বইপোকার বইঘর - অনিন্দিতা মণ্ডল
Posted in বইপোকার বইঘর
বইপোকার বইঘর
অনিন্দিতা মণ্ডল
দে’জ থেকে প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ নির্জন শালিক। কবি তাপস মহাপাত্র। কবিতা প্রতিবেদকের ব্যক্তিগত অনুভবে একটি বোধের বিষয়। সেই বোধ যা মন ছেয়ে থাকে। নানা ব্যাকরণ প্রকরণের কারিকুরি ছাপিয়ে যা এক মায়ায় এক অন্যতর চেতনভুমিতে মনকে স্থাপন করে। সমান্তরাল বাস্তবতা বলব একে। প্রায় আটষট্টিটি কবিতা আছে বইটিতে। তাপস মহাপাত্র আত্মমগ্ন কবি। সেরকম প্রকট উচ্চারণে তিনি প্রতিবাদ বা খারাপ লাগা জানান না। নিজের ভেতরে ডুব দিয়ে তুলে আনেন মুহূর্ত। অনুভূতির রঙের সঙ্গে মিলে যায় তাঁর দীর্ঘদিনের চর্চার বৈদগ্ধ্য। পাঠককে তা মুগ্ধ করে। যেমন বইটির নাম যে কবিতার নামে, কবি লিখছেন তাতে – আমার গৃহস্থালী পর্ণমোচী মনে/ কী করে লুকাই নিজে ঝরাপাতা বনে! এক নিমেষে পাঠক পৌঁছে যান কবিমনের সেই পর্ণমোচী বনে। এবং কবি স্পষ্ট করেন যে এ তাঁর একান্ত আত্মকথন। কবিতার শেষ লাইন জানিয়ে দেয় – এখন নির্জনে কী চাওয়া খুঁজি, নিজের ভিতরে নিজে বন্দী বুঝি। বিলীন কবিতার অংশ বিশেষ। “দুবাহুতে ভাসাই আমার অসীম আমাকে। মেঘের মতো জড়িয়ে থাকে কে!” এই সেই উপলব্ধির জগত। কবি নিজের অসীম সত্ত্বার কাছে সমর্পিত। সে তাঁকে জড়িয়ে থাকে মেঘের মতন। “অবশ করে বিবশ করে...”। বিরহ এমন একটি অনুভব যা চিরস্থায়ী। সেই অনুভব বাখানিতে তিলে তিলে নূতন হোয়। কবি নিজের ভিতরে সেই অনুভব জাগ প্রদীপের মতো জ্বালিয়ে রেখেছেন। তাই লিখছেন – আসিস কে রে পথে পথে ছড়াস যত ক্ষত/ কেন আমায় করল কে যে/ এমন হৃদয়-হত!(আহত)। সে যে নির্দিষ্ট কেউ নয় সে কবির উচ্চারণে স্পষ্ট। তিনি তাঁর মুখ দেখেননি। তবু কী আর্তি তাঁকে দেখার! গন্ধে বিভোর দূরের ভূমি/ অলক্ষ্যে তার আত্মীয় হোয়, বুঝতে না দেয়/ দুই অচেনার মধ্যিখানে-/ এক অন্তর, আকুল গোকুল। (ব্রজবাস)। একটি মাত্র শব্দে কবি বলে দেন অন্তরটি তাঁর আকুল গোকুল। হৃদিবৃন্দাবন। অসীমের স্পর্শ লাগা সেই অন্তর কি আর অন্য কিছু খুঁজতে পারে? তাপসের কবিতা জ্যৈষ্ঠ দিনের দুপুরবেলার শীতল জল। চারিদিকে অশান্ত পরিবেশ, চাওয়াপাওয়ার বিরক্ত ভিড়ে নির্জন শালিকের মতো পাঠকও সেই শীতল জল আকণ্ঠ পান করবেন। এক অন্য সমান্তরাল জগতে বেঁচে থাকবেন। একটিই কথা ছিল। কবি যদি প্রকাশিত কবিতার সন তারিখ সহ প্রকাশ পরিচয়টুকু জানিয়ে দিতেন তবে ভবিষ্যতের পাঠকের জন্য সুবিধে হত। এটি একান্তই নিজস্ব অনুভব।
প্রচ্ছদে শাদা আকাশের তলে সবুজ ঘাসজমিতে একটি একলা শালিক। ঠিক আমাদেরই মতো। শিল্পী দেবাশিস সাহা কবির মনের কথাটি ভারী সুন্দর বুঝেছেন। সুন্দর কাগজ ও বাঁধাইয়ে বইটি দীর্ঘজীবী হবে নিশ্চয়।
0 comments: