ধারাবাহিক - সুজিত নারায়ণ চট্টোপাধ্যায়
Posted in ধারাবাহিক
ধারাবাহিক
এক কিশোরীর রোজনামচা - ২২
সুজিত নারায়ণ চট্টোপাধ্যায়
Diary Entry - 20
29, September, 1942, Tuesday
প্রিয় কিটী,
আমাদের কথা আর কি বলব? যাদের জীবনটা লুকিয়ে লুকিয়ে কাটাতে হয়, কিংবা, যারা এ’ভাবেই জীবন কাটাতে বাধ্য হয়, তাদের জীবনে আনেক কিছু আশ্চর্যজনক, অস্বাভাবিক বা অপ্রাসঙ্গিক ঘটনা ঘটে, যার কোন কারণ তোমরা যারা বাইরে আছ, স্বাধীনভাবে থাকতে পার, তারা ভাবতে পারবে না। যেমন আমাদের এই অন্তরালবর্তী জীবনে অহরহ ঘটে চলেছে। একদিন, যখন আমরা স্বাভাবিক জীবন যাপন করতাম, তখন ঘুণাক্ষরেও ভাবতে পারিনি ভবিষ্যতে এসব কিছু আমাদের জীবনে প্রত্যহই ঘটে চলবে। আর আমরা তার মধ্যে দিয়েই এই রকম গোপন জীবন অতিবাহিত করে চলব। আমাদের এখানে জামা-কাপড় ধোবার জন্যে একটা বড় জায়গা বা টাব আছে। ভাবতে পার, আমরা যেখানে আছি সেখানে স্নান করার মত যথেষ্ট বড় জায়গা না থাকার কারণে, আমরা ঔই বড় টাবটাকে আনেক সময় স্নানের জন্যে ব্যবহার করি? ওখানেই অফিস থেকে গরম জলের পাইপ দিয়ে গরম জল এসে জমা হয় (অফিস বলতে আমি তোমায় আমাদের নীচের তলার গোটা অংশটাকে বোঝাচ্ছি)। আমরা এখন এখানে মোট সাতজন আছি। আমরা সাতজনই করে টবের ঐ গরম জলটা ভাগবাঁটোয়ারা করে ব্যবহার করি। বলতে পার এই মুহূর্তে এটা আমাদের জীবনের একটা বড় শৌখীনতা।
কিন্তু এ’টা ত’ অস্বীকার করা যায় না যে, আমরা এ’কে অন্যের থেকে বষস ছাড়াও আরও অনেক কিছু বিষয়ে পৃথক। আবার আমাদের মধ্যে নিশ্চয়ই এমন কেউ কেউ আছেন, যারা নিজের এবং নিজের পরিবারের বাকী সদস্যদের শালীনতার ব্যাপারে একটু বেশী সচেতন। তাই আমরা বাড়ির প্রায় সকলে, নিজেদের স্নান ও শৌচকর্ম ইত্যাদি জন্যে নিজের নিজের সুবিধা ও পছন্দ মত জায়গা ও স্থান ঠিক করে নিয়েছিলেন। ভাবতে পার, আমরা একটা বাড়িতে বাস করছি, একসাথে,আর সেটা এমনই বাড়ি যেখানে প্রত্যেকে তার মৌলিক প্রয়োজনীতা নিয়ে আলাদা আলাদা করে ভাবতে বাধ্য হচ্ছে।
আমাদের উপগৃহে বা অ্যানেক্সের তিনটি তলায় তিনটি জায়গা আছে, যেগুলো আমরা আমাদের শৌচাগার বা বাথরুম হিসাবে ব্যবহার করতে পারি। যেমন, নীচের তলায়, সামনের দিকে অফিসের পিছনে একটি ব্যাক্তিগত অফিস ছিল। ব্যাক্তিগত অফিসের পিছনে, চা, জলখাবার তৈরীর উপযুক্ত একটা রান্নার জায়গা ছিল। ঠিক তার পিছনেই ছিল একটি ছোট শৌচালয়। সামনের দিকে অফিস থাকার জন্যে, যে কোন সময় সেখানে অবাধে যাতায়াত করা যেত না। আর গেলেও বিশেষ সতর্কতা সহ একটু সন্তর্পণে যেতে হতো। দ্বিতীয় তলায়, যেখানে দুটো বিছানা বিশিষ্ট ঘর আছে, সেখানে বিপরীত প্রান্তের দেওয়াল ঘেঁষা বিছানার ঠিক পাশে আর একটি ছোট শৌচালয় আছে। স্বাভাবিক অবস্থায় এটাকে হাত মুখ ধোয়ার জন্যে ব্যবহার করা যায়। কিন্তু আমরা সেটা শৌচালয় হিসাবে ব্যবহার করি। এ’ছাড়া, তৃতীয় তলায় ঠিক পিটারের ছোট ঘর বা খুপরির পাশে আর একটা বাথরুম আছে । সেটাও হাতমুখ ধোওয়ার জন্যে উপযুক্ত। তবে আমরা সেটাকেও শৌচালয় হিসাবেই ব্যবহার করি।
পিটার সাধারণতঃ রান্নার জায়গার পাশের ছোট বাথরুমটাকে ব্যবহার করত। বাথরুমের দরজাটা কাঁচের দরজা হওয়া স্বত্বেও সে সেটাই ব্যবহার করত। সে বাথরুমে যাওয়ার আগে, সবার কাছে জনে জনে গিয়ে বলে আসত, যে, সে এখন বাথরুমে যাবে। আগামী আধ ঘণ্টা কেউ যেন তার বাথরুমের সামনে না যায়। তার মতে, এটা করা তার জরুরী। কারণ সে বাথরুমে তার গোপনীয়তা রক্ষা করতে চায়। মিঃ ভ্যান ড্যান একেবারে ওপরের তলার বাথরুমে যেতেন। তার জন্যে, তাঁকে কষ্ট করে নীচ থেকে গরম জল বয়ে নিয়ে যেতে হতো। তবেঁ, এ’টা তাঁর কাছে বিশেষ কোন ব্যাপার ছিল না। কারণ তাঁর মতে একটু আলাদাভাবে ফাঁকায় বাথরুমে যাওয়াটা অনেক বেশী শান্তিপ্রদ। শ্রীমতী ভ্যান ড্যান সাধারণতঃ স্নানই করতেন না। তবে বাথরুম ব্যবহারের ব্যাপারে তিনি লক্ষ্য রাখতেন, কোনটাতে যাওয়া সব থেকে সুবিধাজনক। আমার বাবা ঠিকঠাক সময় বুঝে নীচের তলায় ব্যক্তিগত অফিসের পিছনের বাথরুমটাকে ব্যবহার করতেন। আমার মা রান্নাঘরের ফায়ার গার্ডের পিছনের বাথরুমটাকে ব্যবহার করতেন। আমি আর মারগট নীচের তলার সামনের দিককার অফিসের পিছনের বাথরুমটাকে ব্যবহার করতাম। প্রতি শনিবার সামনের দিককার অফিসের পিছনের অংশে একটা মোটা পর্দা টাঙ্গিয়ে দেওয়া হতো। পর্দার মধ্যে দিয়ে আসা আলো আধাঁরের মধ্যে আমরা বাথরুম ব্যবহার করতাম।
এ’সব যাই বলি না কেন, আমার আর এই জায়গা, এই বাড়ি, কোনটাই ভাল লাগছে না। গত সপ্তাহ থেকে আমি আরও ভাল জায়গার খোঁজ করছি। এ’ভাবে কোনদিন বাথরুম ব্যবহার করা যায়? পিটারের সাথেও বিষয়টা নিয়ে আলোচনা করেছি। পিটারের পরিকল্পনা হলো, সামনের বা পিছনের অফিসের লাগোয়া বাথরুমটাকে W.C. করা যায় কি’না সেটা ভাবতে হবে (W.C. র অর্থ হল, এমন একটা বাথরুম যেখানে জল রাখার জায়গা থাকবে, চৌবাচ্চা থেকে জল বেরুনোর যেমন ব্যবস্থা থাকবে, তেমনি চৌবাচ্চায় বাইরে থেকে জল ঢোকানোর ব্যবস্থাও থাকবে; স্যানিট্যারী শৌচালয় থাকবে,ইত্যাদি )। যেখানে আমি ঢুকে আলো জ্বেলে শৌচালয়ের দরজা বন্ধ করে ব্যবহার করতে পারব। তাতে আর কিছু না হোক আমি ত’ নিজেকে কৌতূহলী চোখ থেকে আড়াল করে রাখতে পারব।
গত রবিবার, তুমি বলতে পার আমি সবথেকে ভাল ভাবে স্নান করেছি, বাথরুম ব্যবহার করেছি। শুনলে তোমার পাগলের প্রলাপ বলে মনে হতে পারে; তবুও এখানে আসার পর এই প্রথম আমি এত ভালভাবে বাথরুম করেছি। গত সপ্তাহে ছুতোর মিস্ত্রী আর কলের মিস্ত্রী নীচের তলায় কাজ করছিল। ড্রেনের পাইপ আর জলের পাইপকে বাইরে থেকে ভিতরে অফিসের শৌচালয়ের সঙ্গে যুক্ত করছিল। অফিসের ভিতরের প্যাসেজের মধ্যে দিয়ে জল বেরোনোর এবং জল ঢোকার পথ নতুন করে তৈরী করা হল। আসলে কলের মিস্ত্রীকে দিয়ে এই কাজটা করানোর উদ্দেশ্য হল, শীতের সময় তুষার পাতের হাত থেকে পাইপ লাইনদুটোকে রক্ষা করা। বাইরের দিকে থাকলে, দুটোতেই জল ঠাণ্ডায় জমে বরফ হয়ে যেতে পারত। বেশী শীত পড়লে এখানে এ’রকম ঘটনা প্রায়ই দেখতে পাওয়া যায়।
তবে কলের মিস্ত্রী আর কাঠের মিস্ত্রী একটানা কাজের ফলে আমাদের বাড়ির মধ্যে ঘোরাফেরা করা বেশি অসুবিধাজনক হয়ে পড়েছিল। বলা যায় কার্যত প্রায় বন্ধই ছিল। কারণ কোন রকম পায়ের শব্দ বা আমাদের উপস্থিতি জানতে পারলে সেটা আমাদের পক্ষেই বিপদজনক হয়ে উঠতে পারত। এটা ত’ গেল আমাদের বর্তমান অবস্থানের সমস্যা। তার বাইরে আরোও ভীষণ গুরুতর সমস্যা ছিল। ওরা যেদিন কাজ করছিল, সে’দিন প্রায় সারাদিন আমরা একফোঁটা জল পাই নি, বা, বলা ভাল, সংগ্রহ করতে পারি নি। এমন কি সারাদিন আমরা কেউ শৌচালয় পর্যন্ত ব্যবহার করতে পারি নি। তোমায় ঠিক ভদ্র ভাষায় বলা সম্ভব নয়, সেদিন আমরা সকলে কি পরিমাণ দৈহিক কষ্ট বা অস্বস্তি ভোগ করেছি; এবং কিভাবে সেই অস্বস্তিকর সময়গুলোকে পার করেছি। তুমি ত’ জানই, এবিষয়ে বিস্তৃতভাবে তোমায় বলার মতো অশালীন মেয়ে আমি নই।
আমরা যেদিন এখানে প্রথম এসেছিলাম, সেদিনই, প্রথম দিনেই আমি আর আমার বাবা, হাতের নাগালের মধ্যে যা পেয়েছি, সে সব দিয়ে আমাদের জন্যে একটা শৌচালয় বা “পটি” করার একটা ব্যবস্থা করেছিলাম। “পটির” জন্যে কোন ভাল আধার না পেয়ে, শেষ পর্যন্ত একটা কাঁচের জিনিষ রাখার “জার”-কে প্রয়োজনে ব্যবহার করার জন্যে আলাদা করে সরিয়ে রাখি। যেদিন কলের মিস্ত্রী পাইপ লাইন ঠিক করতে এসেছিল, সেদিন আমরা আমাদের সারাদিনের “প্রাকৃতিক সম্পদ” সেই বড় জারেই জমিয়ে রেখেছিলাম। আমার মনে হয় অন্য কিছু করা বা সব কিছু জোর করে চেপেচুপে বসে থাকা কোন সাধারণ মানুষের পক্ষে সম্ভব ছিল না। এর উপর সারাদিন প্রায় চুপ করে থাকা আর সবার কাছে কেমন জানি না, কিন্তু আমার মত রাতদিন “বকর বকর” করা বাচালের পক্ষে বেশ কঠিনই ছিল। অন্যদিন দিনের বেলায় তবু আস্তে আস্তে কথা বলার অনুমতি থাকে, সেদিন শুধু কথাই বন্ধ করে ছিলাম না, ঘরের মধ্যে ঘোরাফেরা করাও বন্ধ করে এক জায়গায় চুপ করে বসে ছিলাম। কারণ ওপরে নড়াচড়া বা বেশী অসাবধানতার সঙ্গে হাঁটাহাঁটি করলে, নীচে পায়ের শব্দ পাওয়ার সম্ভাবনা থেকেই যায়। সেটা আবার আমাদের গুপ্ত জীবনের নিরাপত্তার পক্ষে বেশ বিপদজনক। জান, সেদিন এক নাগাড়ে এক জায়গায় চুপচাপ “থাবড়” গেড়ে বসে বসে আমার পিছনে রীতিমত যন্ত্রণা করছিল। পিছনের নরম মাংসপেশিগুলো বেশ শক্ত হয়ে গিয়েছিল। যন্ত্রণা আর শক্ত মাংসপেশিকে শিথিল করার জন্যে শোওয়ার সময় আমায় নিজে নিজেই ম্যাসাজ করতে হয়েছিল।
ইতি,
অ্যানি
0 comments: