0

প্রাচীন কথা - অনিন্দিতা মণ্ডল

Posted in


প্রাচীন কথা


রাজোচিত 
অনিন্দিতা মণ্ডল


পর্ব – ১

এই ক্ষুদ্র পার্বতী নদীটির বুকে বর্ষা শেষে ভরা জল। এর পূর্বতীরে একটি বড়সড় গোলাকার পাথরের ওপরে বসে আছেন এক রাজপুরুষ। সম্ভ্রম জাগানো চেহারা। এঁর গাঢ় বাদামী ত্বকে শুভ্র কার্পাস বস্ত্রটি যেন আরও শাদা দেখাচ্ছে। যেন একটি জ্যোতির অম্বর ঘিরেছে তাঁকে। মাথাতেও অনুরূপ একটি বস্ত্রখণ্ড পাকে পাকে জড়ানো। অঙ্গে অলঙ্কারাদি শোভা পাচ্ছে। কণ্ঠে একটি শুভ্র উপবীত এঁর ব্রাহ্মণত্বের সাক্ষী। অথচ যোদ্ধার ন্যায় অস্ত্র ধারণ করেছেন। আপাতত চিন্তিত মুখে চেয়ে আছেন ফেনিল জলরাশির দিকে। পাশে নামিয়ে রাখা তুনীর ধনুক ও বর্শা। লোহার ফলক লাগানো দৃঢ় কঠিন কাঠের বর্শা ও তূণ। এ ছাড়াও একটি বস্তু রাখা তাঁর পাশে। কাঠের দ্বিভুজাকৃতি একটি খণ্ডের দুটি প্রান্ত পশুচর্মের চওড়া ফিতা লাগানো একটি বস্তু। সেটি দিয়ে বড় বড় পাথর ছুঁড়ে বিপক্ষ সৈন্যকে আঘাত ও ছত্রভঙ্গ করা যায়। একসঙ্গে প্রচুর প্রতিপক্ষ সেনাকে আঘাত করা যায়। তাঁর কাছে সংবাদ এসেছে তক্ষশীলারাজ অম্ভি এক যবন রাজপুত্রের বশ্যতা স্বীকার করেছেন। এই যবন রাজপুত্র তক্ষশীলার পশ্চিমে পারসিক আকামেনেদীয় সাম্রাজ্যের পূর্বাংশ স্পর্শ করেছে। এই সৈন্যবাহিনী নাকি অজেয়। তাদের দেবতা জিউসের নাকি আশীর্বাদ আছে এই রাজপুত্রের ওপরে। এই পররাজ্যলোভী মদমত্ত যবন রাজপুত্র এখন এসে পড়েছেন বিতস্তার অদূরে। সেখান থেকে তিনি আসছেন ইন্দ্রস্থানের মূল ভূখণ্ডে। মূল ভূখণ্ডের উত্তর পশ্চিম সীমানায় এই ত্রিগর্ত রাজ্য। অতএব সে আক্রমণ প্রতিহত করতে ত্রিগর্তকে সময় বুঝে প্রস্তুত হতে হবে। কাশ্মীর রাজ অভিসার এই দুর্দিনে নিশ্চুপ। তিনি রাজা অম্ভির দিকে সমর্থনের হাত বাড়িয়ে দেননি, আবার ত্রিগর্তকেও সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেননা। সম্ভবত একটি সংশয়ের দোলাচলে আছেন। জয়ী পক্ষে যোগ দেবেন। সেটিই রাজনীতি। তবে ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ যে বেশি ফলদায়ী হতো সেবিষয়ে রাজপুরুষ নিঃসন্দেহ। কিন্তু তা হবার নয়। পূর্ব ও মধ্য ইন্দ্রস্থানের রাজ্যগুলি মহাজনপদ। সব কটিই রাজশাসিত নয়। কতগুলি গণসংঘও আছে। তবে এই মহাজনপদগুলি বেশির ভাগই শ্রেষ্ঠী বণিকদের সম্পদে সম্পদবান। সমৃদ্ধিশালী মহাজনপদগুলিতে বাণিজ্য জন্য একতা থাকলেও প্রত্যেকেই বড় স্বাধীনচেতা। ফলে ছোটখাট যুদ্ধবিবাদ লেগেই থাকে। আবার আত্মীয়তা থেকে একে অন্যের কাছে চলে আসে। সম্পদের একটি দুর্বলতা হলো দস্যু তস্করের প্রাদুর্ভাব। সেটি ষোলআনা আছে। অধুনা আরও বেড়েছে। এমনিতেই উত্তরপূর্বাঞ্চলের মানুষ বহুকাল থেকেই সনাতন ধর্মের ছায়ায় আসেনি। তাদের পৃথক ধর্মচেতনা। বহু জ্ঞানী গুনী সাধু আছেন সেখানে। তবে বর্ধমান মহাবীর তীর্থঙ্করের পর প্রায় দ্বিশত বৎসর অতিক্রম হতে চলেছে, তথাগত এসেছিলেন। সেই সব গোষ্ঠীর সাধু ভিক্ষু সারা ইন্দ্রস্থান জুড়ে ক্রমাগত পরিব্রাজন করতে থাকেন। নিজেদের ধর্মচেতনার কথা প্রচার করেন। অন্য ধর্মের কথা শোনেন। আলোচনা হয়। রাজপুরুষ জানেন, ইন্দ্রস্থানের সনাতনপন্থী ব্রাহ্মণ্য ধর্মের আচার্যরা স্বাভাবিক কারণে এঁদের ওপরে বিরূপ হলেও সাধারণ মানুষ বিপুল সংখ্যায় এঁদের অনুসারী হয়েছে। এঁরা ঈশ্বরের অনস্তিত্বে বিশ্বাসী। তিনি তো অম্বার পূজক। তবু তিনি নিজেও শ্রদ্ধাশীল। স্বয়ং মহারাজ পরমানন্দ চন্দ্রের অন্যতম সেনাপতি। আচার্য জয়বর্মা। তিনি একটি কারণেই বিরক্ত বোধ করেন। এঁদের অহিংসার শিক্ষা। মানুষ গ্রহণ করছে। সাধারণ মানুষ যুদ্ধবিমুখ তো বটেই, শত্রুর সঙ্গে লড়তেও তাদের মন চায়না। অথচ ত্রিগর্ত ক্ষত্রিয় রাজ্য। যোদ্ধা বলে খ্যাতি আছে তাদের। আবার ফিরে এলেন তিনি নিজের চিন্তার বৃত্তে। এই যবন বা গ্রীক সৈন্য নাকি নিমেষের মধ্যে আয়তাকার বা বর্গাকার বা বৃত্তাকার বিশাল ব্যুহ রচনা করতে পারে। প্রতিপক্ষ সেনা সেই বিশাল ব্যুহের সম্মুখে পতঙ্গের মতই ধূলিসাৎ হয়। তাদের অশ্বগুলি খুব দ্রুতগতি। অশ্বারোহী সেনা সেই অশ্বের ওপরে চড়ে বসে অনায়াসে, কোনওরকম পৃষ্ঠ আচ্ছাদন ছাড়াই। বিশেষ পাদুকা ছাড়াই। ফলে ওজন কম হয়। লঘুতার কারণে তারা আরও দ্রুতগামী হয়। আরও দক্ষ হয়। তিনি শুনেছেন এই রাজপুত্র নাকি অশ্বকে পোষ মানাতে যাদুকরের মতো ক্ষমতা ধরেন। তা হতেই পারে। তাঁদের রাজকন্যা অম্বিকাকে তো তিনি নিজে হস্তীর ভাষা ও ইঙ্গিত শিখিয়েছেন। তিনিও তো পারেন হাতীদের সঙ্গে কথা বলতে। তবে আশ্চর্য লাগে এই ভেবে যে, যুবক নাকি পিতৃহন্তা। অদ্ভুত! বন্য জন্তুর প্রতি এত মমতা আর পিতার ঘাতক! নারী ধর্ষক! শিশুঘাতক! এই একটি প্রশ্নে তিনি বিচলিত। এমন কুচরিত্র রাজা প্রজাপালন করবেন কিভাবে? এই বিজিত রাজ্যের অধীশ্বর হয়ে এই দাম্ভিক রাজা প্রজাদের কি করে স্বস্তি দেবেন? ইন্দ্রস্থানের সাধারণ মানুষ এমন রাজাকে সিংহাসনচ্যুত করে। ইতিহাসে তার প্রমাণ আছে।

সেনাপতি জয়বর্মার চিন্তার অপর একটি কারণ, নদীবক্ষে এমন স্রোত এবং এত জল যে, গোলার জন্য পাথর সংগ্রহ করা অসম্ভব হয়ে পড়ছে। অথচ এই নূতন অস্ত্রটির ব্যবহারে সুবিধা ছিল। তাঁর অদূরে দাঁড়িয়ে রয়েছে দুটি প্রতিহারী। কাছে দূরে সেনা ছাউনিগুলিতে সেনাদের কোলাহল, অস্ত্রচর্চার ঝনঝনি শোনা যাচ্ছে। দিবালোক এখনও বর্তমান। তবু প্রতিহারী দুটি সতর্ক হয়ে প্রহরায় নিযুক্ত। সামনেই নদীতীরবর্তী গিরিবর্ত্মটি পাকদণ্ডী পথে দূরে পর্বতপ্রাচীর গুলির মধ্যে মিলিয়ে গিয়েছে। ওই পথ ধরে পূর্বের জনপদগুলি থেকে বহু পথিক আসেন। অশ্বারোহীও আসেন। তাদের মধ্যে দস্যু তস্কর থাকাও অসম্ভব নয়। বিশেষত ত্রিগর্ত স্বর্ণের জন্য খ্যাত। অম্বার সেবক ত্রিগর্ত। তাই সম্পদবান। সেনাপতিও যে আক্রান্ত হবেননা একথা নিশ্চিত করে বলা যায়না। প্রতিহারীর নজরে এসেছে সেনাপতির চিন্তায় আনমনা অবস্থা। এমন সময়ে অস্তসূর্যের রক্তিমাভা গায়ে মেখে ঘনঘোর রক্তাম্বর এক ভিক্ষুকে দেখা গেলো। সঙ্গে শ্বেতাম্বর এক শ্রমণ। গিরিবর্ত্মটি ধরে পদব্রজে নেমে আসছেন। এক রক্ষী সতর্ক ভাবেই অপরজনকে বলল – ওই দ্যাখো, স্বর্ণসন্ধানী পিঁপড়ে আসছে। তার গলায় ব্যাঙ্গ থাকলেও নিরস্ত্র বাম্ভন বা সমনকে আক্রমণ করা বা অসম্মান করা গর্হিত অপরাধ। মহারাজ ক্ষমা করেন না। তাই কাছাকাছি আসতে প্রতিহারীরা এগিয়ে গেলো। “দাঁড়ান। আবাস? কোথা থেকে আসছেন? কি পরিচয় আপনাদের?” ভিক্ষু সৌম্যকান্তি। করুণায় স্নিগ্ধ আনন। দর্শনে শান্তি আসে। কিন্তু বিদেশীর আক্রমণে আক্রান্ত রাজ্যকে এই দৃষ্টি স্বস্তি দেয়না। ভিক্ষু নম্র স্বরে বললেন – সাভতি। রক্ষী তীক্ষ্ণ স্বরে বলল – পরিচয়পত্র? পাঞ্জা দেখান। ভিক্ষু নিজের বস্ত্রের ভিতরে হাত দিলেন। সেনাপতি জয়বর্মার মাথার পিছনের অদৃশ্য চোখ দুটি সচল হয়ে উঠল। বস্ত্রের ভিতরে লুকোনো বাঘনখ বা বিষফলক থাকতেই পারে। কিন্তু ভিক্ষু বের করে আনলেন একটি মুদ্রা। সচকিত সেনাপতি উঠে এসে দাঁড়ালেন তাঁর সামনে। অভিবাদন করলেন আনত হয়। “ভিক্ষু সোমদেব! কি কারণে পদব্রজে এতদূর এসেছেন? সংবাদ দিলে মহারাজ নিজে আয়োজন করে দিতেন!” ভিক্ষুর মুখের শান্ত হাসিটি পীড়া হরণ করে। তিনি হাত তুললেন। “স্বস্তি। একটি বিশেষ কারণে যাত্রা করেছি। ধর্মনীতি আলোচনার কারণে চলেছি বিতস্তা অভিমুখে। পাত্র এক বিদেশী সম্রাট। তিনি নিজেকে সম্রাট বলেই পরিচয় দেন। তবে আচার ইন্দ্রস্থানের তস্কর দস্যুগুলির ন্যায়। অথচ শুনেছি তাঁর সঙ্গে নাকি সে দেশের বহু পণ্ডিত জ্ঞানী ও গুণীজন এসেছেন। তাঁর পরিক্রমায় এঁদের ভূমিকা আছে। তিনি অবসরে এঁদের সঙ্গে জ্ঞান বিজ্ঞান আলোচনা করেন। তাই চলেছি রাজ সন্দর্শনে। সেই সব গুনীজনেরও দর্শন প্রার্থনা করব। জানতে ইচ্ছা যে এমন মহামতি সম্রাট এত পরসম্পদলোভী নিষ্ঠুর কেন? শুনেছি তাঁর সেনারাও নাকি সম্রাটের ওপরে বিরক্ত। তাঁকে জনান্তিকে নিষ্ঠুর বলছে। বহুকাল গৃহহীন হয়ে তারা ক্লান্ত। কিন্তু তারা দাস। রাজার আদেশ অমান্য করার শক্তি নেই। কেন তাঁকে কেউ সুপরামর্শ দিচ্ছেন না? এইটিই জানতে চলেছি জয়বর্মা।” সেনাপতি হাসলেন। তিনি ব্যক্তিগত ভাবে চেনেন ভিক্ষু সোমদেবকে। তাঁকে শ্রদ্ধা করেন। সাভতির সাধারণ মানুষ সোমদেবকে দেবতা জ্ঞান করে। তাঁর নাকি অলৌকিক ক্ষমতা আছে। ভূত ভবিষ্যৎ দেখতে পান। জয়বর্মা সেইদিকে ইঙ্গিত করলেন – এই কারণে এত দূরের পথ পরিব্রাজনের কি প্রয়োজন ছিল ভদ্র? আপনার তৃতীয় নয়ন তো জাগ্রত! ভিক্ষু তেমনই স্মিত স্বরে বললেন – দেবী অম্বার তৃতীয় নয়ন কি আর এই অর্বাচীনের প্রাপ্য? না সেনাপতি। সম্মুখে বসে আলোচনার ফল বেশি। হয়ত সম্রাট নিজের বাসনা থেকে মুক্তি পেতে পারেন। জয়বর্মা দেখলেন ভিক্ষু নিজের সংকল্পে অবিচল। তিনি বললেন – ভদ্র তবে সঙ্গে দুটি প্রতিহারী দিই? – কেন সেনাপতি? এমন দরিদ্রকে কে আর আক্রমণ করবে? জয়বর্মা উত্তর দিলেন না। ভিক্ষু যেন বুঝতে পারলেন কিছু। অর্থপূর্ণ হাসলেন - ছদ্মবেশে যাবে তারা? জয়বর্মা হেসে ইঙ্গিত করলেন প্রতিহারীদের।

গিরিবর্ত্ম ছাড়িয়ে নদীতীর ধরে দক্ষিণে অগ্রসর হলো চারজনের একটি সমন দল। গন্তব্য বিতস্তার তীরে গ্রীক স্কন্ধাবার।

চলবে

0 comments: