0

সম্পাদকীয়: সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়

Posted in


অতিথি  সম্পাদকের কলমে 
সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়

এরকম একটা সময় পৃথিবীতে আসবে কি, যখন আর কাগজের বইয়ের কোনও অস্তিত্ব থাকবে না? বা থাকলেও সেটা সীমাবদ্ধ থাকবে শুধু সংগ্রহশালার আলমারির ভিতর? কিরকম হবে সেই সময়টা? খুব দুঃখজনক? Depressing?

আপাতচিন্তায় সেই রকমই তো মনে হয়। বসার ঘরের bookrack ভরা রঙ-বেরঙের বই, পড়ার টেবিলের উপর স্তূপীকৃত বইয়ের রাশি, তার মধ্যে থেকে টুক করে একখানা তুলে নিয়ে পাশের বিছানায় গড়িয়ে পড়ার আরামই যদি না থাকে, তাহলে আমাদের মতন পাঠপিপাসু মানুষের জীবনে আর থাকে কি? তাই বই নেই – এইরকম একটা পরিস্থিতির কথা ভাবতেই আমাদের শরীর, মন, অন্তরাত্মা অবধি কিকরম যেন করে ওঠে!

বিশেষ করে বছরের এই সময়টায়। সামনেই বইমেলা। বাঙালির প্রায় তিন প্রজন্মের বোহেমিয়ান রোম্যান্টিকতার স্থানীয় লীলাভূমি, মননের শিল্পক্ষেত্র, জ্ঞানচর্চার পীঠস্থান ভারতবর্ষের একমেবদ্বিতীয়ম পুস্তকোৎসব। ঠাঁইনাড়া হওয়া সত্ত্বেও সে এখনও স্বমহিমায় ভাস্বর। কয়েক লক্ষ বাঙালির সম্বৎসর প্রতীক্ষার মাঠজোড়া ফসল। স্কুল-কলেজ-অফিস ফেরতা সান্ধ্যভ্রমণ বা সপ্তাহান্তে সপরিবার একটা ছোটখাটো পিকনিক... বইমেলা ছাড়া কলকাতা ও তার আশপাশের অঞ্চলবাসী শিক্ষিত বাঙালির শীতকালটাই সম্পূর্ণ হয় না। কিন্তু বই না থাকলে যে বইমেলাও থাকবে না, সে কথা স্বতঃসিদ্ধ। এবং সে যে ভারি দুঃখের বিষয় হবে, সে কথা বাঙালিকে আর আলাদা করে বলার প্রয়োজন নেই।

কিন্তু মুশকিল হলো, বিশ্বব্যাপী পরিসংখ্যান বলছে, গত কয়েক দশকে প্রকাশনা ও পাঠকের সংখ্যা হু হু করে বেড়েছে। সেটাই স্বাভাবিক, কারণ শিক্ষার প্রসার যে বেড়েছে পৃথিবীতে, তাতে বিশেষ সন্দেহ নেই। হ্যাঁ, যাঁদের রসবোধে অম্লরসের একটু আধিক্য, সেই চিরকালের প্রতিষ্ঠানবিরোধীরা জিজ্ঞেস করতেই পারেন, চারপাশের এই ধর্মধ্বজরা কি সেই প্রসারিত শিক্ষার নিদর্শন? সে প্রশ্নের সদুত্তর দেওয়ার মতন বিদ্যেবুদ্ধি আমার নেই। তবে পরিসংখ্যানকে যেহেতু ফেলে দেওয়া যায় না, সেই কারণে একথা মেনে নিতেই হবে, যে সারা পৃথিবীর নিরিখে মানুষের পাঠাগ্রহ বেড়েছে, এবং সেই সঙ্গে বেড়েছে বইয়ের সংখ্যা – সেটা যে রূপ বা format-এই হোক না কেন।

আসলে বই বা book কথাটা এখন আর শুধুমাত্র কাগজে ছাপা পৃষ্ঠার সংকলন বোঝায় না। সে কথা অবশ্যই এই web magazine-এর পাঠক-পাঠিকাদের আলাদা করে বলার প্রয়োজন নেই। আমি নিশ্চিত, আপনারা প্রায় সবাই e-book বা kindle জাতীয় জিনিস পড়তে অভ্যস্ত। কাগজের বইয়ের মতন সর্বার্থে সুখপাঠ্য সেগুলো যে নয়, সে কথা অনস্বীকার্য। টানা অতক্ষণ আলোর উৎসের দিকে তাকিয়ে থাকা যে চোখের জন্যও খুব স্বাস্থ্যকর নয়, সেও সত্যি। কিন্তু তার থেকেও বড় একটা সত্যি এই কাগজের বইয়ের সংখ্যা হ্রাস পাওয়ার পিছনে লুকিয়ে আছে।

সেই সত্যিটা হলো, শুধু বই নয়, কাগজ বস্তুটার যে কোনও ব্যবহার আমাদের এই গ্রহটার প্রায় অপূরণীয় ক্ষতি করে দিচ্ছে। কাগজ তৈরি হতে কাঠ লাগে, এবং সেই কাঠের জোগান দিতে দিতে প্রকৃতির এখন নাভিশ্বাস ওঠার উপক্রম। কৃত্রিম কাগজ তৈরি করার কিছু উপায় patented হয়েছে বটে, কিন্তু যা দিয়ে সে কাগজ তৈরি হয়, সেই polyolefin বা styrene polymer জাতীয় রাসায়নিক বস্তুগুলোর সম্পূর্ণ জৈববিনাশ বা biodegradation হয় না। তাই পৃথিবীর স্বাস্থ্যের খাতিরে সম্ভবত মানুষের খানিকটা স্বাস্থ্য আর বেশ কিছুটা আনন্দ পরিত্যাগ করার সময় ঘনিয়ে আসছে। পুস্তকপ্রেমী মানুষদের যে দুর্দিন আসছে, সে কথা বলা বাহুল্য।

তবে পরিস্থিতিটা আপাতদৃষ্টিতে যতখানি নৈরাশ্যব্যঞ্জক মনে হয়, ততখানি বোধহয় নয়। আসলে ওই পুস্তকপ্রেম এবং পাঠপ্রেমের মধ্যেকার তফাৎটাকে ধীরে ধীরে বাড়িয়ে তুলতে হবে, এই যা। ব্যবসা-বানিজ্য-প্রশাসনের কাজে কাগজের ব্যবহার চট করে কমিয়ে ফেলা কঠিন। তার জন্য নানারকম আইন বদলানোর প্রয়োজন। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার ক্ষেত্রেও তাই। শুধু কাগজের যে ব্যবহারটিকে এই পর্যায়ে কমানো সম্ভব, সেটি হলো পাঠক্রমবহির্ভূত বইয়ের উৎপাদন। বই-পত্রিকা-সংবাদপত্র পড়ার অন্যান্য পদ্ধতিগুলি, অর্থাৎ তাদের digital সংস্করণগুলি যত তাড়াতাড়ি জনপ্রিয়তর হবে, তত তাড়াতাড়ি বোধহয় কাগজের বই ছাপার প্রয়োজন কমে আসবে।

আমি অনেককে বলতে শুনেছি, digital সংস্করণের গ্রহস্বত্বাপহরণ বা piracy নাকি খুব সহজ। কিন্তু একটু খেয়াল করে দেখবেন, যে সমস্ত pirated e-book গুলি আমরা download করে পড়ি, সেগুলি বেশির ভাগই কিন্তু মুদ্রিত বইয়ের scanned copy। একবার বই হাতে পেলে তাকে scan করে upload করে ফেলা অত্যন্ত সহজ কাজ, এবং সে কাজ আটকানোরও কোনও উপায় নেই। কিন্তু যদি সে বই ছাপাই না হয়, শুধুমাত্র digital সংস্করণেই সীমিত থাকে, তাহলে তাকে download‌‌‌‌‌-সুরক্ষিত রাখলেই কিন্তু গ্রহস্বত্বাপহরণের সম্ভাবনা অনেকখানি কমে যায়। 

তবে বই, পত্রিকা বা সংবাদপত্র ছাপা বন্ধ হয়ে গেলে যে অনেক সংস্থা এবং ব্যক্তির বানিজ্যিক স্বার্থে ব্যাঘাত ঘটবে, সে কথাও ঠিক। বিক্রির হার এক ধাক্কায় অনেকখানি কমে যাবে। বিজ্ঞাপনের ব্যবসায়িক মুনাফাও হ্রাস পাবে। তবে সে সবই সাময়িক। যে কোনও সামাজিক বা প্রযুক্তিগত বিবর্তনেই অভ্যস্ত হতে আমাদের সময় লাগে। কিন্তু সেই সময়ের সঙ্গে সঙ্গে যখন মানুষের সমাজচেতনায় সে বিবর্তনের সুফল স্পষ্ট হয়ে ওঠে, তখন আর অসুবিধা হয় না। সমাজবিবর্তনের ইতিহাস তা-ই বলে, এবং সেটাই rationality-র নিয়ম।

তাই মুদ্রিত বই বা তার দোকানের সংখ্যা কমে গেলেই যে সেটা খুব আতঙ্কিত হওয়ার মতন বিষয় হবে, তা মনে হয় না। বরং যেটা বেশ দুশ্চিন্তার বিষয়, সেটা হলো সাহিত্যের মানগত অবনমন বা অবমূল্যায়ন। বাংলা সাহিত্যের ক্ষেত্রে সেটা ঘটছে কি না, এবং সেই কারণে বাঙালির পাঠাগ্রহ কমে যাচ্ছে কি না, সেটা সম্পূর্ণ অন্য বিষয়। তার বিশ্লেষণ করার জন্য আমার থেকে অনেক বেশি ধীসম্পন্ন বিচক্ষণ আলোচকের প্রয়োজন। অদূর ভবিষ্যতে ঋতবাকের e-পৃষ্ঠায় সে বিষয়ে লেখা পড়ার অপেক্ষায় রইলাম।


0 comments: