নেই।

তা যাইহোক, ভুবনেশ্বর এয়ারপোর্টে নেমে আমার এককালীন ছাত্রী মৌমিতাকে ফোনে ধরলাম। প্রসঙ্গতঃ উল্লেখযোগ্য, সেই সবুজ স্কার্ট পরা, অতীব দুষ্টু, ক্লাসে বসে বকবক করা কিশোরীটি এখন পূর্ণ যুবতী। কলকাতা ছেড়ে পুরীতে বসে অত্যন্ত সাফল্যের সঙ্গে একটি ট্যুরিজম সার্ভিস কম্পানি চালাচ্ছে। ওর ভরসাতেই ভিতরকণিকা সফর আমার। 

ও মা, ফোনের ওপার থেকে মেয়ে আমায় বলে, ‘একটু দেরি হবে আন্টি, আমি রাস্তায়। বেশি না...এই ঘন্টা খানেক লাগবে। আপনি বসুন না, ভিতরেই বসুন।’

পেট চুঁইচুঁই করছে। মনে মনে মৌমিতার কান ১০০ বার মলে দিয়ে, ক্যাবলার মতন বিমানবন্দরে বসে রইলাম।

আধ ঘন্টা কাটতে আবার ফোনাঘাতে জর্জরিত করি ছেলেমানুষ মেয়েটাকে। 

‘ওরে মা জননী, তুই কতদূর?’ উত্তর আসে, ‘বেশি দূর নয় আন্টি, এই আর মিনিট পঁচিশ। আসলে আমাদের সঙ্গে আরেকজন যিনি যাবেন, তিনি তো আজ ভোরে পুরীতে এসে নামলেন। একটু ফ্রেশ হয়ে নিলেন, তাই বেরোতে দেরি হয়ে গেল। বসুন না, অসুবিধা কি? বেশ ঠাণ্ডা ঠাণ্ডায় বসুন।’

ভাবলাম বলি, ‘তুই আর ওই আরেকজন ভ্রমণসঙ্গী কচুপোড়া খা। আমি একপেট খিদে নিয়ে এখানে বসে বসে স্যান্ড-আর্ট দেখি’।

আবার ফোন, ‘আন্টি আমি ড্রাইভারকে আপনার নম্বর দিয়ে দিয়েছি, ও আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করে নিচ্ছে। আপনি বেরিয়ে গাড়িতে উঠুন। আমরা মাঝপথে উঠছি। শুধু কিলোমিটারটা দেখে নেবেন। নয়ত...’ 

অগত্যা গুটিগুটি পায়ে বিমানবন্দরের শীতল আশ্রয় ছেড়ে রাজপথে নামি। আকাশ তখন সেজেছে বেশ! একটু বাদেই ঝরঝর ঝরবে।

ড্রাইভারটিকে প্রথম দর্শনে বড় সহৃদয় লাগলো। যত্ন করে গাড়িতে বসাল। কিছুদূর নিয়ে গেল। এই যা! কিলোমিটার রীডিং নিতে বলেছিল না মৌমিতা! একদম ভুলে গেছি। তখন গাড়ি থামিয়ে আমার ভয়ঙ্কর হিন্দীতে তাকে জিজ্ঞেস করে নিলাম। উত্তরে কি একখান কইল সে! এখন আর মনে নেই। 

বাপরে, তখন কে জানত এ সফর এত লম্বা! মাঝপথে মৌমিতা উঠল আরেকজনকে নিয়ে। তিনি শুনলাম লেফটেন্যান্ট, কিন্তু অমন গোবেচারা মুখ আমি জন্মেও দেখিনি।

গাড়ি চলল। হাইওয়ের ধারে একটা রেস্তোরাঁয় খাওয়া দাওয়া করা গেল। কিঞ্চিৎ শান্ত হলাম। তারপর গাড়ি চলছে তো চলছেই। আরে ভাই, তখন কি আর জানতাম সেই সহৃদয় ড্রাইভার কোনও হোমওয়ার্ক না করেই আমাদের নিয়ে দূর সফরে পাড়ি দিয়েছে! চাঁদবালির অরণ্যনিবাসে যে রাতটুকু কাটানোর ব্যবস্থা, সেটা পর্যন্ত মন দিয়ে শোনেনি। চাঁদবালির পথ না ধরে অন্য পথ ধরেছে! ভুল পথ ধরার পর আমাদের মুখে চাঁদবালি শুনে ড্রাইভারের কি তড়পানি! তার মাতৃভাষায় এমন তড়পাচ্ছে যে মনে হলো সটান কলি থেকে দ্বাপরে ট্রান্সপোর্টেড হলাম। কুরুক্ষেত্র প্রান্তরে দামামা বাজছে যেন! উফ!

তড়পানি শেষে চালক ধরল এক ভাঙাচোরা রাস্তা। অশীতিপর বৃদ্ধর উচ্চাবচ গালের মতন খানা খন্দ ভরা সে রাস্তা। আমার শরীরের প্রত্যেক অঙ্গ প্রত্যঙ্গ সেদিন দুলতে, দুলতে ঈশান নৈঋত সকল দিক চিনে গেল। মোটামুটি সাড়ে চার ঘন্টার পথ সাড়ে ছয় ঘন্টায় এসে পৌঁছনো গেল। OTDC অরণ্যনিবাসটি বেশ। পরের দিন বোটে বৈতরণী পার হয়ে, ব্রাহ্মণীর জলে ভাসতে ভাসতে, কোলা খাঁড়ি বেয়ে কুমিরের সাথে মোলাকাৎ হবে। তার প্রস্তুতি পূর্ণমাত্রায় চলতে লাগল। 

অরণ্যনিবাস বড় সড়। কিন্তু ওই - সরকারী ব্যবস্থা তো! গিজার চলে না, ইমারশন হিটার দিয়ে যায়। ইন্টারকমের কোনও ব্যবস্থা নেই। পাওয়ার-কাট নৈমিত্তিক। জেনারেটরে এসি চলে না। আর খাওয়া দাওয়া? উহ্য থাক সে কথা। পাঁচফোড়ন দেওয়া ডিমের ডালনা খেয়েছেন কখনও? খান নি? আপনি ভাগ্যবান, মশাই।

আরে দূর! বেড়াতে এসে কে আর আমাকে কালিয়া পোলাও করে দেবে? খুঁতখুঁত করতে নেই।

পরের দিন সকাল সাতটায় OTDর বোট ছাড়ল। ফাইবার বোট। যাত্রা শুরু। বিস্তৃত জল আর দুধারে সবুজের মেলা - কোনও সবুজ বাংলাদেশের পতাকার মতন, কোনও সবুজ আমার সদ্য কেনা জামদানি রঙা, কোনও সবুজ এক্কেবারে জলে ধোয়া। গাছ জলের ধারে নেমে এসে নদীর সাথে ফিসফিসিয়ে গল্প করছে। প্রকৃ্তি যেন ছেঁটে, কেটে বাগান বসিয়েছে জলের ধারে। ব্রাহ্মণী নদীতে বোট ঢোকার আগেই বোট-চালকের চিৎকার, ‘ওই দেখো কুমির, কুমির’।

জলের ধার ঘেঁষে জংলা ঘাস, কেমন দ্বীপের মতন। তার পাশেই মৃদু নড়াচড়া। হঠাৎ মুখ তুললো। ব্রেকফাস্ট করছে। চোয়াল নড়ছে।হায় রে, কিছু মাছ কুমিরের পাকস্থলী হয়ে সোজা অমৃতলোকে যাত্রা করল। রুটটা একটু কষ্টকর বটে, তবু বন্ধনমুক্তি বলে কথা! পরের জন্মে হয়ত হীন মীনগণ আমার মতন বোটে বসে কুমিরের প্রাতরাশ দেখবে!

কি ভাবছেন? আমি তখন মাছ হয়ে ওই কুৎসিত সরীসৃপের পেটে সেঁধবো? সে গুড়ে বালি! আমি ততদিনে ব্রহ্মে লীন... পুনঃজন্ম চক্রে আমায় রাখে কে ডা? আমি রাজ্য সরকারি কর্মচারী। অর্থাৎ কি না সহনশীলতার পরাকাষ্ঠা। এ কৃচ্ছসাধন বিফলে যায় কখনও?

আর একটু এগোতেই জলে ভেসে উঠল খাঁজকাটা খাঁজকাটা ল্যাজ। আরে আরে, মুখ তোল না বাছা। শুধুই ল্যাজের বাহার দেখাবি? কুমিরই যদি হবি তাহলে শুধু ন্যাজ কেন? সত্যিই তো, শুধু ন্যাজ কেন? বাকি ছায়ায় বোঝা যায় সব মিলিয়ে ১৫ ফুটের কাছাকাছি হবেই সে। টুকি খেলতে খেলতে ভুস!

রসিক চালক বললে, ‘কি দিদি যাবেন না কি কুমিরের সাথে হ্যান্ডশেক করতে?’ বললাম, ‘না ভাই, আমি খাঁটি ভারতীয়, হ্যান্ডশেকে বিশ্বাসী নই। যুক্তকরে অভিবাদন জানাই সবাইকে।’

যেতে যেতে ছায়া শরীর দেখাচ্ছে সব। দূর কুমির, না কুমির-ভূত রে ভাই? তবে নদীতে কুমিরের সংখ্যা প্রায় চীনদেশের জন সংখ্যার মতনই প্রায়।

বোট এসে এক জায়গায় থামল। এবার কোর এরিয়া শুরু। পারমিশান নিতে হবে জঙ্গলে ঢোকার। অনুমতি-পত্র হাতে নিয়ে রসিক সারেঙ, তার আধা বাংলা আর পুরো উড়িয়ায় কি বলল, তা হুবহু তুলে দিচ্ছি -
‘জয় জগন্নাথো, জঙ্গলে কোর এরিয়া শুরু---সবাই ব্যালেঞ্ছ করি বসিবে---নাইলে বোটো হেলি যাবে---নিচে কিছুতে ধাক্কা লাগি গেলে বোটো ভাঙি যাবে---বোটো ডুবি যাবে---তারপরে কি হবে ভাবি লও---আর বল্লুম না।’

জয় মা দুর্গা, এ কোন কুমির-গারদে এসে পড়লাম মা গো। না হয় কলকাতার উৎকট ভিড়ে মিশে থাকতাম। তোমার সিংহ তো মাটির মা--- আমাকে অ্যাট লিস্ট জলখাবার ভাবত না! এখানে যে সব জ্যান্ত কুমিরের দল। হায় হায়! কি করতে এলাম! এ লঞ্চ-চালক বলে কি রে ভাই! কি ক্যাজুয়ালি বলে দিল। 

তা কলকাতাস্হিত মৃণ্ময়ী মা সে প্রার্থনা মঞ্জুর করলেন কি না জানা নেই, বোট ছাড়ল। এবার একটি খাঁড়ি বেয়ে পথ চলা। হঠাৎ সহকারী চালকের চিৎকার---অই দেখো ডাঙায়। আর যায় কোথায়---লহমায় সব্বাই বোটের একদিকে ক্যামেরা নিয়ে। আমি সেই অমোঘ সাবধানবাণী ভুলি নি। সকলের উল্টো দিকেই বসে রইলাম। কলেবর খাটো নয়। তাই এ যাত্রা ব্যালেন্স রক্ষা হলো। জীবনে প্রথমবার ওবিসিটি-অসুরের গালে চকাম করে একটা চুমু দিলাম মনে মনে। 

ডাঙায় একটি পূর্ণ বয়স্ক সরীসৃপ। আমারই মতন জড়ভড়ত। লোকজন দেখছে তাকে। জঙ্গলের শান্ত, সমাহিত পরিবেশে রীতিমত সুর-ছন্দহীন কলকাকলি। তাও ব্যাটা নড়ে না! সারেঙের আবার সরস মন্তব্য, ‘কি ভাবচ, উঠা প্লাস্টিকের? হ্যাঁ গো হ্যাঁ, তোমরা আজ আসিবি বলি কাল আমার এই ছেলেটা রাখি গেছে - তোমাদের এই গাইড ছেলেটা গো। একটা মজা দেখবে? এই গাইড তর হাতে রিমোট আছে তো? দেখ ওটি জলে নামিবে।’

এই কথা বলে ইঞ্জিনের শব্দ বন্ধ করে কাছে এগোতেই, চালকের ইন্সট্রাকশন - ‘মুভি কর, মুভি কর। জলে আসবে’। না মিলল না। কুমির তার চারিত্রিক উদাসীনতায় প্রথমটা দৃকপাত করল না, তারপর বোধহয় তার বোধোদয় হলো! মনে পড়ল দাদু শিখিয়েছিল ওই দুপেয়ে আহাম্মকগুলোকে যথাসম্ভব এড়িয়ে চলতে। 

জলে না এসে কুমির নড়ে, চড়ে নল-খাগড়ার বনে সেঁধিয়ে গেল।চালকের প্রাণখোলা হাসি আর তীক্ষ্ণ মন্তব্য, ‘কি হে গাইড, তোমার রিমোট কি উলটো ছিল?’

ভাসছি তো ভাসছি। দুপাশে গাছ জল ছুঁয়ে ধ্যানে বসেছে... নির্মোক।দু পা যেতে না যেতেই হয় শামুকখোলের, নয় বকের ব্যস্ততা নজরে পড়ার মতন। ডালের উপর থেকে জল-ময়দানে চোখ রাখছে আকাশ-নীল মাছরাঙা। মনে মনে বককে বলছে, ‘দুয়ো, দুয়ো! আমি মাছ পাবো ঠিইইইইইক। তুই শামুক আর কাঁকড়া খেয়ে মর।’

একটা নীলকন্ঠ পাখি ডানা মেলে উড়ল কোন দিশায়! আজ তো সবে মহাসপ্তমী। গুগল ম্যাপ পাখির দিশা গুলিয়ে দিয়েছে, তাই সপ্তমী থেকে ইতিউতি উড়ে ঠিকঠাক পথ খুঁজে চলেছে বেচারা! 

অতঃপর ডাংমালে অবতরণের সময় এল। চুপচাপ চলতে হবে। পথে উঠে দেখি মানুষেরই হাতের কাজ খানিক। নারকেল গাছের সারির মধ্যে দিয়ে মেঠো পথ ধরে হাঁটা। জঙ্গল বেশ পাতলা। গাইডের ঠোঁটে আঙুল হঠাৎ। চোখের ইশারায় পাশের দিকে দেখতে বলে সে। চেয়ে দেখি একপাল চিতল হরিণ প্রায় ‘স্বাগতম’ প্ল্যাকার্ড হাতে দাঁড়িয়ে। নিজের মনে ঘুরছে, ফিরছে, আমাদের দেখে পালানোর কোনও লক্ষণই নেই। ওদের মধ্যে একটাই শিঙল, বাকিগুলো ন্যাড়া।হরিণরা আমাদের পাত্তা দিল না বিশেষ। কিন্তু আমরা তো আদেখলা - ছবি তুলেই যাচ্ছি। বোঝা গেল, আমাদের মতন আপদদের সঙ্গে ওদের জান-পহেচান আছে ভালোই।

একটু এগোতে ভিতরকণিকার ভিতরে ট্যুরিস্টদের জন্য গেস্ট-হাউস। ও মা গো! এমন হরিণ-বিছোনো পথের ধারে সরকারী গেস্ট-হাউসগুলো বেবাক ফাঁকা! মৌমিতাকে চেপে ধরি, ‘এই মেয়ে, তুই এখানে থাকার বন্দোবস্ত করিস নি কেন? আহা এমন ছায়া বীথিতল!’ মৌমিতা হতবাক, বলে, ‘অনেক চেষ্টা করেছি আন্টি, বারবার বলেছে সব বুকিং হয়ে গেছে। কোনও অ্যাকোমোডেশন নেই। কিন্তু কি হলো? সবই যে খালি! কোনও গেস্ট নেই। কি টুপি দিল কে জানে বাবা।’

‘তাহলে গেস্টদের কি কুমিরে খেলো?’ সাথে ছিলের এক ডাক্তার বাবু। তিনিও দেখি সরকারী কর্মচারীদের উপর খড়্গহস্ত হয়ে তেড়ে যান আর কি। নিবাসগুলির কর্মীদের ডেকে প্রচুর ধমকাতে থাকেন, ‘কলকাতা ফিরে তোমাদের মজা আমি বের করছি। নেটে সব ফুল দেখাচ্ছে। দু, দুবার ওটিডিসির অফিসে গেছি বুকিং এর জন্য।বারবার ফিরিয়ে দিয়েছে। এখন দেখি সব খালি! আচ্ছা, গেস্ট এলে খাটতে হবে বলে এই ট্রিক করেছো, না? গিয়েই কমপ্লেন করছি। খালি বসে বসে মাইনে পাবার ধান্দা!’

উত্তরে তারা না রাম না গঙ্গা! আর একটু গিয়ে একটা ওয়াটার বডি, বেশ ঘেরা [না না... পাকাপোক্ত কিছু দিয়ে নয়, রীড আর চট দিয়ে ঘেরা]। বড়সড় অক্ষরে লেখা, ‘সাবধান’। ওই জলে বিভিন্ন প্রজাতির কুমিরের সংকরায়ন ঘটানো হয়। প্রশ্বাস বন্ধ করে জায়গাটা পেরিয়ে এলাম।

এবার ট্যুরিস্ট ইনফর্মেশন সেন্টার। তার পাশে খড় ছাওয়া কি চমৎকার এক গোলঘর! নাম ‘হেঁতাল-হাউস’। হ্যাঁ হ্যাঁ... টুরিস্টদের থাকার জন্যই। কিন্তু ওই যে! সরকারী সম্পত্তিতে আমাদের বিশেষ অধিকার নেই। তাই ভুল তথ্য দিয়ে ওয়েবসাইট ভরিয়ে রাখা হচ্ছে সরকারী দস্তুরের।

ট্যুরিস্ট ইনফর্মেশন সেন্টারে জুতো খুলে ঢুকতে হয়। প্রথমেই নজর কাড়বে একটি ১৯ ফুট লম্বা কুমিরের কঙ্কাল। জঙ্গলে পাওয়া যায় এমন সকল জন্তুর দেহাংশ সুন্দর করে সাজানো আছে। বিশদে বলছি না। নিচে ছবি দিয়ে দিচ্ছি দেখে শুনে, বুঝে নিন। বেশি বললে আবার অ্যানিমাল কিংডম নিয়ে আমার গভীর জ্ঞানের অহেতুক বিচ্ছুরণ ঘটবে! সেটা কি ঠিক? আমি এতই মডেস্ট যে নিজের বিশেষজ্ঞতার[বিশেষ অজ্ঞতার] পরিচয় দিতে লাজে রাঙা হয়ে উঠি।

দিব্যি হাঁটছি। নড়বড়ে দুই হাঁটু এই ঊনিশটি মণ হাসতে হাসতে বহন করছে। বিদ্রোহ করে সন্ত্রাসবাদের লাল চোখ দেখাচ্ছে না একবারও! সামনে যেতেই অপার বিস্ময়। জাল দিয়ে ঘেরা একটি অলমোস্ট সেক্লুডেড জায়গা। জলের রঙ ভয়ানক ঘোলা। বাইরে সাইনবোর্ডে লেখা ‘গোরি’। এই গোরির বিশদ পরিচয় বাইরে লেখা আছে। সে লাইট-কালার্ড ক্রকোডাইল। ১৯৭৫ সালে জন্মেছে। সাদা কুমির কিন্তু অ্যালবিনো নয়।ভিতরকণিকার একেবারে একান্ত আপন প্রজাতি। এ তো গেল বাইরের কথা। অবাক করা কথা হলো, এ কুমিরণী ইন্দ্রিয়জয়ী। যতবার তাকে সঙ্গী যোগানো হয়েছে, ততবারই পত্রপাঠ বিদায় করেছে উপযুক্ত পাত্রটিকে। একবার সেই সাপোজড টু বি মেট এর সাথে ঘোরতর যুদ্ধে একটা চোখ পর্যন্ত খুইয়ে বসে আছে বেচারি যোগিনী! 

কামজয়ী কুমিরাণীর সাথে মোলাকাৎ আর হলো না। উঁকিঝুকিই সার হলো। এখানেও সেই হ্যোয়াইট অ্যারোগান্স। অগত্যা গুটিগুটি পায়ে বোটানুগমন। সাথে একটি ক্লাস এইটে পড়া ছেলে ছিল। তার মা হঠাৎ একটা কুল-গাছ দেখিয়ে প্র্যাক্টিকাল পরীক্ষার পরীক্ষকের মতন প্রশ্ন করলেন, ‘বলতো এটা কি গাছ?’

ছেলের চটজলদি উত্তর, ‘সবুজ গাছ।’ মা চোখ গোলগোল করে হাসি চাপতে ব্যস্ত আর আমরা হেসে কুটিপাটি।

বোট চললো আবার। চলছে তো চলছেই। বাতাস কত গল্পই না বলছে কানে কানে! কিছু গল্প দেখি আমারই গল্প। আবার অন্য এক কূলে ভিড়ল তরীখান। চালক জানালে, ‘তিন কিলমিটার হেঁটে যাবো আবার তিন কিলমিটার হেঁটে ফিরব। যারা যারা হাঁটতে পারবে তারাই শুধু নামবে। বাকিরা বোটে বসে থাকো।’

আরে, দূর দূর! তিন আর তিন - ছয় কিলোমিটারই তো। কি আর এমন হাতি-ঘোড়া! স্মার্টলি নেমে পড়ি। বীর বিক্রমে হাঁটতে থাকি। ঝুঁঝকো আঁধার, ঘন ডালপালা। গাছে গাছে জড়াজড়ি। বনপথে আলোছায়া জাফরি কাটা আলপনা। আহা, সীরিনিটি ওয়াজ অলমোস্ট প্যালপেবাল। কোথাও বসবার জো নেই। মাটিতে এসে পড়ল এক ফ্লোরেসেন্ট সবুজ রঙা পোকা। পাশের ঘাসে দুলছে প্রজাপতি। ডানায় টমেটো লাল রঙের কারুকাজ।

নিঝুম বন। ভয়ানক জানোয়ার কিছু দেখলাম না। নিস্তব্ধতায় অনাদিকালের উদাসীন স্বাক্ষর। বাঁ হাতে পড়ল এক পদ্ম পুকুর। পদ্ম-পাতায় জলের ফোঁটা রোদ্দুরের উষ্ণ আদর মেখে উচ্ছ্বল। উদ্বেল জল-ফোঁটারা তাদের উজ্জ্বলতম হাসি হাসছে আকাশের দিকে তাকিয়ে। হাসিতে ঝরছে চোখ ধাঁধানো হীরে কুচি।

সঙ্গী লেফট্যানেন্টটি দেখি গড়গড় করে পদ্মপুকুরে নেমে যান। কোথা থেকে একটি বছর পনেরোর স্হানীয় ছেলে এসে তাকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে পরিত্রাহি চেঁচায়, ‘কুমির, কুমির’।

নামলে আর রক্ষে ছিল না। আরে টোল ট্যাক্স প্লাজা ওনার আইডেন্টিটি কার্ড দেখে ছেড়ে দিয়েছে বলে কি, কুমিরও ছেড়ে দেবে?

কি সুন্দর সহাবস্থান - জলে কুমির, ডাঙায় মানুষ! আরে এমন একটা পাণ্ডব বর্জিত জায়গায় একটা বাচ্ছা ছেলে এল কি করে? ভোজবাজি? না। এখানে জঙ্গল বেশ হাল্কা। অদূরে একটা প্রসাধন বিহীন ছোট্ট মন্দির। পায়ে পায়ে এগোই। মন্দির এত নিচু যে মাথা ঝুঁকিয়ে ঢুকতে হয়। বনদুর্গার মন্দির। পাথরের সীলমোহরের উপর পাথরে খোদাই করা মূর্তি। ভিতরে পূজারী কোমর বেঁকিয়ে দাঁড়িয়ে আর বাইরে দুজন সবল পুরুষ বসে পিতলের থালায় ফল সাজাচ্ছে। একজন কলাপাতার উপর রাশিকৃত নারকেল কুরিয়েই চলেছে।

দুজনেই অতীব মনোযোগী। পাশে একটি শিব মন্দির। আর আছে ওয়াচ টাওয়ার। দশ পা মতন এগোতেই দেখি পুজোর ভোগ রান্না চলছে। বনদুর্গা, তাই নন ভেজ। মাছ আর ভাত রান্না হচ্ছে।

এ কি, জঙ্গল লাগোয়া ধানক্ষেত! ইকোলজিকাল ব্যালেন্সের হদ্দমুদ্দ এক্কেবারে! পথে পড়ে আছে সজারুর কাঁটা। চিনলাম ষাঁড়া গাছ।ষাঁড়া-সুন্দরী। তিনবার বৌ মারা গেলে না কি ষাঁড়া সুন্দরীকে বিয়ে করে তবে চতুর্থবার দার পরিগ্রহ করতে হয়। বাপরে, এক পাপ চার বার! 

এবার ফেরার পথ ধরি। পথে ঝমঝম বৃষ্টি। গাছের পাতা ছাতা হয়ে আশ্রয় দিল। আর যে পা চলে না ফেরার সময়। ভাবছি বসি। কিন্তু কোথায়? কুমির ধরতে এলে টের পাব কিন্তু সাপ কাটতে এলে যে টেরটুকু পাবো না! কিছু না আসুক, কাঠ পিঁপড়ে কি ছেড়ে কথা বলবে!

হাঁটতে হাঁটতে মনে হচ্ছে দুম করে পড়ে যাবো। কি কষ্ট যে হয়েছে ফিরতে কি বলব! কেঁদে ককিয়ে বোটে ফিরে ঘোষণা করলাম, ‘পা জবাব দিয়েছে। আগামীকাল ভুবনেশ্বরের হোটেলে সারাদিন অন্তরীণ থাকব। কোথাও বেরবো না।’

বোট চলল চাঁদবালির উদ্দেশ্যে। সেই সাত সক্কালে বেরিয়ে ঘাটে ভিড়লাম বিকেল সাড়ে চারটের সময়। চোখ থেকে কোমর আনন্দে উন্মনা কিন্তু পা যে বিলাপ করছে! মনের তিন চতুর্থাংশ ভরপুর কিন্তু বাকি এক চতুর্থাংশ আমার পদ যুগলের বিলাপে গলা মেলাচ্ছে। 

জল থেকে ডাঙায় পা দিয়েই আবার বাহনে আসীন হতে হলো। গন্তব্য ভুবনেশ্বর। না এবার আর ওরকম ভয়ঙ্কর রাস্তা দিয়ে নয়, এবারে জাজপুরের রাস্তা ধরল গাড়ি। ফিরতি পথ যুবতীর ত্বকের মতন নিভাঁজ, মসৃণ। কিন্তু পথশ্রমে হাক্লান্ত আমি গাড়িতে এমন ঘুম ঘুমোলাম যে, বার চারেক মাথা ঠুকে গেল, ঠকাস ঠকাস।
























































2 comments: