1

ধারাবাহিক - অমিতাভ প্রামাণিক

Posted in


ধারাবাহিক


সূর্যোদয়ের প্রাক্কালে
অমিতাভ প্রামাণিক



। আট ।



অষ্টাদশ শতাব্দী – সে ছিল এক অন্যরকম সময়। বাংলায় নগর তখন মুষ্টিমেয় কয়েকটি মাত্র, হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে অধিকাংশ মানুষ যাপন করত সাধারণ গ্রাম্য জীবন। হিন্দু মানুষের জীবন চলত হিন্দু দর্শন কেন্দ্র করে, গীতা-পুরাণ-মনুসংহিতা মেনে। অপরপক্ষে মুসলমানদের জীবন ছিল কোরাণ-হাদিস-শরিয়তকেন্দ্রিক। এই দুইয়ের মধ্যে সামগ্রিক মিল না থাকলেও বাঙালির বাঙালিয়ানা ছিল হিন্দু-মুসলমান ঐক্যের মূলভিত্তি। অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থানে তাদের মধ্যে বিশেষ পার্থক্য ছিল না। 

বাঙালিকে চেনা যেত তার খাদ্য পছন্দের বিচারে। সে খাদ্য ছিল অতি সাধারণ, তবে কী হিন্দু, কী মুসলমান, সকল বাঙালির পছন্দের খাদ্য ছিল ভাত, মাছ, মাংস, ডাল, শাকসব্জি, ফল, দুধ, ঘি, সরষের তেল, দই, মিষ্টি। গম বা যবের প্রচলন ছিল না বললেই চলে। ভাতের পাতে কাঁচালঙ্কা ও লবণ পছন্দসই ছিল। বেগুন, শাকসব্জি, লেবু একসাথে ফুটিয়ে ঠাণ্ডা জলে ডুবিয়ে পরদিন লবণ দিয়ে খাওয়ার চল ছিল। আর ছিল লুচির সাথে মিষ্টি – জিলিপি, খাজা, বাতাসা, সরভাজা, মণ্ডা, সন্দেশ। 

ভারতচন্দ্রের অন্নদামঙ্গলে যে খাদ্য রন্ধনের বিবরণ আছে, তার তালিকা দেখলেই বোঝা যাবে সে যুগের ভোজনবিলাস। তার শুরু শাক ডাল ও নানাবিধ নিরামিষ খাদ্য দিয়ে –

হাস্যমুখে পদ্মমুখী আরম্ভিলা পাক।
শড়শড়ি ঘন্ট ভাজা নানামত শাক।।
ডালি রান্ধে ঘনতর ছোলা অড়হরে।
মুগ মাষ বরবটি বাটুল মটরে।।
বড় বড়ি কলা মূলা নারিকেল ভাজা।
দুধ থোড় ডালনা সুক্তানি ঘন্ট তাজা।।
কাটালের বীজ রান্ধে চিনি-রসে গুঁড়া।
তিল পিটালিতে লাউ বার্তাকু কুমড়া।।

এরপর অনিবার্যভাবে এসে যেত মাছের বিভিন্ন পদ। কী তার বৈচিত্র্য –

নিরামিষ তেইশ রান্ধিলা অনায়াসে।
আরম্ভিলা বিবিধ রন্ধন মৎস্য মাংসে।।
কাৎলা ভেকুট কই ঝাল ভাজা কোল।
শিকপোড়া ঝুরা কাঁটালের বীজে ঝোল।।
ঝাল ঝোল ভাজা রান্ধে চিতল ফলই।
কই মাগুরের ঝোল ভিন্ন ভাজে কই।।
মায়া সোনাখড়কির ঝোল ভাজা সার।
চিংড়ির ঝাল বাগা অমৃতের তার।।
কণ্ঠা রান্ধি রান্ধে কই কাৎলার মুড়া।
তিতা দিয়া পচা-মাছে রান্ধিলেক গুঁড়া।।
আম্র দিয়া শোল মাছে ঝোল চচ্চড়ি।
আর রান্ধে আদা-রসে দিয়া ফুলবড়ি।।
রুই কাৎলার তৈলে রান্ধে তৈল শাক।
মাছের ডিমের বড়া মৃতে দেয় ডাক।।
বাটার করিলা ঝোল খয়রার ভাজা।
অমৃত অধিক বলে অমৃতের রাজা।।
সুমাছ বাছের মাছ আর মাছ যত।
ঝাল ঝোল চড়চড়ি ভাজা কৈলা কত।।

ডিমের তেমন প্রচলন ছিল না, কাছিমের ডিম ছাড়া। আর এর পর মাংস –

বড়া কিছু সিদ্ধ কিছু কাছিমের ডিম।
গঙ্গাফল তার নাম অমৃত অসীম।।
কচি ছাগ মৃগমাংসে ঝাল ঝোল রসা।
কালিয়া দোলমা বাগা সেকচি সমসা।।
অন্য মাংস শিকভাজা কাবাব করিয়া।
রান্ধিলেন মুড়া আগে মসলা পুরিয়া।।

তারপর অম্বল –

মৎস্য মাংস সাং করি অম্বল রান্ধিলা।
মৎস্য মূলা বড়া বড়ি চিনি আদি দিলা।।
আম আমসত্ত্ব আর আমসি আচার।
চালিতা, তেঁতুল কুল আমড়া মান্দার।।

শেষে বিবিধ মিষ্টান্ন –

অম্বল রান্ধিলা বামা আরম্ভিলা পিঠা।
সুধা বলে এই সঙ্গে আমি হব মিঠা।।
বড়া এলো আসিকা শীযুষী পুরি পুলি।
চুষি রুটি রামরোট মুগের শামুলি।।
কালবড়া ঘিয়ড় পাপড় ভাজা পুলি।
সুধারুচি মুচমুচি পুচি কতগুলি।।
পিঠা হৈল পরে পরমান্ন আরম্ভিলা।
চালু চিনা ভুরা রাজবর চালু দিলা।।
পরমান্ন পরে খেচরান্ন রান্ধে আর।
বিষ্ণুভোগ রান্ধিলা রান্ধুনী লক্ষ্মী যার।।

এ সব রান্না শেষ হয়ে গেলে শুরু হ’ত অন্নপাক, অর্থাৎ ভাত রান্না। বিভিন্ন চালের ভাত –

অতুলিত অগণিত রান্ধিয়া ব্যঞ্জন।
অন্ন রান্ধে রাশি রাশি অন্নদামোহন।।
মোটা সরু ধানের তণ্ডুল তরতমে।
আশু বোরো আমন রান্ধিলা ক্রমে ক্রমে।।
দলকচু ওলকচু ঘিকলা পাতরা।
মেঘহাসা কালামনা রায় পানিভরা।।
কালিন্দী কনকচূড় ছায়াচূড় পুদি।
শুয়া শাহী হারলেবু গুয়াখুরি সুঁদি।।
বিশালি পোয়াল বিড়া কলামোচা আর।
কৈজুড়ি খাবুরছড়ি চিনা ধলবার।।
দাসুসাহি বাঁশফুল ছিলাট করুচি।
কেলেজিরা পদ্মরাজ দুধরাজ লুচি।।
কাঁটারাঙ্গি কোঁচাই কপিলভোগ রান্ধে।
ধূলে বাঁশ গজাল ইন্দ্রের মন বান্ধে।।
বাজাল মরীচশালি ভুরা বেণাফুল।
কাজলা শঙ্করচিনা চিনি সমতুল।।
মাকু মেটে মসিলোট শিবজটা পরে।
দুধপনা গঙ্গাজল মুনিমন হরে।।
সুধা দুধকমল খড়িকামুটি রান্ধে।
বিষ্ণুভোগ গন্ধেশ্বরী গন্ধভার কান্দে।।
রান্ধিয়া পায়রারস রান্ধে বাঁশমতি।
কদমা কুসুমাশালি মনোহর অতি।।
রমা লক্ষ্মী আলতা দানার গুঁড়া রান্ধে।
জুতী গন্ধমালতী অমৃতে ফেলে বান্ধে।।
লতামউ প্রভৃতি রাঢ়ের সরু চালু।
রসে গন্ধে অমৃত আপনি আলুথালু।।

রাজারাজড়ারা ভোজনবিলাসী ছিলেন, তারা চর্ব-চোষ্য-লেহ্য-পেয় গ্রহণ করতেন ইচ্ছামত। ভোরবেলা কালো গরুর দুধ দুইয়ে তার ননী থেকে ঘি বানিয়ে দেওয়া হতো রাজা কৃষ্ণচন্দ্রকে। 

হিন্দু শাক্তরা ছাগ, মেষ ও মৃগমাংস খেত, তবে সাধারণত তা পুজোর বলির প্রসাদ হিসাবে। বিধবারা নিরামিষ খেত, তারা ছিল একাহারী। বৈষ্ণবরা মাংস স্পর্শ করত না, অনেকে মাছও না। গরীবদের কাছে শাকান্নই ছিল পরমান্ন। 

তবে এসব সাধারণ খাদ্যাদির সঙ্গে সমাজে নেশার বস্তু গ্রহণেরও ব্যাপক প্রচলন ছিল। তামাক ছিল ঘরে ঘরে, হুঁকা আর গড়গড়ায়। এছাড়া আফিং, গাঁজা, সিদ্ধি, ভাঙ, তাড়ি ও দেশি মদের প্রসার ছিল। মদের তুলনায় অবশ্য তামাক, সিদ্ধি, গাঁজা লোকে বেশি খেত। চাষি ও মজুররা তাল ও খেজুরের রসের তাড়ি খেত, ধনীরা এসব ঘৃণা করত। তারা খেত মদ, আফিং, ভাঙ। সিদ্ধি খাওয়াকে কেউ অসামাজিক বলে ভাবত না। 

বিদেশী বণিকদের আগমনের ফলে বাংলায় এ সময় বিদেশী মদের প্রচলন শুরু হয়। তাদের ভিন্ন ভিন্ন নাম – মদিরা, ব্র্যান্ডি, শেরি, হুইস্কি, জিন, ক্লারেট, পোর্ট, শ্যাম্পেন। আড়াই টাকায় এক এক বোতল ব্র্যান্ডি, হুইস্কি বা জিন পাওয়া যেত, তিন টাকা দিলে অন্যগুলোর বোতল। মূল্যবান শ্যাম্পেন পাওয়া যেত বোতলপ্রতি ছ’টাকায়।

অন্নের পর বস্ত্র। সাধারণ গ্রাম্য বাঙালির পোশাক মানে একবস্ত্র – সে পুরুষ হোক বা নারী। বৃষ্টি-বাদলায় বা গরমে-ঠাণ্ডায় তারা কষ্ট পেত খুবই। মাথায় পাগড়ি পরার প্রথা ছিল তখন পুরুষদের, তার প্রকরণ অবশ্য আলাদা, মাথার ওপর চুল দেখা যেত। পুরুষদের পরণে ধুতি, ঊর্ধাঙ্গ অনাবৃত, নারীর পরণে একমাত্র শাড়ি। কারও জন্যই কোনওরকম অন্তর্বাসের বালাই ছিল না। মহিলারা মাথায় ঘোমটা দিত না। উচ্চবংশীয় নাগরিক অভিজাতরা একমাত্র জুতো-মোজা পরত, তাদের গায়ে শাল-দোশালা উঠত। গ্রামের মহিলারা ঘরে বন্দী ছিল না, তারা রীতিমত বাইরে যেত এবং হাটবাজারও করত। সর্ষের তেল মেখে পুকুরে বা নদীতে স্নান করত সবাই। 

সুখ-দুঃখের সেই জীবনের গান শুনিয়েছেন সাধক রামপ্রসাদ –

কেহ দিনান্তরে পায় না খেতে
কারো পেটে ভাত কারো গেঁটে সোনা।।
কেহ যায় মা পালকি চড়ে
কেহ তারে কাঁধে করে।
কেহ গায়ে দেয় শাল দোশালা
কেহ পায়না ছেঁড়া টেনা।।

নগরাঞ্চলে পুরুষের পোশাক গরমকালে ধুতির সঙ্গে দোবজা বা একপাট্টা এবং শীতে ধুতির সঙ্গে হামাম বা দস্তানা, কখনও গায়ে বেনিয়ান বা মেরজাই, মাথায় টুপি বা উষ্ণীষ। প্রবীণরা ভোরবেলা বনাৎ, রাতে রেজাই ব্যবহার করত। তরুণদের শীত নিবারণের পোশাক ছিল দোলাই। অত্যন্ত অভিজাত মানুষেরা ব্যবহার করত রুমাল, শাল, জামেয়ার। মহিলাদের বেশি শীত লাগলে একটা শাড়ির ওপর আর একটা শাড়ি জড়িয়ে নিত। 

অভিজাত নাগরিকদের অনেকে নবাবী পোশাক পরত – জামা, ইজের, পাগড়ি। রাজার বাড়ির মহিলারা সাধারণত সুতির শাড়ি পরতেন, কিন্তু শুভকাজে তাদের অঙ্গে উঠত কাঁচুলি, ঘাগরা, ওড়না। শীতকালে তারা ব্যবহার করতেন মূল্যবান কৌষেয় ও রান্ধব বস্ত্র, পায়ে চামড়ার পাদুকা। শান্তিপুরে সূক্ষ্ম তাঁতের ধুতি-শাড়ি তৈরি হতো, ঢাকায় তৈরি হয় অতিসূক্ষ্ম শবনম, মসলিন নামে তা বিদেশে রপ্তানি হ’ত চড়াদামে। সূক্ষ্ম বস্ত্র পরার চল ছিল না বাঙালি হিন্দু সমাজে। বাংলার তাঁতিরা যে কাপড় বুনত, তা দিয়েই চাহিদা মিটে যেত বাঙালিদের। 

তবে বিত্তশালী মহিলাদের অলঙ্কার পরার ঘটা ছিল চিরকালই। নাকে নথ, কানে মাকড়ি, ঝুমকা বা কর্ণফুল, গলায় পাঁচনরী, সাতনরী বা কণ্ঠমালা, প্রভৃতি স্বর্ণালঙ্কার ও বাহুতে তাড়, হাতে বাউটি, গজরা, রশুন, কুশী, কঙ্কণ, পুঁইচা, কোমরে গোট বা চন্দ্রহার, পায়ে মল, পায়ের আঙুলে পাশুলি, ইত্যাদি রৌপ্যালঙ্কারে নিজেদের সাজাতে ভালবাসত তারা। 

গঙ্গাদাসের গঙ্গাভক্তিতরঙ্গিনীতে বিবাহিতা নারীদের সেই অলঙ্কারের বর্ণনা –

ঢেড়ি চাঁপি মাকড়ি কর্ণেতে কর্ণফুল।
কেহ পরে হীরার কমল নহে তুল।।
নাসিকাতে নথ কার মুক্তা চুনী ভাল।
লবঙ্গ কেশরে কার মুখ করে আলো।।
কিবা গজমুক্তা কারো নাসিকায় ঝোলে।
দোলে সে অপূর্বভাবে হাসির হিল্লোলে।।
কুন্দ কলিকার মত কার দন্তপাতি।
দাড়িম্বের বীজ মুক্তা কার দন্তভাতি।।
মুখশোভা করে কার মন্দ মন্দ হাসি।
সুধার সাগরে ঢেউ হেন মনে বাসি।।
পড়িল গলায় কেন তেনরী সোনার।
মুকুতার মালা কণ্ঠমালা চন্দ্রহার।।
ধুকধুকি জড়াও পদক পরে সুখে।
সোনার কঙ্কণ কার শঙ্খের সম্মুখে।।
পতির আয়ত চিহ্ন সোহাগ যাহাতে।
পরাণ বাঁধন লোহা সকলের হাতে।।
পাতা মল পাসুলি আঙট বিছা পায়।
গজরীপঞ্চম আর শোভা কিবা তায়।।

এর সঙ্গে ছিল রূপচর্চার ঘটা, বিশেষ করে উচ্চবিত্ত মহলে, পুরুষ নারী নির্বিশেষে। স্ত্রীলোকরা ব্যবহার করত কুমকুম, কস্তুরী, জাফরান, যাদের সঙ্গতি কম, তারা গায়ে চন্দন লেপত। কেউ কেউ চন্দনের সাথে মিশিয়ে নিত মৃগনাভি বা মুচকুন্দ। চাঁপা বা কোয়ার রেণু, কাঁচা হলুদ, কাবাবচিনি, খাঁড়ি মুসুরি বা কালোজিরে, ইত্যাদি দুধের সরে মিশিয়ে গায়ে লাগাত ত্বকের যত্ন নিতে। নদীয়ার মহিলাদের নিয়ে প্রবাদ আছে – উলার মেয়ে কুল কুনুটি, নদের মেয়ের খোঁপা / শান্তিপুরের নথ নাড়া আর গুপ্তিপাড়ার চোপা। 

ব্রাহ্মণ পুরুষরা মাথায় ঝুঁটি রাখত, সে ঝুঁটির চুল নানাভাবে পিঠে লতিয়ে যেত, তার যত্ন নেওয়া হতো প্রতি একাদশীতে। পণ্ডিত, পুরোহিত, বৈদ্যরা ভ্রুর চুল অনেকখানি কামিয়ে ফেলত, গোঁফ রাখত না। তান্ত্রিক ব্রাহ্মণরা দাড়ি রাখত। ব্রাহ্মণ মাত্রেই টিকি রাখত তো বটেই, জল-চল সমস্ত জাতিই যেমন বৈদ্য, কায়স্থরাও টিকি রাখত। শূদ্রদের মাথায় টিকি ও গলায় কণ্ঠি না থাকলে ব্রাহ্মণরা তাদের হাতের জল গ্রহণ করত না।

বস্তুত পুরুষদের রূপচর্চার অধিকাংশ অংশই ছিল চুল-দাড়ি-গোঁফের বাহার নিয়ে। বাবরি-কাটা চুল রাখত অনেকেই। সামনে ছোট করে কেটে পেছনে লম্বা লতানে চুল রাখা ছিল ফ্যাশন। ব্রহ্মতালুর খানিকটা কামিয়ে সেখানে অনেকে চন্দন, তিলবাটা, গোলাপের প্রলেপ দিত। দাড়ি-গোঁফের তদ্বির করত। অনেকে মুখের দুপাশে বিশাল জুলফি বা গালপাট্টা রাখত। 

অন্ন-বস্ত্রের পর আবাস। আর্থিক সচ্ছলতা অনুযায়ী বাঙালি ঘরবাড়ি বানাত। গ্রামের বাড়ি মানে বাঁশের বা মাটির দেওয়াল, খড়েরচাল। যাদের অবস্থা একটু সচ্ছল, তাদের বাড়ি দোতালা, ইঁট-চুন-সুরকির। ঘরে সাধারণ আসবাবপত্র, বাহুল্যবর্জিত। গ্রামে ব্যবহার হতো মাটির বাসনপত্র, ধনীগৃহে পিতল বা কাঁসার। অভিজাতরা তাম্রপাত্রে আহার গ্রহণ করত। হিন্দু-মুসলমান সব অভিজাত ঘরেই কাঠের সোফা, কার্পেট, লেপ প্রভৃতি ছিল। দরিদ্রদের ঘরে থাকত মাদুর, পাটি, শীতলপাটি, চট। পুজো পার্বণে রাজা রাজড়ারা কাঁসা-পিতল-তামার বাসন ব্যবহার করতেন, সেগুলোর উৎস ছিল নবদ্বীপের কাঁসারিরা। অধিকাংশ ধাতব বাসনপত্রে কারুকার্য করা থাকত। যাতায়াতের জন্য ছিল পালকি, জোবলা, গোযান, হাতি। ঘোড়া ছিল ব্যয়বহুল, তাই অতীব ধনীরাই ব্যবহার করত। নদীপথে যাতায়াতের জন্যে ছিল নৌকা, বজরা, পানসি। ভদ্রঘরের স্ত্রীলোকেরা পালকি বা ডুলিতে চড়ে দরকারে অন্যত্র যেত। 

পারিবারিক প্রথা ও বিনোদন, গান-বাজনা, চিকিৎসা, পুজো-আচ্চা ও ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান – সব মিলিয়ে মিশিয়ে মোটামুটি এক শান্তির বাতাবরণ ছিল সেই বাংলায় বর্গী আক্রমণের আগে অবধি। অবশ্য অনেক কুপ্রথাও চালু ছিল। কিছু কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া হিন্দু-মুসলমান উভয় সমাজে নারীর স্থান ছিল অনেক নীচে, তাদের পিতা বা স্বামীর সম্পত্তির অধিকার ছিল না। ক্রীতদাস প্রথা চালু ছিল। চালু ছিল গৌরীদান অর্থাৎ শিশু-বিবাহ, কুমারীপূজা, জাতিভেদ, সতীদাহ, অন্তর্জলি যাত্রা, গঙ্গাজলি। বাঙালিদের মধ্যে চতুর্বণের দুই বর্ণ – ক্ষত্রিয় ও বৈশ্য – দেখা যেত না, ফলে ব্রাহ্মণ ও শূদ্র, এই দুই বর্ণেরই আধিক্য ছিল। শূদ্রদের আবার তিন ভাগ – উত্তম সঙ্কর বা জল-চল, মধ্যম সঙ্কর বা জল-অচল এবং অধম সঙ্কর বা অস্পৃশ্য। বৈদ্য ও কায়স্থরা ছিল উত্তম সঙ্কর। কায়স্থদের মধ্যে ব্রাহ্মণদের মত কুলীন ছিল। জল-অচলদের হাতে ব্রাহ্মণরা জল গ্রহণ করত না এবং নীচু শ্রেণির ব্রাহ্মণরাই এদের পুজো-পার্বণে পুরোহিতের কাজ করত। মুসলমানদেরও তেমনি তিন ভাগ – আশরাফ, আতরাফ, আরজল। শেখ, সৈয়দ, পাঠান, মোগল হলো আশরাফ, এরা উচ্চশ্রেণি। চাষা, মজুর, কারিগর, শিল্পী, দোকানি, তাঁতী হচ্ছে আরতাফ মানে মধ্যম। চামার, বেদে, বাজিকর হচ্ছে আরজল বা পতিত। 

হিন্দু বা মুসলমান সমাজে নিজেদের মধ্যে বাচ-বচার চালু থাকলেও হিন্দু-মুসলমান বিবাদ ছিল খুবই কম। সেই অর্থে স্বাভাবিক কষ্টে ক্লিষ্ট বাঙালি সমাজে এক ধরণের শান্তি ছিল। 

তাতে এসে গেল ইংরেজ কম্পানির শাসন। শুরু হ’ল অশান্তি। 





(চলবে)

1 comment:

  1. চমৎকার অমিতাভবাবু! অসাধারণ হচ্ছে।

    ReplyDelete