0

গল্প - শুক্লা মালাকার

Posted in


গল্প


মেয়েটা
শুক্লা মালাকার

- আর বলবেন না! ওই এক মেয়ে আমার ছেলের জীবনটা শেষ করে দিল। ঝগড়া অশান্তি। আমার ছেলের জন্য চাকরি ছেড়ে কলকাতায় থাকছে সেটা রোজ বলা চাই। কে তোমাকে চাকরি ছাড়তে বলেছিল বাপু! তখন ভালোবাসা উথলে উঠেছিল। বিয়ের একমাস যেতে না যেতেই সেই ভালোবাসা চুলোয় গেছে। এখানে কেন গেছ, ওদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে বারণ করেছিলাম, তাও রাখছো কেন! দেরি হলো কেন? গিফট্ আনেনি কেন? নতুন সার্ট কোথায় পেলে! রাত নটা অব্দি কিসের অফিস! রবিবারেও ছুটি নেই কেন? ওভারটাইম দেয় না কেন? এটা কেন! ওটা কেন! এই কেনর জ্বালায় ছেলেটা আমার ভাজাভাজা হয়ে যাচ্ছিল। ছেলেদের অত বেঁধে রাখা যায় নাকি। তিতিবিরক্ত হয়ে ডিভোর্স ফাইল করেছে। সে মেয়ে এমন- বলে - আমি অনাথ, কোথায় যাব? পঞ্চাশ লাখ দাও, না হয় বাড়িটা লিখে দাও তবে ডিভোর্স দেব। কি সেয়ানা ভাবুন! মোটে দু বছর বিয়ে হয়েছে তাতেই এত টাকা চাইছে।

- সে কী! কী সাংঘাতিক! তারপর!

- তারপর আর কি? ছেলের অত সময় কোথায়? তাছাড়া ব্যাঙ্গালোর থেকে একটা ভালো অফার পেয়েছিল। তাই মামলা না করে মিউচুয়াল সেটেলমেন্টে গেল। একদিন খুব কাঁদল। হাজার হোক ভালোবাসার বিয়ে। বলল- চল মা-ছেলে ব্যাঙ্গালোরে চলে যাই। বাড়িটা দিয়ে দাও। আমি যা অফার পেয়েছি ওখানে একটা ফ্ল্যাট কিনে নেব। আমি চলে গেলে তুমি একা থাকবেই বা কি করে?

- সে যা বলেছেন। এই বয়সে একা থাকা এক বিষম ব্যাপার। কিন্তু আপনি তাহলে এখানে এলেন কি করে?

- ব্যঙ্গালোরে গিয়ে ছেলে তো ভীষণ ব্যস্ত হয়ে পড়ল। মাঝে মাঝে রবিবারেও অফিসে যেত। একা একা অত বড় ফ্লাটে বিরক্ত হয়ে গেলাম। ভাষা বুঝিনা। কারো সঙ্গে মিশতেও পারি না। চার মাস পরে ফিরে আসতে চাইলাম। কলকাতার বাড়ি তো সেই মেয়ে নিয়েছে। থাকার জায়গা নেই। তাই ছেলে এখানে রেখে গেল। আত্মীয় স্বজন তো আছে। তাদের দেখতে যাই, ওরাও আসে, দেখেননি?

- হ্যাঁ এক বোন তো প্রায়ই আসে দেখি।

- হ্যাঁ। ফোনেও তো খোঁজ নেয় অনেকে। একা বাড়ি ভাড়া করে থাকার চেয়ে এখানে থাকাই ভালো। আপনাদের সঙ্গে দিব্যি দিন কেটে যায়।

- ছেলে আর বিয়ে করেনি?

- না। আমি বলে ছিলাম বিয়ে করে নে, তাহলে আমিও ব্যাঙ্গালোরে থাকত পারব। ও আর ঝামেলাতে যেতে চাইলো না। ডিভোর্সের পেছনে কতগুলো টাকা গেছে। ফ্ল্যাটের লোন। বলল পরে ভেবে দেখবে।

- আপনার ছেলে খুব ব্যস্ত, না? ফোন-টোন খুব একটা করতে দেখি না।

- হাঁ। খুব ব্যস্ত। কাজের চাপে ফোন করতে না পারলেও সময়মতো ঠিক টাকা পাঠিয়ে দেয়। অবহেলা করে না। আমার সে রকম ছেলেই না।

- আপনি ভাগ্যবতী। আমাদের তো সব থেকেও কেউ নেই।

- হ্যাঁ। বছর খানেক তো হলো আমি এসেছি, কারো ছেলে মেয়েদেরই দেখিনা আসতে। কি করে যে পারে ! আমার বাবু অন্যরকম।

- আপনার মেয়ে দেখা করেনা কেন? অফিস থেকে খোঁজখবর নিয়ে চলে যায়, ঝগড়া-টগড়া হয়েছে নাকি?

- মেয়ে? আমার তো মেয়ে নেই? ওই একটিই ছেলে। অন্য কারো কাছে আসে হয়তো।

- না! না! আপনার কথাই জানতে চাইছিল সেদিন। অসুধ আনার জন্য অফিসে গেছিলাম দেখলাম একটি মেয়ে আপনি কেমন আছেন জানতে চাইছে। ফল-টলও কিছু নিয়ে এসেছিল দেখলাম।

- কি বলছেন! আমার মেয়ে নেই। তবে হয়তো বোনের মেয়েটা এসে থাকবে। সময় ছিল না বলে দেখা করে যায়নি।

- হবে ! আচ্ছা বেশ পুতুল কে ডেকে জিজ্ঞেসা করুন।

- আরে সে হবেখন। এখন চলুন চা খেয়ে আসি।

মনে মনে হাসেন নীভা দেবী। উনি জানেন এই আশ্রমের সব বুড়ি ওঁকে হিংসে করে। বলতে গেলে রোজই কেউনা কেউ আসে ওঁর কাছে। হাতে করে ফল মিষ্টি নিয়ে আসে। রান্না করা খাবারও আনে। ফোন আসে প্রায়ই। অন্য সবার তো ছ-মাসে ন-মাসে ভিজিটর। ওঁকে নিয়ে পেছনে আলোচনা চলে জানেন। আজ কৌতূহল মিটিয়ে দিলেন। ওদের মতো তার ছেলে যে তাকে ফেলে রেখে যায়নি, সেটা বুঝিয়ে দিলেন। বুকের মধ্যে গর্বের অনুভুতিটা সবে উঁকি মারছে পুতুল এল। তার জন্য ফুল বই মিষ্টি নিয়ে এসেছে।

- নাও গো নতুন মাসি, এগুলো ধর।

- কে দিয়ে গেল রে?

- ওই যে গো, যে মেয়েটা মাঝে মাঝে এসে খোঁজ নিয়ে যায়, মাসের টাকা দিয়ে যায়। সে এসেছে। শোন গো মাসিরা আজ নতুন মাসির জন্মদিন। তাই তোমাদের জন্যও মিষ্টি নিয়ে এসেছে। খেয়ে নাও। ভয় পেও না সুগার ফ্রি মিষ্টি। মেয়ে জানে সব।

- কি নাম বলেছে রে? দেখা করল না কেন?

- উনি তো তোমার কাছে আসে না। যা দেবার দিয়ে, তোমার খবর নিয়ে চলে যায়। সেবার যে তোমার জ্বর হলো, তখন একবার তোমায় দেখে গেছিল। তারপর রোজ এসে খবর নিয়ে যেত।

- কি জানি! বুঝতে পারছিনা। বোনের মেয়েটা নয় তো?

- ও হ্যাঁ! একদিন দিদি আমায় ডেকেছে জিনিস আনতে, দেখি ফোনে কাকে যেন বকছে- মাকে যদি ফোন না করো, তাহলে তোমার আসল চেহারাটা জানিয়ে দেব। কে গো মেয়েটা?

নিভা দেবীর মনে পড়ল এখানে আসার পর একবারই ছেলের ফোন এসেছে। জ্বর থেকে উঠে তার ফোনটা পেয়ে মনটা ভালো হয়ে গিয়েছিল।

- চলে গেছে নাকি রে?

- না গো নতুন মাসি। অফিসে সুমি দিদির সঙ্গে কথা বলছে।

এবার কৌতূহলের পালা নিভা দেবীর। অন্য সকলে যে তার দিকে ইর্ষার চোখে তাকিয়ে আছে ফিরেও দেখলেন না। একটি মেয়ে তার জন্মদিন মনে রেখেছে, উপহার এনেছে। আজকের দিনটা তিনি নিজেই তো ভুলে গেছিলেন। কে সে? পায়ে পায়ে অফিসের দিকে গেলেন। পর্দা সরাতেই তিনি যেন পৃথিবীর সবচেয়ে আশ্চর্য্য বস্তু দেখলেন। এযে সেই মেয়ে! যার জন্য তার ছেলের জীবন নষ্ট হয়েছে!

0 comments: