ঝরনাতলার নির্জনে - শিবাংশু দে
Posted in ঝরনাতলার নির্জনে
ঝরনাতলার নির্জনে
জোড়াসাঁকো জংশন ও জেনএক্স রকেটপ্যাড
শিবাংশু দে
২
আমি যে গান গাই, জানিনে সে...
নিজের গান, বা বৃহদার্থে 'গান' সম্বন্ধে কবির ধারণা সারা জীবনে পাল্টে গেছে বারবার। নিজের বিষয়ে তিনি বলেছিলেন যে তাঁর 'গ্রেটেস্ট ভাইস' হলো 'ইনকনসিস্টেন্সি' আর তাঁর 'গ্রেটেস্ট ভার্চু'ও হলো ঐ 'ইনকনসিস্টেন্সি' ।
নিজের সম্বন্ধে তাঁর এই মূল্যায়ণ যে কতো যথার্থ ছিলো তার প্রমাণ পেয়েছি বহুবার। যেমন ১৯১২ সালে 'জীবনস্মৃতি'র একটি অধ্যায় তিনি শুরু করেছিলেন এইভাবে, '' বাক্য যেখানে শেষ হইয়াছে সেই খানেই গানের প্রারম্ভ।'' তিনি লিখেছিলেন, ''সুর কেন কথার দাস হইবে'' অথবা '' .... গীতকলার নিজেরই একটি বিশেষ প্রকৃতি ও বিশেষ কাজ আছে। গানে যখন কথা থাকে তখন কথার উচিত হয়না সেই সুযোগে গান'কে ছাড়াইয়া যাওয়া, সেখানে সে গানেরই বাহনমাত্র। গান নিজের ঐশ্বর্যেই বড়ো, বাক্যের দাসত্ব সে কেন করিতে যাইবে।'' এখানে 'গান' বলতে তিনি সুর'কেই সমার্থ বোধ করছেন। সেই গ্রন্থেরই আরেক স্থানে তিনি একটি বিশেষ স্মৃতির উল্লেখ করে বলছেন, ''... সুর যে জায়গায় কথাটা উড়াইয়া লইয়া গেল, কথা আপনি সেখানে পায়ে হাঁটিয়া গিয়া পৌঁছিতে পারিত না।'' অথচ দিলীপকুমারের সঙ্গে তাঁর যখনই প্রাসঙ্গিক আলাপ হয়েছে তিনি আমাদের কালোয়াতি গানে সুরের ইম্প্রোভাইজেশন, অর্থাৎ দৈলীপী 'সুরবিহার', বিষয়ে নিজের দ্বিধা প্রকট করেছেন। ১৯১২ সালে তাঁর এ বিষয়ে ধারণা ১৯৩৮ সালে পাল্টে গেলো। তখন তিনি বলছেন ( এ বিষয়ে) '' ....মত বদলিয়েছি। কতোবার বদলিয়েছি তার ঠিক নেই।'' তিনি আরও জানাচ্ছেন, হিন্দুস্তানি কালোয়াতি গানের তিনি কদরদান, তার রস তিনি পূর্ণতঃ উপভোগ করেন। কিন্তু 'খাঁচার পাখি'র মতো শুধু বুলি আউড়ে গেলে কিন্তু সঙ্গীতে মুক্তি নেই। তিনি চাইছেন নতুন সৃষ্টি ও গণ্ডী ভেঙে নতুন জীবনের পথ। এই ধারণাটি তিনি গ্রহণ করেছেন আবহমান কালের বাংলা পদাবলীসঙ্গীত থেকে। যে শৈলিতে পদাবলী, গীতকলাকে সঙ্গিনী করে শিল্পকে জাগিয়ে তুলেছিলো। সুর যখন কথার সঙ্গিনী হয়ে উঠবে, তখনই এই যুগলবন্দি থেকেই সার্থক হয়ে উঠবে সঙ্গীত। এই বর্ণনাটি কিন্তু যথার্থ উপমা সহকারে তিনি ব্যাখ্যা করেছিলেন 'জীবনস্মৃতি'তে বহুকাল আগেই, ''.... আমাদের দেশে স্ত্রী যেমন স্বামীর অধীনতা স্বীকার করিয়াই স্বামীর উপর কর্তৃত্ব করিতে পারে, এ দেশে গানও তেমনি বাক্যের অনুবর্তন করিবার ভার লইয়া বাক্যকে ছাড়াইয়া যায়।'' ১৯৩৭ সালে তিনি ধূর্জটিপ্রসাদকে লিখেছিলেন , ''... কথাও সুরকে বেগ দেয়, সুরও কথাকে বেগ দেয়, উভয়ের মধ্যে আদানপ্রদানের স্বাভাবিক সম্বন্ধ আছে।'' ১৯২১ সালে বলেছিলেন, ''... সংগীতের মধ্যে বাণীর মিলন সাধনই এখন আমার প্রধান সাধনা হয়ে উঠেছে'' (আমাদের সংগীত)। এই সময়েই তিনি আরো লিখেছিলেন, ''... বাংলাদেশে কাব্যের সহযোগে সংগীতের যে বিকাশ হচ্ছে, সে এক অপরূপ জিনিস হয়ে উঠবে। তাতে রাগরাগিণীর বিশুদ্ধতা থাকবে না, যেমন কীর্তনে তা নেই; অর্থাৎ গানের জাত রক্ষা হবে না, নিয়মের স্খলন হতে থাকবে, কেননা তাকে বাণীর দাবি মেনে চলতে হবে। কিন্তু এমনতরো পরিণয়ে পরস্পরের মন জোগাবার জন্য উভয় পক্ষেরই নিজের জিদ কিছু কিছু না ছাড়লে মিলন সুন্দর হয় না।'' তার পর ১৯২৬ সালে তিনি দিলীপকুমারকে আবার লিখেছিলেন, ''... কীর্তনে বাঙালির গানে সঙ্গীত ও কাব্যের যে অর্ধনারীশ্বর মূর্তি, বাঙালির অন্য সাধারণ গানেও তাই।''
দিলীপকুমারের সঙ্গে তাঁর এই বার্তালাপ থেকে স্পষ্ট হয়ে ওঠে রবীন্দ্রসঙ্গীতের মূল কাঠামোটি বিষয়ে কবির অবস্থান কী রকম। দিলীপকুমার চেয়েছিলেন তাঁর গানের ব্যক্তিত্বস্বরূপটি নির্মাণ করবেন গায়ক নিজেই। তিনিই হবেন গানের 'রূপকার'। আমাদের কালোয়াতি গানের মতো। কিন্তু কবি জানতেন গানের ব্যক্তিত্ব ইতোমধ্যেই নির্মিত হয়ে গেছে সুরকারের সৃজিত কাঠামোতে। গায়ক বা রূপকার সেই প্রচ্ছন্ন ব্যক্তিত্বকে প্রাণ দেবেন তাঁর স্বরে, পরিবেশনায়, কিন্তু সুরকারকে অতিক্রম করে যাবার অধিকার তাঁর থাকবে না।
'' ... যে মানুষ গান বাঁধিবে আর যে মানুষ গান গাহিবে দুজনেই যদি সৃষ্টিকর্তা হয় তবে তো রসের গঙ্গাযমুনাসংগম। যে গান গাওয়া হইতেছে সেটা যে কেবল আবৃত্তি নয়, তাহা যে তখন-তখনি জীবন-উৎস হইতে তাজা উঠিতেছে, এটা অনুভব করিলে শ্রোতার আনন্দ অক্লান্ত অম্লান হইয়া থাকে। কিন্তু মুশকিল এই যে, সৃষ্টি করিবার ক্ষমতা জগতে বিরল। যাদের শক্তি আছে তারা গান বাঁধে, আর যাদের শিক্ষা আছে তারা গান গায়–সাধারণত এরা দুই জাতের মানুষ। দৈবাৎ ইহাদের জোড় মেলে, কিন্তু প্রায় মেলে না। ফলে দাঁড়ায় এই যে, কলাকৌশলের কলা অংশটা থাকে গানকর্তার ভাগে, আর ওস্তাদের ভাগে পড়ে কৌশল অংশটা। কৌশল জিনিসটা খাদ হিসাবেই চলে, সোনা হিসাবে নয়। কিন্তু ওস্তাদের হাতে খাদের মিশল বাড়িতেই থাকে। কেননা, ওস্তাদ মানুষটাই মাঝারি, এবং মাঝারির প্রভুত্বই জগতে সব চেয়ে বড়ো দুর্ঘটনা। এইজন্যে ভারতের বৈঠকী সংগীত কালক্রমে সুরসভা ছাড়িয়া অসুরের কুস্তির আখড়ায় নামিয়াছে। সেখানে তান-মান-লয়ের তাণ্ডবটাই প্রবল হইয়া ওঠে, আসল গানটা ঝাপ্সা হইয়া থাকে।'' (সংগীতের মুক্তি)
এ বিষয়ে আমার মনে হয় তাঁর অভিপ্রেত অনেকটা পাশ্চাত্যের শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের ধরনের সঙ্গে মেলে। সেখানেও স্বরলিপির নির্দিষ্ট বাঁধনকে আপোসহীনভাবে স্বীকার করে নিয়েও বিভিন্ন শিল্পীর পরিবেশনে নিজস্বতার সিলমোহর লক্ষ্য করা যায়। তবে এই মিলটা শুধু সুরের ক্ষেত্রেই প্রযুক্ত হতে পারে, সুর ও বাণীর মালা গাঁথার সাফল্য এক্ষেত্রে অর্জিত হয়না। নিজের সৃষ্টির অবয়বকে এইভাবে রক্ষনবেক্ষণ করার সাধ ও সাধ্য, শুধু বাংলায় কেন সারা ভারতবর্ষে কোথাও চোখে পড়েনি। বাংলাতে অন্য যেসব প্রধান কম্পোজার ছিলেন, অতুলপ্রসাদ, রজনীকান্ত, দ্বিজেন্দ্রলাল বা নজরুল কেউই নিজস্ব সৃষ্টির পরিবেশন পদ্ধতি বিষয়ে এ জাতীয় স্পষ্ট ও নির্দিষ্ট নীতিনির্দেশ রেখে যাননি। তাই তাঁদের গান পরিবেশনের ক্ষেত্রে পরবর্তীকালে দিলীপকুমারের ঈপ্সিত পদ্ধতিটিই বলবতী হয়েছে । উল্লেখ্য, যা আমাদের আবহমান কালের গীতকৌশল।
এখন হবে প্রাণের আলাপ
রবীন্দ্রসঙ্গীত বিচার করার সময় পণ্ডিতেরা মোটামুটি দুটি পর্যায় লক্ষ্য করেন। ১৯১৩র আগে ও তার পরে। ইন্দিরাদেবী ১৯৪২ সালে ( অর্থাৎ কবির চলে যাওয়ার অব্যবহিত পরে) বলেছেন , তিনি নোবেল পাওয়ার আগের রবীন্দ্রসঙ্গীতকে 'সাবেক' এবং পরবর্তী কালের রচনাকে 'আধুনিক' আখ্যা দিয়েছিলেন। এই 'আধুনিক' রবীন্দ্রসঙ্গীত সৃষ্টি হয়েছে ১৯১৫ সালের পর থেকে। 'সাবেক' রচনাগুলি মূলত রাগাশ্রয়ী ঐশী ও আরাধনাকেন্দ্রিক, যার রচনা, সুরসৃষ্টি ও স্বরলিপিকরণ হয়েছিলো ব্রাহ্মসমাজের প্রয়োজনের দিকে দৃষ্টি রেখে। এই ধারার বাইরে যেসব গান, ধরা যাক তাঁর নিজের সুর করা একেবারে প্রথমযুগের গান, শাহিবাগের প্রাসাদে বসে লেখা 'বলি ও আমার গোলাপ বালা' গোছের গান অবশ্যই রবিবাবুর গান, কিন্তু 'রবীন্দ্রসঙ্গীত' হয়ে উঠতে পারেনি। এরকম অনেক উদাহরণ হয়তো দেওয়া যায় কিন্তু তা নিষ্প্রয়োজন। মূল কথা হচ্ছে রবীন্দ্রনাথ তাঁর গানে স্বাতন্ত্র্য ও আত্মবিশ্বাস খুঁজে পান নোবেল পাওয়ার পর। এই ধরনের কথা শুধু ইন্দিরাদেবী নন, ধূর্জটিপ্রসাদও বলেছিলেন। তাঁর 'আমরা ও তাহারা' বইয়ে রবীন্দ্রসঙ্গীতের যুগবিভাগ করেছিলেন সুরপ্রয়োগের বৈশিষ্ট্য দিয়ে। প্রথমযুগের গানে নানা শাস্ত্রীয়গানের উৎস থেকে আহরণ করা অমিশ্রিত সুরপ্রয়োগ পরবর্তীকালে বিভিন্ন রাগের মিশেলে সম্পূর্ণ নতুনধরনের সুরব্যক্তিত্ব নিয়ে হাজির হয়েছিলো। প্রমথনাথ বিশী যেরকম বলেছিলেন, ''প্রথমবয়সের গানের মুখ বিরহমিলনপূর্ণ খণ্ডক্ষুদ্র সংসারের দিকে, শেষ বয়সের গানের মুখ বিরহ-মিলনাতীত অখন্ড সৌন্দর্যলোকের দিকে; মধ্য বয়সের গানে, অল্প কিছুদিনের জন্য এই দুই স্বতোবিরোধের মধ্যে সেতুবন্ধনের সুর।''
এ প্রসঙ্গে শান্তিদেব বলেছেন, '' মধ্যজীবনে দেখি ছন্দপ্রধান গানের প্রতি তাঁর আকর্ষণ বেশি ও আগের অনুপাতে ঢিমে লয়ের গানের সংখ্যা অনেক কম''। কবি নিজে ইন্দিরা দেবীকে বলতেন, ''আগেকার গান গুলি ইমোশনাল , এখনকার গুলি এসথেটিক''। আবার কবি নিজে বলছেন, ''।।। প্রথম বয়সে আমি হৃদয়ভাব প্রকাশ করবার চেষ্টা করেছি গানে, আশা করি সেটা কাটিয়ে উঠেছি পরে। পরিণত বয়সের গান ভাব বাৎলাবার জন্যে নয়, রূপ দেবার জন্য''। এই 'রূপ' দেওয়া প্রসঙ্গে উদাহরণ দিয়েছেন যে গানটির, '' কেন বাজাও কাঁকন কনকন'', সেটি কিন্তু তাঁর মাত্র ছত্রিশ বছর বয়সের রচনা। তাই তাঁর নিজের মতে গান বিষয়ে 'পরিণত বয়স' এসে গেছে আরো আগেই ।
আবার ধূর্জটিপ্রসাদ ব্যাপারটিকে দেখছেন সম্পূর্ণ অন্য স্তর থেকে। তিনি রবীন্দ্রসঙ্গীতের যুগবিভাগ করছেন সুর যোজনার লক্ষণ থেকে। তিনি লিখেছিলেন, '' ... রাধিকাবাবুর মুখে ভালো ধ্রুপদ শুনে হিন্দুস্তানি কথার বদলে বাংলা কথা বসানো-ই তাঁর কাজ, যেমন- 'সত্যমঙ্গল প্রেমময় তুমি', 'মন্দিরে মম কে'; এই সব গান হিন্দুস্তানি সুরের তর্জমা। দ্বিতীয় যুগে তিনি কথায় ভালো ভালো সুর বসাচ্ছেন, যেমন-'ঝরঝর বরিষে বারিধারা, 'রিমঝিম ঘন ঘন রে' প্রভৃতি গান । তৃতীয় যুগে তিনি সঙ্গীত রচনা করলেন -বাহারের সঙ্গে মল্লার মিশল, ভৈরবীর সঙ্গে মিশল খাম্বাজ, বেহাগের সঙ্গে কেদারা।'' এই মূল্যায়ণটি আজকের দিনে শ্রোতারা হয়তো সঠিক মনে নাও করতে পারেন, কিন্তু যাঁরা কালোয়াতি গানের সমঝদার, তাঁদের বিচারে এই রকম একটা পর্ববিভাগ সমুচিত মনে হওয়াটা অসম্ভব নয়।
আমরা নিজেদের মধ্যে আড্ডায় লঘুমেজাজে বলতুম মহর্ষির পাঁচশো টাকা পুরস্কারের মোহ কবিকে নোবেল পাওয়া পর্যন্ত ‘রবিবাবু’ করে রেখে দিয়েছিলো। যখনই আমাদের কেউ ঐ সব পর্যায়ের গান গাইতে বলতেন, আমরা হয়তো ঈষৎ আড়ষ্টবোধ করতুম, স্বতোচ্ছাস গায়ন হয়ে উঠতো না। এ বিষয়ে সম্প্রতি একজন পরিণতমনস্ক গায়কের সঙ্গে আলাপসূত্রে সেই কথাই হচ্ছিলো। তাঁকে দীর্ঘকাল ধরে সনিষ্ঠভাবে পূজা পর্যায়ের ঐ সব গান পরিবেশন করতে শুনেছি, কিন্তু তিনিও এখন জানালেন ঐসব গানে তিনি ঠিক স্ফূর্তি পাননা। এর একটাই কারণ , আমাদের মনে 'রবীন্দ্রসঙ্গীতে'র শ্রেষ্ঠতর কাজগুলির ছাপ এতোটা প্রবল, যে অপেক্ষাকৃত দুর্বলতর কাজগুলির প্রতি তাদের ঐতিহাসিক তাৎপর্য ছাড়া বিশেষ আগ্রহ আর উৎসাহ বোধ হয়না।
রবীন্দ্রসঙ্গীতের পর্যায়ভেদ বিষয়ে এত বিশদ চর্চা এই জন্য প্রয়োজন, যে আমাদের সময়ে যেসব শিল্পী রবিবাবুর গানকে 'রবীন্দ্রসঙ্গীত' করে তুলেছিলেন, তাঁদের পরিবেশনায় এই গুণগত পর্যায়বাচী সৃষ্টির ধারা বেশ স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছিলো। রবীন্দ্রসঙ্গীত পরিবেশনার যে সমস্ত ঘরানাগুলি রয়েছে তার মধ্যে মুখ্য উৎস জোড়াসাঁকো আর শান্তিনিকেতন। ইন্দিরা দেবী বলেছেন কলকাতাকেন্দ্রিক ঘরানা মুখ্যত ব্রাহ্মসমাজমুখী, যেখানে কাঙালিচরণ সেন, প্রতিভাদেবী, সরলাদেবী ও তিনি নিজে যুক্ত ছিলেন। শান্তিনিকেতন সঙ্গীতঘরানার মুখ্য ব্যক্তি দিনু ঠাকুর ও সঙ্গে অনাদি দস্তিদার, শৈলজারঞ্জন ও শান্তিদেব। এই দুই ঘরানার মধ্যে রবীন্দ্রসঙ্গীত পরিবেশনার বিবিধ অঙ্গ নিয়ে বেশ তর্কবিতর্ক চলতো। বিশেষত দিনু ঠাকুর ও ইন্দিরাদেবীর মধ্যে। দিনু ঠাকুর যে গায়নশৈলির প্রচারক ছিলেন সে প্রসঙ্গে ইন্দিরাদেবীর কিছু ভিন্নমত ছিলো।
আপাতভাবে মনে হতে পারে ইন্দিরাদেবী হয়তো একটু 'রক্ষণশীল', কিন্তু তিনি যখন লেখেন, "..... স্বরশুদ্ধি এক জিনিস, সুরসিদ্ধি বা রসসিদ্ধি আর। সেই রসপূর্ণ গায়কীতে উত্তীর্ণ হওয়াই গায়কের লক্ষ্য ; এবং সেই উদ্দেশ্যসিদ্ধ করবার জন্য সদগুরুর দ্বারস্থ হওয়া চাই, নিজ সাধনা দ্বারা স্বরলিপির কঙ্কালে প্রাণপ্রতিষ্ঠা করা চাই।'' ইন্দিরা দেবীর দীক্ষিত বিখ্যাততম শিল্পী ছিলেন দেবব্রত বিশ্বাস। রবীন্দ্রসঙ্গীতে প্রথাগত 'গুরু' বলতে তিনি সংক্ষিপ্তকালের জন্য হলেও শুধু ইন্দিরাদেবীরই সান্নিধ্য পেয়েছিলেন। তার আগে তাঁর চর্চা তো সীমিত ছিলো শুধু ব্রাহ্মসমাজের প্রার্থনাসঙ্গীতের সমবেত স্বরের একটি স্বর হিসেবে। তাই বিভিন্ন মহল থেকে প্রচারিত রবীন্দ্রসঙ্গীতে 'রক্ষণশীলতা'র মিথটি মনে হতে পরে কিছু কায়েমি স্বার্থান্বেষীর গড়ে তোলা ব্যাপার। যদি ইন্দিরা দেবীর মতো 'রক্ষণশীল' গুরুর শিক্ষা শ্রোতাদের জন্য একজন দেবব্রত বিশ্বাসকে এনে দিতে পারে, তবে এই রটনাটিকে ভ্রান্ত ও ভিত্তিহীন ভেবে বর্জন করাই শ্রেয়। এই ভ্রান্ত অপপ্রচারের বিরুদ্ধে আরো একটি প্রমাণ, স্বত্ববিলোপের এতোদিন পরেও রবীন্দ্রসঙ্গীতের মূলস্রোতটিতে এখনও সৎ শিল্পী ও শ্রোতাদেরই স্বরাজ চোখে পড়ে।
0 comments: