0

প্রাচীন কথা - অনিন্দিতা মণ্ডল

Posted in


প্রাচীন কথা


বেদবতী
অনিন্দিতা মণ্ডল



সে অনেক দিন আগের কথা। তখনও তপোবন, মুনি ঋষিদের অবস্থানে ভারত খুঁজে চলেছে তার নিজস্ব গতি প্রকৃতি, ধর্ম সংস্কৃতি। এমনকি মানচিত্রেরও পরিবর্তন ঘটে চলেছে অহরহ। তখনও শ্রুতি সম্পূর্ণভাবে বিভক্ত হয়নি। তবে আদি মুনি শ্রীকৃষ্ণদ্বৈপায়ন শুরু করেছিলেন সে কাজ। সেও বহুযুগ হ’ল। উত্তরভারতের সরযূ তীরস্থ তপোবন থেকে এক সদ্য তরুণ নির্গত হয়েছেন তপস্যার মানসে। এখন তপোবনও বড্ড বেশি জনপূর্ণ। তপস্যার জন্য যে নির্জনতা প্রয়োজন তা আর এখানে মেলেনা। এই তরুণ মাত্র অষ্টাদশ বর্ষীয়। তবে স্মৃতিধর ও শ্রুতিধর বলে তাঁর খ্যাতি রটেছে ঋষি সমাজে। সকলের আশা তিনি শ্রীকৃষ্ণদ্বৈপায়নের অসম্পূর্ণ কাজকে সম্পূর্ণতার দিকে এগিয়ে নিয়ে যাবেন। তরুণ মুনির নাম বিবস্বান। তবে এ নাম তপোবনের মুনিপত্নীদের দেওয়া। জন্মেই পরিত্যক্ত শিশু নিজের পিতামাতার স্নেহ বঞ্চিত। এমনকি অবাঞ্ছিতও বটে। সরযূতীরে স্নানরতা মুনিপত্নীদের চোখে পড়ে একটি ঘাসখড়ে বাঁধা ঝুড়ির মধ্যে এক সদ্যোজাত শিশু। সেই থেকে বিবস্বান এই অরণ্যগৃহে প্রতিপালিত। যদিও এখানে কেউ তাঁকে অনাথ বলেনা। কেউ তাঁর প্রতি কোনও অনুকম্পার ভাব পোষণ করেনা। স্নেহের কোনও অপ্রাচুর্যও ঘটেনি কখনও। তবু বিবস্বান মাঝে মাঝে মনে করেন যখন ভাগ্যই তাঁকে এভাবে একলা করেছে তখন একা থেকে দেখাই যাক না, কি আছে নিয়তিতে লেখা! তাঁর পালকপিতার কাছে যখন নির্জনে তপস্যার অনুমতি চাইতে গিয়েছিলেন বিবস্বান, তিনি উপদেশ দিয়েছিলেন তাঁকে সংসারী হতে। গার্হস্থ্য সম্পূর্ণভাবে পালন না করে বাণপ্রস্থে যাওয়া কি যুক্তিসঙ্গত? বিবস্বান মাথা নত করে উত্তর দিয়েছিলেন, কে বলতে পারে যে তিনিও তাঁর সংসারের দায়দায়িত্ব অন্যায়ভাবে মাঝপথে পরিত্যাগ করবেন না? বিশেষ তাঁর রক্তে যখন সেই দায়িত্বহীনতার বীজ রয়ে গিয়েছে। পিতা কোনও উত্তর দেননি। দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করে উপলব্ধি করেছিলেন, এ বালক জনক জননীর পাপকে ক্ষমা করতে পারেনি। আর সেই অক্ষমতা তাঁকে পালক পরিবারের প্রতি ভালোবাসায় প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর পক্ষে সংসারাশ্রমে প্রবেশ সম্ভব হবেনা হয়ত। হয়ত মহাকাল অন্য কোনও উপহার রেখেছেন এর জন্য। অগত্যা অনুমতি দিতে হয়। 

যাত্রা শুরু করেছেন বিবস্বান। মুনিপত্নীদের কথা দিতে হয়েছে তপস্যায় সিদ্ধিলাভের পর তিনি ফিরে আসবেন। আপাতত জ্ঞানমার্গের সেই চূড়ায় উত্তরণই তাঁর লক্ষ্য যেখানে এই মর্ত্যের কোনও মোহ তাঁকে আর মোহগ্রস্ত করতে পারবেনা। কেউ জানুক আর না জানুক, ভবিষ্যৎদ্রষ্টা ঋষি নিজের ভবিষ্যৎ স্পষ্ট প্রত্যক্ষ করেছেন ধ্যানে। জেনেছেন যে, তিনি তাঁর অভীপ্সিত লক্ষ্যে পৌঁছবেন। শুধু কালের অপেক্ষা। মাঝে কিছু বছর শুধু তাঁর কঠিন তপস্যার সময়। নদী পেরিয়ে তিনি চলেছেন পশ্চিমে। বেশ ক'টি গ্রাম ও জনপদ চোখে পড়ে এখানে। সমৃদ্ধ নদী উপত্যকার জনপদ। শস্যশ্যামলা ধরিত্রী। শিশুর কলকাকলিতে মুখর প্রান্তর। কৃষকের কর্ষণে ক্লান্ত গবাদি পশু। দৃষ্টিনন্দন। কিন্তু এই মায়ায় তিনি যে আবদ্ধ হবেন না! দিক পরিবর্তন করে তিনি চললেন উত্তরে। পিতা মহর্ষির কাছে তিনি শুনেছেন উত্তরে তুষারমৌলী হিমগিরি আছেন। মহাকাল মহাদেবের আসন। তপস্যায় তাঁর আরাধ্য মহাদেব ছাড়া আর কেই বা হবেন! সেই বৈরাগ্যের মূর্ত প্রতীক, বিরাগভস্ম যাঁর অঙ্গের শোভা, তিনিই যে বিবস্বানের আরাধ্য দেবতা! তাই গন্তব্য হিমালয়। যতই উত্তর মুখে চলেছেন ততই জনবিরল হতে শুরু করেছে ভূমি। নদী উপত্যকা থেকে এত দূরে মানুষ গ্রাসাচ্ছাদনের ব্যবস্থা কিভাবেই বা করবে। ধীরে ধীরে জনপদ অপসৃত হলো। তবে একেবারে বিরল হলোনা। মাঝে একটি দুটি পার্বত্য নদী চোখে পড়ল। সেইসব খরস্রোতা নদীর পাশে দু'চারটি পর্ণকুটীর চোখে পড়ল। দু'একটি পার্বত নরনারীও দেখা গেলো। কিন্তু ক্রমে অরণ্য এল। বিশাল বিশাল বৃক্ষরাজির মাঝে মধ্যাহ্নসূর্য যেন প্রবেশ করতেও ভয় পায়। বৃক্ষগুলি যেন ধ্যানমগ্ন ঋষি সব। কতকাল ধরে যেন তাঁরা বিশ্ববিধাতার ধ্যানে মগ্ন। অরণ্যের মধ্যে দিয়ে, গিরি উপত্যকার সঙ্কীর্ণ খাত ধরে তিনি এগিয়ে চললেন। তপোবলে তাঁকে দেখে বন্যপশু দূরে সরে যায়। তাঁকে হিংসার পাত্র বলে মনে হয়না। তিনি জানেন, যে হিংসাকে জয় করেছে সে পশুরও অবধ্য। এভাবেই দিন যায়। ঝর্নার জল আর ভূপতিত ফল তাঁকে আহার জুগিয়ে চলেছে। হেঁটে চলেছেন তিনি। আর মধুর ভাবে বিবশ হয়ে পড়ছেন। এই ভূমি তাঁর জন্মভুমি। এ তাঁকে পরিত্যাগ করেনি। জননী পরিত্যাগ করলেও এই ভূমিমাতা তাঁর ক্ষুধা তৃষ্ণা মিটিয়ে রক্ষা করে চলেছেন। কী রূপ তাঁর! ভিতরে ভিতরে এক অদ্ভুত স্নেহের পরশ অনুভব করছেন তিনি। মাঝে মাঝে বোধ হচ্ছে মাতার প্রতি দায়িত্ব কি কিছু আছে? যদি অনুভব করেন সে প্রয়োজনীয়তা তবে নিশ্চয় তা পূরণ করবেন। আপাতত চারিদিকের অরণ্যও বিলীন হচ্ছে। ক্রমে রুক্ষ পার্বত্য ভূমি। বিরল জীবন চিহ্ন। দুর্গম গিরিপথ দিয়ে উচ্চে আরোহণ করছেন তিনি। অকস্মাৎ দৃষ্টিপথের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা পর্বত প্রাচীর ছাড়িয়ে উঠে দেখতে পেলেন তুষারমৌলী হিমশৃঙ্গ। দর্শন মাত্রই বিবস্বান ভীষণ আবেগ অনুভব করলেন। হ্যাঁ, ঐ সুউচ্চ ভুমিই তাঁর ধ্যানাসন। ধ্যানে না স্বপ্নে? তিনি তো এই আসনটিকেই দেখতে পেয়েছিলেন! জগতের সকল গাম্ভীর্যকে ধারণ করে রেখেছে যেন। এই বিশাল নগরাজ যেন তাঁর শুভ্র বিশাল বক্ষ মেলে তাঁকে আহ্বান করছেন, আশ্রয় দিচ্ছেন। দেবাদিদেব স্বয়ং যেন মূর্ত হয়েছেন এঁর মাঝে। মনের সমস্ত খেদ মিটে যায় বিবস্বানের। পরম আশ্রয় লাভ করেছেন তিনি। এবার আর চলার পথে তাঁর কোনও ক্লান্তিই এলনা। মাঝে মাঝে দাঁড়িয়ে এই অপূর্ব হৈমকান্তি দর্শন করেন, তারপর আবার চলতে শুরু করেন। ক্লান্তি তাঁকে স্পর্শ করেনা। তপঃপ্রভাবে প্রাকৃতিক বিরূপতাকে নিজ আয়ত্ত্বে আনতে পারেন। সূর্য ও চন্দ্রের গতির ওপর লক্ষ্য রেখে দিক নির্ণয় করে এগিয়ে চলেন। দৈব নির্দেশে তিনি জেনেছেন, এক উত্তুন্গ গিরিপথের এক ঢালে, যেখানে ভূমি কর্কশ নয়, আর পর্বত গাত্রের মতো উচ্চ ও দুর্গম নয়, সেইখানেই তাঁকে তপস্যার আসন নির্দিষ্ট করতে হবে। ক্রমে সমস্ত শ্যমলিমা অন্তর্হিত হলো। তৃণভূমি পর্যন্ত চোখে পড়েনা। জনমানবহীন প্রান্তর। এই দীর্ঘ যাত্রাপথে কখনও কখনও পার্বত্য উপজাতির মানুষ তাঁকে আহার ভিক্ষা দিয়েছেন। পর্ণকুটীরে আশ্রয় দিয়েছেন। কিন্তু এবার তিনি একা। মনে মনে এক স্বাধীন আনন্দ অনুভব করছেন। তবে মানুষ বা প্রকৃতির সাহায্য পাবার আশা আর রইল না। এক দিন বিবস্বান দেখলেন, সামনে এক শ্বেত পর্বত, যাকে অতিক্রম করা মানুষের দুঃসাধ্য, তুষার কিরীট মাথায় নিয়ে তাঁর সামনে প্রাচীরের মতো দাঁড়িয়ে। তখন সূর্যাস্ত হয়ে গেছে। চন্দ্রকিরণে পর্বতমালার শৃঙ্গগুলি রূপার মতো ঝকঝক করছে। তিনি মোহিত হয়ে দেখছেন। কিন্তু তার সঙ্গে লক্ষ্য করছেন যদি একটি আশ্রয় মেলে। যা প্রবল শীত! রাত্রি যাপনের জন্য একটি আচ্ছাদযুক্ত স্থান বড় প্রয়োজন। অবশেষে একটি বড় পাথরের খাঁজে তিনি রাত্রি অতিবাহিত করবেন স্থির করলেন। গন্তব্য অদূরে। কাল যাত্রা করবেন পুনরায়। কিছু শুকনো ফল ও রসযুক্ত কন্দ ছিল কাছে। তাই উদরস্থ করে তিনি আশ্রয় নিলেন পাথরের খাঁজটিতে। হঠাৎ রাত্রি মধ্যযামে তাঁর নিদ্রাভঙ্গ হলো। খাঁজের আড়াল থেকে দৃষ্টিপাত করে দেখলেন, চরাচর ভেসে যাচ্ছে এক নীলাভ মায়াবী জ্যোৎস্নায়। আর সেই মৃদু আলোয় একদল অপরূপা নারী যেন নৃত্যরত। কি সুরের জাদু! সেই স্বর্গীয় সুরের ছন্দে তাঁরা নেচে চলেছেন। বিবস্বান মুগ্ধ হয়ে গেলেন। কিন্তু সে ক্ষণকাল মাত্র। তিনি জানতেন, হিমালয়ের এ অঞ্চলে কিন্নরদের বাস। এরা না মানুষ, না দেবতা। বহুরকমের মায়াজাল রচনায় পারদর্শী এরা। এই বিরূপ পরিবেশে তো মানুষের পক্ষে জীবন ধারণ অসম্ভব। এরা কিন্নরী। চন্দ্রালোকে নৃত্যগীত এদের খুব প্রিয়। তাই বিবস্বান কালক্ষেপ না করে পুনরায় পাহাড়ের খাঁজে আশ্রয় নিলেন। কিন্তু হঠাৎ একটি সুরেলা স্বর। তাকিয়ে দেখলেন এক অপরূপ নারী। নারী কোনও কথা বলছেনা। শুধু সুরেলা এক ধ্বনি তার কণ্ঠে। মুহূর্তে বিবস্বান সোজা হয়ে বসলেন। কিন্নরীদের ছলাকলা বিষয়ে তিনি বিলক্ষণ অবহিত। তিনি বলে উঠলেন – দেবী, আমি সামান্য মানুষ। ঈশ্বর আরাধনার কারণে দেবতাত্মার দ্বারে এসেছি। স্বপ্নে সেই দিব্যভূমি দেখেছি। অচিরেই সেই স্থানে পৌঁছব। আমার লক্ষ্য নির্দিষ্ট। দয়া করে আমাকে লক্ষ্যভ্রষ্ট করবেন না, এই বিনতি। কথা ক’টি শেষ হবার আগেই নারী অন্তর্হিত হলো। প্রভাতে বিবস্বান যাত্রা শুরু করলেন । কিছুদূর অগ্রসর হতেই সেই দৈবনির্দিষ্ট গিরিপথ সন্নিকটস্থ পর্বত ঢালের দেখা মিলল। তিনি দেখলেন, আকাশ থেকে যেন তুষার ধবল হিম বর্ষিত হয়ে পর্বতশৃঙ্গ, পর্বতগাত্র থেকে শুরু করে বহু নিম্নে উপত্যকা পর্যন্ত আচ্ছাদিত করে ফেলেছে। কি তার শোভা! দুর্গম, ভয়ংকর, আর সুন্দর! তবে এখানে কোনও পার্বতী নদী নেই। এই স্তব্ধ করা সৌন্দর্য তিনি খানিক উপভোগ করলেন। এমন স্থান ও হয়? শুধু শুনেছেন, এই প্রত্যক্ষ করলেন। অতঃপর পর্বত ঢালের এক কোণে একটি বড়সড় পাথরকে গড়িয়ে আনলেন। আর তার খাঁজে আসন করলেন। রাত্রি হলো। অপূর্ব এই পার্বত্য ভূমি। বিবস্বান মুগ্ধ হয়ে দেখছেন চন্দ্রকিরণে প্রতিবিম্বিত শিখরগুলি ও চতুর্দিকের তুষার আবরণ থেকে যেন একরকম শুভ্র আলোর বিচ্ছুরণ ঘটছে। নীলকণ্ঠ মহাদেবের ভালের চন্দ্র যেন দেবাদিদেবের বিপুল সর্বময়তাকে মূর্ত করে তুলেছে। এই সৌন্দর্য প্রাণ ভরে উপভোগ করতে করতে তিনি হঠাৎ দেখতে পেলেন এক তুষারশুভ্র হরিণ। চাঁদের আলোয় গড়া যেন। তার শাখাপ্রশাখায় সুন্দর শৃঙ্গ দুটি বাঁকিয়ে কাজল কালো চোখ মেলে তাঁকে দেখছে। বিবস্বান কেমন করে যেন বুঝতে পারলেন, এ সেই কিন্নরী। তাঁকে অনুসরণ করছে। প্রমাদ গণলেন তিনি। এইভাবে বিঘ্ন ঘটলে তাঁর তপস্যা হবে কি করে? পায়ে পায়ে এগিয়ে এসে হরিণীটি ততক্ষণে বিবস্বানের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। বিবস্বান সম্বোধন করলেন – মাতঃ, কি জন্য পুনর্বার আমায় দেখতে এসেছেন? হরিণী স্পষ্ট মানুষের গলায় বলে উঠল – হে মহাঋষি, আপনাকে কোনও মায়াজালে আবদ্ধ করতে আসিনি। এই মুহূর্তে মর্ত্যে যে ক'জন মহাজ্ঞানী আছেন, তার মধ্যে আপনি অগ্রগণ্য। কালে আপনার খ্যাতি পৃথিবী ব্যাপ্ত হবে। যে মহামুনি পরম্পরার আপনি প্রতিনিধি হতে চলেছেন, সেই পরম্পরায় আপনার অবদানে মানুষ কৃতার্থ হবে। আপনার দ্বারা সম্যক ভাবে বেদের বিভাগ হবে। আদিমুনির অসমাপ্ত কাজ এই ভাবেই যুগে যুগে এগিয়ে যাবে। আপনি এই যুগের বেদব্যাস। আমি সামান্যা কিন্নরী। এই প্রতিকূলতায় প্রকৃতিকে নিজের সহায় করতে না পারলে আপনার সিদ্ধি অধরা থেকে যাবে। অথচ এখানে মানুষের পক্ষে জীবন ধারণ অসম্ভব। বায়ুস্তর হালকা, পানীয় জল নেই। এমন নানা বিপদ। এর ওপর আছে পার্বত্য জীব। তাই আপনাকে অনুসরণ করছি। যদি আপনার সহায় হতে পারি তবে আপনার সিদ্ধিলাভ হবেই। বিবস্বান যারপরনাই বিস্মিত হলেন। আশৈশব বেদচর্চা তাঁকে যে প্রজ্ঞা দিয়েছে, এই কিন্নরী কোন মন্ত্রবলে তা জেনেছে? তবে তো এ সামান্যা নয়! বিবস্বান এবার সম্ভ্রমের সঙ্গে বললেন – দেবী আমি কাল থেকে ধ্যানে বসব। ন্যূনাধিক দ্বাদশ বৎসর কাল। এই তপস্যাকালে আপনি লক্ষ্য রাখবেন আমার, তা আমি জেনেছি। তপস্যা শেষে আমি আপনাকে বর দেবো। বহুজন হিতায় সে বর আপনারও জীবন সার্থক করবে। কিন্নরী হাসল। মানুষের জন্য যা বারো বছর তাদের কাছে তা বারোটি পল মাত্র। বিবস্বানকে আশ্বস্ত করে সে বলল – ঋষি আপনি তপস্যায় বসুন। আমি এখানেই আছি। বিবস্বান বহুকাল পর অনুভব করলেন এক মাতৃহৃদয়ের আকুলতা। সন্তানকে রক্ষা করতে কি ভীষণ আগ্রহ তার! এরপর বিবস্বান ডুবে গেলেন গভীর ধ্যানে। তাঁর মাথায় কখনও সূর্য কখনও চন্দ্র। কখনও রৌদ্রকর কখনও তুষার বর্ষণ। মাস যায়। বছর যায়। সম্পূর্ণ তুষারে আচ্ছাদিত হয়ে যান। আবার গ্রীষ্ম এলে সূর্যকিরণে বরফ গলে যায়। কিছুতেই ভ্রূক্ষেপ নেই। তাঁর অদূরেই এক অপরূপা নারী, কখনও হরিণী, ধীরে ধীরে সঞ্চরন করতে থাকে। লক্ষ্য রাখে বিবস্বানের ওপর। বারো বৎসর অতিক্রান্ত। তপস্যা শেষ হয়েছে বিবস্বানের। তপস্যার দ্বারা তিনি নির্ভুল ভাবে বেদ বিভাগের জ্ঞান লাভ করেছেন। হৃদয় আনন্দে পরিপূর্ণ তাঁর। আকাশে বাতাসে যেন দৈববাণী হচ্ছে তাঁর নতুন নাম, বেদব্যাস। একটু আত্মস্থ হতে চিন্তারাশি সরে যেতে তিনি লক্ষ্য করলেন যে পাথরটির ওপর বসে তিনি এই দীর্ঘকাল তপস্যা করেছেন, সেটি ক্ষয় পেতে পেতে একটি গহ্বরের সৃষ্টি হয়েছে। সরে এসে বসতেই তিনি দেখতে পেলেন সেই কিন্নরী। প্রবল তুষারপাত উপেক্ষা করে তাঁকে নজর রেখেছে। করুণায় দ্রবীভূত হলো মহাঋষির হৃদয়। তপোবলে তিনি সেই কিন্নরীকে নিক্ষেপ করলেন ঐ গহ্বরে। কিন্নরী অবাক বিস্ময়ে প্রশ্ন করলেন – একি দেব? বিবস্বান বললেন – মা, তোমার স্নেহ বারিধারা হয়ে নীচের উপত্যকায় স্রোতস্বিনী হোক। ধরিত্রীর তৃষ্ণা মিটুক। আমি এখানে আসার সময় লক্ষ্য করেছিলাম, এই গহন প্রদেশ যেমন দুর্গম তেমন রুক্ষ। একটি নদী নেই। মা আজ থেকে তুমি নদী হয়ে প্রবাহিত হবে। কিন্নরী আহত দৃষ্টিতে গহ্বর থেকে মুনির দিকে চেয়ে আছে। ঋষি পুনরায় বললেন – মা, মনে দুঃখ রেখো না। তোমার তীরে তীরে দেবালয় গড়ে উঠবে। তুমি এক পবিত্র ধারা হিসেবে গণ্য হবে মানুষের কাছে। পুণ্যা হবে তুমি। আর সকলেই তোমাকে চিনবে সেই আদিমুনির নামে। কারণ সেই বিশাল কর্মযজ্ঞে তোমার অবদানও এই নামের মধ্যে বাঁধা পড়বে। আজ থেকে তোমার নাম হলো ব্যাস । 

[হিমাচল হিমালয়ের দুর্গম অঞ্চল, রোহতাং গিরিপথের এক ঢালে ব্যাস বা বিয়াস নদীর উৎস। একটি গহ্বর মাত্র। ভিতরে জলের আওয়াজ। কথিত আছে সেখানে বসে ব্যাস তপস্যা করেছিলেন। একটি পাথরের ফলকে সেটি লেখা আছে। বেদব্যাস কোনও একজন ঋষি ছিলেন না। এ এক উপাধি। যে ঋষিপরম্পরা বেদকে ভাগ করেছিলেন সেই পরম্পরাটিই বেদব্যাস বলে পরিচিত হয়। এই ধারণার ওপর ভিত্তি করে গল্পটি লেখা। বাকিটা গল্পকারের।]

0 comments: