3

প্রবন্ধ - ফাল্গুনী ঘোষ

Posted in



প্রবন্ধ


বাঁধনা পরব 
ফাল্গুনী ঘোষ


তথাকথিত সভ্য ভারতীয়রা যখন প্রবল আনন্দে অমাবস্যার অন্ধকার দূর করে ‘দীপাবলী’ বা আলোর উৎসবে মাতোয়ারা হয়ে ওঠে, ঠিক তখনই ভারতবর্ষের আদি ও অকৃত্রিম অধিবাসীদের ‘বাঁধনা পরব’ পালন হয়, যা হয়ত আমরা অনেকে জানি না বা অল্পবিস্তর জানি। সমগ্র ঝাড়খণ্ড, পশ্চিমবঙ্গের পুরুলিয়া, মেদিনীপুর ও বীরভূমের পশ্চিমাংশ, বাঁকুড়া জেলায় কৃষিনির্ভর কুরমী, লোধা, মাহাত, ভূমিজ সাঁওতালদের অন্যতম প্রধান এই পরব বাঁধনা। আসলে কথাটি বাঁদনা। গো বন্দনা থেকে বাঁদনা। আদিবাসী মুখে ‘দ’ এর উচ্চারণ ‘ধ’ এর মতো হয়ে যায়। ফলস্বরূপ ‘বাঁধনা’ পরব। চাষবাস ও প্রকৃতিনির্ভর প্রাণখোলা আদি অকৃত্তিম মানুষগুলির জীবনে মাঠে ধান রোপণ থেকে শুরু করে মাঠ থেকে পাকা ধান কেটে ঘরে তোলা পর্যন্ত বিশ্বস্ত সাথী গোরু। সেকারণে হাল আবাদের নিত্য প্রয়োজনীয় ও অত্যাবশ্যকীয় ‘গোরু’কে কেন্দ্র করে পালিত হয় ‘বাঁধনা’ পরব। আদিবাসীদের ‘সহরায়’ পরবের সাথে নিয়ম, রীতি কানুনের অনেক মিল থাকলেও উৎসব পালনের সময়ে ভিন্নতা দেখা যায়। ‘সহরায়’ পৌষ মাসেও পালন হয়, কিন্তু কার্ত্তিক মাসের অমাবস্যা তিথিতে অর্থাৎ কালীপুজোর রাত্রে বাঁধনা পালিত হয়। 

বাঁদনা’র অর্থ চুমান বা বরণ করা। বাড়ির জামাইকে পরিবারের সদস্য জ্ঞানে বরণ করার রীতি রয়েছে এই পরবে। ঠিক তেমনই গাই গোরুকে বাড়ির গৃহস্থরা মেয়ে জামাই জ্ঞানে চুমায়, বরণ করে। এটাই লোকরীতি, যদিও এই লোকাচারের সাথে ব্রাহ্মণ্য ধর্মের ছায়া মিশেছে পরবর্তীতে। গল্পটি এরকম- কপিলা’রা মর্ত্যে আসতে চায় না কারণ মানুষ তাদেরকে খাটিয়ে নেয়, দুধ দুয়ে নেয়। অথচ নোংরা আবর্জনার মধ্যে অযত্নে তাদেরকে রাখে। তখন মহাদেব এর প্রতিবিধান করলেন। শুরু হল ‘বাঁধনা’ পরব। সে কারণে ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতির কালীপুজো ও অনার্য সংস্কৃতির বাঁধনা পরব পরস্পর ঘনিষ্ঠতায় বাঁধা পড়েছে। গো জাগরণ, গো বন্দনা, গরু খুঁটা’র পাশাপাশি উঠোনে পিঠালি দিয়ে লক্ষীর চোখ আঁকা, অলক্ষী বিতারণও হয়- অনুষ্ঠান পর্বে। সাধারণত কালীপুজোর আগের দিন লক্ষী অলক্ষী পুজো অনেক জায়গাতেই হয়। যার প্রধান উদ্দেশ্য লক্ষীর আবাহন আর অলক্ষীর বিতারণ। কালীপুজোর আগের দিন ধনলক্ষী পুজোর সব থেকে বড় নমুনা সমগ্র ভারতবর্ষব্যাপী ‘ধনতেরাস’ উৎসব তা বলার অপেক্ষা রাখে না। 

বড়ই চমৎকার বাঁধনা পরবের লোকাচার। অমাবস্যার দিন সকাল থেকে শুরু হওয়া উৎসবকে বেশ কয়েকটি অংশে ভাগ করা যায়—‘গোঠপুজো’, ‘কাচিজিয়ারি’, ‘জাগরণ’, ‘গরয়া গোঁসাই পুজো’, ‘গরুখুঁটা’। এই দিনে গোয়ালের সব গরু মহিষের শিং-এ মহুয়া বীজ নিঃসৃত তেল মাখিয়ে, হলুদ জল দিয়ে পা ধুইয়ে গ্রামের মোড়ে একজায়গায় করা হয়। সব গোরু জড়ো হলে ছাঁদনদড়ি ও বাঁধনদড়ি পুজো হয়। অর্থাৎ গোষ্ঠদেবের অবয়ব এঁকে সিঁদুরের টীকা লাগিয়ে শুরু হয় লোকাচার। এরপর সমস্ত কৃষিকর্মী বা বাগালের লাঠি একসাথে রেখে তেল সিঁদুর মাখিয়ে শুরু হয় লাঠি চেনার খেলা। অনেকটা যেন ছোটোবেলার রুমালচুরি খেলা। চোখবাঁধা অবস্থায় নিজের লাঠিটি খুঁজে নিতে বলা হয় প্রত্যেককে। যে এটি পারে ঐ দিনে সে বিশেষ একজন। এই সমস্ত প্রক্রিয়াটিই গোঠপুজো। পুজো শেষে আলপনার ভেতরে ডিম রেখে ঢাক ঢোল পিটিয়ে গোরুগুলোকে এলোমেলো ছোটানো হয়। উদ্দেশ্য একটাই কোন গোরুর খুরে ডিম ভাঙা পড়ছে তা লক্ষ্য করা। সেই বিশেষ গোরুটিকে মাথায় তেল সিঁদুর ধানের শীষ দিয়ে সাজানো হয়। 

দীপাবলীর দিন সন্ধ্যে নামতেই শুরু হয় কাচিজিয়ারি। কাঁঠাল, শাল বা মাটির প্রদীপে চালের গুঁড়োর মধ্যে সলতে দিয়ে দীপ জ্বালানো। এই অমাবস্যার রাত এদের জাগরণের রাত- নাচে, গানে, বাদ্যে হাড়িয়া/ মহুয়ায় ভরপুর সে রাত। রাতের সূচনাতেই গোঠপুজো থেকে ফিরে আসা গোরুগুলোকে নতুন কাপড় চোপড় পরা গৃহিনীরা দূর্বা, আমের শাখা, ধূপ ধুনো, হলুদ জল দিয়ে সুর করে ছড়া কেটে বরণ করে— 

ওরে অহিরে, জাগত লক্ষ্মী জাগত ভগবতী 
জাগত আমাবসিয়া রাতিরে..., 
গাবত পাঁচ পুতায় দেশধনুর গুণ রে। 

এই গানগুলি অহিরা গান নামেই পরিচিত। সারারাত গোয়ালে আগুন জ্বালিয়ে অহিরা গান গেয়ে গোরু জাগিয়ে রাখতে হয়। যে যুবকরা এই কাজ করেন তারা ‘ধাঁগড়িয়া’ বা ‘ধাঁগড়’ হিসেবে পরিচিত। লোকশ্রুতির গবেষক অরবিন্দ চট্টোপাধ্যায়ের বক্তব্য অনুযায়ী, ‘ভারতবর্ষের আদিম অধিবাসী ‘ধাঙ্গড়’ থেকেই ‘ধাঁগড়’ কথাটির উৎপত্তি। অহিরা গায়কদের সুলুক সন্ধানে দেখা যায়- বাউড়ি, ভূমিজ, ওঁরাও, মুন্ডা, সহিস, কুরমী, রাজোয়াড়, দেশোয়ালী মাঝি সমাজ এর সাথে জড়িত। তাই সাধারণত মুনিস বাগালরাই হয় এই গানের গায়ক। এরা ঢোল, ধামসা মাদল বাজিয়ে বাড়ি বাড়ি জাগরণের জানান দেয় গো মাতার বন্দনা গেয়ে— 

ধাংগড়িয়াকে দিলে ভালা, 
জলে নাহি পড়বে 
যুগে যুগে নাম রহবে রে......... 

গৃহ বধূরা উপযুক্ত দান (টাকা, চাল, পিঠা, মহুয়া/ হাড়িয়া) দিয়ে চালগোলা পিটুলি নিয়ে ধাঁগড়দের সাথে হোলিখেলা, রঙ্গরসে মাতে। কাটান ধরাধরি হয়।– 

প্রশ্নঃ 
কেহ মরিলে ভালা কাঁচা কুঁওর রে 
কেহ মরিলে রে টুয়র? 
কেহ মরিলে ভালা জোড়বাহি টুটয়ে 
কেহ মরিলে গিরহ শূন

অর্থাৎ কে মরে গেলে মানুষ নাবালকের মতো অসহায়? কে মরে গেলে মানুষ অনাথ? কে মরে গেলে জোড়াবাহুর একটি ভেঙে যায়? কে মরলে গৃহ শূন্য? 

উত্তরঃ 
বাপে মরিলে ভালা কাঁচা কুঁওর রে 
মা অ মরিলে টুয়র 
ভাইয়া মরিলে ভালা জোড়বাহি টুটয়ে 
বহু মরিলে গিরহ শূন 

ওরে গোপ, বাবা মরলে মানুষ নাবালক শিশু। মা মরে গেলে মানুষ অনাথ। ভাই/দাদা মরে গেলে জোড়া বাহু’র একটি ভেঙে যায়।বউ মরলে গৃহ শূন্য হয়। 

রঙ্গতামাশা আর প্রশ্নোত্তরের ছলে জীবনের চালচিত্রটি যেভাবে চোখের সামনে ভেসে ওঠে তা অনেক আধুনিক, যুক্তিবাদী, বুদ্ধিবাদী, নারিবাদী, পুরুষবাদী মানুষকে কিছুক্ষণের জন্য ভাবতে বাধ্য করে। 

জাগরণের পরের দিন সকালে পুরুষেরা স্নান করে হাল লাঙলের যন্ত্রপাতি পরিষ্কার করে, মাঠ থেকে খড় বিচালি, ঘাসের শিষ নিয়ে এসে গয়না বানিয়ে গোরুর শিঙে গুঁজে দেয়। বউয়েরা গোবর জলে উঠোন নিকিয়ে চালের গুঁড়ি, জল আর ‘পাইনা’ পাতার রস (ল্যালল্যেলে ও আঠালো) দিয়ে আলপনা দেয়। এদিন তাদের ‘গরইয়া’ পুজো। গোয়ালে এই পুজোতে মুরগী বলি যেমন হয় তেমনই ‘বাঘুত’ দেবতার সামনে কেবলমাত্র কালো মুরগী বলি দেওয়া হয়, যাতে বনে জঙ্গলে গোরুকে বাঘে না খায়। পুনরায় ধূপ ধুনো তেল সিঁদুরে গোরুকে পুজো করে কচি ঘাস খেতে দেওয়া হয় আর বলির মুরগীর মাংস, ভাত, মাংসের পিঠা দিয়ে ধুমধাম করে আত্মীয় কুটুম, মেয়ে জামাই নিয়ে খাওয়া দাওয়া চলে। 

‘বাঁধনা’ পরবের সবথেকে মজার দিন হল গরুখুঁটা। ভাই ফোঁটা’র দিন গোয়ালের দুষ্টু গোরুগুলিকে বিভিন্ন রঙে ছুপিয়ে রাস্তার মোড়ের মাথায় মোটা খুঁটি পুঁতে দড়িতে গোরুগুলিকে বেঁধে দেয়। এইবার গোরুগুলির সামনে অন্য কোনও পশুর শুকনো চামড়া নাচানো হয়। গোরু শিং নেড়ে গুঁতোতে আসে। ধামসা, মাদল এই ‘রগড়’ দেখে উল্লাসে ফেটে পড়ে— 

ওরে অহিরে 
এত দিন যে খাওয়ালি 
বরদা ঘাস ছানি জাবনা রে, 
আইজ তোর দেখব মরদানিরে। 
ওরে, 
চারিপায়ে রুখিবি দুই শিং-এ মারিবি 
আকাশ পাতাল উড়াবে ধূলারে।

এই যে অহিরা গান তা মূলত দুধরণের- প্রশ্ন উত্তরমূলক আর ধাঁগড়িয়াদের গান। ধাঁগড়’রা একটি করে স্তবক গাওয়ার পর ধামসা, মাদল, ঢোল, ঝুমকো প্রভৃতি বাজানো হয়। বাজনা থেমে গেলে আবার একই রীতিতে গান চলতে থাকে। আচারসর্বস্ব প্রাচীন গানগুলির সুর বৈচিত্রহীন, সেকারণে নতুন সংস্করণও তৈরী হয়নি। মাগধী, মৈথিলের প্রভাব দেখা যায় গানের ভাষাতে। কপিলা গীত বা ‘ডহরিয়া’ অহিরা’র অন্য নাম। সারারাত পথে ঘুরে ঘুরে গোরুর জীবন প্রণালী, বৈশিষ্ট্য, স্তুতি, গৃহস্থের সম্বৃদ্ধি কামনা সুরে তালে, ছন্দের দোলায়। 

যে উৎসবের যা-ই নিয়ম, কানুন, আচার থাকুক না কেন সবটাই হয় জীবনের প্রয়োজনীয়তার মাপে। চাষের কাজের নিত্যসাথী গোরুগুলি এই দু-চারদিন একটু বিশ্রাম ও আরামে থাকে। তাছাড়াও দৈনন্দিন থোড় বড়ি খাড়ার জীবন থেকে এই পরব তাদেরকে মুক্তি দেয় বলেই সমগ্র গ্রাম, অঞ্চলের মানুষ দূর বা কাছে থেকে উৎসবে সামিল হতে চায়। আত্মার আত্মীয়তার খোঁজ হয়ে ওঠে নিরন্তর এক প্রক্রিয়া। 

কন মরিলে ভালা ঘুরি ফেরি আসেরে কন মরিলে নাহি ঘুরে। 
বনে কেরি কাঠপাত গাঁয়ে কেরি আগুন খসি খসি পড়ে যে আঁগার।।
কে মারা গেলে আবার ফিরে আসে, কে মারা গেলে আর ফিরে না? বনে কাঠ পাতা আর গাঁয়ের আগুন দিয়ে রচিত চিতা থেকে শুধু জ্বলন্ত অঙ্গার খসে খসে পড়ে। 


ওরে অহিরে 
পরব মরিলে ভালা ঘুরি ফেরি আসে রে মানমী মরি নাহি ঘুরে।

পরব শেষ হলেও আবার ফিরে আসে। মানুষ মরে গেলে আর ফিরে আসে না—জীবনের সারসত্য বহন করেই যাবতীয় পরব/ উৎসব মহাকালের স্রোতে ভেসে চলে অবিরত। 

3 comments:

  1. তথ্যবহুল অথচ সরস, দিব্যি লাগলো বাঁধনা পরবের গল্প পড়তে।

    ReplyDelete
  2. কার্যকরী তথ্য। সংরক্ষণ যতগ্যও বটে।

    ReplyDelete