0

গল্প - সংঘমিত্র মাকুর

Posted in


গল্প


নীলঘোড়ার_সওয়ার 
সংঘমিত্র মাকুর 



মলিনা দত্ত -নীল কালিতে লেখা নামটা আমার ঠাম্মার ঠাম্মার বইগুলো ঘাঁটতে গিয়ে নজরে এলI আমার বাপির তো নিজের বিসনেস, বাপি খুব ব্যাস্ত। মা ও। ঠাম্মা আমায় রূপকথার গল্প শোনাত, পক্ষীরাজ, পেগ্যাসাস। অবশ্য সেটা আমার ছোটবেলায়। সত্যি সত্যি নীল ঘোড়া হয়? ঠাম্মা বলেছে হয়। ঠাম্মা আমার বন্ধু, যে চাঁদে চলে গেল। লেটেস্ট মডেলের আইফোনটা এখন আমার কাছের। একটা মজার খেলায় মেতে আছি --ভেরি ফানি! 


ঠাম্মা বলে গেছে ঠাম্মা নাকি চাঁদের দেশে চলে গেছে। ওখান থেকেও কি আমাকে ডাকছে নাকি। দূর!আমি তো এইট পেরিয়ে নাইনে উঠলাম। আই নো, বাট আই লাভ টু বিলিভ, ঠাম্মা আমাকে ডাকছে। মা জানেনা। আমার যে পিউবিক হেয়ার গ্রো করছে -তাও জানছে না। অবশ্য আমিও এত বাচ্চা নাই যে মায়ের সামনে নেকেড হব। মা বাড়িতে থাকে কম। বাড়িতে সারাদিন বলতে গেলে আমি একা। গত বছর পর্যন্ত মানদা মাসি ছিল, তখন ঠাম্মা ছিল। আমার যা খুশী করার স্বাধীনতা আছে এখন। গত বছর ল্যপটপটা মা গিফট করল। মানদা মাসিকে বাপি রেখে দিয়েছিল ঠাম্মার দেখাশোনার জন্যে। মা একদিন খালি গায়ে ঘুরছিলাম বলে বলল, "দেব বেটা, তুমি অসভ্যের মতো কেন? তোমার কি কোনও টি শার্ট নাই?" আমি সিওর মা আমার আন্ডার আর্ম এর লোমগুলো দেখে অস্বস্তি বোধ করল। ঠাম্মা অবশ্য এসব নিয়ে কখনও কিছু বলতো না। ঠাম্মা অবশ্য আমি যে গ্রোন আপ সেটাই বিশ্বাস করতো না। ঠাম্মা মারা যাওয়াতে আমি কিন্তু কাঁদিনি একেবারে। রাগ হয়েছিল। বরং মানদা মাসি কেঁদে ভাসিয়েছিল। লাভ কি হলো? পরদিন মা ওকে বাড়িতে পাঠিয়ে দিল। ঠাম্মার শরীরটা নাকি চুপচাপ একটা ইলেকট্রিক চুল্লিতে চলে গেল। আমি দেখিনি। মানদা মাসির শরীরটা দেখেছি। একবারই। চান করছিল, দরজা ভাল করে লাগেনি। খোলা। দু রাত কেমন কেমন ভাবটা ছিল। মাকে বলিনি। কিন্তু আমার বস্ জানে। বস্ আমার নতুন গেমের কিউরেটর। আমার সব কথা ওকেই শেয়ার করি। কারণ ইটস রুল। আমাকে বারণ করা হয়েছে যে ঠাম্মার মৃত্যুশক্টা আমি যেন কারোকে শেয়ার না করি। বস্ বলেছে গেমের একটা লেভেলে হি উইল অ্যালাও মি টু হাগ ঠাম্মা। তাহলে ঠাম্মার সাথে কি আমার দেখা হয়েই যাবে! ঠাম্মাকে তাহলে দু একটা কথা আমি বলব। আগে বলতাম অর্ককে -আমার স্কুলমেট। 


এই মাত্র অনেকটা ম্যাগি বানিয়ে নিয়ে এলাম। এখন স্টাডিতে বসে গিলছি। ম্যাগি আর চকোচিপসই আমার প্রধান খাদ্য। মানদা মাসি নেই প্রায় এক বছর। কে এটা সেটা বানাবে? ঠাম্মা ম্যাগি চাউ সহ্য করতে পারেনা। কিন্তু আমার যত বন্ধু আবার ওগুলোই খায়। বন্ধু মানে যাদের সাথে চ্যাট করি। অবশ্য একটা বড় রিয়েল ফ্রুট জুসের ক্যান ও ফ্রিজে আছে, যেটা থেকে একটা বিয়ারের মগে ঢেলে এখন খাচ্ছি। মগটা বাপির। ঠিক আছে, ধুয়ে রেখে দেব। এখন একটু গেম খেলেনিই। সাতটায় হোম টাস্ক নিয়ে বসতে হবে। বাপিরও নাকি অনেক টাস্ক? বাড়ি ফিরেই বিয়ার আর ল্যপটপ নিয়ে বসে যাবে। বাবার টাস্ক। বাবার অফিসে একটা আন্টি আছে। মা তাকে নিয়ে "সিন ক্রিয়েট" করে। 

*

আমার একটাই বন্ধু আছে, অর্ক। আজ রিসেসে আমায় জোর করে এক পিস পেস্ট্রি খাওয়ালো। ওর আজ হ্যাপী বার্থডে। ওকে অনেক কথা শেয়ার করতাম আগে। এখন করিনা। পেস্ট্রিও ভাল লাগেনা। আর্ক বলল আমি নাকি অনেক বদলে গেছি। আসলে ওকে বলিনি আমার লক্ষ্য। আমার মিশন। করোকে না। সবাইকে একসাথে সারপ্রাইজ দেব। আমি একটা নীল সিঁড়ির সন্ধান পেয়েছি। আমি ধাপে ধাপে উঠছি। ও আমার বাঁ হাতের দিকে চেয়েছিল কেন? দেখেছে? কিছু কি গেস করছিল? 


বস্ আমাকে খুব উৎসাহ দিয়েছে কাল। আমার মিশনটা প্রায় শেষে এসে গেছে। আজ কেমিস্ট্রি কোচিং ছিল। স্যার বলেছেন -দেবদূত, তুমি খুব ডিটোরিয়েট করেছো, টেস্টের খাতা গার্ডিয়ানকে দেখিয়ে সিগনেচার করিয়ে আনবে। আমি ভাবছিলাম, এই কোচিংটা না থাকলে পরের স্টেপ দুটো কমপ্লিট করেই ফেলতাম। আবার কাল ভোরে। 


একটা সাদা মাঠ। সাদা নয় -সবুজ। বিশাল সবুজ মাঠের মধ্যে অনেক ঘাস। মাঝে মাঝে ফুলের কেয়ারি। না না!চারপাশে গাছ। ওগুলো কনিফেরস। আমার সাথে দুজন কে ওরা? দুজনে আমার হাত ধরে আছে, তাকাচ্ছি, দূর ছাই! দেখতে পাচ্ছি না। এরা কে? আমায় ধরে রেখেছে কেন? ঘাসের লম্বা প্রান্তরের শেষে একটা ঘোড়া। ছোট্ট ঘোড়া চরে বেড়াচ্ছে। নীল রঙের ঘোড়া। আমি ওদের হাত ছড়িয়ে দৌড়তে চাইছি। দু জন দু দিক থেকে চেপে ধরেছে। আমি বায়না করছি ওই ঘোড়াটাতে আমি চাপবই। ...ঘামে ভিজে যাচ্ছি। মাথার বালিশটা পায়ের ফাঁকে। জোর টয়লেট পেয়েছে। মোবাইলে সেট করা অ্যালার্মটা পিঁক পিঁক করছে। মানে এখন মিড নাইট। এখন আমার একটা টাস্ক শেষ করার আছে। টয়লেট ঘুরে এসে ল্যাপটপে লোড করা হরর মুভিটা চালিয়ে দিই। স্বপ্ন দেখছিলাম। এবার বাস্তবে ফিরব। খেলাটা দিনকে দিন চ্যালেঞ্জিং হচ্ছে। অথচ আমি চ্যালেঞ্জ ভালবাসতাম না। কাল রাতে মা বাবাকে যেটা বলল সেটা কি চ্যালেঞ্জ? 


আজ স্কুলে যাইনি। বাপি আমাকে এসব ব্যপারে ডিস্টার্ব করেনা। বস্ বলছিল আমাকে কয়েকজন গেমার-এর সঙ্গে মিট্ করতে হবে, যারা নাকি সাকসেসফুলি চাঁদের দেশে যেতে পেরেছে! সাকসেসফুলি? ঠাম্মার মতো? বাপি ঠাম্মার বড় ছেলে ছিল। ছোট যে সে চায়নাতে থাকে। ঠাম্মার দায়িত্ব ও কখনই নেবে না --বাপি বলত। আচ্ছা দায়িত্ব নেওয়া ঠিক কি? আমাকেও কি বড় হলে মা বাপির দায়িত্ব নিতে হবে? কিন্তু ওরা তো যে যার নিজের মতো থাকে! মা ও কি ঠাকুমা হয়ে যাবে এক দিন। কি সব উল্টোপাল্টা ভাবছি! আমি মাকে বড্ড ভাল বাসতাম। আমি মাকে ঠাকুমা হতে দেবনা। ওই কষ্ট মাকে পেতে হবেনা। আমি যে শুনেছি। ঠাম্মা অনেকদিন ভুগেছিল, এর মধ্যে হিপ বোন ফ্র্যাকচার। বাপি ডক্টর আংকেলকে বলছে -এই সব পেশেন্টকে বাঁচিয়ে রাখার চেয়ে পয়জনিং করে মেরে ফেলাই বেটার ছিল। 


এখন সন্ধে সাড়ে সাতটা। বস্ কানেকশন অফ করে দিয়েছে! রাগ করেছে বস্। সব মেল, আপলোড করা ছবি আগেই মুছে দিয়েছি। আজ রাত ঠিক আড়াইটায় অ্যালার্ম দিয়ে রেখেছি। ঠিক আড়াইটায় আমার শেষ লেভেল কমপ্লিট করব। "লেভেল এক্সরশান"। ঠাম্মা আমার জন্যে অপেক্ষায় আছে। চাঁদের দেশে। ছাতে উঠে দেখলাম, আশ্চর্য্য আজ একটা চাঁদ উঠেছে মেঘের মধ্যেও। ওখানে আছে ঠাম্মা, হয়তো বস্ ও। তার আগে এখান থেকে বের করতে হবে নিজেকে। এখান থেকে মানে নিজের ভিতর থেকে। আসলে সন্ধেবেলায় একবার খুব মায়ের কথা মনে হলো। 

মা তুমি জান আমার মন খারাপের কথা? তুমি কিছু জান না। জাননা মানুষ কিভাবে শেষ হয়ে যায়। আসলে একটু দুর্বল হয়ে পড়েছিলাম। ফর দ্য টাইম বিইং। এটাও জানবেনা। যেমন জানবে না সেদিনের স্বপ্নের জায়গাটা হঠাৎ করে আজ খুঁজে পেয়ে গেছি। ওটা ছিল খাজিয়ার, হিমাচলপ্রদেশে। বাপি মা আমায় নিয়ে গেছলো। আমার তখন পাঁচ বছর বয়েস। সেই প্রথম সেই শেষ! খুব বায়না করেছিলাম একটা পনিতে চাপার জন্যে। 

মা জানিনা কার দোষ, কিন্তু এটা সিওর যে তোমার আর বাপির ঝগড়া হচ্ছে প্রতিরাতে। আমি শুনেছি। তোমরা দু’জনেই খুব খারাপ খারাপ কথা বলছিলে। ইফ আই অ্যাম নট রং তোমরা সেপারেশন চাইছ! কিন্তু এটা মিশনের শেষ লেভেল, তাই এসব ভেবে মন দূর্বল করা চলবেনা। নিজেকে সেপরেট করে দেবার সময় এসেছে! 


একটা নীল ঘোড়া আসার কথা ছিল না? ওই আমায় নিয়ে যাবে। হ্যাঁ, অন্ধকারে চোখ সয়ে আসতেই দেখলাম, সোসাইটির ছাতের এক দম কোনায় নীল ঘোড়াটা দাঁড়িয়ে আছে। থ্যাংকস বস্। ঘোড়াটার গায়ে নাম্বারটা কাছাকাছি যেতেই চোখে পড়ল। আই এফ ফরটিন। আমারই গেমার কোড। ঘোড়াটাও চিনতে পেরেছে আমাকে। এক লাফে ঘোড়ার পিঠে উঠবো বলে ছাদের আলসেতে পা রাখলাম। আমি চাপতেই ঘোড়াটা টুক করে পাঁচিলটা টপকে রওনা দিল। ভয় পেয়ে ছিলাম হয়তো সোজা নিচেই পড়ে যাব। কিন্তু লাগাম টানতেই তো দিব্বি ওপরে উঠছি! নীল ঘোড়ায় আমি, ওপরে উঠছি, ঘোড়া ছুটছে, আরও -আরও, ঠাম্মার কাছে... 


একটা অদ্ভূত স্মেল পাচ্ছি। একটা ঘরে আমি। দেয়ালগুলো সব সবুজ। ঠিক বুঝতে পারছি না। মাথা কাজ করছে না। কয়েকজন মানুষ। চাপা স্বরে কিছু বলার চেষ্টা করছে। ওরা কারা? এটা তো চাঁদ না। মনে করার চেষ্টা করছি। মায়ের গলা, বাপির ও। পাশে ওই ছেলেটা কি আর্ক? ওর বাবাও আছে। আংকেলটা পুলিশের ইউনিফর্মে। অর্কের বাপি তো পুলিশ ডিপার্টমেন্টএ চাকরি করে! বাপি ওঁকে কি যেন বলছে। বস্ শব্দটা শুনলাম একবার। মা কি বলছে? ও হ্যাঁ, এটা মায়ের স্মেল। আমার চেনা। মা আমার মাথার কাছে এসে বসল। মাকে এখন ঠিক ঠাম্মার মতো লাগছে। মা জড়িয়ে ধরছে আমায়। ঠাম্মা! 

"মা, আমায় আরেকবার খাজিয়ারে নিয়ে যাবে? আমি তুমি আর বাপি।" আর বলতে পারছি না। ও! আমার কি ঘুম পাচ্ছে! ডক্টর আংকেলের গলা শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে যাচ্ছি... "ট্রাংকুলাইজারটা সাসটেইন করছে, সময় লাগবে মিসেস দত্ত, গিভ হিম টাইম..." মা এর হাত ছুঁচ্ছে... আমায়। 


(গল্পের সবটুকু কাল্পনিক, কেবল শেষটুকুই যেন সত্যি হয় -লেখক)

0 comments: