0

ধারাবাহিক - সুবল দত্ত

Posted in


ধারাবাহিক


প্রতিস্রোত
সুবল দত্ত



॥৫॥ 



হিংসার মহড়ায় কাঁপে জতুগৃহের মাটি দর্ভে সৈনিকের আঙুলে ট্রিগার



মেজর জেনারেল সৌমজিত দাস

শিমুলিয়া বস্তির পাশে এক বিশাল গ্রীন গল্ফ গ্রাউন্ডের মত মসৃণ মাঠের উপর দু রকমের ছাউনি। তাঁবুর রঙ দেখলেই বোঝা যায় দুটি ভিন্ন দেশের। দুরকমের ছাউনির মধ্যে দূরত্ব একটু বেশিই। তবে সপাট সমতল ঘাসভূমির জন্যে খুব কাছাকাছি মনে হয়। অনেকগুলি অত্যাধুনিক ট্যাংক সাঁজোয়া গাড়ি এবং মিলিটারী ট্রাক ও জীপ। পাহাড়ের দিকে মুখ করে দু'ধরনের ট্রেঞ্চ খোঁড়া হয়েছে। দুদিকের ছাউনির পাশে বেশ কয়েক রকমের বালির বস্তার দেওয়াল। সেগুলোর পাশে আধুনিক রকেট লঞ্চার ও মেশিনগান ফিট করা। দুদিকে দুরকমের প্রচুর মিলিটারি কনভয়। এবারের মহড়ার নাম অসুরনিধন। চারতারার জেনারেল চিফ অফ আর্মি স্টাফের কমাণ্ডে ভারতীয় টিম রাশিয়ান আর্মির সহযোগে যুগ্ম অভ্যাস হবে এবার শিমুলিয়াতে। এই আদেশটি অনুমোদন করেন দেশের প্রেসিডেন্ট। তিনিই আসলে সুপ্রীম কমাণ্ডার। এই যুগ্ম অভ্যাসে প্রায় দেড়শো ভারতীয় স্থলসেনা ভাগ নিচ্ছে। এই প্র্যাকটিসের একটি উল্লেখযোগ্য বিশেষত্ব হলো, অন্তিম চরণে উগ্রবাদী ধরা এবং মারার জন্য এই বিস্তীর্ণ এলাকায় যৌথ ভাবে চিরুনি তল্লাশি চালানো হবে। আপাত দৃষ্টিতে অভ্যাসজনিত নাটক বা নিছক কল্পিত মহড়া,কিন্তু আসলে তা বাস্তবমুখী। এই সময় একটা যে এন্টিটেররিস্ট অপারেশন ও ড্রিল চালানো হবে তাতে দুচারজন খুনখার পলাতক দাগী খুনী জঙ্গল ম্যান যে ধরা পড়বে ও মারা যাবে অন্তত সে বিষয়ে সমু নিশ্চিত। সমু মানে গোরাচাঁদ দাসের পুত্র মেজর জেনারেল সৌমজিত দাস। 

ভারতীয়দের পঁচিশটারও বেশি তাঁবুর মধ্যে যেটার মাথায় জাতীয় পতাকা পতপত করে উড়ছে, সেটা মেজর জেনারেল সৌমজিতের বাতানুকূল অফিস ঘর। তাঁবুর বাইরে চার কোণায় চারজন রক্ষাকর্মী এ কে সাতচল্লিশ কাঁধে মোতায়েন। একজন নায়েব সুবেদার ও দুজন লেন্স নায়েক সিপাহী বাইরে দাঁড়িয়ে। ওদের সাথে পাঁচজন রাশিয়ান ফৌজী ওদের পদমর্যাদা হিসেবে ভিন্ন ভিন্ন তকমা এঁটে অস্ত্রশস্ত্রে সেজে দাঁড়িয়ে রয়েছে তাঁবুর বাইরে। ভিতরে লাল কার্পেটবিছানো মেঝের উপরে এক বেশ বড় টেবিলে দুহাতে চিবুক রেখে সমু বসে। তার সামনে বসে এক উচ্চপদস্থ রাশিয়ান অফিসার। পাশে দাঁড়িয়ে এক দ্বিভাষী ইন্টারপ্রেটর। বয়েস হিসেবে সৌমজিত খুব কম সময়ে আশাতীত ভাবেই এত উঁচু পদে পৌঁছে গেছে যে মিলিটারি হায়ারারকিতে বিরল দৃষ্টান্ত। এই লাইনে বেশিরভাগ অফিসারই কর্নেল অব্দি প্রোমোশন হয়ে রিটায়ার হয়ে যায়। এন ডি এ তে ইঞ্জিনিয়ারিং এ টপ করে তার দু বছরের মধ্যে একাডেমিতেই থেকে ম্যানেজমেন্টে টপ করে খুব প্রশংসার অধিকারি হয়েছিল। মেজর পোস্টে রিক্রুটেড হওয়ার এক বছরের মধ্যেই সিরিয়া লেবাননে টাস্কফোর্সে গিয়ে খুব নাম কামিয়ে যখন দেশে ফিরেছিল তখনই সে দুধাপ পেরিয়ে ব্রিগ্রেডিয়ারের পোস্টে উন্নত হয়ে গিয়েছিল। এই হালে, ২০১৫ তে আমেরিকায় নতুন ক্ষেপণাস্ত্র ও তার ব্যবহার বিষয়ে দু দেশের পদাতিককে বিশেষ ট্রেনিং করিয়ে তার খুব নাম হলো। সেই সময়ে, বহু বছর ধরে দক্ষিণ আমেরিকা এবং এফ এ আর সি গেরিলাদের প্রচণ্ড লড়াই চলছিল। সেখানে ভারতীয় সেনাদের সাথে আমেরিকান সৈন্যদের একটা যুগ্ম অভ্যাস চলছিল আমেরিকার জয়েন্ট বেস লিউইস ম্যাক কর্ড এ। নাম ছিল যুদ্ধ অভ্যাস ২০১৫। ভারতীয়দের একটা ছোটো টুকড়ি সৈন্য নিয়ে ব্রাজিলে সেই FARC গেরিলাদের একটা বড়সড় দলকে নাস্তানাবুদ করে দিয়ে ওদের আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য করেছিল ব্রিগ্রেডিয়ার সৌমজিত। দেশে ফিরেই বর্ষশেষে তাকে মেজর জেনারেলের পদে সন্মানিত করা হয়।

মেজর জেনারেল সৌমজিত একদৃষ্টে তাকিয়ে তার সামনে বসা রাশিয়ান অফিসারটির দিকে। র‍্যঙ্ক হিসেবে দুজনের ক্ষমতা সমান সমান। এমনিতে মিটিং হলে বেশ কয়েকজন ভারতীয় ও রাশিয়ান পদস্থ অফিসার একসাথে বসেন। কার্যসূচী নিয়ে কথা হয় এবং রুটিন। কিন্তু আজ হঠাত্‍ একা একা এরকম একটা এপয়েণ্টমেন্ট কেন নিয়ে বসলেন? কী বলার আছে? কি বলার থাকতে পারে? ভেবে কুলকিনারা পেল না সমু। 

রাশিয়ান অফিসারটি মুখ নিচু করে বসেই আছেন। ইন্টারপ্রেটর লোকটি বাঙালি। বেশ শান্তশিষ্ট ভদ্রলোক কিন্তু সমুর ভালোলাগে না তাকে।ও একটু বেশিই আবেগপ্রবণ। একটু মাত্রাতিরিক্ত সাম্যবাদী। আর সবচেয়ে অস্বস্তির কারণ হলো এ লোকটা আবার বাংলা সাহিত্য চর্চা করে। বাবার সমস্ত অবগুণগুলোই ওই লোকটার মধ্যে রয়েছে আর সেটাই সমুর ঘৃণা ও ক্রোধের কারণ। তাই পরিস্থিতি একটু বেশিই অস্বস্তিকর লাগল সমুর। একটু আশঙ্কার সংকেতও মাথার ভিতরে হন্ট করছে। প্রায় ছয়মাস ধরে শিমুলিয়াতেই এই বিশেষ যৌথ অভ্যাস মহড়ার অনুমতি ও ব্যবস্থাপনার জন্যে কত যে ঝামেলা কত যে বিপত্তির সামনা করতে হয়েছে তার হিসেব নেই। এখন যদি রাশিয়ান আর্মি কোনও কারণে পিছিয়ে যায় তো সব প্ল্যান মাটি। সমু আবার তাকাল দুজনের মুখের দিকে দেখল দোভাষী লোকটি তর্জমা করার জন্যে উন্মুখ আর রাশিয়ান সাহেবটি একদৃষ্টে তাকিয়ে রয়েছেন সমুর চোখের দিকে। অন্তর্ভেদী দৃষ্টি। সমু প্রচণ্ড অস্বস্তিতে চোখ নামিয়ে ফেললো। কিন্তু ভুল বুঝতে পেরে পরক্ষণেই চোখ তুলে তাকাল। সৈনিকদের চোখ নামিয়ে কথা বলা নিজের দুর্বলতা প্রকাশ করা। অফিসারটি হাত বাড়িয়ে হ্যাণ্ডসেক করে নিজের পরিচয় আবার দিলেন। ওনার নাম সারগেই ইভানোভিচ। 



(সব চরিত্র ও ঘটনা কাল্পনিক)

0 comments: