প্রবন্ধ - সুজন ভট্টাচার্য
Posted in প্রবন্ধ
প্রবন্ধ
প্রসঙ্গ পঞ্চকন্যা
সুজন ভট্টাচার্য
অহল্যা দ্রৌপদী কুন্তি তারা মন্দোদরী
পঞ্চকন্যা স্মরে নিত্যং মহাপাতক নাশনম।
এই শ্লোকটি আমাদের অনেকেরই খুব পরিচিত। এমন প্রশ্ন আসতেই পারে, সাধারণভাবে যেসব নারীচরিত্রকে সতীত্বের চরম প্রতীক বলে গণ্য করা হয়, যেমন সীতা বা সাবিত্রী, তাদের নাম এই তালিকায় এল না কেন। প্রশ্নটা ভেবে দেখার মতো। এই তালিকার প্রতিটি নারীই কিন্তু বহুগামিনী। সতীত্বের প্রচলিত সংজ্ঞা অনুযায়ী এরা কেউই সতী নন। তাহলে এরা প্রাতঃস্মরণীয়া হলেন কিভাবে? এদের মধ্যে অহল্যা, কুন্তী ও দ্রৌপদী আর্যগোত্রীয়। তারা বানররাজ বালির স্ত্রী এবং বালির মৃত্যুর পরে সুগ্রীব তাকে বিবাহ করেন। মন্দোদরী মায়াসুরের কন্যা ও রাক্ষসরাজ রাবণের স্ত্রী। এটা কি বিস্ময়ের নয় যে আর্যকৃতিতে বানর এবং রক্ষনারীকে স্থান দেওয়া হলো? আবার যে তিন আর্য নারীকে বেছে নেওয়া হলো, তারা সকলেই বহুগামিনী। এই রহস্যের কারণ কি?
পুরাণ ও রামায়ণের অহল্যা উপাখ্যানের মূল গল্পটি সবারই জানা। গৌতমমুনির অনুপস্থিতিতে দেবরাজ ইন্দ্র তার স্ত্রী অহল্যার সঙ্গে মিলিত হন। গৌতম টের পান এবং অহল্যাকে অভিশাপ দিয়ে একটি পাথরে পরিণত করেন। পরবর্তীকালে রামচন্দ্রের স্পর্শে অহল্যা পুনরায় মানবীরূপ ফিরে পান। পুরাণের প্রায় সমস্ত কাহিনীর মধ্যেই দুটি স্তর থাকে। একটি স্তর বাহ্যিক, যা গল্পের কাহিনী থেকে সরাসরি টের পাওয়া যায়। আরেকটি স্তর লুকিয়ে থাকে গল্পের মধ্যে। তাকে বাইরে টেনে আনতে হয়। এই গল্পের মধ্যেও এমন কোনও অন্তর্কাহিনী আছে কিনা দেখা যাক। তবে সেই পথে উদ্যোগী হবার আগে আমাদের আরও কতকগুলো প্রশ্নকে সমাধান করে নিতে হবে।
হিন্দু শাস্ত্র অনুযায়ী গৌতমমুনি বর্তমান বিবস্বান মন্বন্তরের সপ্তর্ষির অন্যতম। তিনি আবার প্রথম মন্বন্তর অর্থাৎ স্বয়ম্ভূ মনুর আমলের সপ্তর্ষিদের অন্যতম অঙ্গিরার পুত্র। হিন্দুশাস্ত্রের কথন অনুযায়ী প্রতিটি মন্বন্তরের সূচনায় ব্রহ্মা একজন করে মনু সৃষ্টি করেন। সেই মনুর দ্বারাই মানবসমাজের সূচনা হয়। মনু প্রথম সৃষ্টি করেন সপ্তর্ষিদের। কাজেই গৌতমমুনি হলেন বর্তমান মন্বন্তরের একদম প্রথমযুগের মানুষ। বর্তমান মন্বন্তরে চারটি যুগ – সত্য, ত্রেতা, দ্বাপর ও কলি। রামচন্দ্র ত্রেতাযুগের অবতার, যেমন কৃষ্ণ হলেন দ্বাপরযুগের। তাহলে হয় গৌতমমুনিকে ত্রেতাযুগের মানুষ হতে হয় অথবা রামচন্দ্রকে সত্যযুগের। রামচন্দ্রকে রামায়ণ বা পুরাণের কাহিনী অনুযায়ী সত্যযুগে পাঠানো যাবে না। তাহলে গৌতমমুনিকেই আসতে হবে ত্রেতাযুগে।
কিন্তু তাতেও একটু সমস্যা আছে। আমরা আগেই বলেছি গৌতমমুনি সপ্তর্ষির অন্যতম অর্থাৎ মনুর প্রথম সৃষ্টির মধ্যেই তিনি আছেন। তাহলে কি সত্য ও ত্রেতার মধ্যে আসলে কোনও ফারাক নেই? নাকি থাকলেও অতি সামান্য? দেখা যাক পুরাণ কি বলছে। পুরাণের মতে সত্যযুগে চারভাগ পূণ্য, পাপের অস্তিত্ব নেই। ত্রেতায় তিনভাগ পূণ্য, একভাগ পাপ। সেই পাপের বিনাশের জন্যই বিষ্ণুকে রামচন্দ্রের রূপ ধরে মানবজন্ম নিতে হয়। পাপবিহীনতা থেকে পাপের উদ্ভব রাতারাতি হতে পারে না। তার জন্য সময় দিতে হয়। এখন প্রশ্ন হলো এই পাপ বস্তুটি কি? তার উত্তর পেতে হলে আমাদের একটু অন্যদিকে ভেবে দেখতে হবে।
হিন্দু ধর্মের যাবতীয় শাস্ত্র আর্যকৃতি অনুসারেই রচিত। আর্যরা এদেশের আদি অধিবাসী নন। নৃতত্ববিদদের ধারণা অনুযায়ী ককেশাস পর্বতমালার সন্নিহিত অঞ্চলে নর্ডিক জনগোষ্ঠীর উদ্ভব হয়। এদের একটা অংশ মধ্য এশিয়ার মধ্য দিয়ে প্রথমে আসে পারস্যে। পরবর্তীকালে তাদের বংশধরদের একাংশ হিমালয় পর্বতমালা ডিঙিয়ে ভারতে প্রবেশ করে। এবং ক্রমশ আরও ছড়িয়ে পড়ে। এই পুরো পর্যায়ে আর্যজনগোষ্ঠী ছিল যাযাবর। যাযাবরবৃত্তির মধ্যে শিকড়বিন্যাসের ধর্ম নেই। অর্থাৎ যাযাবরগোষ্ঠী কোথাও বাঁধা পড়ে যেতে রাজি নয়। তার মানে এইসময়ের মানুষদের মধ্যে স্থিতির উপাদান ছিল না। এই সময়েই বেদের উচ্চারণ। কাজেই এই সময়টাকে যদি সত্যযুগ বলে ধরে নিই, তাহলে তার এক ও একমাত্র মন্ত্র হলো চরৈবেতি, এগিয়ে চলো।
পরবর্তীকালে এরাই ভারতবর্ষে স্থায়ী জনপদ গড়ে তুললেন। স্থায়ী জনপদ গড়ে তুলতে হলে প্রাথমিক করণীয় হলো কৃষিকাজ। কৃষিকাজ ছাড়া কোনও জনপদ স্থায়িত্ব পেতে পারে না। অতএব যাযাবর আর্যদেরও কৃষিকাজে আবদ্ধ হতে হলো। এবং সেই সূত্রে এল স্থায়িত্ব। যদিও তদানীন্তন সমাজের উৎপাদিকা শক্তি খুব উন্নত না হওয়ার কারণে হয়তো এইসব জনপদগুলির স্থায়িত্ব খুব বেশি হতো না; কিছুদিন পরে মাটির উর্বরতা হ্রাস পেলে আবার স্থানান্তরে চলে যেতে হতো। কৃষিকাজ শেখার একদম আদি পর্যায়ে এটাই ছিল অবশ্যাম্ভাবী। এখনও পাহাড়ি অধিবাসীদের ঝুম প্রথায় চাষের ক্ষেত্রেও এই চরিত্র লক্ষ্য করা যায়। যদি এই বিষয়টিকে মাথায় রাখা যায়, তাহলে এই স্থায়িত্বের আস্বাদ বা সম্ভাবনাকেই পাপ বলে বিবেচনা করা হয়েছিল বলে ভাবা যেতে পারে কি? এবং যেহেতু সেই স্থায়িত্ব খুব বেশিদিনের জন্য নয়, তারপরে আবার যাত্রার ডাক, তাই বোধহয় পাপের ভাগ মাত্র এক। সেক্ষেত্রে কৃষি ছাড়াও পরবর্তীকালে অন্যান্য উৎপাদনের বিকাশের সূত্রে স্থায়িত্বের উপাদান আরও বেড়ে যাওয়া, এবং তার ফলে পাপের ভারা বেড়ে যাওয়ার ইঙ্গিত কি বুঝে নিতে খুব কষ্ট হয়?
এখানে আরেকটি কথা মাথায় রাখতে হবে। রামের শ্বশুর মিথিলার রাজা জনকের গুরু ছিলেন শতনন্দ, যিনি নাকি গৌতম ও অহল্যার সন্তান। আমরা আগেই দেখলাম, গৌতম বর্তমান অর্থাৎ সপ্তম মন্বন্তরের মানুষ। তার পিতা অঙ্গিরা যিনি নিজে আবার প্রথম মন্বন্তরের। হয় একেকটি মন্বন্তরের সময়কাল খুব কম, যা পুরাণের কাহিনীবিস্তারের ফলে কখনওই সম্ভব নয়। তাহলে একটিই বিকল্প পড়ে থাকলো যে গৌতমমুনি আঙ্গিরসের বংশভূক্ত, তাই তার সন্তান। সেই অর্থে শতনন্দও গৌতমের প্রত্যক্ষ সন্তান নন, তার বংশভুক্ত। এবারে মূল কাহিনীতে আসা যাক।
অহল্যা শব্দের অর্থ যে নারীকে হলন করা হয়নি। হলন শব্দের অর্থ হলো লাঙল চালনা করা। আমরা জানি লাঙল চালিয়েই মাটির বুকে খাত খনন করে বীজ বপন করা হয়। সেই বীজ জলের সাহায্যে ধীরে ধীরে বিকশিত হয়, একসময়ে শস্যের জন্ম দেয়। কৃষির জন্য প্রয়োজনীয় জল সেই যুগে নিঃসন্দেহে বৃষ্টিপাতের উপরই নির্ভরশীল ছিল। দেবরাজ ইন্দ্র বজ্রের অধিপতি। সাধারণভাবে বজ্রপাত হয় বৃষ্টিপাতের আগে ও পরে। অর্থাৎ বজ্রের সাথে বৃষ্টির আগমনের প্রত্যক্ষ যোগাযোগ রয়েছে। দেবরাজ ইন্দ্র অর্থাৎ আকাশের বজ্র যখন অহল্যা মাটির সঙ্গে সংলগ্ন হলো অর্থাৎ বৃষ্টির হলো এসে নামল মাটির উপরে, শস্যের বীজ মাথা তুলে দাঁড়াল। অর্থাৎ এই অংশটুকু আর্যদের কৃষিকাজের সূচনার কাহিনী।
প্রাচীনপন্থী আর্যরা, বিশেষত তাদের সামাজিক বোধের নিয়ন্ত্রক ব্রাহ্মণ-ঋত্বিকরা এই সূচনার মধ্যে স্থিতাবস্থার যে ইঙ্গিত ছিল তাকে মেনে নিতে পারেননি। তারা তাই বিধান দিয়ে কৃষিকাজের সেই সূচনাকে সম্ভবত নিষিদ্ধ করেন। তাই গৌতমমুনি অহল্যাকে অভিশাপ দিয়ে পাথরে পরিণত করেন। পাথরে আর যাই হোক, কৃষিকাজ হয় না। অর্থাৎ সেইসব শস্যসমৃদ্ধ ভূমি ছেড়ে আর্যরা আবার পরিভ্রমণে বের হন। এইভাবে প্রাথমিক কৃষিকাজকে দমন করে সেই যাযাবরবৃত্তির পথে সমাজকে আবার চলতে বাধ্য করা হয়।
ত্রেতাযুগে মিথিলার রাজা জনক জমিতে হলচালনার সময় একটি শিশুকন্যাকে খুঁজে পান। সীত অর্থাৎ লাঙলের দাগের ভিতর থেকে পাওয়া গেল বলে তার নাম হলো সীতা। আবার একটি চমৎকার রূপকের সন্ধান পাওয়া গেল। লাঙলের ফলার দাগের ভিতর থেকে কি উৎপন্ন হয়? একটাই উত্তর। শস্য। অর্থাৎ সীতা হলেন শস্য। সেই শস্য পরবর্তীকালে আবার নতুন শস্যের জন্মদাত্রী হবে। অর্থাৎ সীতা কৃষিকাজের প্রতীক। তাকে বিবাহ করলেন কে? রাম। রাম শব্দের অর্থ রমণ করে যে। রাম কার সঙ্গে রমণ করেন? সীতার সঙ্গে। কৃষিকর্মের সঙ্গে যিনি নিত্য রমণ করেন, তিনিই তো আসলে কৃষিসভ্যতার ধারক, পালক, উদ্ধারক। তাই রাম হলেন ত্রেতাযুগের অবতার।
রামের স্পর্শে অহল্যা আবার মানবীরূপ ফিরে পেলেন। আশা করি কৃষিসভ্যতার বিস্তারের ফলে পাথুরে, বন্ধ্যা জমিতেও শস্যের ফলনের ইঙ্গিতটা বুঝে নিতে অসুবিধা হচ্ছে না। ত্রেতাযুগে এসে কিন্তু আর গৌতমমুনি বা তার সমগোত্রীয় কাউকে আবার অভিশাপ দিতে দেখা গেল না। যাবার প্রশ্নও ছিল না। কারণ ততদিনে আর্যরা কৃষিভিত্তিক স্থায়ী জনপদ বসিয়ে ফেলেছে। আর আগের যাযাবরবৃত্তিতে ফিরে যাবার আগ্রহ বা সুযোগ নেই। এই হলো গৌতমমুনি ও অহল্যার উপাখ্যানের অন্তর্নিহিত তাৎপর্য।
তারা বানররাজ বালির পত্নী। হঠাৎ বানরদের নিয়ে মানুষ এত উৎসাহী হয়ে উঠেছিল কেন? নাকি বানররা মানুষের সমদক্ষ ছিল সেই রামায়ণের সময়ে? একটু ভেবে দেখলেই বোঝা যাবে, কোনওটাই নয়। আসলে এই বানর মানে হলো বানর টোটেমধারী অরণ্যচারী মানুষ। মধ্যভারতের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে ছিল তাদের বসবাস। এই টোটেমের প্রসঙ্গ থেকেই তাদের প্রোটো-অস্ট্রলয়েড অর্থাৎ আজকের সাঁওতাল, কোল, ভিল ইত্যাদি জনজাতিদের পূর্বপুরুষ বলেই মনে হয়য়। বালি তাদের এক পরাক্রান্ত রাজা, যার শক্তির কাছে আর্যরাও পর্যুদস্ত ছিল। বালি আবার রাক্ষসরাজ রাবণের প্রথমে শত্রু, পরে বন্ধু।
রাবণের বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রার আগে আর্যনেতা রামের শক্তিবৃদ্ধির প্রয়োজন ছিল। বানররাজ্যের আভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের সুযোগে রাম সুগ্রীবের পক্ষ নেন এবং বালিকে নিহত করে সুগ্রীবকে বানররাজ্যের রাজা হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করেন। এর ফলে রাম অনার্য রাক্ষস রাবণের বিরুদ্ধে যুদ্ধের উপযোগী শক্তি সংগ্রহ করেন। বালির মৃত্যুর পর সুগ্রীব তারাকে বিবাহ করেন। আদিবাসী প্রথার সাথেও এই ঘটনাটা মিলে যায়।
রামায়ণের কাহিনী অনুযায়ী সিংহাসনে বসার পর সুগ্রীব টালবাহানা করতে শুরু করেন। ফলে রামলক্ষণ ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন। এই পরিস্থিতিতে রাণী তারা হস্তক্ষেপ করেন। শেষ পর্যন্ত সুগ্রীব রাবণের বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করতে সম্মত হন। তারার এই ভূমিকা ছাড়া রামায়ণের কাহিনী রামের পক্ষে ঢলে পড়া সম্ভব ছিল না। অর্থাৎ অনার্য সভ্যতার উপর আর্য নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা সম্ভব হতো না। এই ঐতিহাসিক বাস্তবতাকে স্বীকৃতি দেবার জন্যই হয়তো তারাকে পঞ্চকন্যার অন্তর্ভূক্ত করা হলো। তারা হয়তো আদিবাসী সমাজের সেই গোপন শক্তি যা আদিবাসী-স্বাতন্ত্রকে অস্বীকার করে আর্যদের বশ্যতা স্বীকার করে নিতে চেয়েছিল। বালির স্ত্রী থেকে রাতারাতি সুগ্রীবের পত্নী হয়ে ওঠার মধ্যেও বোধহয় এই ইঙ্গিতটাই আছে।
মন্দোদরী মায়াসুরের কন্যা, রাবণের স্ত্রী। অর্থাৎ তার মাধ্যমে অনার্য সভ্যতার দুটি ধারার মিলন ঘটেছিল। রাক্ষসরাজ রাবণ সীতাকে হরণ করেন। সীতা অযোনিজা। মিথিলাধিপতি জনকের হলকর্ষণ পূজার সময় লাঙলের ফলায় মাটি চিঁড়ে গেলে সীতার আবির্ভাব হয়। স্পষ্টতই সীতা হলকর্ষণ-সভ্যতার প্রতীক। রাবণ সীতাকে হরণ করার একটি তাৎপর্যই সঙ্গত বলে মনে হয়। আর সেটি হলো আর্যদের হাসিল করা কর্ষণযোগ্য জমি দখল করে নেওয়া। প্রসঙ্গত 'বনবাসী' রামের রাবণের বোন শূর্পনখার অধীন অরণ্যে প্রবেশ আর্যদের সম্প্রসারণের ইতিহাসেরই সাক্ষ্য দেয়। বিপরীতে রাবণের প্রতিরোধ ছিল অবশ্যাম্ভাবী।
মন্দোদরী প্রতিমুহূর্তে রাবণকে বোঝানোর চেষ্টা করেন সীতাকে মুক্তি দেওয়াটাই মঙ্গলের কাজ হবে। রাবণ কর্ণপাত করেননি। তখন মন্দোদরী প্রাণপণে চেষ্টা করেন রাবণ যাতে সীতাকে নষ্ট না করেন। প্রচলিত মতে নষ্ট করার অর্থ করা হয় শারীরিক সম্ভোগ করা বা ধর্ষণ করা। এই মতটা খুব বাস্তব বলে মনে হয় না। এক প্রবল পরাক্রান্ত রাজা যদি একটি নারীকে দখল করে আনেন, তবে হাজার যুক্তি দিয়েও তাকে নিবৃত্ত করা যায় বলে মনে হয় না। তাই একটু অন্যভাবে ভাবা যাক।
যুদ্ধে পোড়ামাটি নীতি চিরকাল প্রয়োগ করা হয়ে আসছে। পোড়ামাটি নীতির মূলকথা হলো যুদ্ধে যদি পরাজয় অনিবার্য মনে হয়, তাহলে যে জমির উপর অদূরভবিষ্যতে আর কবজা থাকবে না, তাকে এমনভাবে অকেজো করে দাও যাতে শত্রুপক্ষ আর তাকে ব্যবহার করতে না পারে। সদ্য কর্ষণযোগ্য হয়েছে যে মাটি তাকে যাতে নষ্ট না করা হয়, সম্ভবত মন্দোদরী সেই পরামর্শই দিয়েছিলেন এবং রাবণ তা মেনেও নেন। অর্থাৎ মন্দোদরীর সুপরামর্শেই নবজাত কৃষিসভ্যতা রক্ষা পায়।
এরপরের ইতিহাস বানররাজ্যের মতোই। সুগ্রীবের মতোই রাবণের ভাই বিভীষণ রামের সাথে মিত্রতা গড়ে তুলল। রাবণের হত্যার পরে বিভীষণ হলেন রাক্ষসরাজ। আর রামের পরামর্শে তিনি মন্দোদরীকে বিবাহ করলেন। তারার উপাখ্যানের সঙ্গে এখানেও মিল রয়েছে। এবং এখানেই একটা ইঙ্গিত খুব স্পষ্ট যে এই দুই সভ্যতাই ছিল মাতৃতান্ত্রিক। তাই প্রাক্তন রাণীর স্বীকৃতি ছাড়া নতুন রাজার মান্যতা পাওয়াও সম্ভব ছিল না। তারা এবং মন্দোদরী - দুই অনার্য রাণীই শেষ পর্যন্ত আর্যসভ্যতার প্রভাব বিস্তারের সহায়ক হন। আর সেই ভূমিকারই স্বীকৃতি হলো পঞ্চনারীর তালিকায় স্থান পাওয়া।
যুগের হিসাবে অহল্যার জন্ম সত্যযুগে। আর্যরা তখনও কোনও জায়গায় স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেনি। জমি তখনও অহল্যা অর্থাৎ অকর্ষিত। তারা ও মন্দোদরী ত্রেতাযুগের চরিত্র। অহল্যার পাথর থেকে মানবীরূপে প্রত্যাবর্তন এই যুগেই। অর্থাৎ ত্রেতাযুগেই আর্যরা কৃষিতে পারদর্শী হয়ে ওঠেন। এবং সুফলা জমির সন্ধানে আদিবাসী ও অনার্যদের বিরুদ্ধে তারা যুদ্ধ করেন এবং তাদের উপর কর্তৃত্ব আরোপ করেন। এর পরের যুগ হলো দ্বাপর অর্থাৎ মহাভারতের যুগ। কুন্তী ও দ্রৌপদী এইযুগের চরিত্র। এবারে তাদের নিয়ে আলোচনা করা যাক।
কুন্তী কুন্তীভোজ রাজার মেয়ে। অবিবাহিত অবস্থায় সূর্যদেবের সঙ্গে মিলনের ফলে তিনি কর্ণের জন্ম দেন। পরবর্তীকালে হস্তিনাপুরের রাজা পাণ্ডুর সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়। পাণ্ডু ছিলেন শারীরিকভাবে অসুস্থ। তাই নিয়োগপ্রথার মাধ্যমে কুন্তী যুধিষ্ঠির, ভীম ও অর্জুন, এই তিনটি সন্তানের জন্ম দেন। স্পষ্টতই তিন অগ্রজ পাণ্ডব আর যাই হোক পান্ডুর রক্ত বহন করতেন না। অথচ তারা পাণ্ডব বলেই শুধু পরিচিত হননি, কুরুবংশের সিংহাসনেরও দাবিদার হয়ে ওঠেন। একটু অবাক হতে হয় নাকি!
কুরুবংশের অতীতটা একবার দেখে নেওয়া যাক। মহাভারতের কাহিনী অনুযায়ী কুরুবংশের প্রতিষ্ঠাতা হলেন কুরু। কিন্তু তার প্রত্যক্ষ সন্তানাদির কোনও বিবরণ পাওয়া যায় না। কেউ কেউ মনে করেন কুরু আসলে একটি গোষ্ঠীর নাম, যা উত্তরভারতের দোয়াব অঞ্চলে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে। কুরুবংশ নাম থেকেও এই ইঙ্গিত পাওয়া যায়। মহাভারতে প্রথম যে কুরুরাজের বিস্তৃত পরিচয় পাওয়া যায়, তিনি হলেন শান্তনু। শান্তনু প্রথমে গঙ্গাকে বিবাহ করেন। তাদের প্রথম সাতটি সন্তানকে জন্মের পরেই জলে ভাসিয়ে দেন গঙ্গা নিজেই। অষ্টম পুত্র দেবব্রত রেহাই পান শান্তনু সচেষ্ট হওয়ায়। পরে শান্তনু সত্যবতীকে বিবাহ করেন। সত্যবতী ছিলেন ধীবরকন্যা। কুমারী অবস্থাতেই তিনি মুনি পরাশরের ঔরসে ব্যাসের জন্ম দেন, যিনি আবার মহাভারতের কথাকার।
শান্তনুর ঔরসে সত্যবতী চিত্রাঙ্গদ ও বিচিত্রবীর্য নামে দুটি সন্তানের জন্ম দেন। চিত্রাঙ্গদ অতি অল্পবয়সেই মারা যায়। বিচিত্রবীর্যের মৃত্যু হয় তার বিবাহের সামান্য পরেই নিঃসন্তান অবস্থায়। শেষে সত্যবতীর নির্দেশে ব্যাস তার দুই বিধবা স্ত্রীর গর্ভে ধৃতরাষ্ট্র ও পাণ্ডু নামের দুই পুত্রের জন্ম দেন। অর্থাৎ তিনটি প্রজন্মের মধ্যেই সিংহাসনের উত্তরাধিকারীদের বাস্তবত আজকের হিসাবে আর কুরুবংশের সন্তান বলার উপায় রইল না। অথচ তারাও রাজা হলেন পরপর। তাহলে কি এমনটাই মেনে নেওয়া যৌক্তিক হবে না যে বংশধারা আসলে মায়ের উৎস ধরেই নির্ধারিত হতো? একমাত্র তাহলেই এই জটিলতার উত্তর পাওয়া যায়। গঙ্গার সাতটি সন্তান (যারা শান্তনুর ঔরসজাত) জলে ভাসিয়ে দেওয়া, চিত্রাঙ্গদ ও বিচিত্রবীর্যের অল্পবয়সে মৃত্যু কি আসলে এই সত্যকে প্রতিষ্ঠা দেবার জন্যই যে নিজস্ব গোষ্ঠীর মধ্যে বৈবাহিক সূত্রে আবদ্ধ থাকলে উত্তরণ সম্ভব নয়, রক্তের সংমিশ্রণ চাই। নিয়োগপ্রথার কথা তুললে সেই মায়ের উৎসের সত্যতাই কিন্তু স্বীকৃত হয়।
কাজেই কুন্তী হলেন সেই নারীশক্তির প্রতীক যিনি বিভিন্ন উৎস থেকে বীজ আহরণ করে সমাজকে পুষ্ট করেছেন; নতুন যুগের উপযোগী মানুষের জন্ম দিয়েছেন। এই কথা মানলে কুন্তীকে প্রণম্যা বলে স্বীকৃতি দেওয়াটাই উচিৎ। কুন্তী কোনও একজন নারী নাও হতে পারেন। কুন্তীর প্রকৃত নাম পৃথা অর্থাৎ পৃথ্বী-দুহিতা। যে অর্থে অহল্যা স্বয়ং মৃত্তিকা, সীতা হলনের ক্ষত, কুন্তী তাদেরই উত্তরসূরী। পৃথিবী যেমন তার বুকে যখন যে জাতের বীজ এসে পড়ে, তারই অঙ্কুরোদ্গম ঘটায়, পৃথাও যেন তারই রূপক। যে সংমিশ্রণ ছিল অবধারিত, এবং যা না ঘটলে সমাজের বিকাশও সম্ভবপর হতো না, কুন্তী তারই প্রতীক বলেই অবশ্যস্মরণীয়া।
দ্রৌপদীর প্রকৃত নাম যাজ্ঞসেনী। যজ্ঞের আগুন থেকেই তার জন্ম। যজ্ঞের আগুন থেকে কি সৃষ্টি হয়? ধোঁয়া। এই ধোঁয়াই ক্রমাগত আকাশে উঠে মেঘ তৈরি করে; আনে বৃষ্টি। পৃথা-মানবী যে সূতিকাগার তৈরি করেছেন, যাজ্ঞসেনী মেঘ বৃষ্টির জল ঢেলে যেন তার চারাগুলিকে লালন করেন, পুষ্ট করেন। মহাভারতের কাহিনীতে দ্রৌপদীকে ঠিক সেই ভূমিকাতেই দেখা যায়। পঞ্চপাণ্ডবের একমাত্র প্রত্যক্ষা স্ত্রী হিসাবে তিনি যেন তাদের অভিভাবিকা। তাদের লালন করছেন যাতে তারা ঐক্যবদ্ধ থাকে শেষ সংগ্রামের দিন পর্যন্ত।
একটা বিষয় কেউ ভেবে দেখেছেন, দুর্যোধন পাণ্ডব ছাড়া আর কার সঙ্গে অপরাধ করেছিলেন? আমি একটাও উদাহরণ পাইনি। কুরুপাণ্ডবের দ্বন্দ্বের এক ও একমাত্র কারণ ছিল সিংহাসনের অধিকার। দুর্যোধনের বক্তব্য ছিল সে কুরুরাজ ধৃতরাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ উত্তরাধিকারী। তাহলে সিংহাসনে তারই অধিকার। অপরপক্ষে পাণ্ডবেরা গতায়ু রাজা পান্ডুর প্রথমা স্ত্রীর গর্ভের সন্তান। হস্তিনাপুরের রাজসভার যাবতীয় প্রাজ্ঞ ব্যক্তি, যেমন ভীষ্ম, দ্রোণ, বিদুর, সকলেই তাদের দাবিকে যথার্থ বলে মনে করতেন। মাতৃতান্ত্রিকতার বাতাবরণ ছাড়া এই বিষয়টিকে কি যৌক্তিক বলে মনে হয়? কাজেই কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ আসলে পিতৃতান্ত্রিক ও মাতৃতান্ত্রিক অধিকারের মধ্যে শেষ লড়াই। সেই লড়াইয়ে দ্রৌপদী মাতৃতান্ত্রিকতার প্রতিনিধিদের ঐক্যবদ্ধ করে রেখেছিলেন।
আশ্চর্যের বিষয় হলো, দ্রৌপদীর মাধ্যমেই কিন্তু মাতৃতান্ত্রিক উত্তরাধিকারের প্রথা শেষ হয়ে গেল। কারণ দ্রৌপদীর সন্তানেরা কেউই আর বেঁচে রইল না যুদ্ধের শেষে। এবং যে কায়দায় অশ্বত্থামা ঘুমন্ত শিশুদের হত্যা করল, তাকে স্রেফ একটা আচম্বিত যবনিকাপাত ছাড়া আর কিছুই বলা যায় না। অর্জুনের পুত্র অভিমন্যু নিহত হলেও তার ঔরসজাত ভ্রূণ তখন তার স্ত্রী উত্তরার গর্ভে। যুধিষ্ঠিরের পরে সেই সন্তান পরীক্ষিৎ-ই হলো রাজা। অর্থাৎ দ্রৌপদী এক ঐতিহাসিক বিবর্তনের প্রতিভূ। সমাজে রক্তসংমিশ্রণের প্রথার মধ্য দিয়ে যে বিকাশ ঘটেছে, এবারে তাকে সুস্থিত করতে হলে পিতৃতান্ত্রিক উত্তরাধিকার চাই। দ্রৌপদী নিজের হাতে সেই কাজটি করে গেলেন। তাই বোধহয় তাকেও পঞ্চনারীর তালিকায় স্থান দেওয়া হলো।
একটি যুক্তিপূর্ণ পরিক্রমা। ইতিহাস কে নির্ভর করে সমকালিন পর্যালোচনা। প্রবন্ধটির মূল্য অপরিসীম। সুজন দা-র থেকে প্রতিনিয়ত শিখি। সবাইকে অনুরোধ লেখাটি পড়ুন।
ReplyDeleteএমন সাসিত্য বাতাবরণের আঙিনায় সুজন দা-র লেখার পাশে নিজের লেখাও স্থান পাওয়ার অনুভুতি আলাদা।
পিনাকী দত্ত গুপ্ত
অনবদ্য যুক্তি সহ প্রতিটি সতীর বিশ্লেষণ ভাবা যায় না ।
ReplyDeleteসুখপাঠ্য প্রবন্ধ ।
ReplyDeleteঅসাধারণ লেখনী। তৎকালীন ইতিহাসের সম্যক বিশ্লেষণ। অজানা অনেক কিছু জানতে পারলাম। ভাবনা গুলো সুস্পষ্ট হলো।
ReplyDeleteএই ভাবে যুগান্তর পরম্পরার মধ্যে সুক্ষ সুত্র খুঁজে তার গোড়া থেকে ডগা পর্যন্ত এই বিশ্লেষণ পড়ে আমি অভিভূত। সুজন্ বাবুকে কুর্ণি। পিতৃতান্ত্রিকতাই কি মনুষ্য সভ্যতার বিনাশের কারণ হবে?
ReplyDeleteএকটি ধারণা ডঃ রাধা কৃষ্ণাণ ও কবি গুরুর থেকে আমার মনে বাসা বেঁধেছিল আজ অনেকটা স্পষ্ট হলো ভাববার পথ। আপনাকে আমার আন্তরিক অভিনন্দন জানাচ্ছি। নমস্কার।
ReplyDeleteএকটা বিষয় ক্লিয়ার বুঝলাম না বিচিত্রবীর্যের কি দুই স্ক্রী ছিল?
ReplyDelete