1

রম্যরচনা - পিনাকী চক্রবর্তী

Posted in


রম্যরচনা


একটা কাল্পনিক ট্রেনযাত্রা, সঙ্গে একটা সত্যি গল্প
 পিনাকী চক্রবর্তী



এই যে ট্রেনে উঠেই সবাই হয় খেতে লাগে আর নাহলে নাক ডাকিয়ে ঘুমায়, এইটাই আমার একদম পছন্দ না, জ্যেঠু …

তাহলে, আর কি করতে বলো তুমি বাপু? একে তো রাতের ট্রেন, তায় কামরায় আলোর যা অবস্থা! এতে তো একটা গল্পের বইও পড়া যাবে না।

বই পড়তে কে বলছে ? আড্ডা আছে, গল্পগাছা আছে, আর আপনি তো সঙ্গেই আছেন, আমাদের চলমান রচনাবলী! আপনিই ধরুন না একটা গল্প! দেখবেন সবকটা গুটি গুটি এসে বসে পড়বে!

আমি? আরে, না, না, আমিও একটু পরেই উঠে যাবো ওপরের বাঙ্কে। বুড়ো মানুষ, ঘুম পায় না আমার?

জ্যেঠু, আবার আপনি ট্রেনে ঘুমানোর কথা বলছেন? আপনার না ট্রেনে ঘুমানো বারণ! আপনি ঘুমিয়ে পড়লেই নাকি আপনার স্যুটকেস পত্তর সব চুরি হয়ে যায়?

আরে বাবা, সে তো একা একা ট্রেনে চড়ার সময়ে, হে! এখানে তোমরা সবাই আছো! তার ওপরে, এই আস্ত ট্রেনটাই তো তোমার। আচ্ছা, এটাকে কি করে পেলে হে! আমি অনেকদিন আগে টিভিতে একটা হাসির সিরিয়ালে দেখেছিলাম, কে যেন একটা রোড রোলার জিতেছিল লটারিতে। তারপরে তার কি হাঁড়ির হাল হয়েছিল, সেই নিয়ে গল্প!

হ্যাঁ জ্যেঠু, ওটা ছিল মালগুড়ি ডেজ – এ।

হ্যাঁ, হ্যাঁ, ঠিক ঠিক। কিন্তু তোমার এই হামাগুড়ি ডেজ-টাকে পেলে কোথায়? এর চালচলন তো দেখি সেই “গুড় গুড় গুড় গুড়িয়ে হামা” টাইপস! সাঁতরাগাছি পৌঁছাতেই এত আমড়াগাছি করছে! 

স্পীডের কথাটা পরে বলছি, জ্যেঠু। আসলে আস্ত ট্রেনটা তো না, ট্রেনের একটা কামরাই জিতেছি শুধু, রেলের সঙ্গে একটা মামলায় জিতে, ক্ষতিপূরণ হিসাবে। পেছনের গার্ডের কামরাটা রেলেরই ডিসপোজাল সেল থেকে কিনেছি, সস্তায়। ওটা না থাকলে ট্রেনটা চালাতে দিত না আমাদের, তাই! মামাকে রিকোয়েস্ট করেছি আজ রাতটা ওখানে থাকতে। একটু রেসপনসিবল কাউকে তো রাখতে হবে ওখানে, বলুন! আর রেলের থেকে ইঞ্জিনটা ওয়েট লীজে নেওয়া। মানে ড্রাইভার, ফায়ারম্যান, কয়লা, জল… সব সমেত ভাড়া করা। তা কয়লার ইঞ্জিন তো আজকাল পড়েই থাকে, তাই পড়ে থেকে থেকে আমাদের ইঞ্জিনটা বোধহয় একটু ডিফেক্টিভ হয়ে গেছে, স্পীড তুলতে পারছে না, হামাগুড়ি দিচ্ছে। সে যাকগে, আপনি একটা গল্প বলুন। 

আমার গল্প মানেই তো তেল আর গ্যাসের গল্প হে! লোকে বেদম বোর হয়ে যাবে। যে ক’টা জেগে আছে, তাদেরও ঘুম এসে যাবে।

কি যে বলেন! আপনার গল্পে বোর হবে কেউ? আপনি নিজে বিশ্বাস করেন এ’কথা? এই তো, আপনার সেদিনের ঝুমরিতিলাইয়ার গল্পটা! লোকে তো আপনাকে আর এগোতেই দিলো না। ঝুমরিতিলাইয়া নিয়ে প্রশ্নে প্রশ্নে আপনাকে জর্জরিত করে ফেললো সবাই। কিন্তু আপনি তো যাচ্ছিলেন চম্পারণ না মধুবনীতে, কি সব গ্যাস শো অনুসন্ধান করতে! সেটাই শেষ করুন আজকে নাহয়!

সেবার আমার যাত্রা ছিলো পূর্ব চম্পারণ জেলার ঘোড়াসাহান গ্রামের উদ্দেশ্যে। নেপালের বর্ডারের কাছে।

জ্যেঠু, এক মিনিট! আমি একটু সবাইকে ডেকে আনি, নাহলে পরে লোকে আমাকে কথা শোনাবে। এই, সবাই এদিকে এসো! পিনাকী জ্যেঠু গল্প শোনাচ্ছেন। পরে আমাকে কেউ দোষ দিও না, “তোমাদের ডাকা হয়নি কেন ?” বলে …

সে কি পিনাকীদা, এখনও ঘুমোননি আপনি? আরে, গল্প শুরু হয়ে গেছে নাকি? তা, এবার কোথায় চললেন?

ওই তো, কলকাতা থেকে ধানবাদ, ঝুমরিতিলাইয়া, পাটনা, মতিহারি হয়ে চম্পারণ জিলার ঘোড়াসাহান গ্রামে।

আপনি দাদা, সবসময় খালি দূরে দূরে ঘুরে বেড়াতেন। ঘরের কাছে কোথাও তেল গ্যাস খুঁজতে যাননি কোনওদিন?

তাও গিয়েছিলাম তো! বারাসাতের কাছে …

এ কি, দাদা, গল্প বলছেন নাকি? আমরাও শুনবো!

এসো, এসো, বসো। আমি বলছিলাম ঝুমরিতিলাইয়ার গল্প, কিন্তু …

না, না, দাদা, ওই বারাসাতের কাছের গল্পটা বলুন।

“বারাসাতের কাছেই” কি পিনাকীদার আগামী সিরিয়ালের নাম?

দূর! বারাসাতের কাছে, মানে ... একবার বেড়াচাঁপার একটা পুকুর থেকে গ্যাস বেরিয়েছিল। সে কি কেচ্ছা! কিন্তু সেটা অন্য গল্প…

ওটাই শুনবো। নতুন মানেই অন্য, তা বলে কি গপ্পো শুনবো না?

মেজদি, পিনাকী জেঠু গল্প শোনাচ্ছেন। হাত ধুয়ে, সটান এদিকে চলে এসো।

হিমালয় মা দুর্গাকে দিয়েছিলেন সিংহ। আমার বস আমাকে দিলেন তাঁর গাড়িটা, ড্রাইভার সমেত। 

কেন দাদা, ব্যাপারটা কি ছিলো ?

আসলে কোথাও থেকে যদি তেল বা গ্যাস বেরোনোর খবর পাওয়া যায়, তাহলে আমাদের নিকটতম অফিস থেকে কাউকে গিয়ে সেই ঘটনাটার ডিটেইলড ইনভেস্টিগেশন করতে হয়। আমার চাকরী জীবনের প্রথম দিকে সেই “কাউকে”-র ভারটা আমার কাঁধে যখন তখন এসে পড়তো। এবারেও তাই হয়েছিলো। আমি ...

শুধু আপনি? মানে আপনি একাই গেলেন ?

না, মানে আরও ছিলেন আমার দুই অফিসতুতো সিনিয়র দাদা। আমাকে পাহারা দিয়ে নিয়ে যাবেন বলে সাথে এলেন তাঁরা। আমি যত বলি, পাহারা কেন লাগবে, দাদা? তো তাঁরা বললেন, লাগে, লাগে, zআন্তি পারিস না! পরে বুঝবি

বসের অ্যাম্বাসেডার গাড়ির পেছনে দুই দাদা। আমি যন্ত্রপাতি নিয়ে সামনের সীটে।

কি জ্বালা! যন্তর-মন্তর সব তো ডিকি-তে রাখবেন তো!

উঁহু! কাচের শিশি বোতল, গ্যাস জার... ও সব ভেঙে যেত ডিকিতে। তো, তাপ্পর চলতে চলতে চলতে চলতে গাড়ী এসে দাঁড়ালো চাঁপাডালির মোড়ে। ওটা, বুঝলি, বারাসতের একটা ল্যান্ডমার্ক, চাঁপাডালির মোড়।

হ্যাঁ, হ্যাঁ, চাঁপাডালির মোড় খুব চিনি। 

এদিকে আমার আবার শ্বশুরমশাইয়ের শ্বশুরবাড়ি বারাসত। এই ঘটনার ক'দিন আগেই বিয়ের পরে পেত্থম আমার দিদিশাশুড়ীকে পেন্নাম করতে গেছিলাম সেখানে।

আরে, এ তো মেগাসিরিয়াল হচ্ছে! খালি, কি বলে, আসলি গ্যাসের গপ্পো কিধার গ্যয়ী?

আরে, হচ্ছে হচ্ছে, গল্পই তো হচ্ছে। এত তাড়াহুড়ো কিসের? সে কি ঝামেলি, বুঝলি, এক বাড়ী মামাশ্বশুর, তার ওপর এক গাড়ী মামীশাশুড়ি, আর সর্বোপরি এক কিন্ডারগার্টেন ভত্তি মামাতো শালা শালি। পেন্নাম কত্তে গিয়ে কেস খেয়ে গেছি। মহিলামহলে সে কি হাসাহাসি! ক’টা এক্স্ট্রা প্রণাম ঠুকেছি, কে জানে? তা সে যাই হোক, সব্বাই বলে, বাঃ কি সুন্দঅঅঅঅর জামাই। হইচই শুনে পাড়াপড়শীরাও এসে হাজির। তা, তারাও বললো, বাঃ জামাই, বেশ জামাই, খাসা জামাই! চলো জামাই, সিনেমা দেখাবে চলো!

শেষে লালী সিনেমায় সিলসিলা দেখাতে নিয়ে যেতে হয়েছিলো সব্বাইকে। ইনক্লুডিং মামাজ, মামীজ এন্ড পাড়াপড়শীজ ...

তারপরে জ্যোতি মিষ্টান্ন ভাণ্ডারে নিয়ে গিয়ে ভেজিটেবল চপ আর তালশাঁস। হাঁসফাঁশ অবস্থা হয়ে গিয়েছিলো আমার সেদিন প্রায়… আমি তাপ্পর থেকে সব সিনেমা দেখি, হলে অথবা টিভিতে, সঅঅঅঅব সিনেমা! শুধু সিলসিলা ছাড়া… আমার বোধহয় সিলসিলা ফোবিয়া হয়ে গেছে। আমার আর জয়াদির... 

তা সে যাই হোক, আমি যাচ্ছি গ্যাস বের করতে বেড়াচাঁপার পুকুর থেকে…

এর মধ্যে চাঁপাডালির মোড়ে পৌঁছাতেই দুই দাদা পেছন থেকে বললেন... এই! পৃথিবীর গাড়ীটা থামাও। আমি (মানে আমি না, ওঁরা) নেমে যাবো।

আমি বললাম, সে কি? এটা তো বারাসত! আমাদের তো যেতে হবে বসিরহাটের দিকে... বেড়াচাঁপা

দাদারা বললেন, সে আমরা কি জানি? তোকে পাঠিয়েছে, তুই যাবি। আমরা এই পর্যন্ত তোকে পাহারা দেবো ঠিক করেছি। এতদূর গার্ড দিয়ে নিয়ে এলাম... এর পরের টুকু তুই বুঝে নে! নাহলে চাকরী কত্তে এয়েছিস কেন?

বোঝো ঠ্যালা, দাদার দাদারা সব "কেটে পড়ি ভেগে পড়ি"-র ধান্দা করতেছেন!

আমি বললাম, তাইলে এটুকুই বা এলেন কেন? আমার আসল সাহায্যের দরকার তো ওখানে...

তাঁরা বললেন, বাচ্চা ছেলে, বাচ্চাদের মতো থাকবি। বাচ্চাদের বেশী কতা কইতে নেই। আর শোন, বেড়াচাঁপা ঢোকার মুখেই একটা থানা পড়বে রাস্তার বাঁ হাতে। ওই থানাতে গিয়ে নিজের আই ডি দেখিয়ে দুটো পুলিশ নিবি সাথে। পুলিশ ছাড়া একদম ঢুকবি না ওদিকে, বুঝলি... 

বলেই দাদারা সুড়ুত করে কোথায় যেন কেটে পড়লেন।

কি বিচ্ছিরি সব দাদা জোগাড় করেছিলেন আপনি, দাদা!

তা আমি তখন একা পড়ে গিয়ে মনের দুঃখে জ্যোতি মিষ্টান্ন ভাণ্ডারে গিয়ে দুটো সিঙ্গারা আর চা নিয়ে ড্রাইভারের সঙ্গে ভাগ করে খাচ্ছি। চা পেয়ে ড্রাইভারের হঠাৎ মৌনীব্রত ভাঙল। সে বললো, স্যার, এই দুজনকে এনেছেন কেন সঙ্গে?

আমি বললাম, এঁরা আমার বস হে! না এনে কি উপায় আছে? 

সে বললো, আপনি নতুন ঢুকেছেন, কিছু জানেন না। এনাদের অন্য ধান্দা আছে।

আমি জিজ্ঞেস করলাম সেটা কি ?

ড্রাইভার বললো, আমাকে বলেছে ফেরার সময়ে ওদেরকে নোয়াপাড়া থেকে তুলে নিতে। 

আমি, কোথায় নোয়াপাড়া, কেন নোয়াপাড়া … এ সব কিছুই না বুঝে ভ্যাবলার মতো বললাম, আচ্ছা !

এমন সময়ে মিষ্টির দোকানের মালিক বললেন, আপনি দুলালের জামাই না? আমি ঘাবড়ে গিয়ে বললাম, আমার শ্বশুর মশাইয়ের নাম দুলাল নয়। তিনি বললেন, আরে তোমার শ্বশুর অইলো অগো জামাই। আমি তোমারে চিনসি ... তুমি তো দুলালের ভাগ্নী জামাই।

আমি কাতর গলায় বললাম, আমাকে ছেড়ে দিন, আমি আর কক্ষনো আপনার দোকানে আসবো না ! 

ভদ্রলোক বললেন, তুমারে ছাড়বো ক্যান? তুমি তো এই দুকানের লক্ষ্মী। 

আমি বললাম, আমি লক্ষ্মীও নই, সরস্বতীও নই। আমাকে ছেড়ে দিন। আজকে আমি অফিসের কাজে এসেছি। পকেটে মাত্তর পঞ্চাশটা টাকা আছে।

ভদ্রলোক বললেন, তুমি আমাগো জামাই, তোমাত্থে পয়সা নিমু না। 

আমি মনে মনে বললাম, দেড়শ টাকা যেদিন বিল হয়েছিলো, সেদিন কি আমি আপনাদের জামাই ছিলাম না? এখন এক টাকা তিরিশ পয়সা ছেড়ে দিয়ে জামাই আদর দেখাচ্ছেন? মুখে বললাম, না, এই টাকাটা আপনি নিয়ে নিন। আর কোনওদিন এখানে আসবো না …

তারপরে শুনি দোকানদার ভেতরে গিয়ে একটা ছেলেকে বলছেন, দুলালের বাড়ীত য্যায়া কয়্যা আয়, তাগো জামাই আইসে! শুনেই আমি টেবিলের ওপর পয়সা রেখে, এক ঢোঁকে এক ভাঁড় দুধের সর-ওয়ালা চা ক্যোঁৎ করে গিলে, দে দৌড়। দৌড়তে দৌড়তে গাড়ীতে উঠে সোজা বেড়াচাঁপা পি এস। মানে থানা।

সেখানে দেখি সেকেন্ড অফিসার নেই, থার্ড অফিসার রাউন্ডে গেছেন – এই রকম অবস্থা। শুনলাম বসতে হবে। খানিকক্ষণ উশখুশ করে বললাম, মেজবাবু কোথায় গেছেন? খুব তাচ্ছিল্যের সাথে উত্তর এলো, সে জেনে আপনি কি করবেন? আমি বললাম, আমার একটু তাড়া আছে। ছোটবাবু বললেন, আরে রাখুন মশায় আপনার তাড়া! একটা পুকুর দুম ফটাস হয়ে যেতে বসেছে, আর আপনি বলছেন তাড়া !

পুকুর দুম ফটাস মানে কি? আরে, এ তো মনে হচ্ছে আমারই পুকুর! ছোটবাবু বললেন, আপনার পুকুর মানে? এটা অমুকের খাস জমিতে খোঁড়া চলছে, আর আপনি বলছেন আপনার পুকুর? কে আপনি, হরিদাস পাল? আমি বললাম, দেখুন... ওই পুকুরের ইনভেস্টিগেশন করতেই আমি এসেছি। তিনি এবার উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, ইনভেস্টিগেশন করার আপনি কে, মশাই? ইনভেস্টিগেশন করে পুলিশ। আপনি কে? সি বি আই?

এমন সময় মেজোবাবু এলেন। মাথায় টুপি নেই। ঘর্মাক্ত কলেবর। ঘাম মুছতে মুছতে চেয়ারখানা পা দিয়ে ফ্যানের নিচে টেনে এনে বসতে বসতে ছোটবাবুকে বললেন, প্রেস আসছে! শালা **** আমাদেরও ফাঁসাবে এইবার! 

ছোটবাবু আমার দিকে ইশারা করে বললেন, সি বি আই!

মেজোবাবুর আর চেয়ারে বসা হলো না। তিনি ঝপাং করে লাফিয়ে উঠতেই আমি আমার আই কার্ডটা দেখালাম। তিনি ও সব দেখতেই চান না, খালি বলেন, দিল্লী? দিল্লী? 

আমি বললাম, না স্যার, আমি কলকাতা থেকে আসছি।

কেন? কেন? কলকাতা থেকে আসছেন কেন? 

আমি বললাম, কলকাতাতেই ছিলাম তো! আমার অফিস কলকাতায়। এই যে আমার আই কার্ড। 

ভদ্রলোক কার্ড দেখতেই চান না। আমাকে টপকে পেছনের চেয়ারে বসা ছোটবাবুকে জিজ্ঞেস করলেন, বাইরে গভর্নমেন্ট অফ ইন্ডিয়া লেখা সাদা অ্যাম্বাস্যাডারটা কার? ছোটবাবু আমাকে দেখিয়ে দিলেন ... তখন মেজোবাবু আমার দিকে ফিরে বললেন, স্যার, দিস ইজ এ কেস অফ লোকাল পলিটিকাল রাইভালরি। উই শ্যাল সাবমিট আওয়ার ইনভেস্টিগেশন রিপোর্ট টুডে টু দা সিআই অ্যান্ড এসডিপিও অফিস। ইউ নীড নট গেট ইনটু দিস।

আমি বললাম, আই হ্যাভ অলরেডী গট ইনটু দিস। কিচ্ছুটি করার নেই। আমার ওই গ্যাসটা পরীক্ষা করে স্যাম্পল নেওয়া দরকার। আপনি দয়া করে দুয়েকজন কনস্টেবলকে আমার সঙ্গে দিয়ে দিতে পারবেন, যাতে আমার কাজে অসুবিধে না হয় ?

মেজোবাবু বললেন, আপনি কে? কি কাজ করেন? কোথায় থাকেন? আপনার পরিচয় কি? 

আমি বললাম, আপনাদের ছোটবাবুর মতে, আমার নাম হরিদাস পাল। আমি সি বি আই -তে চাকরী করি। আপনাদের কাজ নিজের ঘাড়ে নেবো বলে এখানে এসেছি। আর বাইরের গাড়ীটা আমার।

কিন্তু আসলে, আমার নাম পিনাকী চক্রবর্তী। পেশায় জিওলজিস্ট। আপাতত আমি কেন্দ্রের তেল গ্যাস বিভাগ থেকে আসছি। দেশে কোন জায়গা থেকে তেল বা প্রাকৃতিক গ্যাস বেরোতে থাকলে, এবং সেটা সরকারের কানে গেলে, আমাদের মতো কিছু লোককে সেটা পরীক্ষা করতে পাঠানো হয়। আমাকে সেই কাজে পাঠানো হয়েছে। আর বাইরের গাড়ীটা আমাদের ডাইরেক্টরের। তাঁর কাছে কেন্দ্রীয় তেল মন্ত্রকের থেকে খবর এসেছে এই পুকুর থেকে গ্যাস বেরোনোর। তিনি স্বয়ং নিজের গাড়ী দিয়ে আমাকে এখানে পাঠিয়েছেন। এবারে বলুন আপনি আমাকে কি ভাবে সাহায্য করতে পারেন ?

ওব্বাবা, মেজোবাবুকে চমকালেন তো ভালোই !

আমি চমকাইনি। ভদ্রলোক প্রেস টেস নিয়ে এমনিতেই চিন্তিত ছিলেন। তার ওপর ছোটবাবুর ছ্যাবলামোটা ওনার চিন্তিত মাথায় ঠিকমতো ঢোকেনি। ওদের মধ্যেই একটু ভালোমানুষ টাইপস ... ঘোঁ ঘুররর ঘুঁৎ ...

ও দাদা, ঘুমালেন নাকি? ও পিনাকীদা!

উঁ? অ্যাঁ? এহে, ঘুমিয়ে পড়েছিলাম নাকি? ওই ট্রেনে উঠলে আমার কিরকম যেন ঘুম পেয়েই যায়। তা ... কি যেন বলছিলাম ... হ্যাঁ, মনে পড়েছে! মেজোবাবুর কথা। মেজোবাবু বললেন, আপনার কি ধরনের সাহায্য চাই, স্যার? ইয়ে, মানে আমি ছাপোষা মানুষ, বাড়ীতে একপাল পুষ্যি। এখানে স্যার, বুঝলেন না, ব্যাপারটায় একটু গণ্ডগোল আছে। আপনাকে সাহায্য করতে গিয়ে আমি যদি ফেঁসে যাই !

ই কি কারবার রে বাবা! আমি সরকারী চাকুরে, সরকারী কাজে এসেছি পুলিশের কাছে! আর পুলিশ বলে কি না আমাকে সাহায্য করলে ফেঁসে যাবে? বললাম, আপনাকে কিচ্ছু করতে হবে না। আপনি শুধু আমাকে বলুন যে কি হয়েছে! ঘটনাটা কি ঘটেছে এখানে? কথা নেই বার্তা নেই... একটা পুকুর থেকে শুদুমুদু গ্যাস বেরোতে লাগলো! ধুর মশাই, ওরকম হয় নাকি?

ছোটবাবু এর মধ্যে একটা ছোকরাকে ধরে নিয়ে এসেছেন। সে একটা চ্যাটচ্যাটে কাচের গেলাসে গাঢ় বাদামী রঙের চা রেখে গেল আমার সামনে। উপস্থিত আর সবাইকেও দিলো। মেজোবাবু বললেন, নিন স্যার, চা খান।

আমার চায়ের দরকার ছিলো না, এইমাত্তর জ্যোতি মিস্টান্ন ভাণ্ডারের সর দিয়ে মাখামাখি চা খেয়ে এসেছি। তাও নিলাম গেলাসটা। মেজোবাবু বললেন, ওই স্যার, একটা পুকুর খোঁড়া হচ্ছিলো। আমি বললাম, কার পুকুর? মেজোবাবু বললেন, কেন স্যার? কার পুকুর, তা দিয়ে কি দরকার? আমি বললাম, এটা তো আমাকে লিখতে হবে রিপোর্টে, যে পুকুরটা কার? মানে যদি সত্যিই আমাদের কাজের গ্যাস, মানে প্রাকৃতিক গ্যাস বেরিয়ে থাকে পুকুরটা খোঁড়ার সময়, তাহলে তো ওই জমি অধিগ্রহণ করতে হবে, তারপর ...! 

মেজোবাবু বললেন, স্যার, জমি অধিগ্রহণ করতে হবে না ! আসলে, গ্যাস বেরোয়নি ! 

আমি চমকে উঠে বিষম খেলাম! আমি চমকে উঠলেই বিষম খাই। ওটা আমার বদ অভ্যাস। তা, নিজের পকেট থেকে রুমাল বের করে টেবিলটার আমার সামনের অংশটা পরিষ্কার করতে করতে মেজোবাবু বললেন, স্যার, বিষম তো খাওয়ারই কথা! এতক্ষণে আপনার কথা নিশ্চয়ই জানাজানি হয়ে গেছে, আর আপনাকে সবাই নিশ্চয়ই গালমন্দ করছে! শুনে আমি আবার বিষম খেলাম।

এবার অনেকটা সময় নিয়ে ঝেড়ে কেসে গুছিয়ে নিয়ে বললাম, প্রথমে বলুন, ‘গ্যাস বেরোয়নি’ মানে কি? তাহলে কি মিনিস্ট্রিতে ভুল খবর দেওয়া হয়েছে? আচ্ছা, সে যাক! সে খবর ঠিক হোক, ভুল হোক, আপনি একটা কাগজে আমাকে লিখে দিন যে এখানে, মানে বেড়াচাঁপাতে কোন পুকুর থেকে অতীতে কোন গ্যাস বেরোয়নি, বা ভবিষ্যতেও বেরোবে না। তারপর নিচে সই করে থানার স্ট্যাম্প লাগিয়ে দিন। আমারও কাজ শেষ, আপনারও ঝামেলার হাত থেকে ছুটী।

মেজোবাবু বললেন, গ্যাস বেরোয়নি, মানে বেরিয়েছে। মানে গ্যাস বের করা হয়েছে! 

অ্যাঃ, লোকটা কি খারাপ খারাপ কথা বলছে! আমি বিরক্ত হয়ে অন্যদিকে তাকালাম। তাই দেখে ছোটবাবু দয়াপরবশ হয়ে বলে দিলেন, স্যার, পুকুরটা খুঁড়ছিল একটা ডিসপিউটেড জমিতে। তাই অন্য পার্টি এসে পুকুরে কার্বাইড ফেলে দিয়েছে। তাইতেই গ্যাস বেরিয়েছে। হেঃ হেঃ হে !

আচ্ছা জ্যেঠু, ফেলতে হলে তো ড্রাই আইস-ই ফেললে পারত... ভুড়ভুড় করে জলে বুদবুদ উঠে ধোঁয়া বেরোতো... লোকে আরও ভয় খেত।

সে নাহয় ভয় খেত, কিন্তু আমার আর ড্রাই আইস লাগবে না… ছোটবাবুর সব্বোনেশে কথা শুনেই আমার তখন মাথায় বুদবুদ বেরিয়ে ধোঁয়া উঠছ! বলে কিনা, কে বা কাহারা পুকুরে কার্বাইড ফেলেছে, অ্যাঁ! সে কি কাণ্ড! গ্যাস মানে তো তাহলে অ্যাসিটিলীন? আরে, এ তো বিপজ্জনক ব্যাপার! তা আপনারা কি করলেন? 

মেজোকত্তা খুব ক্ষুণ্ণ মনে বললেন, আঃ, আপনি আবার এসব কথা তুললেন কেন, ছোটবাবু? ওনার ডিপার্টের ব্যাপার না, এটুকু বললেই চলতো! কে কার্বাইড ফেলেছে, কে পুকুর খুঁড়ছিল, এত কথায় ওঁর কাজ কি? না স্যার, আমরা যা জানি, আপনাকে বলেছি। হেডকোয়ার্টারেও জানিয়ে দিয়েছি। এখন আপনি যা চান, করতে পারেন।

আমি বললাম, আমার সঙ্গে দুজন কনস্টেবল দিন। আমি ওখানে গিয়ে গ্যাসের স্যাম্পল কালেক্ট করা যায় না কি, দেখবো। আপনার লোক আমার সঙ্গে থাকবে শুধু, ওদের স্যাম্পল নিতে হবে না। আমি পারলে স্যাম্পল নেবো, না পারলে ফেরত চলে যাবো। ফিরে গিয়ে রিপোর্ট দেবো। সে রিপোর্ট যাবে দিল্লী। ব্যাস, আমার কাজ শেষ। 

মেজোবাবু বললেন, আমার কনস্টেবল ওখানেই আছে। আপনি চলে যান। গিয়ে যা পারেন করুন। কিন্তু মারধোর খেলে আমার কাছে আসবেন না কমপ্লেন করতে। আমি কিন্তু আপনাকে ওখানে যেতে একবারও বলিনি। বলে তিনি অভিমান ভরা ছোট বাচ্চার মতো অন্য দিকে মুখ করে বসে থাকলেন।

আমি দুগগা দুগগা করে তো গেলাম পুকুরপারে। গাড়ীটা বড় রাস্তাতেই ছেড়ে রেখে বোতল টোতল, বালতি টালতি কোলে কাঁকে ঝুলিয়ে গুটিগুটি পায়ে হেঁটে গেলাম। তা, সেখানে দেখি বিরাট ভিড়। সেই ভিড় ঠেলে পুকুরের সামনে গিয়ে খুঁজতে লাগলাম সেই পুলিশের কনস্টেবল কোথায়! দেখি সে উল্টোদিকের গাছতলায় বসে বসে ঢুলছে। তার কাছে গিয়ে গাছতলায় পোঁটলাপুঁটলি নামিয়ে তাকে জাগালাম। জিগেস করলাম, পুকুরটা যিনি কাটাচ্ছেন, তিনি কোথায় ?

আমাকে অচেনা লোক দেখে গ্রামের অনেক ছেলে ছোকরাই দল বেঁধে কাছ ঘেঁষে এসেছিলো। তাদের একজন বললো, লোক জোগাড় করতে গেছে বাড়ীতে। ফিরে এসে লাশ নামিয়ে দেবে ! 

কার লাশ, কে জানে! কিন্তু ওটুকু শুনেই আমার অবস্থা টাইট! তাও জিগালাম, নামটা কি সেই ভদ্রলোকের? সবাই সমস্বরে একটা নাম বললো। তার পরে বললো, চুরি করে পুকুর কাটছিলো, ধরা পড়ে গিয়ে তড়পাচ্ছে!

ওরেব্বাবা, এক্কেরে লাশ ? শুনে লাগে হাঁসফাঁস !

বাপরে ক্ষি কাণ্ড !

চুরি করে পুকুর কাটা আগে শুনিনি ! 

একেই বোধহয় বলে পুকুর চুরি ! 

সে যাই হোক, আমি দেখলাম একটা দিকে পুকুরে অল্প জল আছে। আর অন্য দিকটায় বাঁধ দিয়ে আলাদা করা আছে। সে দিকে একটা পাম্পও লাগানো আছে। কাটার সুবিধের জন্যে জলটা ছেঁচে বাইরে ফেলার জন্যে। আর যা দেখলাম, তাতে আমার চোখ খুলে গেলো। দেখতে পেলাম মাটির ফুট দশ পনেরো নিচে একটা কালো লেয়ার। পাতলা, দুই তিন ফুটের লেয়ার, কিন্তু দেখে কয়লা কয়লা লাগছে। এটা তাহলে নিশ্চয়ই ক্যালক্যাটা পীট।

ক্যালকাটা পীট কি ?

পীট হলো কচি কয়লা, বাচ্চা বয়েস, সবে জন্মেছে - এখনও কয়লা হয়ে ওঠেনি। কিছুদিন (কয়েক লক্ষ বছর) মাটীর নিচে কাটালে লিগনাইট হবে। তার পরে কপাল ভালো থাকলে আরও লাখ কুড়ি বছর পর হয়তো বিটুমিনাস কোল হবে, যা আমরা ব্যবহার করি।আর আরও বিবর্তন হলে হালকা ফুলকা অ্যান্থ্রাসাইট হবে। নাও হতে পারে। সে যাক, কিন্তু এই ক্যালক্যাটা পীট লেয়ারটা আমাদের বাড়ীর কাছে (টালীগঞ্জে) মাটির অনেক গভীরে পাওয়া যায় - মেট্রো রেলের খোঁড়াখুঁড়ির সময়ে দেখেছিলাম। কলেজের ল্যাবে নিয়ে গিয়ে টেস্টও করেছিলাম। এই পীটের সঙ্গে অনেকটাই মিথেন বা মারশ গ্যাস মিশে থাকে। চাপ পড়লে বেরিয়ে আসে...

বেড়াচাঁপায় ক্যালকাটা পীট, বটে বটে, কি আনন্দ !

আসলে দক্ষিণবঙ্গের উপকূলবর্তী অঞ্চল আস্তে আস্তে দেবে যাচ্ছে মাটির নিচে। তাই যত দক্ষিণে যাওয়া যায়, একেকটা লেয়ার মাটির মধ্যে আরও গভীরে পাওয়া যায়। সবই কাদা মাটি হলে চেনা যেত না। কিন্তু এইরকম পীটের লেয়ারগুলো কাদা মাটির মধ্যে এক রকম মারকার হিসাবে কাজ করে। এরা বোঝায় সে সুন্দরবন টাইপের জঙ্গল এককালে এই অঞ্চলে ভরে ছিলো। কোন এক প্রাকৃতিক দুর্যোগে হঠাৎ মাটি চাপা পড়ে যায়। সেই মাটির ওপরে আবার জঙ্গল গজায়। আবার তার গাছপালারা চাপা পড়ে। এই করে করে এই ক্যালক্যাটা পীটের সৃষ্টি ...

দারুণ তো, দাদা !

খুব সুন্দর। জ্ঞান বাড়লো। জয় গুরু !

গ্যাস দেখতে গিয়ে পুকুরচুরি, তাপ্পর নবজাতক কয়লা, এপ্পর আরও কি আছে জ্যেঠু ?

এপ্পর আছে চামর! মানে চামরমণি... কিন্তু সে নাহয় হবে পরে। আপাতত এই ক্যালক্যাটা পীটকে সামলাই। এই ক্যালক্যাটা পীটকে ঘাঁটাঘাঁটি করলে একটু আধটু মিথেন বেরোতেই পারে। কাজেই স্যামপলটা নেওয়া দরকার। তাই আমি আশপাশের ছেলেগুলোকে বললাম, আমি একটু গ্যাসের স্যাম্পল নেবো। আপনারা একটু জায়গাটা খালি করে দেবেন ? 

তারা বললো, আপনি নিন না যত খুশী গ্যাস। শুধু আমাদের জন্যেও একটু রেখে দেবেন, যাতে রাতের রান্নাটা হয়ে যায়। আর একটু আলো জ্বালানো যায়।

এখানে যা অবস্থা, এদেরকে আর বোঝাতে গেলাম না যে এই গ্যাসে আলো না, আলেয়া জ্বলে। আমি বললাম, কাজটা একটু বিপদজনক। পুকুর হঠাৎ করে দুম ফটাশ হতে পারে (থানার ছোটবাবু বেশ ভালো আইডিয়া দিয়ে দিয়েছিলেন মাথার মধ্যে) …

এই ধরনের সতর্কবাণীতে বিহার ইউ পি থেকে ত্রিপুরা পর্যন্ত দেখেছি লোক সড়াৎ করে হাওয়া হয়ে যায়। কিন্তু বেড়াচাঁপার লোক বেশ চালাক চতুর। আলোকপ্রাপ্তও বটে... অত অল্পে ঘাবড়ায় না। ছোকরাগুলো বললো, আপনি লেগে পড়ুন দাদা। আপনার কিছু হলে আমরা বডি তুলে বাড়ি পাঠিয়ে দেবো …

মেজাজটা গরম হয়ে গেল, কিন্তু নিজেকে খালি বোঝাতে লাগলাম, এখানে খাপ খুলোনা শিবাজী, এ হলো পলাশী! যাই হোক, তারপর গ্যাস জার, ফানেল, টিউব, বালতি টালতি সব নিয়ে জলে নেমে পড়লাম, যা থাকে কপালে...

পুকুরে যেদিকে জল ওই পীটের লেয়ারটাকে ঢেকে রেখেছে, সেখান দিয়ে সমানে বুদবুদ উঠছে। আমি সেগুলোকে ফানেল চাপা দিলেই সে গ্যাস সেখান থেকে সরে গিয়ে অন্য কোথাও দিয়ে বেরচ্ছে। আসলে ওদের এই একটা গ্যাস জারে ঢুকে নিজেদের সদ্যপ্রাপ্ত মুক্তিযোগটা হারানোর কোনই ইচ্ছে নেই। সিরিঞ্জ দিয়ে টেনে হিঁচড়েও ওদেরকে কোনমতেই বোতলে ঢোকানো যাচ্ছে না। আমি একদিকে চেষ্টা চরিত্র করার সময়ে ওরা অন্য দিকে গিয়ে বুড়বুড়ি কাটছে ... আমি ওদের পেছনে লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে দৌড়চ্ছি, দৌড়তে গিয়ে কাদা আর পাঁকের মধ্যে আছাড় খাওয়ার উপক্রম ... এই সবই পাড়ের ওপর দাঁড়ানো জনতার বেশ হাসির খোরাক হচ্ছে। 

তাই দেখে আমি বললাম, আচ্ছা, দাঁড়াও ! হাসি বের কচ্ছি! বলে, পকেট থেকে দেশলাই বের করে একটা কাঠি জ্বেলে আমি ওই বুড়বুড়ির মধ্যে ফেলে দিতেই পুকুরের ওপর একটা ছোট্ট আগুনের শিখা এদিক ওদিক করতে করতে মিলিয়ে গেলো। পাড়ের থেকে একটা সম্মিলিত "সর, সর" ধ্বনি শোনা গেলো। কিন্তু একটু সরে গেলেও, কেউ পারমানেন্টলি পালালো না। বরং সবাই একটু প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে উঠলো। একটা ছেলে আমাকে বললো, এই দিকে না, ওই দিকে দেখুন দাদা, ওই গ্যাসটা ধরুন। বলে পুকুরের একদিকে একটা ঢ্যালা ছুঁড়ে মারলো। আমার কানের পাশ দিয়ে বোঁ করে বেরিয়ে গেলো সেটা। আমি তাড়াতাড়ি দুটো বোতলেই জল আর হাওয়া ভরে নিয়ে, দুটো পীটের স্যাম্পল তুলে নিয়ে বড় রাস্তায় পালিয়ে এলাম প্রাণ বাঁচিয়ে।

পুকুরপাড় থেকে এক দৌড়ে বড় রাস্তায় উঠে এসে দেখি ড্রাইভার বুদ্ধি করে গাড়ীর মুখ উল্টোদিকে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে রাস্তার এপাশে ঘাসের ওপর পার্ক করে রেখেছে। কিন্তু গেল কোথায় ব্যাটা? ড্রাইভার দাদা, কোথায় গেলেন ভাই, আমাকে এই শত্রুপুরীতে ফেলে! এই অসময়ে কেউ চা খেতে যায়? আমার দুই হাতে দুটো গ্যাস জার, এক বগলে ঢাউস ফানেল আর লটর পটর পাইপ, অন্য হাতের কনুই থেকে ঝোলানো বালতি – সে দৃশ্য দেখলে অতি পাষাণহৃদয়ও গলে যাবে। কিন্তু আমার পেছনে উৎসাহী দর্শকদের মন গলছে না। তার ওপর আবার আছে লাশ ফেলে দেওয়া পাব্লিক। তার সঙ্গে তো এখনও দেখাই হয়নি... ওরে বাবারে! ওরে ব্যাটা ড্রাইভার, গেলি কোথায় লক্ষ্মণ ভাই আমার? 

সত্যিই তো, গেল কোথায় সে আপনাকে ফেলে?

পুকুর পারে গিয়ে বসে নেই তো? দেখুন, মজা দেখতে ওখানেই গেছে নিশ্চই!

আরে যাক না, পুকুরপারে! আমি কি মানা করেছি নাকি? কিন্তু আমাকে পালাতে দেখে, ওরও তো পালিয়ে আসা উচিৎ ছিলো! সে ব্যাটা নিজেও তো ওখানে অচেনা লোক! জনতা দেখতে পেলে তো পেঁ... না, না ঠেঙিয়ে বৃন্দাবন দেখিয়ে দেবে! 

স্যার, আপনি এসে গেছেন? আমি তো আপনাকেই খুঁজতে গেছিলাম। দাঁড়ান, পেছনটা খুলে দিই, স্যার? 

আপনাকে কষ্ট করে কিছু খুলে দিতে হবে না। শুধু এই বালতিটা একটু ধরবেন? আর এই জারটা? উফ, এই বোতলটা হে বোতলটা, এটাকেই জার বলে। আরে, আরে, উল্টাবেন না ওটাকে! যেমন আছে তেমনই রাখুন, নইলে সব গ্যাস বেরিয়ে যাবে!

স্যার, উল্টো তো আপনিই ধরেছেন। দৌড়ে আসতে গিয়ে আপনার কিছু খেয়াল নেই !

আপনি দাঁড়ান তো এগুলো ধরে। আমাকে আগে উঠে বসতে দিন। 

সামনের সীটে বসে, গাড়ির মেঝের কার্পেটে একটা জারের কর্কটা রেখে দুই হাঁটু দিয়ে সেটাকে পজিশনে ফিক্স করলাম। এবার ওর হাত থেকে দ্বিতীয় জারটা নিয়ে আমার কোলের মধ্যে উল্টো করে রেখে প্রিয়তমার মতো জাপটে ধরলাম। এবার বালতিটাকে পায়ের সামনে স্থান দিয়ে মনে মনে হিন্দ মোটরস কম্পানীকে ধন্যবাদ দিলাম। গাড়ী একটা বানিয়েছে বটে, ট্যাঙ্ককে বলে ওদিকে থাক। মুখে বললাম, নিন, এবার চালান, চালান – কিন্তু প্রাণের মধ্যে থেকে ডাক আসছিলো, পালান পালান !

যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালানোর ট্রেনিং পাওয়া আছে এনার। অন্তত দেখে তাই মনে হলো। বাঁইবাঁই করে গাড়ি লোকালয় ছাড়িয়ে বেরিয়ে এলো। চারপাশে চষাক্ষেত। বললাম, গাড়ী থামান। 

অনিচ্ছাস্বত্বেও তিনি গাড়ি স্লো করলেন। কেন, স্যার? 

আরে, বোতলগুলো সীল করতে হবে না? গাড়ীটা একটু সাইড করে থামান। 

দেগঙ্গা ছাড়িয়ে দাঁড়ালে হতো না, স্যার? 

আরে, কোথায় দেগঙ্গা কে জানে? এখানটা বেশ নির্জন আছে। এখানেই দাঁড়ান। 

ওই দেখতেই নির্জন স্যার, আসলে খেত খামারে লোকজন ভর্তি আছে। 

থাক লোক, আপনি দাঁড়ান।

রাস্তার ধারের ঘাসের ওপর গাড়ী থামিয়ে নামা গেল। ড্রাইভার দাদাকে বসালাম আমার জায়গায়, বোতল ধরে।

আপনার ড্রাইভার কখনও দাদা, কখনও আবার লক্ষ্মণ ভাই, তাই না দাদা !

আরে এখনও লক্ষ্মণ ভাই-ই আছে। ওনাকে বললাম লক্ষ্মণ ভাই ধরো, আর উনি বোতল ধরে বসে গেলেন। আর আমি বসলাম ঘাসের ওপর, স্পিরিট ল্যাম্প জ্বেলে, তার ওপর একটা বাটিতে মোমের বড় একটা ডেলা রেখে।

এসব আবার কোথায় ছিলো ? 

আরে ওই বালতিটা আমার দাদুর দস্তানা। কি নেই ওর মধ্যে? এ সব তো তুশ্চু! যাই হোক, খানিকক্ষণের মধ্যে মোম গলে গেল। এবার এক নম্বর বোতলটার কর্ক শুদ্ধু চুবিয়ে দিলাম ওই গলানো মোমের মধ্যে। বোতলের কান, নাক, গলা যখন মোমে ঢেকে গেল, তখন তুলে নিলাম তাকে। মোমটা শুকোতে মিনিট খানেক লাগলো। এর পর পরেরটারও ওই এক ব্যবস্থা। সব যখন চুকেবুকে গেল, তখন বালতি, ফানেল, নল, দময়ন্তী... সব চালান করলাম গাড়ীর পেছনে। তারপর গাড়িতে উঠে দুই কোলে দুই বোতল নিয়ে রওনা দিলাম আবার বারাসতের পথে।

বারাসতে এসে গাড়ী দেখি কলকাতার দিকে না ঘুরে উল্টোদিকে চললো বহরমপুরের দিকে। আমি আঁতকে উঠে বললাম, এ কি? এদিকে কেন ? 

লক্ষ্মণ ভাই বললেন, এদিকে নোয়াপাড়া। 

সে কি? নোয়াপাড়া? নোয়াপাড়া কি? নোয়াপাড়া কেন? 

ড্রাইভার দাদা বললেন, আপনাকে সকালে বলেছিলাম না, স্যার, নোয়াপাড়া! ওখানে একটা দোকানে ভালো চাল পাওয়া যায়।

চাল! চাল মানে? চাল কেন? কিসের চাল? 

আজ্ঞে, ভাতের চাল। আপনার দাদারা এয়েচেন না, সঙ্গে? তাঁরা এয়েছেন চাল কিনতে। 

কেন, চাল কিনতে এতদূর কেন? আর বসের গাড়িতেই বা কেন? এনারা তো এসেছেন আমাকে পাহারা দিয়ে নিয়ে আসতে আর নিয়ে যেতে, তাই না?

আরে না না স্যার, আপনি কিছুই বোঝেন না! আসলে স্যার, এখানে ভালো চাল সস্তায় পাওয়া যায়। আর জানেন তো, চাল এখন এক জেলার থেকে আর এক জেলায় নিয়ে যাওয়া মানা? জানেন তো, নাকি জানেন না? বাইরের চাল কলকাতায় চালান করলে পুলিশে ধরে, শোনেননি? কাগজেও পড়েননি? সে কি, স্যার? রোজ কত কেস হয়, রেলস্টেশনে আর বাসের গুমটিতে...

অ্যাঁ? তাহলে কি হবে? দাদারা যদি বস্তা বস্তা চাল তোলেন এই গাড়িতে, আর ওই থানার ছোটবাবু যদি রাউন্ডে বেরিয়ে আমাদের গাড়ী দাঁড় করিয়ে সার্চ করেন, তখন? 

আরে না, না, স্যার, এই গাড়ীতে গরমেন্ট লেখা আছে না? গরমেন্টের গাড়ী পুলিশ ধরে না, তা সে পচ্চিমবঙ্গ সরকারই হোক অথবা ভারত সরকার। আপনার স্যার, এখনও অনেক কিছু শেখা বাকী আছে !

তা, দাদা, শেষমেষ কত চাল উঠলো?

কুড়ি কুড়ি...

1 comment:

  1. মনোজ্ঞ রচনা । পিনাকীর গদ্যের হাত বেশ ভালো ।

    ReplyDelete