0

গল্প - অভীক চৌধুরী

Posted in

গল্প


আলোর পথযাত্রী
অভীক চৌধুরী



মহাবিশ্বে, মহাকাশে, মহাকাল-মাঝে/আমি মানব একাকী ভ্ৰমি বিস্ময়ে...

মধুর চায়ের দোকানে সকল থেকেই ভিড়। সকাল ছটা থেকে এগারোটা আবার সন্ধ্যাতেও সেই পাঁচ ঘন্টা। পালা করে ছেলে যুব আর বুড়োর দল রোজ যার যার নিদির্ষ্ট সময়ে মধুর দোকানের বেঞ্চিগুলোর দখল নেয়। এক কাপ চা আর বিস্কুট নিয়ে এ বিশ্বের সমাজ সংসারের যতরকম আলোচনা আর সমালোচনা মধুর দোকানের আবহাওয়া সরগরম করে রাখে। মধুর বেশ ভালো লাগে। বাবা হঠাৎ করে চলে যাবার পর বাবার এই দোকানের দায়িত্ব নেয় ষোল বছর বয়েসে। মধ্যমিকটা আর দেওয়া হয়নি। ভাগ্যিস, পড়াশুনা করলে মধুর এত জানা হতো কি? 

মধুদা দুটো ডিমটোস্ট, মধু ঘুঘনি আর আলুরদম কাঁচা লঙ্কা কুচিয়ে দাও তো এক প্লেট। 

কাকু রুটি হবে। নারে মামনি ওসবতো আমি করতে পারিনা মা - মধু তাকায় মেয়েটির দিকে। বাড়ি বাড়ি আচার ফেরি করে, কাঁধে বড় ব্যাগ। তুই পাউরুটি আর ঘুগনি নিবি? দশ টাকা মাত্ৰ। মেয়েটি কিছুনা বলে চলে যায়। কমলা স্কুলে এবার বেলার ক্লাস শুরু হবে। মেয়েদের বাবা মায়েদের ভিড় শুরু হবে। মধু আরও বেশ কিছু লোকের আবদার মিটিয়ে তারপর সকালের মতন পাততাড়ি গোটাবে। আজ বাড়ি ফিরে সুধার কাছে একবার কথাটা পারবে, রুটিটা করা যায় কিনা। 

রানীমা, কি হলো তোমার? মুখে হাসি নেই কেন, দেরি হয়েছে বলে তাই... সুধা বলে - ওর গা টা একটু গরম লাগছে কিনা দেখতো? মধু মেয়ের গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে পরখ করার চেষ্টা করে কিন্তু তেমন কিছু ঠাওর হয়না। 

নাগো তেমন কিছু নয়, কাল রাতে একটু বৃষ্টি হলো আবার আজ বেশ গরম তাই হয়তো এরকম। আজ নাহয় গা’টা মুছিয়ে দাও। সুধা ঘাড় নারে। মধু বাড়ি ফিরেই রানীমাকে নিয়ে বসে। কত সাধ ছিল ওর দোকানের সামনে কমলা স্কুলে রানীমা পড়াশুনা করবে ক্লাস ফাইভ থেকে। একটা ছোট স্কুলে বেশ চলছিল। মধু কমলা স্কুলের দিদিমণিদের সঙ্গে কথাও বলেছিলো। বছর বারো বয়েস হবে রানীমার। কিন্তু দেখলে মনে হয় বেশ ছোট। 

হ্যা রে মধু কত দেরি করবি রে বাবা সাড়ে নটা তো বাজতে চললো - বাবুদা হাঁক দেয়। রাত নটার ব্যাচ। বেশির ভাগ সময় তো সবাই ফালতু আড্ডা মারতে আসে। বাজে বকবক করে আর সঙ্গে সিগারেটের ধোঁয়ায় মিশে থাকে অশ্রাব্য সব মধুর কথন। কতবার ভেবেছে মধু একটা নোটিস লিখবে। 

আসলে মধু আজকে বাবুদাদের ব্যাচের মনোময়ের কথাগুলো বোঝার চেষ্টা করছিলো। এই সময় মনোময় বাদে বাকি সবাই ষাটের আগে পরে। অনেক বছর ধরে ওদের এই সময়টা বাঁধা। হই হট্টগোলের মাঝে সবাই একদিন আবিষ্কার করলো বাসে ওদের আলাদা সিট্ আছে, ট্রেনে কনসেশন আছে, ব্যাংকে ছিটেফোঁটা সুদ বেশি আছে আরও কত কি, কিন্তু অফিসের বসার চেয়ারটা আর নেই। সেদিন ওদের কি হুল্লোড়। আর সেদিনকেই মধু বুঝতে পারলো নিজের শরীরের শিরা উপশিরা বেয়ে বয়েস এগিয়ে চলেছে। সুধা বেশ ছোট, আর রানীমার ভবিষ্যৎ ভেবে চোখের কোনে দু ফোঁটা জল বাস্প হয়ে গেলো সকালের অজান্তে।

কাল তো কিছুই শুনলে না হরিবাবু আজ বলবো কি? মনোময়ের কথার পিঠে বাবুদা বললো, হ্যা শুরু কর মনো।

ছোটবেলা থেকেই ছেলেটা বেশ চৌখস, স্কুলে স্ট্যান্ড না করলেও অঙ্কে খুব ভালো। তারপর সে একদিন স্কুলের গণ্ডি ছাড়িয়ে কলেজে। আর পাঁচজনের মতই প্রাণচঞ্চল হাসিখুশি। কিন্তু কি যে হলো তারপর ...মনোময় চুপ করে যায়। শ্রোতারা অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে মনোর দিকে। কাপে চা ঢালতে গিয়ে মধুর হাত কেঁপে যায়। 

অরে কি হলো বলোনা, এত সাসপেন্সের কি আছে? বাবুদা অধৈর্য হয়। ইতিমধ্যে মধু সকলের সামনে চায়ের কাপ রেখে গেছে। জান ছেলেটা খুব আকাশ দেখতে ভালোবাসতো, আমরা যেমন দেখি তেমন নয়। আমাদের এই চেনা আকাশ ছাড়িয়ে আরও অনেক অনেক দূরে - মনোময় যেন আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে। আড্ডার সকলের যে খুব আগ্রহ আছে তা নয়, তবু সকলে চুপ থাকে। রাত হয়ে আসে, দশটা বেজে গেছে। বুঝতে পেরেছে আজকের আড্ডাটা ওদের কাছে খুব পানসে লাগছে। 

---নাগো বাবুদা, আজ উঠি। অফিসের একটা ফাইল আজি শেষ করতে হবে। পরমা বেহালা গেছে, মা একা।

মনোময় বাড়ি ফেরার পথে পা বাড়ায়। তারপরই কি যেন মনে করে বলে, মধু তোমার মেয়ে কেমন আছে? ডাক্তারবাবু কি বললেন? 

কিছু তো বলেননি, ওষুধ দিলেন। অনেকরকম পরীক্ষা করতে বললেন। কোথা থেকে যে টাকা আসবে জানিনা? মধু উত্তর দেয়, ছেলেটা কে গো? তোমার চেনাজানা কেউ নাকি? 

মধু তোমার মেয়ে খুব আকাশ দেখতে ভালোবাসে তাই না? মনোময় জানতে চায়। 

হ্যাগো দাদা, ও তো আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে। ক্ষিদে তেষ্টা কিছু নেই, আকাশটা চেটেপুটে খেয়ে যেন ওর পেট ভারে যায়। 

মনোময়ের কেমন দম বন্ধ হয়ে আসে,ওর দুপাশে সামনে পিছনে সারা শরীর জুড়ে জোনাকির মতন তারাদের ভিড়। হাজার হাজার তারার রোশনাই ওর চোখ ধাঁধিয়ে দেয়, তারপর যেতে যেতে চারপাশের চেনা পৃথিবীটা যেন ছোট হতে হতে এক নিকষ কালো গর্তের ভিতরে ঢুকে যাচ্ছে, সঙ্গে সঙ্গে মনোময় দুচোখ বুজে ফেলে। এতদিন বইতে পড়া এটাই কি সেই? চোখ খুলতে সাহস হয় না। অনুভব করে চায়ের দোকানে গল্পে বলা রাজকুমার যেন ওখানে বসে আছে, আর কি আশ্চর্য সঙ্গে ওটা কে? 

শোনো, আমার দিকে তাকাও, আমার যখন একুশ ডাক্তার বলে দিলো আর বড়জোর তিনবছর। 

কি হলো তোমার? ভয় পেয়েছিলে? কি হয়েছিল তোমার? 

আমার সারা শরীর আস্তে আস্তে অকেজো হয়ে আসছিলো। ভাবলাম বাঁচবো না ঠিক আছে কিন্তু কিছুতো করতে হবে, কত কিছু করার আছে মানুষের জীবনে। এই যে তুমি, কি যেন নাম তোমার? 

বাবা ডাকে রানীমা বলে। 

ঘোরের মধ্যে মনোময়ের মাথা কেমন গোলমাল হয়ে যায়, এখানে মধুর মেয়ে এল কি ভাবে? 

ঘুম ভেঙে যায় মনোময়ের, তিনতলার জানলা দিয়ে আকাশ দেখা যাচ্ছে, তারাদের ঝিলমিল। এতক্ষণ ধরে কি যে সব আবোলতাবোল স্বপ্ন, মাথামুণ্ডু নেই কোনও। 

মধুর মেয়েটা আস্তে আস্তে পঙ্গু হয়ে যাচ্ছে, মেয়েকে নিয়ে দুএকদিন অন্তর ডাক্তার হাসপাতাল করতে হয় বলে সকালে মধুর দোকান প্রায় বন্ধ যদিও রাতের বেলা নিয়ম করে খোলে। মনোময় লক্ষ্য করছে ওদের আড্ডাটা ঠিক যেন জমছেনা, বাবুদা ছাড়া অন্যরা খুবই অনিয়মিত। আজ দুজনেই চা নিয়ে মধুর দোকানে। আজ একদম ফাঁকা দোকান, একটু আগে ঝড় বৃষ্টি হয়ে গেছে, গোটা পাড়া সুনসান করছে। সাড়ে ন’টা বাজে, মধু আজ তাড়াতাড়ি দোকান বন্ধ করতে চায়। মুখ গোমড়া করে বসে আছে, কোনও কথা নেই।

মধু, কেমন আছে রে মেয়েটা, বাবুদা জানতে চায়। 

ওই ছেলেটার কি হলো গো মনোদা, এখন কি একটু ঠিক আছে? উত্তর শোনার আশায় বসে থাকে মধু, যেন ওই ছেলেটার সঙ্গেই জড়িয়ে আছে ওর মেয়ের বাঁচামরা। 

মনোময় সস্নেহে হাসে, অনেক গল্পরে মধু, মেয়েটার যত্ন নে। আমি এক ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলেছি তোকে নিয়ে যাবো শিগগির। আজ আমরা উঠি, তুই দোকান বন্ধ কর।

রাস্তা দিয়ে হাঁটা দেয় মনোময় বাবুদার সঙ্গে। বাবুদা জান, রাজকুমারকে যখন ডাক্তারবাবু মুখের ওপর বলে দিলেন বেশি দিন নেই...

রাজকুমার আবার কে? বাবুদার বেশ শুনতে ইচ্ছে করছে। যেতে যেতে পার্কের বেঞ্চিতে বসে পরে দুজনে। আকাশ এখন বেশ পরিষ্কার, দশটাও বাজেনি, কাজেই দুজনে মিলে পার্কে বসে রইল। মনোময় কোনও কথা বলছেনা।

যত গ্রহনক্ষত্রের/দূর হতে দূরতর ঘূর্ণমান স্তরে স্তরে/অগণিত অজ্ঞাত শক্তির/আলোড়ন আবর্তন/মহাকাল সমুদ্রের কূলহীন বক্ষতলে/সমস্তই আমার এ চৈতন্যের/শেষ সূক্ষ অকম্পিত রেখার এ ধারে...

মনোময়ের গলা বুজে আসে আবেগে, জানো বাবুদা, রাজকুমার বোধহয় কবিগুরুর কবিতা থেকে বেঁচে থাকার প্রেরণা পেয়েছিলেন নাহলে কেমন করে পঙ্গু অসক্ত শরীরে শুধু নিজে বেঁচে থাকা নয়, চারপাশের সমাজ সংসারের ভবিষ্যতের কথা ভেবে একের পর এক বৈজ্ঞানিক তথ্য আবিষ্কার করেছেন যেখানে যত অন্যায় অবিচারের প্রতিবাদ করেছেন। পরিপূর্ণ সুস্থ মানুষের মতোই প্রেম করেছেন। মারণরোগের বিষাক্ত ছোবলে নীল হয়ে গেছে সারা শরীর, হুইলচেয়ার তার নিত্যসঙ্গী। তবুও থামেনি তার বিজয়রথ। তোমার ভ্রুকুতিভঙ্গে তরঙ্গিল আসন্ন উৎপাত---/নামিল আঘাত/পাঁজর উঠিল কেঁপে/বক্ষে হাত চেপে শুধালেম, আরো কিছু আছে নাকি,/আছে বাকি শেষ বজ্রপাত?

নামিল আঘাত/এই মাত্র? আর কিছু নয়?/ভেঙে গেলো ভয়...

বাবুদা অপলক চোখে চেয়ে থাকেন মনোময়ের দিকে, কি যেন ভর করেছে। 

মধুদাকে এই খেলাটা জিততেই হবে বাবুদা, তুমি আমি আমরা সবাই ওর রানীমার জন্য লড়ে যাবো। আমাদের সঙ্গে আছেন রাজকুমার, আছেন গুরুদেব রবিঠাকুর, তুমি নেই আমার সঙ্গে?--- মনোময় সম্মতি চায় বাবুদার। 

রাজকুমারের গল্পটা শেষ কর মনো।

ও গল্পের শুরু আছে কিন্তু শেষ নেই বাবুদা, এ এক অনন্ত অসীম মহাকাশ ছাড়িয়ে কোটি কোটি কোটি আলোকবর্ষ পার হয়ে একদিন আমাদের যেতে হবে এ পৃথিবী ছেড়ে, দেখছোনা এই পৃথিবীটা কেমন ধূর্ত লোভী হিংস্র বর্বর মানুষরূপী নেকড়ে আর হায়নাতে ভরে গেছে। রাজকুমার আমাদের পথ দেখাবে। 

অনেক কষ্ট করে ডাক্তারের এপয়েন্টমেন্ট পাওয়া গেছে। সাতদিন পরে যেতে হবে। লাখ দুয়েক টাকার জোগাড় হয়ে গেছে। অর্ধেকের বেশি দিয়েছে মনোময়। মনোময় অফিস থেকে ছুটি নিয়েছে। বাবুদাও সঙ্গে যাবে, মধু আর মধুর বৌ তো যাবেই। মধু খুব নার্ভাস হয়ে আছে। ল্প শুনতে ভালো লাগে না তবু বলে, রাজকুমার কি ভালো হয়েছিল মনোদা? 

মনোময়ের ঘুম আসে না রাতে, এক অজানা আশা ও আশঙ্কায় আধো ঘুম আধো জাগরণে ভোর হয়ে আসে। আট বছর বিয়ে হয়েছে মনোময় আর পরমার, এখনও ওরা অপেক্ষায় আছে। মধুর মেয়েকে মনোময় খুব ভালোবাসে। এভাবেই দিন কেটে যায়। তারপর মধু আর সুধা তাদের রাণীমাকে নিয়ে সঙ্গে মনোময় আর বাবুদা ট্রেনে উঠে পরে। 

শুনুন একটা অপারেশন করতে হাতে পারে, তাতেও সিওর করে কিছু বলা যায় না, পেশেন্ট রিকভার করবে কিনা, যতই হোক ব্রেইন অপারেশন, রিস্ক আছেই। তিনদিন টেস্টগুলো হবে, তারপর রেজাল্ট পেলে বোঝা যাবে অপারেশন করা যাবে কিনা। হাসপাতালের বেডে শুয়ে থাকে রানীমা। হাসপাতালের কাছাকাছি দুটো ঘর পাওয়া গেছে, বাবুদাই সব ব্যবস্থা করেছে। 

জানিস মধু, তোকে তো রাজকুমারের গল্পটা বলাই হয়নি। মধুর এখন কোনও গল্প ভালো লাগছেনা। মেয়েটা কোনওদিন একা থাকেনি কোথাও। হাসপাতালের বেডে একা একা শুয়ে কি করছে কে জানে? মনোদা সত্যি করে বলতো রাজকুমার এখন কেমন আছে?

হাঁ রে, যখন হাঁটাচলা একদম বন্ধ হয়ে গেলো হুইলচেয়ার বন্দি জীবন, তখনও কিন্তু মনে কোনও ভয় নেই। কথা বলতে খুব কষ্ট, রাজকুমার তখন কবিগুরুর কবিতা পড়ছেন। 

যখন উদ্যত ছিল তোমার অশনি/ তোমারে আমার চেয়ে বড় বলে নিয়েছিনু গনি। তোমার আঘাত-সাথে নেমে এলে তুমি/ যেথা মোর আপনার ভূমি...

মধু এত কিছু মানে বোঝে না, সুধা বলে, মনোদা আমার রানী ভালো হবে তো?

মনোময় বোঝে রানীমার কেসটা খুব জটিল, তাবু হাল ছাড়া যাবে না, কোনও ভয় নেই গো সুধা, রানী আবার কথা বলবে, হাঁটবে, স্কুলে পড়াশুনা করবে। 

ডাক্তারের রিপোর্ট হাতে এসে গেছে, অপারেশন করতে হবে কিন্তু শরীর নিতে পারবে কিনা সেটাই দেখার। আরো চব্বিশ ঘন্টা পারে ফাইনাল জানা যাবে। চব্বিশ ঘন্টা যে এত দীর্ঘ জানা ছিলোনা মনোময়ের। কিভাবে কেজানে ও এত জড়িয়ে পড়েছে মধুর মেয়েটার জীবনে? বাবুদার সঙ্গে মনোময় একটা ঘরে শুয়েছে। বাবুদাও ছটফট করছে বিছানায় ঘুম আসছে না। পাশের ঘরে মধুদের এখনও আলো জ্বলছে। তিনতলার এই ঘরটার জানলা দিয়ে শহরের রাস্তা দেখা যাচ্ছে। সার সার গাড়ি চলছে, পাশেই শপিং মলে এখনও ভিড় লেগে আছে, রাস্তায় কত লোক। কলকাতায় এত রাতে এত লোক থাকেনা, কেমন গা ছমছম করছে। 

বাতাসে বেশ ঠাণ্ডা ভাব এই মার্চ মাসেও। এ শহরে নাকি গরম পরে না, কি যে ভালো। হাসপাতালটা এখন থেকে একটু দূরে, মনোময়ের মোবাইল নাম্বার দেওয়া আছে, কোনও প্রয়োজন হলে ডাকতে পারে। 

মনো উঠে পর, সাতটা বাজে, কি ঘুমানো ঘুমাচ্ছিস--- বাবুদার ডাকে ঘুম ভেঙে যায় মনোময়ের, ধড়মড় করে উঠে বসে, তাইতো আটটায় আবার হাসপাতাল যেতে হবে। 

বাবুদা মনোদা উঠে পর, চা এনেছি গরম গরম--- দরজা ঠকঠক করে মধু। 

আরে মধু চা কোথায় পেলি? এখানেও কি একটা চায়ের দোকান দিলি? বেশ ভালো, বেশ ভালো ---রসিকতা করে বাবুদা। 

তোমরা রেডি হয়ে গেছো মধু - মনোময় বলে। 

আসলে কাল সারারাত তো আমরা দুজনে মিলে জেগে ছিলাম, রানীমার ঘুম আসছেনা ছটফট করছে বিছানা জুড়ে আর আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে, আমরা কি করে ঘুমাই?

তোমরা কাল রাতে হাসপাতালে ছিলে নাকি? মনোময় আঁতকে ওঠে। 

আরে তা নয়, কি করে যাবো, আমাদের মনটা পড়েছিল তো তাই বলছি। 

অপারেশন আজই হবে ডাক্তারবাবু জানিয়ে দিলেন, সব গোছগাছ চলছে। ডাক্তার, নার্স অফিস স্টাফ সকলের মুখে হাসি লেগে আছে। কলকাতার কথা ভেবে মনোময়ের নিজেকেই খুব ছোট লাগলো। বয়স্ক একজন ডাক্তারবাবু সুধাকে কি যেন বলছেন সুধা বুঝতে না পারলেও সুধা যেন বুকে বল ফিরে পেলো। মধুকে নিয়ে মনোময় অফিসঘরে সব ফর্ম সইসাবুদ করে এলো, আশি হাজার টাকা জমা দিতে হলো, বাকি টাকা মধুর অবস্থা দেখে ফ্রি করে দেবার আশ্বাস দিলো। এ শহরের আকাশ আজ বড় মেঘলা, যদিও এখন বৃষ্টি নেই তবুও আস্তে পারে যে কোনও সময়। সকাল দশটা থেকে অপারেশন শুরু হয়েছে, এবার সন্ধ্যা ছটা নাগাদ ওটি থেকে বার করার কথা। মধুদা মাথায় হাত দিয়ে বসে আছে, সুধা কেঁদে কেঁদে সারা। 

আরে তোমরা এমন করছো কেন, তোমাদের রানীমা ভালো হয়ে যাবে, ও আবার কথা বলবে, চলতে পারবে, ইস্কুলে যাবে, কাঁদলে কিন্তু এখানে তোমাদের রাখবেনা ---বাবুদা ধমক দেয়। 

সাতটা বেজে গেছে এখনও ওটি থেকে রাণীমাকে বার করেনি। মনোময়ের খুব টেনশন হয়ে যায়, অস্হিরভাবে পায়চারি করে লম্বা করিডর জুড়ে। আকাশের যা ঘনঘটা বৃষ্টি এলো বলে। বাবুদাকে দেখা যাচ্ছে না, কোথায় যে আবার গেলো। 

আকাশ জুড়ে বৃষ্টি নামে,বৃষ্টির সঙ্গে ঝড়োহাওয়া পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকে। এত দুর্যোগ ভাবা যায়নি সকালেও। 

অনেক রাতে বৃষ্টি ধরলো, এ শহরে সেভাবে জাল জমেনা। রাণীমাকে অপারেশন রুম থেকে বার করে আই সি ইউ তে রেখেছে। অবস্থা বেশ ক্রিটিকাল, আজ আর হোটেলে ফেরা হবে না, ভিসিটর্স রুমেতেই পালা করে রাত জাগতে হবে। মধু আর সুধার দিকে তাকানো যাচ্ছে না, বাবুদার মুখ থমথমে। মনোময় এখন বাইরের লনে পায়চারি করছে, ডাক্তার যা বলেছেনা তাতে সেরকম কোনো আশার আলো নেই, শুধুই অন্ধকার। এত কম বয়েসে এত তাড়াতাড়ি হেরে যাবে রানীমা। স্বপ্নে দেখা সেই ব্ল্যাক হোলে মিশে যাবে রানীমা, যেখান থেকে বেরোবার আর পথ নেই। কিন্তু রাজকুমার তো বার বার ওই নিঃসীম অন্ধকারের অতল আহ্বান অগ্রাহ্য করে মাথা উঁচু করে বেরিয়ে এসেছে, রানীমা পারবেনা? সগর্বে ঘোষণা করেছে, তুমি যত বড় হাও/তুমিতো মৃত্যুর চেয়ে বড় নয়, আমি- মৃত্যু- চেয়ে বড় এই শেষ কথা বলে/ যাবো আমি চলে। 

এক সুতোর এপার ওপারে জীবন আর মরণ লুকোচুরি খেলে রানীর সঙ্গে। ঈশ্বর, আল্লা, ভগবান আর বিজ্ঞান ওদের মননে আর হৃদয়ে একাকার হয়ে শক্তি যোগায়। কাছেই কোনো গির্জার ঘন্টা বাজে নিশুতি রাতে, যেন ঘোষণা করে, গহীন রাত পেরোলেই আলোর ভোর...

উদয় দিগন্তে তখন শঙ্খ বাজে, মধু আর সুধা দুহাতজোড় করে নতজানু হয় আলোর প্রভুর কাছে, মনোময় আবৃত্তি করে, ব্যক্ত হোক জীবনের জয়/ব্যক্ত হোক তোমামাঝে অসীমের চিরবিস্ময়...

0 comments: