বইঘর - নন্দিনী সেনগুপ্ত
Posted in বইঘর
বইঘর
বুদ্ধদেব বসুর ‘দ্রৌপদীর শাড়ি’
নন্দিনী সেনগুপ্ত
যে বয়সে এই বইটা প্রথম আমার হাত এসেছিল, সে বয়সে এই কবিতাশৈলী বোঝার কোনও কারণ নেই। কিন্তু ঠিক যেভাবে কিছু দুর্ঘটনা পৃথিবীতে ঘটে যায়, সেভাবেই আমি বইটা বারো বছর বয়সে প্রথম পড়ি। না, ভালো লাগেনি তখন। তবে অদ্ভুতভাবে ভুলে যেতেও পারিনি বইটার কথা। ভালো লাগেনি সেরকম, কারণ বুদ্ধদেব বসুকে ততখানি আধুনিক কবি মনেই হয়নি। জীবনানন্দ সবে পড়ছি সে সময় আমি বা আমার বয়সী আরও অনেকেই। প্রকৃতির মাধুর্য, প্রেমের জটিলতা, এসব বিষয়ের কাব্যিক প্রকাশ দেখে সম্পৃক্তি ঘটে যাচ্ছে আমাদের মনোজগতে খুব সহজ বিক্রিয়ায়। সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে বুদ্ধদেব বসুকে স্পর্শ করাটা সহজ নয়, বয়স একটা বড় অন্তরায়। দুর্ঘটনার বছরদুয়েক পরে প্রথম যে কবিতায় মনে হয়েছিল যে বুদ্ধদেব বসু আবার পড়া দরকার, অদ্ভুতভাবে সেই কবিতা এই বইতে নেই। তবে কবিতাটা জীবনের একটা অদ্ভুত সত্যের দিকে আঙ্গুল তোলে। ‘ইলিশ’ কবিতা শিরোনাম দেখে পড়তে গিয়েছিলাম যে হয়তো বা কোনও ছেলেভুলানো ছড়া হবে। ভীষণ ধাক্কা খেলাম, ‘নদীর নিবিড়তম উল্লাসের মৃত্যুর পাহাড়’ পড়ে। প্রথম লাইনে ‘আকাশে আষাঢ় এলোঃ বাংলাদেশ বর্ষায় বিহ্বল’। বুঝে উঠতে পারি না কবি বর্ষাকে ভালবাসেন না ঘৃণা করেন! এত নিঃস্পৃহ হয়ে ওঠে মাঝে মাঝে তার বর্ষার কবিতারা।
এত কিছুর পরেও এই বইয়ের বেশ কিছু বর্ষার কবিতা মন টানে বার বার। ‘শ্রাবণ’ কবিতার ছন্দের রূপ চমকে দেয়। খুলে গেছে কঠোর অন্তমিলের শৃঙ্খল। ‘জানো কি’ শব্দের সাথে ‘জোনাকি’, ‘দেবো তা’ শব্দবন্ধের সাথে ‘কবিতা’ এসে রচনা করছে উচ্চারণের এক মাধুর্যলোক। এ কবিতা শুধুই নিজে পাঠ করে অনুভবে সমৃদ্ধ হবার জন্য নয়, সম্ভবত বার বার পাঠ করে অন্যকে অনুভব করাবারও বটে! পরম যত্নে নির্মিত কবিতার শরীরে যখন এরকম এক্সপেরিমেন্ট লুকিয়ে থাকে, তাকে আধুনিকতা বলে কুর্ণিশ করা ছাড়া উপায় থাকেনা।
শুধু ছন্দশৈলীর দিক থেকে বৈচিত্রময় কবিতা নয়, সুন্দর চিত্রকল্পের সহজ ভঙ্গিমার কবিতাও আছে এই বইটিতে। ‘রবিবারের দুপুর’ কবিতায় যেন ঝলমলে এক উৎসবের আলো ফুটে ওঠে নিচের পঙক্তিগুলিতে-
‘গাছের ছায়ায় এসে দাঁড়িয়েছে তিনটি তরুণী,
রোদের পৌরুষে ঢেলে লাল নীল হলদে বেগুনি ...’
এরকম চিত্রকল্প আরও দেখি ‘পৌষপূর্ণিমা’ কবিতায়; তবে এখানে ভঙ্গিমা সহজ নয়। অদ্ভুত শব্দঝঙ্কার, যা হয়তো শুধুমাত্র তারই বিশেষত্ব, প্রকাশ পায় এই পঙক্তিগুলিতে...
‘বালিগঞ্জের বাড়ির গম্ভীর ভিড় যদি কোনো ফাঁকে
মেলে দেয় একটু সবুজ, ইলেকট্রিক আলো জ্বেলে
অচন্দ্রচেতন যুবা ঘণ্টা দুই ব্যাডমিনটন খেলে।’
এই ‘অচন্দ্রচেতন’ শব্দটি প্রথম পেয়েছিলাম তারই কবিতায়। ব্যাডমিনটন শব্দের সাথে সমানুপাত সাযুজ্য শুধু নয়, তৈরি করেছেন কবি শব্দটি। হ্যাঁ, এই শব্দবন্ধ নির্মাণ করে স্পর্শ করতে চেয়েছেন শহুরে নির্লিপ্তি এবং স্বার্থপর আত্মমগ্নতাকে।
এই কাব্যগ্রন্থে কবির রবীন্দ্রদ্রোহিতার কোনও চিহ্ন পাইনি। ভেঙে বেরিয়ে এসে কোথাও ভীষণভাবে অস্বীকার করছেন রাবীন্দ্রিক উচ্চারণ, এরকম মনে হয়নি কোনও কবিতাতেই। বরং মনে হয়েছে রবীন্দ্রনাথ রেখে গিয়েছেন যে সংগঠিত ভিত্তি, বুদ্ধদেব বসু তার উপরেই স্তম্ভ তৈরি করে সেতু বেঁধেছেন আধুনিক কাব্যশৈলীর সাথে। হয়তো সেই কারণেই আমার অপরিণত বয়সের প্রথম পাঠে তার কবিতাকে ততটা আধুনিক বলে মনে হয়নি।
বুদ্ধদেব বসুর কবিতার কথা বলতে গেলে অতি অবশ্যই উল্লেখ করতে হবে প্রেমের কবিতার কথা। এই বইতে বেশ কিছু সুন্দর প্রেমের কবিতা আছে, কিংবা এভাবেও বলা যেতে পারে যে প্রায় সব কবিতার মধ্যেই আমরা খুঁজে পেতে পারি প্রেমের বহমান ধারা। কোথাও সে ধারা অন্তঃসলিলা ফল্গুনদীর মতো লুক্কায়িত, কোথাও বা উচ্চকিত জলপ্রপাতে কলনাদিনী। প্রেমের অন্য পিঠে যে বিরহ, সেও প্রেমের আরেক প্রকাশ। ‘কোনো মৃতার প্রতি’ কবিতায় উচ্চারিত হয় যেন জীবনের এক অমোঘ সত্য... ‘ ‘ভুলিবো না’ – এত বড়ো স্পর্ধিত শপথে/ জীবন করে না ক্ষমা। তাই মিথ্যা অঙ্গীকার থাক।’ মাত্র সাত লাইনের এই কবিতার শেষলাইনের অতি সাধারণ কথায়, ‘তুমি ছিলে, তবু তুমি ছিলে’ প্রেমে যেন এক আর্তির মতো উচ্চারিত হয়।
সব কবিতা, প্রায় সব কবিতার মধ্যেই প্রেম। হ্যাঁ, প্রকৃতির কথা বলতে গিয়ে যেন কবি প্রেয়সীকেই সম্বোধন করেন। ‘সলজ্জ আষাঢ়’ কবিতার শিরোনামেই লেগে আছে পূর্বরাগের আবেশ। আষাঢ় যেন দ্বিধাগ্রস্ত প্রিয়া। কবি বলছেন, ...
‘কেন থরোথরো দ্বিধাভরে যাও থমকি’
পরুষ রৌদ্রপরশে সহসা চমকি,
কেন এসে তবু আসো না।’ ... ‘পরুষ রৌদ্রপরশে’ শব্দগুলির মধ্য দিয়ে আষাঢ়ের মেঘসজ্জার এক বিপরীত দ্বন্দ্বমুখর মেরু নির্মাণ করেন কবি।
যেকোনো কবির প্রিয় বিষয় হল কবিতা নিয়ে কবিতা লেখা। ‘নূপুর’ কবিতায়, কবিতাই হয়ে উঠেছে কবির প্রেয়সী। কবি পরম যত্নে যেন নববধূর সাজে তাকে সাজিয়ে তুলতে চেয়েছেন। কিন্তু সে কি বধূ বা সাধারণ কোনও প্রেয়সী? সে যেন অভিসারিকা। কবি কান পেতে থাকেন কখন সে আসবে। তার প্রতি পদক্ষেপে বেজে উঠবে নূপুর। হয়তো কবিতা নিয়ে তার মূল ভাবনাটিই বিম্বিত হয়েছে এই কবিতায়। বলে ওঠেন, ...
‘তোমার চোখে পড়বে ব’লে বিকালে
অস্তরবির রঙিন লিপি লিখালে,
বৃষ্টি পড়া রাতের চাঁদে মাখালে
অশ্রু মেশা হাসির নেশা নববধূর-
পরো নূপুর, পরো নূপুর, পরো নূপুর।’
‘দুই পূর্ণিমা’ কবিতাতেও প্রধান উপজীব্য কবিতা। কবির বিভিন্ন বয়সে লেখা কবিতা মিলেমিশে ‘চিরকালের বঁধু’ হয়ে জেগে আছে হৃদয়ের মাঝে।
প্রেম বড় সুন্দর এবং প্রেমের উচ্চারণ যেন মন্ত্রের মত মহিমামণ্ডিত মনে হয় যখন কবি বলেন,
‘কঙ্কা, তুমি এই স্তব্ধ গম্ভীর আদিম অন্তিম
রাত্রি, শান্তি; ...’ (কালো চুল)
প্রেমের আবাহনে যেন কবিতায় যেন এক সম্মোহনী আবেশের আলো-ছায়া নেমে আসে...
‘তা’হলে উজ্জ্বলতর করো দীপ, মায়াবী টেবিলে
সংকীর্ণ আলোর চক্রে মগ্ন হও, যে- আলোর বীজ
জন্ম দেয় সুন্দরীর...’ (মায়াবী টেবিল)
প্রেমের প্রত্যাখ্যানও যেন মাধুর্যময় হয়ে ওঠে তার কবিতায়।
‘বার বার করেছি আঘাত
খোলে নি দুয়ার।
নিরুত্তর নির্বোধ প্রাসাদ
অবরুদ্ধ অন্তপুর নিঃসাড় পাষাণে।’ (নির্বোধ প্রাসাদ)
তবে তাকে বাস্তববিমুখ, নির্লিপ্ত প্রেমের কবি, কিংবা শুধুই তাত্ত্বিক মননশীল বলে মেনে নিতে কষ্ট হবে যদি কেউ একটু ভেবে এবং মন দিয়ে পড়েন তার কবিতাগুলি। আসলে হয়তো কবিতা এমন একটা শিল্প যেখানে শত আড়াল সত্ত্বেও মানুষ তথা কবি নিজের মনের দরজাগুলি বারে বারে খুলে দিতে পারেন, কারণ কবিতা এমনটাই দাবী করে। হৃদয়ের অন্তস্থলের সত্য স্পর্শ ছাড়া কবিতা প্রাণ পায় না। হ্যাঁ, নৈরাশ্য আছে বটে তার কবিতায়। কিন্তু সে প্রকাশ অবাস্তব নয়...
‘হায় রে, মানুষ করেছে ফন্দী
প্রকৃতির হবে প্রতিদ্বন্দ্বী!
কেড়েছে শক্তি, শেখে নাই তার ছন্দ।...’ (কার্তিকের কবিতা)। একটু নতুন করে হয়তো আবার ভাবা দরকার এই নিয়ত পরিবর্তনশীল প্রকৃতি এবং পৃথিবীতে দাঁড়িয়ে, যে কবি কোন বার্তার দিকে ইঙ্গিত করতে চেয়েছেন কাব্যিক নৈরাশ্যের বাতাবরণে ঢেকে।
এই কাব্যগ্রন্থ প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৪৮ সালে; তখন ভারতবর্ষ স্বাধীনতা পেয়ে গেছে। শেষ হয়ে গেছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। কবিতাগুলি লেখা হচ্ছিল তার কিছুসময় আগে থেকেই। ভুললে চলবে না সে ছিল আমাদের সমাজের, দেশের তথা পৃথিবীর এক রক্তাক্ত সন্ধিক্ষণ। মনে হয় না কি, এ এক নিদারুন চ্যালেঞ্জ ছিল কবির সামনে? কঠিন, কুৎসিত, অন্ধকার সময়ে সুন্দর থাকার চেয়ে বড় স্পর্ধা আর কিছু হতে পারে কি? সেই অস্থির সময়ে কবিতায় নৈরাশ্য প্রতিফলিত হওয়াটাই স্বাভাবিক। আশা নিরাশার দ্বন্দ্বের ছবি এক নৃত্যমুখর ছন্দে ফুটে ওঠে ‘দ্রৌপদীর শাড়ি’ কবিতায়...
‘আকাশে তারই স্বৈরাচার-
কখনো নীল মেঘের ভার,
আলোর বাঘ কখনো ছায়া-
হরিণে করে তাড়া;
আশার দাঁত চিবিয়ে ছেঁড়ে
দ্রৌপদীর শাড়ি...’
যাকে আশা বলে মনে হয়, যাকে আলো বলে মনে হয়, দ্রুত বদলে যায় তার রূপ মরীচিকার মত। মহাকাব্যের থেকে তুলে আনা এই বস্ত্রখণ্ড তবুও এক দুরপনেয় আশার ইঙ্গিত বহনকারী পতাকার প্রতীকে বদলে যায়, যখন শেষ স্তবকে কবি উচ্চারণ করেন...
‘অসম্ভব দ্রৌপদীর
অন্তহীন শাড়ি।’
0 comments: