1

ছোটগল্প - দেবারতি ভট্টাচার্য

Posted in


ছোটগল্প


কাবেরীপত্তনম
দেবারতি ভট্টাচার্য


বৃশল রুবিয়ার ইতিহাসতুতো বন্ধু, খ্রিষ্টীয় প্রথম শতাব্দীর মানুষ। বনিক সার্থবাহ হিরণ্যগর্ভের কাছে কাজ করে, সারা ভারত ঘুরে বেড়ায়। যখনই কোনও সুন্দর জায়গায় যায়, বা কারওর সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিতে ইচ্ছে হয়, ডাকে রুবিয়াকে। তেমনি একবার রুবিয়া গিয়ে পৌঁছল কাবেরীপত্তনম বন্দরে। গিয়ে দেখে মাটির দেওয়ালঘেরা একটা জায়গা। একজায়গায় দেওয়ালে ফাঁক, সেখানে দুজন লোক দাঁড়িয়ে পাহারা দিচ্ছে। রুবিয়াকে ঢুকতে দিল না, বলল
"চোল মহারাজের বাঘের ছাপ দেওয়া পাঞ্জা আছে?"
রুবিয়া পাঞ্জা কোথায় পাবে? বাইরে থেকেই দেখল ভেতরে কাপড়ের গাঁটরি, আরও এটা সেটা ডাঁই করা আছে মাটির ওপর। কী কী জিনিস ভালো করে দেখার আগেই বৃশল এসে ডাক দিল। আর্য হিরণ্যগর্ভ ভেতরে গেছেন, বাইরে বলদের গাড়ির দেখভাল করছে বৃশল। তার বন্ধু মূলা এসেছে গ্রাম থেকে, তার সঙ্গে আলাপ করাতেই রুবিয়াকে ডেকেছে।
"মূলা আসলে নতুন লোকজনের সঙ্গে আলাপ করতে খুব ভালোবাসে। আর আজকে একটু ঝামেলায় পড়েওছে, তাই ভাবলাম তোকে ডাকি।"
মূলার গায়ের রং কালো, কোঁকড়া চুল, শরীরে একটু মেদ নেই। চেহারায় একটা প্রাণ আছে, চকচকে চোখ, আন্তরিক হাসিতে চট করে রুবিয়ার বন্ধু হয়ে গেল। 
"মূলা, তুই তো এখানেই থাকিস, বন্দরে নিশ্চয় অনেক লোকের সঙ্গে আলাপ হয় তোর।"
"না, আমি থাকি গ্রামে। এখান থেকে পায়ে হেঁটে একদিন লাগে যেতে। ওখানে নতুন লোক কোথায় পাব? ওখানে শুধু নিচু চালের ঘর, শুকোতে দেওয়া জাল, আর গাছগাছালি।"
"তোর ভালো লাগে না গ্রাম?"
"ভালো লাগে, কিন্তু সারাজীবন গ্রামে থাকতে ইচ্ছে করেনা। আমি একদিন বনিক হয়ে যাব দেখিস। ওই পাহাড়িদের মতো, নাহয় আর্য হিরণ্যগর্ভের মতো।"
"তাই এসেছিস শহরে?"
"পরশু মাছ ধরতে গিয়ে দেখেছিলাম একটা বিদেশি জাহাজ আসছে, তাই কাল ভোরবেলা বেরিয়েছি শহরে আসব বলে। জাহাজ এলে পাহাড়িরা নেমে আসবে, অন্য বনিকরাও আসবে। ওদের কাছে ঝিনুক, নুন আর নুন দেওয়া মাছ বিক্রি হয় ভালো দামে। তাই জাহাজ দেখলেই আমরা শহরে আসি। যখন নৌকো নিয়ে সমুদ্রে মাছ ধরতে যাই, রাতে শহরের আলো দেখা যায়।দেখি আর ভাবি একদিন আমিও শহরে থাকব। আমারও উঁচু বাড়ি হবে, ঘোরানো বারান্দা হবে। আমার বৌ ওইরকম হাত ভরে চুড়ি আর লাল কাপড় পরে পোষা টিয়া-ময়ূর নিয়ে দিন কাটাবে।"
কথা থেকেই বোঝা যাচ্ছিল মূলা শহরে আসতে কত ভালোবাসে। রুবিয়া বলল
"শহর এত ভালোলাগে তোর, তো শহরেই থাকিস না কেন? আর্য হিরণ্যগর্ভকে বলে দেখ, উনি হয়ত তোকেও কাজে লাগিয়ে দেবেন।"
শুনে বৃশল জোরে জোরে হাসতে লাগল, বলল
"তা মূলা করবে না। যতই শহর শহর করে চেঁচাক, আমি জানি ওর মন পড়ে আছে গ্রামে। ওর বৌ লাল কাপড় পরবে না তো কে পরবে? যা একখানা মেয়ে আকামকাল! বায়না করে করে জ্বালিয়ে মারছে মূলাকে।"
মূলার বৌয়ের কথা শুনে রুবিয়ার কৌতূহল হলো, জিজ্ঞেস করল ওর কথা। বৃশলও মজা পেয়ে গেছে, খোঁচাচ্ছে মূলাকে।
"বল না, তোদের পূর্ণিমা উৎসবের রাতের কথা বল রুবিয়াকে।"
মূলা লজ্জা পায়, কিন্তু বলতেও শুরু করে
"পূর্ণিমারাতে আমরা নৌকো নিয়ে বেরোইনা। নারকেলবনে নাচ হয়, আনন্দ হয়। আমরা তালের রস খাই, যে যত পারি খাই, যতক্ষণ না পুরো নেশা হয় ততক্ষণ খাই। তারপর নেশা হয়ে গেলে গুলতির প্রতিযোগিতা হয়। কার টিপ কত ভালো, কে কত উঁচু থেকে ডাব পেড়ে আনতে পারে।"
নেশা হলে কি হাতের টিপ ভালো হয়? রুবিয়া ভাবে। হওয়ার কথা তো নয়, তবে নেশা হলে নিজের বীরত্ব জাহির করার ইচ্ছে হয়ত বেড়ে যায়। "পূর্ণিমায় মেয়েরাও আসে নারকেলবনে। নাচে, ছেলেদের সঙ্গে আনন্দ করে একসঙ্গে ঘুমিয়ে পড়ে। সেদিন কী হয়েছে জানিস, সকালে উঠে দেখি আমি আকামকালের লম্বা কাপড়টা পরে শুয়ে আছি।"
রুবিয়া তো শুনে অবাক।
"তুই আকামকালের কাপড় পরলি কীকরে?"
বৃশল আর মূলা মিটিমিটি হাসে শুধু। বলে
"বাদ দে, ও তুই বুঝবিনা। শোন যার জন্য তোকে ডেকেছি। আকামকাল বায়না ধরেছে ওকে এমন কিছু এনে দিতে হবে যা গ্রামের আর কোন মেয়ের নেই। আমরা ভেবে পাচ্ছিনা এমন কী দেওয়া যায়, যা আর কোন বর তার বৌকে দিতে পারবেনা। তুই তো ভবিষ্যৎ থেকে এসেছিস, তোর কাছে কিছু আছে এমন? যা আকামকালের পছন্দ হবে?"
রুবিয়া ভাবতে চেষ্টা করে, কী সে জিনিস? তাও যদি আগে থেকে জানা থাকত, কিছু সুন্দর পুতুল বা গয়না নিয়ে আসতে পারত। প্লাস্টিকের কৌটো, জিপ দেওয়া ব্যাগ, ব্যাটারি দেওয়া ঘড়ি, স্যানিটারি ন্যাপকিন, ফোল্ডিং ছাতা.. কতকিছু দেওয়া যেতে পারত, কিন্তু সঙ্গে কিছুই নেই। খালি হাতে এসেছে রুবিয়া তাও মাথা ঠাণ্ডা করে ভাবতে থাকে। একে একে বের করে সম্ভাব্য উপহারগুলো, মূলা নিজেই বেছে নিক। চুল থেকে ক্লাচার আর ক্লিপ খুলে দেয়, কান থেকে প্লাস্টিকের দুল খোলে, জিনসের পকেট থেকে বেরিয়ে আসে খুচরো পয়সা, কয়েকটা লজেন্স আর একপাতা সেফটিপিন। মূলাকে একে একে জিনিসগুলোর ব্যবহার বুঝিয়ে দেয়। প্লাস্টিকের দুল মূলার পছন্দ হয়না, এই ছোট ক্লিপ আর ক্লাচার আকামকালের লম্বা চুলে লাগানো যাবে না। লজেন্সগুলো মূলা আর বৃশলের মুখে মিলিয়ে যায়। সেফটিপিন দেখে মূলা মুগ্ধ, এত ছোট জিনিসের এমন ব্যবহার! খুব কাজে লাগবে আকামকালের, পেয়ে খুব খুশি হবে। মূলাকে আরও বেশি করে ভালোবাসবে, স্বামীগর্বে গ্রামে অনন্যা হয়ে উঠবে।

1 comment:

  1. সেফটিপিনের মহিমা অপার! যুগ যুগ ধরে সে আমাদের কুঁচি আঁচলের প্লিট হ্যানাত্যানা সামলে আসছে। খুউব ভালো লাগলো।

    ReplyDelete