0

ধারাবাহিক - নন্দিনী সেনগুপ্ত

Posted in



















১৩ 

বেশিরভাগ সময়টাই বৃদ্ধ পুরোহিত অত্যন্ত গম্ভীরভাবে তরুণ যাজকের স্বীকারোক্তি শুনছিলেন; ক্বচিৎ তার মুখে ফুটে উঠছিল মৃদু একটি হাসির রেখা। হ্যাঁ, তিনি ফ্রান্সেস্কোকে চেনেন; তার ভিতরে, বাইরে সূক্ষ্ম যুক্তিবোধ, নিয়মানুবর্তিতা, বিবেকবোধ, পরিষ্কার স্বচ্ছ ভাবনার সমস্ত খুঁটিনাটি সমেত তিনি চেনেন ফ্রান্সেস্কোকে। 

-‘ফ্রান্সেস্কো, ভীত হয়োনা। তুমি যে পথে চলছো, সে পথেই চলো।’ - তিনি বলে ওঠেন, ‘যারা শয়তানের সবচেয়ে সুরক্ষিত শিকার, তুমি তাদের উদ্ধার করবার কাজে ব্রতী হয়েছো। অতএব, শয়তানের শত্রুতার ভয়ানক শক্তিমান এবং বিপজ্জনক চেহারা তোমাকে দেখতে হবে। এইসব নানা কৌশল এবং অস্ত্রে ভয় পেলে, বিচলিত হলে চলবে না।’ 

হাল্কা মেজাজে, মুক্ত মনে ফ্রান্সেস্কো পুরোহিতের বাসভবন থেকে বেরিয়ে নেমে আসে লিগর্নেত্তোর রাস্তায়; এখানে কেটেছে তার বয়ঃসন্ধি। এটা একটা ছোট্ট গ্রাম, সমতল একটা উপত্যকায়, একে ঘিরে আছে উর্বর কৃষিক্ষেত্র, যেখানে নানারকম সব্জির চাষ হয়, নানারকমের ফলের গাছ, মাঝেমধ্যে আঙুরের ক্ষেত, আর অজস্র মালবেরি গাছের জঙ্গল। এই অঞ্চলেও জেনারাসো পর্বতমালার গিরিখাত আছে প্রচুর। পশ্চিমদিকে গেলে তা দৃশ্যমান হয়, পর্বতের প্রশস্ত পাদদেশে দাঁড়ালে দেখতে পাওয়া যায় বিশাল পর্বতশ্রেণীর গরিমা। 

এখন দুপুরবেলা, এবং গোটা লিগর্নেত্তো আলস্যে ঝিমিয়ে আছে। রাস্তায় ফ্রান্সেস্কোকে অভ্যর্থনা জানানোর জন্য গুটিকয় মুরগির ছানা, যেগুলো কক্কক শব্দ করে পথে খেলছিলো, কিছু শিশু, তারাও পথে খেলাধূলা করছিলো এবং গ্রামের শেষে ভুকভুক শব্দ করা একটা কুকুরছানা ছাড়া বিশেষ কেউ ছিলনা। এখানে, গ্রামের শেষে তার আরেক কাকার বাড়ি, ভিনসেনজো, যিনি ছিলেন প্রখ্যাত ভাস্কর, এখন মেমোরিয়াল হিসেবে টিসিনো প্রদেশের সরকার অধিগ্রহণ করেছে। কেউ থাকেনা সেখানে; অবসরকালীন ভিলার গড়নে বাড়িটা বানানো হয়েছিল। ফ্রান্সেস্কো বাড়িটার সামনে অযত্নে বেড়ে ওঠা নির্জন বাগানের সিঁড়িটা দিয়ে উপরে উঠলো এবং হঠাৎ তার বাড়িটার ভেতরে যাওয়ার ইচ্ছে হল। পাশেই পূর্বপরিচিত এক চাষির পরিবারের কাছে চাবি ছিল, সেটা ফ্রান্সেস্কোর হাতে দেওয়া হল। 

তরুণ যাজকের যে শিল্পের সঙ্গে সম্পর্ক ছিল, তা অবশ্যই অতীতের ঐতিহ্যবাহী চিরাচরিত এক শাস্ত্রীয় শিল্প; আধুনিক শিল্পকলা সম্পর্কে ফ্রান্সেস্কোর বিশেষ আগ্রহ এবং ধ্যানধারণা কোনোটাই বিশেষ ছিলনা। তার এই কাকা, যিনি প্রখ্যাত ভাস্কর ছিলেন, তিনি প্রায় দশ বছর হল মারা গেছেন। তার মৃত্যুর পরে শেষকৃত্যের সময় সে এই বাড়িতে শেষবার ঢুকেছিল। সে জানেনা, হঠাৎ কেন আজ এই বাড়িটাতে ঢোকবার ইচ্ছে হল তার; অথচ অতীতে এই বিলাসবহুল ভিলার পাশ দিয়ে যাবার সময় একটা অনুকম্পার দৃষ্টিতে সে বাড়িটাকে দেখতো। তার এই কাকা তার সেরকম কাছে আলাদা কিছু নয়, শুধুই এক শ্রদ্ধার পাত্র ছিলেন আর পাঁচজন বয়োজ্যেষ্ঠ গুরুজনের মত। কাকার কাজের পরিমণ্ডল সম্পূর্ণ পৃথক, বিজাতীয় এবং অপ্রাসঙ্গিক ছিল তার কাছে। 

ফ্রান্সেস্কো চাবি ঘুরিয়ে তালা খুলে দরজাটা ঠেলবার সময় একটা বিশ্রী ক্যাঁচক্যাঁচ আওয়াজ হল। দরজা খুলে সামনের করিডরে পা রাখার সঙ্গে সঙ্গে তার কেমন যেন একটা দমবন্ধ করা অস্বস্তি হতে লাগলো। মনে হল সামনের খোলা ঘরগুলোর মধ্যে থেকে ধুলোমাখা বাতাস যেন এসে একটা দীর্ঘশ্বাস ছড়িয়ে দিচ্ছে। ফ্রান্সেস্কোর শরীরটা কেমন যেন শিরশির করে উঠলো। সামনের ডানদিকের ঘরটা মৃত শিল্পীর লাইব্রেরী, যেটা জানান দেয় যে শিল্পী অত্যন্ত জ্ঞানী, রুচিশীল এবং সুশিক্ষিত মানুষ ছিলেন। নিচু শোকেসে ভাসারি ছাড়াও ভিঙ্কেলমানের সমস্ত কাজ রাখা আছে; এছাড়াও ইতালিয়ান শিল্পসাহিত্যের স্বর্ণযুগের কিছু নিদর্শন, যেমন, মিকেলেঞ্জেলোর সনেট, দান্তে, পেত্রার্কা, টাসো, আরিওস্‌ট, এরকম নানা বিখ্যাত মানুষের লেখার সংগ্রহ আছে সেখানে। বিশেষভাবে তৈরি কিছু একটা আলমারির মধ্যে রাখা আছে আঁকা এবং এচিংএর কাজগুলি, পাশের একটা আলমারিতে রেনেসাঁর পদকগুলি এবং আরও নানা দুস্প্রাপ্য বস্তু, নিচের তাকগুলিতে আছে পেইন্টিং, এছাড়া এত্রুস্কান মাটির ফুলদানি, মার্বেল এবং ব্রোঞ্জের নানা পুরাতাত্ত্বিক শিল্পসংগ্রহ- এইসব জিনিস ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে ঘরে। দেয়ালে লিওনার্দো এবং মিকেলেঞ্জেলোর নানা কাজ ফ্রেমে বাঁধিয়ে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে, যার একটা বড় অংশ হল নারী এবং পুরুষের নগ্ন শরীর। পরবর্তী একটা ছোট্ট ঘরের তিনটে দেওয়ালেই ওপর থেকে নিচ পর্যন্ত এরকম ছবি টাঙ্গানো আছে। 

সেই ছোট্ট ঘরটা পেরোলেই একটা বড় হলঘর, যার ছাদ অনেক তলা উঁচু এবং গম্বুজের মত গোল। উপর থেকে বাইরের প্রাকৃতিক আলো এসে ঘরটা আলোকিত করে তুলেছে। এখানেই ভিনসেন্‌জো কাঠ এবং প্লাস্টার নিয়ে তার ভাস্কর্যের কাজ করতেন, তার ছেনি- বাটালির স্পর্শে শৈল্পিক প্রাণ পেতো জড়বস্তুগুলো এখানেই, সব শিল্পকর্মের নিঃশব্দ ভিড় জমে আছে এই অদ্ভুত মন্দিরের মত ঘরে। 

ফ্রান্সেস্কোর মনে হল যেন তার শরীর অবশ লাগছে, ভয় করছে তার; হ্যাঁ, ভয় করছে নিজের পায়ের শব্দ শুনেই। হ্যাঁ, তার নিজেকে অপরাধীও মনে হচ্ছে বৈকি! সে প্রথমবার, হ্যাঁ, প্রথমবার দেখছে তার কাকার শিল্পকর্মগুলি এভাবে খুঁটিয়ে, প্রথমবার এত শ্রদ্ধার চোখে দেখছে সে। পাশে আছে একটা স্ট্যাচু, মিকেলেঞ্জেলোর করা ঘিবার্তির মতো দেখতে। পাশে আছে দান্তের মূর্তি। আরও কিছু অর্ধসমাপ্ত মূর্তি পাশে রয়েছে ঢাকা দেওয়া। এইসব বিখ্যাত মূর্তির দিকে তরুণ যাজকের নজর গেলনা। তার পাশেই রাখা ছিল তিনটি নারীমূর্তি। এক সামন্তপ্রভুর তিন কন্যা। এই ভাস্কর্যের স্রষ্টা একেবারে নিরপেক্ষভাবে তিনজনকেই সম্পূর্ণ নিরাবরণ অবস্থায় মূর্ত করেছেন। মূর্তি দেখে মনে হচ্ছে, সবচেয়ে ছোট কন্যার বয়স বারোর উপরে নয়, দ্বিতীয় জনের বয়স পনেরোর উপরে নয় এবং সবচেয়ে বড় কন্যাটির বয়স সতেরোর উপরে নয়। ফ্রান্সেস্কো কেমন একটা ঘোরের মধ্যে অবশ দৃষ্টিতে দেখতে লাগলো এই তন্বী মূর্তিগুলির দিকে। দীর্ঘক্ষণ ধরে তাকিয়ে রইলো সে। এই মূর্তিগুলির মধ্যে নগ্নতা খুব অনায়াস স্বাভাবিকভাবে রূপ পায়নি; গ্রিক ভাস্কর্যে যেমন মনে হয় যে তা প্রকৃতির অংশ, সুন্দর এবং মহৎ, মূর্তিগুলিতে নগ্নতা আরোপিত বলে বোধ হয়না। কিন্তু এই মূর্তিগুলির ক্ষেত্রে যেন সেরকম নয়। মূর্তির চরিত্রগুলো যেন বলতে চাইছে, আমাদের ইচ্ছের বিরুদ্ধে আমাদের নগ্ন করা হয়েছে, আমাদের লজ্জা হরণ করা হয়েছে বলপ্রয়োগ করে। ফ্রান্সেস্কো ঘোর থেকে চমকে জেগে উঠলো; তার হৃদপিণ্ডে ধড়াস ধড়াস আওয়াজ হচ্ছে, সে ভীতচোখে চারদিকে একবার দেখে নিলো। সে কোনো অন্যায় করেনি, তবুও তার মনে হচ্ছে এরকম মূর্তির সঙ্গে একাকী সময় কাটানো পাপ। 

নাহ, যদি কেউ দেখে ফেলে তাকে যে সে এই মূর্তিগুলিকে বিশেষভাবে নিরীক্ষণ করছে! সে স্থির করলো, এখনই এখান থেকে বেরিয়ে যেতে হবে। যাই হোক, সে সামনের দরজার কাছে পৌঁছালো। সেখানে গিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার বদলে ভিতর থেকে টেনে দরজাটা বন্ধ করে চাবি ঘুরিয়ে দিলো। ব্যাস, সে এখন এই রহস্যময় ভুতুড়ে ভিলার ভেতরে একা আছে, এটা বাইরে থেকে কেউ বুঝতে পারবেনা। দরজাটা ভেতর থেকে বন্ধ করে সে আবার পৌঁছে গেলো তিনটি লাবণ্যময়ী মূর্তির কাছে। সে বিরক্ত হচ্ছিল নিজের উপরে, কিন্তু ভিতরে একটা কষ্ট হচ্ছিল তার, ফিরে না এসে পারছিলো না সে। 

তাড়াতাড়ি ফিরে এলো সে, তার হৃদস্পন্দনের গতিবেগ এখন দ্বিগুণ বেড়ে গিয়েছে। সে কেমন ফ্যাকাসে হয়ে গেছে! এ কোন লজ্জাকর পাগলামিতে আক্রান্ত হল সে? তার সেই সামন্তকন্যাদের জ্যেষ্ঠাকে স্পর্শ করার অদম্য বাসনা হল। সে একবার ছুঁতে চাইছিল, যেন সে এক রক্তমাংসের নারীশরীর, কোনো জড়বস্তু দ্বারা নির্মিত মূর্তি নয়। যদিও তার নিজের বিচারবুদ্ধি অনুসারে তখন তার মনে হয়েছিল, সে পাপ করছে, তবুও মূর্তি স্পর্শ করা তো প্রকৃতপক্ষে পুরোহিতের জন্য পাপ নয়। পুরোহিত কিম্বা যাজক তো মূর্তি স্পর্শ করতেই পারেন। ঈশ্বরের মূর্তি কি তারা স্পর্শ করেন না? জ্যেষ্ঠা কন্যাকে স্পর্শ করতে গিয়ে দ্বিতীয়ার কাঁধের উপর দিয়ে হাত রাখতেই হল তাকে। মূর্তিগুলি তো আলাদা আলাদা নয়, একই সঙ্গে স্থাপিত। দ্বিতীয়ার কাঁধ সুন্দর এবং পরিপুষ্ট, যেখান থেকে নরম এবং পেলব বাহুদুখানি নেমে এসেছে। সবশেষে কনিষ্ঠার গতিময় কোমলতা তাকে আকর্ষণ করলো; এক হতবাক, ভ্রান্ত, অনুতপ্ত পাপী তার হাল্কা লাজুক চুম্বন রাখলো সেই মূর্তির বাম স্তনের নিচে। নিজেকে আদমের মত মনে হচ্ছিল তার, যে জ্ঞানবৃক্ষের আপেল ভক্ষণ করবার পরে ঈশ্বরের দৈববাণী শুনেছিল। সে পালাতে লাগলো। হ্যাঁ, খুব তাড়াহুড়ো করে, দৌড়ে পালিয়ে গেলো সে। 




(চলবে) 

গেরহার্ট হাউপ্টমান রচিত ‘ড্যের কেৎজার ফন সোয়ানা’ অবলম্বনে লেখা 

0 comments: