0

স্মৃতির সরণী - বিপুল দাস

Posted in


স্মৃতির সরণী


কথামালা
বিপুল দাস


আমার লেখালেখি, আমার জীবনবোধ কিছুটা তো অবশ্যই পরিবেশ ঠিক করে দেয়। আমি যা দেখিনি, শুনলেও আমাকে আলোড়িত করেনি, যে ইকো-সিস্টেমে আমার চলন সহজ, স্বচ্ছন্দ নয় – কী ভাবে সে সব বিষয় নিয়ে লিখব। পাঠক তো নিজের অভিজ্ঞতার নিরিখে যাচাই করে নেয় গল্পের সত্যি। যে লেখক পাঠকের বিশ্বাসযোগ্যতার যত কাছে যেতে পারেন, সেই গল্প তত বেশি সার্থক হয়ে ওঠে। কারও বাড়িতে সাত বার বজ্রপাত হতেই পারে, এ হ’ল বাস্তবের সত্য। কিন্তু আমাদের দৈনন্দিন অভিজ্ঞতার বাইরে। গল্পে এমন ঘটনা থাকলে পাঠকের বিশ্বাসের অনেক দূরে থাকে সেই সত্যি।

কী আমি লিখতে চাই, কেমন হবে আমার জীবনবোধ – এ প্রশ্ন আমি নিজেকেই অনেকবার করেছি। একটা গল্প শেষ হলে পড়ে বুঝতে চাই, ঠিক এটাই কি আমি লিখতে চেয়েছি। মহানন্দার ওপর ব্রিজ তৈরি হবে। তিনপুরুষ ধরে ঘাটে পারানির কাজ করছে, সেই মাঝির সমস্যা নিয়ে গল্প লিখলাম। লেখা শেষ হলে বুঝি, আমি যা লিখতে চেয়েছিলাম, সত্যিই আমি সে কথা লিখতে পারিনি। এত দিন ধরে পুরনো মাঝি ইন্দ্রমোহনকে দেখে, ওর নৌকোয় খেয়া পারাপার করে – ব্রিজ হ’লে ওর রুজির সমস্যা ছাড়াও প্রতিদিন নদীর স্রোতকে চ্যালেঞ্জ করবে বলে ওর রক্তের ভেতরে যে আর একটা নদী গর্জে উঠত – আমি আমার জীবনবোধ দিয়ে তার কতটুকে বুঝতে পেরেছি। এখানে ব্যারাজ হবে, ব্রিজ হবে। এতদিন যারা ওকে তোয়াজ করেছে, এখন তারাই গটমটিয়ে ব্রিজ পেরিয়ে ওপারে যাবে। এই ক্রাইসিস তো ওর অমার্জিত, অশিক্ষিত বোধে কয়েকটি খোঁচা হয়ে জেগে থাকে শুধু। আমি আমার মার্জিত বোধে যা বুঝলাম, তাই কি আসল সত্যি।

এবার ধরা যাক আমার পরিবেশ। তাল, নারকেলের ছায়াঢাকা গ্রাম। গ্রামীন কূটকচালি আছে, দুর্গাপুজো আছে, মহরমের তাজিয়া আছে। এখানেই আমার বড় হয়ে ওঠা। এখন আমার বোধে রাষ্ট্রীয়-সন্ত্রাস, রোহিলাদের সমস্যা, গাজা স্ট্রিপ, সিঙ্গুরে কৃষিজমি হস্তান্তর, ২০১৭ সালেও ডাইনি সন্দেহে পুড়িয়ে মারা – এগুলো তাহলে কী ভাবে কাজ করবে।

আসলে আমি কী লিখব, কীসের ভিত্তিতে আমার জীবনবোধ গড়ে উঠবে, সেটা কিছুটা নির্ভর করে আমি কোন মাটিতে দাঁড়িয়ে আছি, আমার শেকড় কোন রস টানছে – তার ওপর। এগুলো প্রত্যক্ষ প্রভাবকের কাজ করে। গল্পের প্রেক্ষিত, চরিত্র সৃষ্টিতে সরাসরি সাহায্য করে। আর একটা প্রক্রিয়া খুব ধীরে ধীরে কাজ করে। সেটা হ’ল ব্যক্তিমানুষ থেকে সামাজিক মানুষ, সামাজিক মানুষ থেকে রাষ্ট্রিক মানুষ হয়ে ওঠার প্রক্রিয়া। নিজেকে সংবিধানের অন্তর্গত একজন নাগরিক ভাবার সঙ্গে সঙ্গে এর ভালো মন্দও যেন নিজের উঠোনে এসে পড়ে। দুনিয়াজোড়া মানুষের ভালোমন্দের দায়িত্বরক্ষার আমিও একজন অংশীদার – এই বোধ খুব গভীরে অস্পষ্ট, কিন্তু নিশ্চিতভাবে কাজ করে। কেউ চাপিয়ে দেয় না, কিন্তু কোথা থেকে যেন এই দায় আসে। এ কথা সাধারণ মানুষ সম্পর্কে যেমন প্রযোজ্য, লেখক সম্পর্কেও। এই মনুষ্যত্ববোধের অহংকার তাকে প্ররোচিত করে যে কোনও রকমের ভাঙন, যা তার এবং তার প্রজাতির অস্তিত্বকে বিপন্ন করে তুলতে পারে – তার বিরুদ্ধে দাঁড়াতে। বিভিন্ন জনের ক্ষেত্রে প্রতিক্রিয়া বিভিন্ন হয়। কেউ ওয়ার অ্যান্ড পিস লেখেন, কেউ কমোডে বসে মেঝেয়ে থুথু ফেলেন, কেউ গেয়ে ওঠে উই শ্যাল ওভারকাম, কেউ রিকশাওয়ালা পেটায়, কেউ ডেপুটেশন দেয়, কেউ পুলিশকে খিস্তি দেয়, আবার কোনও কবি বন্দুক হাতে গ্রানাডা পাহাড়ে চলে যান তবে সব কিছু এত সহজে হয় না। রক্তে বিরুদ্ধগতির প্রবাহও থাকে। অনেক প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবীও পাকিস্তানের সঙ্গে খেলা থাকলে এক্সট্রা উত্তেজনায় জারিত হ’ন। কোথা থেকে আসে এই এক্সট্রা ? এও কভারেজ। রাষ্ট্র বা তার নিজের অস্তিত্বের সংকটের বিরুদ্ধে এক রকম ডিফেন্স মেকানিজম্‌। এক ধরণের পোকা আছে, বিপদ দেখলে দুর্গন্ধময় রস ছড়ায়।

এখন ইনফর্মেশন টেকনোলজির চূড়ান্ত পেশাদারিত্বের ফলে অনেক বেশি তথ্য দ্রুত লেখকের কাছে পৌঁছে যাচ্ছে। এর ভেতরে কিছু তথ্য সংবাদের চেয়েও বেশি ডাইমেনশন নিয়ে লেখকের মনে আলোড়ন তোলে। একই ঘটনা ভিন্ন লেখকের মনোজগতে ভিন্ন প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। ঘটনা একটি, কিন্তু মাল্টি-ফেসেড হওয়ার ফলে এক-এক মানুষের কাছে এক-একটি তলের উজ্জ্বলতা প্রখর হয়ে ওঠে। একটি ঘটনার অনেকগুলো মাউন্টেড স্পট থাকে। লেখক ঝাড়াই বাছাই-এর পরে সিদ্ধান্তে আসেন কী লিখবেন। ধর্মের প্রতি মানুষের সীমাহীন আনুগত্য কী ভাবে মানুষকে অমানুষ বানায়, এ কথা এই মুহূর্তে আর নতুন করা বলার কিছু নেই। প্রত্যক্ষ এবং মিডিয়াবাহিত পরোক্ষ অভিজ্ঞতা সেই রসায়নাগারে কাজ শুরু দেয়। জীবনবোধ পীড়ন শুরু করে। কেউ লেখেন মশাল হাতে এক উন্মাদের নিষ্ঠুরতার গল্প, কেউ লেখেন মানবিকতার গল্প।

মানুষ নামক জটিল প্রাণী অসীম অনন্ত এক রহস্যে মোড়া। আপাতভাবে মনে হয় শান্ত নদীর জল। কিন্তু অনেক চোরাপাথর, মগ্নমৈনাক থাকে জীবনের গভীরে। রহস্যের গোপন কন্দরে ডুবে থাকে সেই সব ডুবোপাহাড়। অসীম বিশ্বাস ও কোটি টাকার অহংকারী টাইটনিকও ডুবে যায় কত সহজে।

সেইসব ডুবোপাহাড়ের সঙ্গে অবিরত ঘর্ষণ হতে থাকে স্থানিক পরিবেশ থেকে সংগৃহীত অসংখ্য তথ্যের সঙ্গে, রক্তে লালিত বিশ্বাসের সঙ্গে, গেঁড়েবসা সংস্কারের সঙ্গে, যাপিত অভিজ্ঞতা ও পঠিত তত্ত্বের সঙ্গে। আমরা কখনও কখনও শান্ত মানুষের হঠাৎ জেগে ওঠা দেখি। ওই গ্রাফ ধরার চেষ্টা করেন লেখক। কী লিখতে চাই মনে হলেই মানুষের বুকের ভেতরের ওই পাথর একবার ছুঁয়ে দেখতে ইচ্ছে করে। এই বোধহয় জীবনবোধের তাড়না, যার থেকে কোনও স্রষ্টারই নিষ্কৃতি নেই।

যন্ত্র আর মানুষের সম্পর্ক নিয়ে আমি খুব ইন্টারেস্ট ফিল করি। যন্ত্র কত দূর পর্যন্ত মানুষের প্রতিস্পর্ধী হয়ে উঠতে পারে ? যন্ত্র কি কোনও দিন মানুষের মগজের সমতুল্য হয়ে উঠবে ? মানুষ যেভাবে জীবনকে চিনেছে সন্তানের গালে চুমু খেয়ে, মানুষ যেভাবে মৃত্যুকে দেখেছে মারী ও মড়কে, সহস্র অপমান ও লাঞ্ছনাবঞ্চনায় -- যন্ত্র কী জীবন ও মৃত্যুকে সেভাবে চিনতে পারবে ? যন্ত্রের কি কোনও দিন টিলার মাথায় দাঁড়িয়ে সূর্যাস্ত দেখার সাধ হবে ? মানুষ যেভাবে লক্ষ লক্ষ বছর ধরে টিকে থাকার লড়াই চালিয়ে গেছে, লক্ষ কোটি সংকেত লিখে রেখেছে মগজের সর্পিলাকার দ্বিতন্ত্রী হিসেবের খাতায় – যন্ত্র কি পারবে ?

0 comments: