3

প্রাচীন কথা - ঋতুপর্ণা চক্রবর্তী

Posted in


প্রাচীন কথা


মিথ-কথন
ঋতুপর্ণা চক্রবর্তী


গ্রীস

গ্রীক পুরাণের বিভিন্ন গল্পে নানা জনপ্রিয় এবং তুলনামুলক কম জনপ্রিয় কিছু চরিত্র বারবার উঠে এসেছে। এই গল্পগুলি জানার জন্য এই চরিত্রগুলির সম্পর্কে একটু ধারণা থাকা দরকারী। আগামী কিছু পর্বে আমরা গ্রীক পুরাণ নিয়ে কথা বলব। এখানে মূলতঃ পুরাণের বিভিন্ন চরিত্রের পরিচয় এবং তাঁদের পারস্পরিক সম্পর্ক নিয়ে একটু আলোচনা করা হলো।



পর্ব ২ - জিউস এবং অলিম্পাসের দেবদেবীরা


আগের পর্বে আলোচনা হয়েছে টাইট্যানদের (Titan) নিয়ে। ধরিত্রী গায়া (Gaia or Gaea) এবং আকাশ ইউরেনাসের (Uranus) সন্তান হলেন বারোজন টাইট্যান। এর মধ্যে ক্রোনোস (Cronus) ইউরেনাসকে পরাজিত করে স্বর্গের রাজত্ব লাভ করেন এবং তাঁর ভগ্নী এবং স্ত্রী রিয়া (Rhea) স্বর্গের রাণী হন। ইউরেনাসকে পরাজিত করার পরেই ক্রোনোস তাঁর ভাইদের অর্থাৎ সাইক্লপস(Cyclops) এবং হেকাটনকেয়ারসদের (Hecatonchires) বন্দী করে ফেলেন টারটারাসে। টারটারাস (Tartarus) এবং গায়ার কন্যা ক্যাম্পে (Campe) নামক এক অর্ধনারী অর্ধড্রাগনকে পাহারায় বসান। ক্যাম্পের আবার নাকি কাঁকড়াবিছের মতো এক হুলসমেত লেজও ছিলো। 

ইউরেনাস এবং গায়ার থেকে ক্রোনোস জানতে পারেন যে একটি ভবিষ্যতবাণী অনুযায়ী তিনি যেমন তাঁর পিতাকে পরাজিত করেছেন, সেরকমই তাঁকেও তাঁর কোনও এক সন্তান পরাজিত করবে। কালক্রমে তাঁর ছটি সন্তান হয়, তিনজন কন্যা, ডিমেটর (Demeter), হেস্টিয়া (Hestia) এবং হেরা (Hera) আর তিনজন পুত্র, হেডিস (Hades), পোসেইডন (Poseidon), জিউস (Zeus)। 

জন্মের পরই ক্রোনোস প্রথম পাঁচজনকে গুপুত গাপুত করে জ্যান্ত গিলে ফেলেন। আমাদের মামা কংসের মতোই, বাবা কংস আর কি। রিয়া ভয় পেয়ে যান, তাই গায়ার সঙ্গে পরামর্শ করে ক্রীট দ্বীপে মাউন্ট ইডায় (Mount Ida) লুকিয়ে রাখেন ষষ্ঠ এবং কনিষ্ঠ পুত্র জিউসকে। তার বদলে একটি সমওজনের পাথর, ওমফালোস (Omphalos) কাপড় মুড়ে ক্রোনোসকে দেওয়া হয়, আর ক্রোনোস বিনা বাক্যব্যায়ে সেটিও ওষুধের মতো গিলে ফেলেন। 

অনেকগুলো মিথ আছে জিউসের বড় হয়ে ওঠা নিয়ে। একটি মতে, অ্যামালথিয়া (Amalthea) নামের একটি ছাগলের দুধ খেয়ে জিউস বড় হন। কোরিবান্টিস (Korybantes) নামে একদল অস্ত্রধারী পুরুষ খানিকটা আমাদের গন্ধর্বদের মতো নৃত্যগীত পটু, তারা জিউসকে ঘিরে সারাক্ষণ নাচতে গাইতে আর ড্রাম বাজাতে থাকতেন, যাতে শিশু জিউসের কান্নার আওয়াজ ক্রোনোসের কানে না পৌঁছতে পারে। 

আবার একটি ভিন্ন মতে আডামেনথিয়া (Adamanthea) নামের এক কিন্নরী তাঁকে মানুষ করেন। পিতা ক্রোনোসের থেকে লুকিয়ে রাখার জন্য তাঁকে দড়ি দিয়ে বেঁধে একটি গাছ থেকে ঝুলিয়ে রাখতেন, যাতে পৃথিবী, আকাশ আর সমুদ্র কোনও কিছুই তাঁকে স্পর্শ না করতে পারে, আর এভাবেই জিউস তাঁর পিতার চোখের আড়ালে থেকে যান। 
আবার আরেক মতানুসারে গায়া তাঁকে বড় করে তোলেন। 

বড় হওয়ার পর সবার প্রথমে তিনি বিবাহ করেন মেটিস (Metis) নামে এক ওশিয়ানিডকে। ওয়াইনের সঙ্গে সর্ষেবাটা মিশিয়ে একটা পানীয় বানিয়ে মেটিস জিউসকে দেন, জিউস কৌশলে সেই পানীয় ক্রোনোসকে খাইয়ে দেন। ফলে ক্রোনোস বমি করে ভাসিয়ে দেন। বমির সময়ে সবথেকে আগে উঠে আসে ওমফালোস নামে পাথরটি। তারপর একে একে দুই ভাই এবং তিন বোন মুক্তি পান। 

ওমফালোস নামক সেই পাথরটি এখনও ডেলফির মিউজিয়ামে আছে। আগে বিশ্বাস করা হতো এই পাথরের নীচে পৃথিবীর কেন্দ্র আছে।

তারপর জিউস ক্যাম্পেকে যুদ্ধে হারিয়ে এবং হত্যা করে টারটারাস থেকে হেকাটনকেয়ারস আর সাইক্লপসদের মুক্ত করেন। কৃতজ্ঞ সাইক্লপস তিন ভাই মিলে তৈরি করেন জিউসের বিখ্যাত বজ্র বা থান্ডারবোল্ট। এছাড়াও তাঁরা পোসেইডনের জন্য ত্রিশূল এবং হেডিসের জন্য অদৃশ্যকরণ মুকুট (helm of darkness) তৈরি করেন। এই মুকুট মাথায় পরলেই যে পরবে তাঁকে দেখা যাবে না। 

সাইক্লপস আর হেকাটনকেয়ারসদের মুক্তির পর জিউস এবং তাঁর ভাইবোনেরা একসঙ্গে ক্রোনোস এবং বাকী টাইট্যানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। এই যুদ্ধই টাইট্যানোম্যাকি (Titanomachy) নামে বিখ্যাত। দীর্ঘ দশ বছর ধরে যুদ্ধ চলেছিল, উল্লেখ্য, থেমিস (Themis) এবং প্রমিথিউস (Prometheus) টাইট্যান হলেও জিউসের পক্ষে যুদ্ধ করেন। যুদ্ধ শেষ হলে ক্রোনোস এবং তাঁর সাঙ্গোপাঙ্গরা পরাজিত হন। জিউস প্রায় সব্বাইকে টারটারাসে বন্দী করে রাখেন। প্রায় বলছি কারণ অ্যাটলাসকে (Atlas) শাস্তি দিয়েছিলেন আকাশ ঘাড়ে ধরে রাখার। 

সোনার টুকরো খোকা খুকুদের টারটারাসে বন্দী রাখার জন্য গায়া তো জিউসের উপর রেগে অস্থির হয়ে গেলেন। তিনি বললেন, কেউ পৃথিবীকে নিজের বলে ঘোষণা করতে পারবে না। তাই জিউস, পোসেইডন আর হেডিস পৃথিবী বাদ দিয়ে বাকি সব ভাগ করে নিলেন। জিউস হলেন স্বর্গের রাজা, তার সঙ্গে বৃষ্টি এবং বায়ুর দেবতাও। ঠিক যেন আমাদের দেবরাজ ইন্দ্র। পোসেইডন পেলেন সমুদ্র এবং ভুমিকম্প। সম্ভবত তিনি “ও ঠাকুমা, কেমন আছ?” জিজ্ঞাসা করলেই গায়া রাগে কেঁপে উঠতেন (“ঠাকুমা বলছিস কাকে অলপ্পেয়ে মুখপোড়া?”)। আর হেডিস পেলেন মাটির নীচের মৃত মানুষদের পাতাল। আমরা যাকে নরক বলি, অর্থাৎ মারা যাওয়ার পর পাপপুণ্যের বিচার যেখানে হয়। ভাইদের মধ্যে বয়সে সবথেকে বড় হয়েও এই দায়িত্ব পাওয়ায় তিনি যথেষ্ট ক্ষুণ্ণ হয়েছিলেন, এবং সময় সুযোগ বুঝে জিউস এবং অন্যান্য দেবতাদের জ্বালাতন করতেন। মাউন্ট অর্থিস ছেড়ে মাউন্ট অলিম্পাসে জিউসরা নতুন প্রাসাদ বানালেন, তাই এঁদের অলিম্পায়েড দেবতা বা অলিম্পাসের দেবতা বলা হয়।

তিন দেবীও নতুন দায়িত্ব পেলেন, ক্রোনোস এবং রিয়ার সন্তানদের মধ্যে হেস্টিয়া সবথেকে বড় হওয়ায় সবার প্রথম পুজো তিনিই পান এঁদের মধ্যে। অর্থাৎ এঁদের গনেশঠাকুর আর কি। প্রাচীন গ্রিকরা আগুনে বিভিন্ন খাদ্যবস্তু অর্পণ করে আরাধনা করত। প্রথম অর্পিত খাদ্যের অধিকারী হলেন হেস্টিয়া। গৃহ সুরক্ষিত রাখার আর রান্না করার যে নিরীহ গৃহপালিত আগুন তার দেবী ইনি। এছাড়াও এঁকে বন্দনা না করে বরকনে সম্বন্ধ দেখা শুরু করতে পারতো না। স্বর্গের গৃহিনী বা হোস্টেসও ইনি। ইনি চিরকালই কুমারী বা ভার্জিন। 

ডিমেটর - মাটি, চাষ আবাদ এবং সবরকম শস্যের দেবী ইনি। মেটিসের পর কিছু সময়ের জন্য জিউসের গার্লফেরেন্ডো ছিলেন। ওঁর আর জিউসের একটি মেয়ে হয়, নাম পার্সিফোনি। একটি মতে পার্সিফোনি এঁর কুমারী অবস্থার সন্তান। 

হেরা - জিউসের স্ত্রী এবং স্বর্গের রাণী। নারী, সন্তানের জন্ম, বিবাহ এবং পরিবারের দেবী। জিউসের সঙ্গে তাঁর সাতটি সন্তান আছে। তবে তার মধ্যে শুধুমাত্র তিনজন হলেন অলিম্পাসের দেবদেবী। 

জিউস একটু নাড়াঢিল্লে ছিলেন। মানে গায়া যেমন সবার মা, ওঁরও সবার বাবা হওয়ার ইচ্ছে হয়েছিল মনে হয়। অগুনতি নারীর সঙ্গে তাঁর আরও অগুনতি কাচ্চাবাচ্চা রয়েছে। হেরা হলেন পরিবারের দেবী, তাই জিউসের এই লাম্পট্য তাঁর এক্কেবারে পছন্দ ছিলো না। ফলে তিনি জিউসের পরকীয়াদের উপর ক্ষেপে থাকতেন এবং তার থেকে জন্মানো সন্তানদের উপর তো বটেই। তাদের নানাভাবে বিপদেও ফেলতেন।

জিউসের বিভিন্ন সন্তানরা ছাড়া আরও একজন অলিম্পাসের দেবী ছিলেন তিনি অ্যাফ্রোদিতি (Aphrodite)। গত পর্বেই জানা গেছে, ইউরেনাসের কর্তিত লিঙ্গ সমুদ্রে পড়ায় সেখান থেকে অ্যাফ্রোদিতির জন্ম হয়। সেই হিসাবে এফ্রোদিতির পিতা ইউরেনাস, মা গায়া। আবার হোমারের ইলিয়াড অনুসারে এফ্রোদিতি জিউস এবং ডায়ানোস নামে এক ভবিষ্যতবক্তা টাইট্যানের কন্যা। অ্যাফ্রোদিতি প্রেম, সৌন্দর্য এবং যৌনতার দেবী। তিনি অসাধারণ সুন্দরী ছিলেন, তাই অন্যান্য দেবতারা ভয় পেয়েছিলেন এই সৌন্দর্য বহু যুদ্ধ এবং ঝগড়ার কারণ হবে, তাই জিউস নিজের ছেলে হেপাস্টাসের সঙ্গে তাঁর বিয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু অ্যাফ্রোদিতি প্রেমের দেবী, হেরার মত তিনি সংসারে বাঁধা থাকার পাত্রী নন। কাজেই তিনি নিজের মতো করে প্রেম বিলিয়েছেন। তাঁর প্রচুর প্রেমিক রয়েছে। এঁদের মধ্যে অনেকেই বিখ্যাত। প্রধানত জিউস এবং হেরার সন্তান এরিস। এছাড়াও তাঁর প্রেমিক ছিলেন এনকাইসে, যিনি ট্রয় রাজ্যের একজন রাজপুত্র ছিলেন, এবং বিখ্যাত পৌরাণিক চরিত্র অ্যাডোনিস। 

বারোজন দেবদেবীকে অলিম্পাসের প্রধান দেবদেবী হিসাবে মানা হয়। এঁরা হলেন জিউস (Zeus), হেরা (Hera), পোসেইডন (Poseidon), ডিমেটর (Demeter), এথেনা (Athena), অ্যাপোলো (Apollo), আর্টেমিস (Artemis),এরিস (Ares),অ্যাফ্রোদিতি (Aphrodite), হেপাস্টাস (Hephaestus), হারমিস (Hermes), হেস্টিয়া (Hestia) এবং ডায়োনিসাস (Dionysus). এঁদের মধ্যে হেডিস এবং তাঁর স্ত্রী পার্সিফোনিকে ধরা হয়না কারণ তাঁরা পাতালেই থাকেন। নিতান্ত নেমন্তন্ন বা মিটিং থাকলে তবেই আসেন। এথেনা, অ্যাপেলো, আর্টেমিস, এরিস, হেপাস্টাস, হারমিস এবং ডায়োনিসাস হলেন জিউসের সন্তান। এঁদের নিয়ে পরের পর্বে বিশদ আলোচনা হবে। 

আবার ফিরে আসি টাইট্যানোম্যাকির পরবর্তী পরিস্থিতিতে। ক্রোনোস এবং অন্যান্য টাইট্যানদের টারটারাসে বন্দী করায় মা গায়া রেগে গেছিলেন আগেই বলেছি। ক্যাম্পে হত্যার পর তিনি আরো রেগে গেলেন। টারটারাসের ঔরসে তিনি জন্ম দিলেন জায়েন্ট বা দৈত্যদের আরেক প্রজন্মের। এঁরা আগের প্রজন্মের থেকে বেশি শক্তিশালী এবং প্রতিজন একজন অলিম্পাস দেবতাকে হারানোর জন্য নির্দিষ্ট। এবং শুধু তাই নয়, কোনও অলিম্পাস দেবতা এঁদের একা হারাতে পারবে না। একজন মরণশীল মানুষের সাহায্য ছাড়া এঁদের হারানো অসম্ভব। নীচে এই দৈত্যদের একটি তালিকা দেওয়া হলো। সঙ্গে কোন দেবতাকে হারানোর জন্য এঁর জন্ম তাও দেওয়া হলো।

পোরফিরিওন (Porphyrion), দৈত্যদের রাজা - জিউস

পলিবটস (Polybotes) - পোসেইডন

অ্যালকাইনিউস ( Alcyoneus), দৈত্যকুলে সবথেকে বড় ভাই - হেডিস

এনসেলাডাস (Enceladus) - এথেনা

এফিয়ালটিস এবং ওটিস (Ephialtes and Otis) - ডায়োনিসাস

ডামাসেন (Damasen) - এরিস

ক্লাইটিয়াস (Clytius) - হেকেটি

ওরিয়ন (Orion) - আর্টেমিস এবং অ্যাপোলো

হিপ্পোলিটাস (Hippolytus) - হারমিস

মিমাস (Mimas) - হেপাস্টাস

পেরিবইয়া (Periboia), দৈত্যদের রাজকন্যা - অ্যাফ্রোদিতি


জিউস এবং অন্যান্য দেবতারা হারকিউলিসের (Hercules) কিছু সাহায্য নিয়ে এই দৈত্যদের পরাজিত করেন জাইগ্যান্টোম্যাকি (Gigantomachy) নামক যুদ্ধে। কিছু দৈত্য মারা যান, তাঁদের বিভিন্ন দ্বীপের নীচে কবর দেওয়া হয়। কিছু পালিয়ে গিয়ে টারটারাসে আশ্রয় নেন, কিছু পরাজিত হন তাঁদের জিউস টারটারাসে প্রেরণ করেন। এইভাবে জিউস নিজের এবং বাকি অলিম্পাস দেবদেবীদের রাজাগিরি বজায় রাখেন। 


ক্রমশ…

3 comments:

  1. অসাধারণ বর্ণনা। তবে দু-একটা ছবি দিলে লেখাটা আরও মনোহর্ষক হতো। আর ঋতবাককেও ধন্যবাদ, এত সুন্দর একটা বিষয় সবার সাথে ভাগ করে নেওয়ার জন্য।

    ReplyDelete
  2. দুর্দান্ত হচ্ছে। পুরো লেখাটা যখন বেরোবে, তখন কিন্তু ছবি চাই, সম্ভব হলে বিভিন্ন ক্লাসিক ভাস্কর্য এবং পেইন্টিং-এর।

    ReplyDelete
  3. পড়লাম সবটা। কি মিত্তি করে লিখেচো!
    ক্রোনোস-টা মহা বদ লোক। আমি অ্যাডোনিসকে খুঁজলাম। পেয়েছি ওকে নিয়ে একটা লাইন। এরপর অ্যাডোনিসকে নিয়ে একটু বড় প্যারাগ্রাফ চাই। ওর সমস্ত হাঁড়ির খবর তোমার মুখে শুনতে ইচ্ছে করছে।

    ReplyDelete