0

ছোটগল্প - কর্ণ শীল

Posted in


ছোটগল্প 


বড়দিন
কর্ণ শীল


এই ডিসেম্বরের শেষ থেকেই বরফ পড়া শুরু হয়েছে। জুলাইতে সবচেয়ে বেশি গরম পড়ে। মার্চ পর্যন্ত এবার চলবে হাড়কালি করা আটলান্টিক মহাসাগরীয় ঠাণ্ডা। রিকজাভিক নুউক ভস্টকের যত মরণদশা শিরশিরানি উত্তুরে ছোবল কোপেনহাগেন জুড়ে ছড়িয়ে যাবে। জুনের সেই রোদজ্বলা সোনাঝরা দিনগুলো মনে পড়ে রডরিকের। জুলাই সেপ্টেম্বরই বা খারাপ কোথায়? সেভিয়র চার্চের চূড়া ছোঁয়া মেপলপাতায় ঝুরঝুরে মিহি বৃষ্টি কি সুন্দর রামধনু মাখিয়ে দেয়। ডিসেম্বরের পনেরো তারিখ পার হ'লেই মেজাজটা খিঁচড়ে যায় ওর। রাস্তাজুড়ে বরফের পুরু প্রলেপ। সিটিহলের সামনেটা যেন ভেজা পেঁজা তুলো দিয়ে কেউ মুড়ে রেখেছে। সেন্ট নিকোলাজ গীর্জের ফাদার আবেরেদিন ডেকে বললেন,
-রডরিক, বাপু বড়দিনের দিনদুটো ফাঁকি দিসনে বাপ। বরফ, পাতা ঠিকমতো পরিস্কার রাখিস যেন। ভ্যাটিকানের প্রতিনিধি আসবেন। ডোবাসনে যেন।

তেইশের বিকেলে তখন ছায়া ছায়া মানুষগুলো বার্চের শঙ্কুআকৃতি মাথাগুলো কাঁধে, গাড়িতে চাপিয়ে ঘরফেরতা। বাড়িতে বাড়িতে লালনীলহলুদ বৈদ্যুতিন ছোটছোট আলোর মালা বেঁধে দেওয়া হচ্ছে। একরাশ বিরক্তি নিয়ে রডরিক তিনচাকা আইসড্রাইভটা গীর্জার পর্চ, সমাধিস্থল, ফোয়ারার নীলচেসাদা পরীটার পাশ দিয়ে দুবার ঘুরিয়ে আনলো। অটোভ্যাকুয়ামে ঝরা বার্চ মেপলপাতাগুলো কন্টেনারে জমা হয়েছে। ডিসপোজাল ভ্যান আসবে সেই ছ'টায়। তিনটের সময় একবার ঘুরে গেছে।

ডিসপোজাল ভ্যানের ড্রাইভার রডরিকের এক ইয়ার। সেও বিরক্ত। দুটো বৌ। একটা অবশ্য ডিভোর্সি। চারটে ছেলে। তিন মেয়ের মধ্যে ছোট মেয়ের শ্বাশুড়ি আবার রডরিকের সাথে খুব ডেটিং করছে ইদানিং। একগাদা রাগ উগরে দিয়ে গেছে বিকেলের শিফটে,
-শালা, মাগী ছানা নিয়ে জ্বলে মরি সারাবছর। বড়দিনে সবাই যখন মাল খেয়ে হুল্লোড় করবে, তুমি আমি বরফ পাতা ঠেলবো। যীশুবাবা জেরুসালেম ছেড়ে যে কি করতে এই পোড়া উত্তুরে বরফের দেশে এসেছিলেন কিজানি! তুমি তো এই এক চার্চ খালাস করেই ঝাড়া ঠ্যাংহাত। আমার কোপেনহাগেন ঘুরে ঘুরে সবার পচাপাতা ভিজে বরফের অ্যাবরশন করতে হবে। শালা, এর চেয়ে আমাদের ভাইকিং থর ওদিনই ভালো। চার্চ টার্চের বালাই নেই।
যাই, ক্রিশ্চানবর্গ প্যালেসে আবার মার্বেলের দেবদূত আকাশে উড়তে গিয়ে ঠ্যাঙ পাখা সব ভেঙেছেন। তা তাঁকে ডিসপোজ করতে হবে কাবারখানায়। চলি। তুমি বাপু সব জড়ো করে রেখো যেন।
জ্বলন্ত সিগারটা দাঁতে চেপে কলারটা টেনে কানটা ঢেকে নিল। গাড়িটা ঝোপড়ালো ওয়ালনাট গাছটার নিচে রেখে ফার্স্ট গিয়ারে নিয়ে সামনের ঢালুটার উপরে তুলে, নিউট্রালে আনলো। স্টার্ট অফ করলো। চাবিটা আজানু ক্লোকের পকেটে রাখলো। কম্ফর্টারে মুখটা জড়িয়ে নিল। 
সবে চারটে। হাতে কম ক'রে এখনও দেড় ঘন্টা। সাড়ে পাঁচটায় এসে আরেকবার ড্রাইভ ক'রে নিলেই হবে।
অপারেশন কার্থেজের মরা লাশের মতো মেয়েদের স্কুলটা দাঁড়িয়ে আছে এখনও। সুইডিশ নর্থ ইন্ডিয়ান আমেরিকান আফ্রিকান ট্যুরিস্টরা ঘুরছে। ফটাফট ক্যামেরার ফ্ল্যাশে গোলাপী বিকেলের নরম শেষ আলোটা চমকে উঠছে। গাইড স্টার্লিং রোজকার মতোই ভ্যানভ্যান ক'রে ত্রাতা মার্শাল মন্টগোমরীর গল্প শুনিয়ে চলেছে। গেস্টাপোনিধন, ফুয়েরারপলায়ন..কত বড় বড় শব্দ। অসহ্য। 
আরও বেশি অসহ্য লাগে ওই চ্যাঁ চ্যাঁ করতে থাকা বাচ্চাগুলো। সারাক্ষণ শালা বায়না করেই চলেছে। ক্যান্ডি দাও। স্যান্টা দাও। না এই লালসাদা না। নীল গোলাপীটা। শালা সান্টা নীলগোলাপী কি করে হয় কিজানি!
অ্যামাগের পার্কে গতবছর গিয়েছিল রডরিক। দশমিনিটে বিরক্ত হয়ে গিয়েছিল ও। নকল দ্বীপটা বরফে বরফে ঢাকা। বাল্টিক সাগরের ঢেউ আছড়ে পড়ে তীরের চিরন্তন সমতলে। উত্তরসাগরের কোনাচে ছুরির মতো হাওয়ায় সমুদ্রশুশুকের পিঠে বসা গালের গা যখন শিরশির ক'রে ওঠে, রডরিকের বুকটা হু হু ক'রে উঠেছিল। কি যেন নেই, কি যেন নেই, মনে হয়েছিল।

এলোমেলো ভাবতে ভাবতে সেভিয়রের চার্চের সামনে কমলা হলুদ ক্যাব থেকে নেমে এলো রডরিক। দুটো ওয়ান ওয়ে পার হ'য়ে উল্টোদিকের বারটা'য় ঢুকে গেল। ক্রীসমাসের বাজারে প্রচণ্ড ভীড়। পেঁচো মাতাল ঝিমুনি মাতাল কবি মাতাল দুখি মাতালে গিজগিজ করছে। একঘন্টা টেম্পোরারি বার টেন্ডারের ভালো রোজগার। দশ ড্যানিশ পাউন্ড। সোয়া পাঁচটায় বেরিয়ে এলো। বখসিস টখসিস মিলিয়ে প্রায় সতেরো পাউন্ড। পকেট গরম। মনটা খুব খুশী।

ছটা'র ডিসপোজাল খালাস করে দিয়েছে রডরিক। দু ঘন্টা আগেই। পাদ্রি ইমান্যুয়েল রডরিকের হাতে কুড়ি পাউন্ডের নোট গুঁজে দিলেন
-সংসার তো আর করলি না। বড়দিনের টাকাগুলো কি করিস কি জানি? প্রতিবছর কুড়ি তারিখ থেকে অমানুষিক খাটনি খাটিস। নেশাভাং তো করতে দেখিনা। রুলেটের আড্ডাতে যাসনা তো ব্যাটা? নরকে যাবি হারামজাদা ..রবিবার যেন কয়্যারে দেখতে পাই। 
আরও একগাদা বিড়বিড় করতে করতে রডরিকের বুকে ক্রশ এঁকে দিয়ে চলে গেলেন।
শস্তায় কেনা সিডানবডির সেকেন্ডহ্যান্ড গাড়িটায় বাড়ি যাওয়ার মতই পেট্রল আছে। বাড়িতে গিয়ে বাসি টুনার স্টেকটা গরম করে নিল। পেঁয়াজের বড় বড় টুকরোগুলো সাজিয়ে নিল। ব্রেডক্রাম্বস্। একটু গোলমরিচ গুঁড়ো। পেট ভ'রে গেছে। ইলেকট্রিক হিটারটা সিওনি গিফট্ করেছে। প্লাগপয়েন্টে তারটা গুঁজে দিয়ে সিওনিকে ফোন করলো একটা।
মৃদু মিঠেগুঞ্জনে এগারোটা বেজে গেল। শুয়ে পড়লো। কাল চার্চে অন্যজনের শিফটিং। ওর ছুটি। কিন্তু সারাদিন কাজ প্রচুর।

শনিবারটা নানান ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে ঘুরতে ঘুরতেই কেটে গেল। শুধু প্রথমে গিয়েছিল ডাউনটাউন ফিলিং স্টেশনে। সন্ধ্যে পাঁচটায় ডিনার ক'রে শুয়ে পড়লো রডরিক।

এগারোটায় অ্যালার্মক্লকটা চেঁচাতে লাগলো তারস্বরে। রডরিক উঠে পড়লো। অন্ধকার ঘরের প্রতিটা কোণ তার নখদর্পণে। তৈরী হ'তে দশমিনিট লাগলো। রাতের অন্ধকারে হারিয়ে গেল ছ ফুটি দেহটা।

রবিবার সেন্ট নিকোলাস চার্চ সেজে উঠেছে। কয়্যারে চলছে মৃদু কোরাসে হিম্। নতমস্তক মাথাগুলো ক্রুশের মানুষের পায়ে প্রেরণ করছে একান্ত আর্তি। প্রার্থনা। তদগতচিত্ত কালোসাদা পোশাকপরা আবেরিদিন ইমান্যুয়েল রা কুমারী মায়ের মহান ঐশ্বরিক সন্তানের বন্দনায় অশ্রুবিগলিত। বেলজিয়াম কাচের ছাঁকনিছাঁকা রোদ্দুরে পরমক্ষমাশীল নগ্ন পিতার দুই নীল চোখে বর্ষিত হচ্ছে অপার ক্ষমাসুন্দর প্রেম। হিম্ শোনা যাচ্ছে ক্রিমসন গথিক খিলানের ফাঁকে ফাঁকে,

Let there be a prayer in our heart
Where blooms your paradise bud
Let your blessing be our flesh
Let your forgiveness our blood.........
ইমান্যুয়েলের চোখদুটো খুঁজে চলেছে চওড়া কাঁধের শক্তিশালী মানুষটাকে। নাঃ, রডরিক আসেনি প্রেয়ারে। চুলোয় যাক ব্যাটা। নিঘঘাত নরকে যাবে।

রডরিকের ঘরময় জুতো জামা ওভারকোট অগোছালো। অ্যালার্মক্লকটা ম্যান্টেলপীসে উপুড় হ'য়ে প'ড়ে আছে রডরিকের ছোটবেলার অনাথাশ্রমে তোলা গ্রুপ ফটোটার পাশে। জানালা দিয়ে আসা রোদ পড়ে রডরিকের ঘুমন্ত মুখটা কুঁচকে উঠলো।

উঠে বসলো ও। ঘুমজড়ানো চোখে লালমলাটের ডাইরিটা টেনে নিল। ডাইরির পঁচিশে ডিসেম্বরের পাতায় এন্ট্রি করলো।

সেন্ট নিকোলাজ অরফানেজ -100 পাউন্ড। 
পুরো ডাইরির ওই একটা পাতাতেই এন্ট্রি। বাকি সব পাতা খালি।

উঠে গেল বিছানা ছেড়ে। ম্যান্টেলপীসের উপরে দেয়ালে শোকেসে লাল ডায়রিটা রাখলো।

সেখানে আগে থেকেই রয়েছে আরও অজস্র ডায়রি। অবিকল একই।

কেউ রডরিকের অজান্তে ডায়রিগুলো খুললে দেখতে পেত, সবকটাতেই শুধু পঁচিশে ডিসেম্বরের এন্ট্রি। একটি করে অনাথাশ্রমের নাম তাতে। আর কিছু পাউন্ডের সংখ্যা লেখা। বাকি সব পাতা সাদা।

এটাই রডরিকের বড়দিন। প্রার্থনা। হিম্।

0 comments: