0

ছোটগল্প - ঈপ্সিতা মণ্ডল

Posted in


ছোটগল্প


শিউলি
ঈপ্সিতা মণ্ডল


এক যে ছিল ছোট্ট শিউলি গাছ। তল্লাটের চিনি-চড়াই সোহাগ করে তার নাম রেখেছিল শিউলি-ফুলি।

শিউলি-ফুলির আজকাল মনে ভারি আনন্দ – শরৎ এসেছে যে। তার ডালপালা শাখাপ্রশাখা সব সেজে উঠেছে সাদা-পাপড়ি হলোদে-ডাঁটি শিউলি ফুলে। সেই ফুলেই তো জগজ্জননী মা দুর্গার পূজা হবে।

শিউলি-ফুলি বাতাসের তালে তালে ডালপালা নাড়ায় আর সারাদিন ভাবে, "কবে মায়ের পুজোর তিথি আসবে?”। রাতের বেলায় কন্যা-শরৎ এসে গাছের পুরানো ফুল তুলে নিয়ে নতুন কুঁড়ি দিয়ে যায়। তারপর ঊষা-দিদি আসবার সাথে সাথে শিউলি-ফুলির সারা অঙ্গ আবার ভরে ওঠে শিউলি ফুলে। এভাবেই কাটে কিছুদিন।

অবশেষে আসে মহাষষ্ঠী – মায়ের বোধন আজ। দুপুর রাতে শরৎ-দিদি এসে সব শিউলি ফুল তুলে নিল; ঠিক তখনি দখিণা-বাতাস এসে শরৎ-দিদিকে খবর দিল -- “দিদি, সর্বনাশ হয়ে গেছে! দক্ষিণপুর গাঁয়ের ঝাঁকড়া-শিউলি গাছের অবস্থা খুব খারাপ। ছেলের দল এসে তার ডালপালা তছনছ করে সব ফুল তুলে নিয়ে গেছে। এমনকি কুঁড়িগুলোও ছাড়েনি। এখন ঝাঁকড়া গাছে যদি ফুল না ফোটে, তবে গ্রামের লোকে কোথা থেকে মা-দুর্গার পুজোর জন্য শিউলি ফুল পাবে? গাঁয়ে তো শিউলি গাছ বলতে ওই একটিই। তুমি যাহোক কিছু একটা ব্যবস্থা করো।” বৃত্তান্ত শুনে শরৎ-কন্যা তখনি পড়িমরি করে ছুটল দক্ষিণপুরের পানে। দখিণা-বাতাস কন্যাকে উড়িয়ে নিয়ে চলল বিদ্যুৎ-গতিতে। এই ফাঁকে শরৎ-দিদি ভুলে গেল শিউলি-ফুলির ডালে কুঁড়ি দেওয়ার কথা। 

শিউলি-ফুলি নেড়া ডালপালা নিয়ে উদাস-নয়নে চেয়ে রইল দক্ষিণ দিকে, যে দিকে শরৎ-দিদি অদৃশ্য হয়েছে। 

ভোররাতে ঊষা-দিদি সোনার শাড়ি পরে মেঘের ঘোমটা খুলে বেরিয়ে এলেন আকাশে। তাঁর রূপের ছটায় দশদিক আলোকিত। সেই আলোর ছোঁয়াচ লাগতেই সকল শিউলি গাছের না-ফোঁটা কুঁড়িগুলো চোখ মেলে তাকাল। এমনকি ঝাঁকড়া-শিউলি গাছেও ফুল ফুটল, ... কিন্তু, ফুটল না শুধু আমাদের ছোট্ট শিউলি গাছে। "হায় মোর কপাল!”, বলে শিউলি-ফুলি মনে মনে কাঁদে। পাড়ার ছেলেরা এসে দেখে গাছে একটাও ফুল নেই। পড়া ফুল দিয়ে কি আর মায়ের পুজো হয়? তাই তারা নিরাশ হয়ে চলে হাটের উদ্দেশ্যে। অন্যান্য ফুল-ফল-পাতার সাথে এ বছর শিউলি ফুলও কিনতে হবে।

শিউলি-ফুলির বুক ভেঙ্গে গেল; বাতাসের তালেতালে আর ডালপালা দোলাল না সে। সে ভাবল, “এ বছর কি তবে মা আমার ওপর বিরূপ হলেন? কি এমন দোষ করলাম আমি?” চিনি-চড়াই এসে শুধাল, “কি রা শিউলি-ফুলি, আমায় তোর ডালে বসিয়ে নাচাবিনে? কি হলো তোর?” শিউলি-ফুলি তখন তার মনের দুঃখের কথা চিনি-চড়াইকে খুলে বলল। চিনি সব শুনেটুনে বলল, “কি আর করবি বল, মঙ্গলময়ী যা করেন মঙ্গলেরই জন্যে। আজ মায়ের বোধন, খামোখা মন খারাপ করিসনে। দেখিস, কাল তোর ডালে অনেক অনেক ফুল ফুটবে।” চিনি-চড়াইয়ের সান্ত্বনা পেয়ে শিউলি-ফুলি কিছুটা শান্ত হলো। 

খানিক বেলা বাড়ল। শিউলি-ফুলি আর চিনি-চড়াই দেখলে যে পাড়ার বস্তির কিছু ছোট ছেলেমেয়ে হইহই করতে করতে তাদের দিকেই এগিয়ে আসছে। চিনি-চড়াই তখন গাছকে বলল, “জানিস ফুলি, এই বছর না পাড়ার এই বস্তির ছেলেমেয়েগুলি নিজেরাই প্রতিমা গড়ে পুজো করছে। ওরা হরিজন বলে বামুন-ঠাকুর ওদের ঘরে পুজো করতে নারাজ। তাই উড়িয়া-পাড়ার উড়ে বামুনকে ধরেকরে ওরা পুজো করার জন্যে রাজি করিয়েছে।” কিছুক্ষণের মধ্যে সেই ছেলেমেয়ের দল গাছের গুঁড়ির কাছে এসে পৌঁছাল। তারপর তারা সবাই মিলে প্রবল উৎসাহে মাটিতে পড়ে থাকা শিউলি ফুল কুড়োতে লাগল। তাদের পুজোর ফুল-পাতা কেনার মত অত পয়সা নেই। এখানওখান থেকে গাছের ফুল, বেলপাতা, তুলসীপাতা আর ফল জোগাড় করেই পুজো করতে হবে। 

তার ফুল পুজোর কাজে লাগবে জেনে শিউলি-ফুলির আর আনন্দের সীমা রইল না। চিনি ফুলিকে বলল, “দেখলি তো, মা তোর দুঃখ বুঝেছেন। নে, আমি গান ধরি আর তুই নাচ। তোর ফুল দুঃখীদের কাজে লেগেছে। ওদের কাছে এই সামান্য ফুলেরই অনেক মূল্য। এর চেয়ে আনন্দের বিষয় আর কি হতে পারে? বড়লোকদের পুজোর ফুলের চেয়ে গরিবদের পুজোর ফুলই আনন্দময়ীর বেশী প্রিয়।” 

খানিকক্ষণ পর ছেলেমেয়েরা ফুল নিয়ে লাফাতে লাফাতে ফিরে চলল। শিউলি-ফুলির মনে হলো যে এই বছরের পূজাই তার জীবনের শ্রেষ্ঠ পূজা।


0 comments: