গল্প - জয়দীপ মজুমদার
Posted in গল্প
গল্প
আম চুরি
জয়দীপ মজুমদার
অনেক দিন বাদে মাটির টানে নিজের জন্মভূমিতে এসেছি প্রকৃতির একটু আদর খাব বলে। প্রকৃতি তো সব জায়গাতেই পাই, কিন্তু সেই আদরটা আর কোথায় পাই। তার ওপর নিজের জন্মভূমি বলে কথা। কোনও কাজ কর্মের তাড়া নেই। অলসভাবে যথেচ্ছ সময় কাটালেও তদারকি করার কেউ নেই। ঘুম থেকে উঠে কোনও কাজ নেই- ভেবে ভেবেই কি আনন্দ। সেই আনন্দ আতশ কাঁচের উত্তোলনের মতো আরও বহু গুণ বেড়ে গেল, যখন সকাল সকাল আমার ছেলেবেলার স্কুলের বন্ধু সোমনাথের একটা কল এলো আমার মোবাইলে "কি করছিস আজকে দুপুরে"। বললাম, কিছুই করছিনা ভেরেন্ডাই ভাজছি বলতে পারিস; কিন্তু সেটাও ঠিক মতো হচ্ছেনা। সোমনাথ বলল দুপুরবেলা চলে আয় আমার বাড়ীতে গাছের আম খাওয়াবো আর তার সঙ্গে একটু ডাল ভাত খেয়ে যাবি। একটু আড্ডা দেব দুজনে। আচমকা এরকম নেমন্তন্ন পেলে কে না খুশী হয়? সাধারণত একবারের নেমন্তন্নে কেউ চট করে রাজি হয় না, কিন্তু সোমনাথকে কথা ফেরাবার কোনও রকম সুযোগ না দিয়ে রাজি হয়ে গেলাম ওর আম খাওয়ানোর নেমন্তন্নে। মনটা আনন্দে তাথৈ তাথৈ করে চার হাত পা তুলে নাচছে। কতদিন দেশের আম খাই না। ক্বচিৎ কদাচিৎ বম্বের আলফান্সো চালানটা পাই আমার এই দেশে বিদেশে বিভুঁইয়ে। হিমসাগর, ল্যাংড়া, ফজলি, চৌসা এসব যেন রূপকথার ফল। যে আমটা বেশী করে পাওয়া যায় সেটা কেনিয়া থেকে আসে। রামধনুর সাত রঙের সঙ্গে রঙ্গোলীর রংগুলো মিশিয়ে দিলে মোট যে কটা রং হয় তার চাইতেও বেশী রং এই কেনিয়ার আমে। এমন কোনও রং কল্পনা করা যায়না, যা ওদের আমে নেই। ওরা যে ধরনের রঙ্গিন জামা কাপড় পরে জুম্বা ডুম্বা ডান্স করে আমগুলোও ঠিক সেই রকম রঙ্গিন। কিন্তু দেখতেই সার, গুণে পলাশ ফুল।
এই আম খাওয়া নিয়ে ছোট বেলার কত ঘটনা মনে পরে যাচ্ছে। চৈত্রের শেষে কাল-বৈশাখী ঝড়ের পরে কচি আম কুড়ানো, সেই কচি আম তুলে এনে দাদুর লোহার হামানদিস্তায় থেঁত করে ভর্তা বানিয়ে তার সঙ্গে চিনি নুন লংকা গুঁড়ো মিশিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে খাওয়া, দিদিমার সন্দেহ-জনক চোখকে বাঁচিয়ে আরও কত কি। দিদিমা মাঝে মাঝে শাসিয়ে যেত এই বলে “এই যে ছেলে শোন। এই হামানদিস্তায় তোমার দাদু কবিরাজি ওষুধ আর ত্রিফলা গুঁড়ো করে। আমি যেন না দেখি এই হামানদিস্তা এখান থেকে সরেছে। বলে সেই হামানদিস্তা তাকের ওপর তুলে রাখত, যাতে আমি না নাগাল পাই। সেই হামানদিস্তা তাকের ওপর থেকে নামিয়ে দাদু খাটের নীচে রেখে দিয়েছিল দিদিমাকে দেখাবার জন্যে- দেখ আমি কত ওয়াকিবহাল যাতে, এই হামানদিস্তার কোনও অসদ্ব্যবহার না হয় আর দাদু যাতে সব সময় এই হামানদিস্তা পাহারা দিতে পারে। আসল উদ্দেশ্য ভেতর ভেতর আমি যাতে সেই হামানদিস্তা ব্যবহার করে আবার জায়গায় রেখে দিতে পারি। আমি কি আর সেটা বুঝি না, তা না হলে হামানদিস্তার মধ্যে একটা চাকু আর তার পাশে একটা বাজারের থলে কেন থাকবে? যাতে আমি এসে কোনও রকম আওয়াজ না করে সেটা নিয়ে যেতে পারি। খুব খারাপ হয়েছিল যেদিন আমি সেটা নিয়ে পুকুর পাড়ে গিয়ে হারিয়ে এসে ছিলাম বন্ধুদের সঙ্গে মজা করতে করতে। যখন মনে পড়ল, সঙ্গে সঙ্গে ছুটে গেলাম পুকুর পাড়ে। কিন্তু ফিরে গিয়ে দেখি সেটা আর নেই সেখানে। ফিরে এসে দাদুর ঘরেই শুয়ে পরেছিলাম, রাত্তিরেও দাদুর সঙ্গে শুয়ে ছিলাম। আর তখন দাদুকে ঘটনাটা বললাম। দাদুর চোখ মুখের কোনও পরিবর্তন দেখলাম না। দাদু বলল, ওটাতো জায়গাতেই রয়েছে, দেখ ভাল করে দাদুভাই। উপুড় হয়ে খাটের নীচে তাকিয়ে দেখি, সত্যি তো জায়গাতেই রয়েছে সেটা। আনন্দে দাদুকে জড়িয়ে ধরলাম। দাদুর এতটাই দূরদৃষ্টি ছিল যে, আন্দাজ করেছিল আমি হামানদিস্তাটা হারিয়ে ফেলতে পারি তাই হুবহু একই রকম আরেকটা আনিয়ে রেখেছিল। আমার প্রতি দাদুর এই গুপ্ত প্রেম কেউ কোনও দিন জানতে পারেনি। এর পর থেকে দাদুর হামানদিস্তায় আর কোনওদিন হাত দিইনি। মাঝখানে দাদু একবার বলেও ছিল, দাদু ভাই তোমরা আজকাল বন্ধুরা মিলে আর আম ভর্তা পার্টি করনা।
এইসব ভাবছিলাম মনে মনে আর ওমনি সোমনাথের আরেকটা ফোন এলো। "জয়দীপ তুই সন্ধ্যের দিকে আয়। আমায় একটু কোর্টে যেতে হবে। তুই আয়, এলে পরে বলব। তুই বাড়ীতে রেডি হয়ে থাকিস আমি তোকে নিয়ে আসব। আমি বললাম, না না তুই তাড়াতাড়ি বাড়ী আয়, আমি একটা রিক্সা নিয়ে তোর বাড়ী পৌঁছে যাব। ভাবলাম হঠাৎ কোর্ট কেন, হবে হয়ত অফিসের কোনও ব্যাপার।
ডাক্তারি পাশ করে সোমনাথ ত্রিপুরা সরকারের স্বাস্থ্য দপ্তরের এক বেশ বড় সড় সাহেব হয়ে বসে আছে। থাকতেই পারে সরকারী কাজ কর্ম কোর্ট কাছারি এসব। কিন্তু তাই বলে সন্ধেবেলা আম খাওয়া কি জমবে? সেই গাছের আম, গাছের আম ব্যাপারের ফ্লেভারটা কি করে আসবে?
একটা রিক্সা ডেকে বসে পরে পাঞ্জাবীর আস্তিন গোটাতে গোটাতে ভাবছিলাম সোমনাথ বলছিল জয়নগরে একটা বাড়ী বানিয়েছে। সেটা বাড়ীও আবার ফ্ল্যাটও। আম গাছ আছে, ফ্ল্যাটেও থাকা যায় আবার আমও পাড়া যায়। খুব এক্সাইটেড হয়ে ছিলাম ওর কথায়। হয়ত ওর বাড়ী গেলে ও গাছে উঠে আমার জন্যে আম পাড়বে বা আমায় বলবে তুই গাছে উঠে আম পাড়। উফ্, কি এক্সাইটেড লাগছে।
কলকাতায় টিভিতে এক বিল্ডারের এরকম এক বিজ্ঞাপন দেখে মনে খুব শিহরণ জেগেছিল আমার। রাজারহাটের বোধিসত্ত্ব বাস্তু কনসট্রাকশানের ভীষ্ম অ্যাপার্টমেন্ট। তাদের অ্যাড। মিসেস চাড্ঢা কলোনিতে মারেন আড্ডা ফ্ল্যাটেও থাকেন আমও পাড়েন। অ্যাপার্টমেন্টের কিটি পার্টির সব মহিলারা এসেছেন মিসেস চাড্ঢার ফ্ল্যাটে আড্ডা দিতে না জানিয়ে। বাড়ীতে এসে অবাক। ফ্ল্যাটের দরজা খোলা বাড়ীতে কেউ নেই। কোথায় আর যাবে হয়ত রয়েছে আশে পাশেই কোথাও। "এইতো সকালে দেখলাম ছেলে মেয়ে স্কুলে গেল একটু আগে বর অফিস গেল" পাশের বাড়ীর মিসেস হাতী বললেন। "দেখি ফোনটা লাগাই তাহলেই বোঝা যাবে কোথায় গেল" মিসেস হাতী বললেন। মিসেস চাড্ঢাকে ফোন লাগাতেই গলায় নেকলেসের মতো করে ঝোলানো মোবাইলটা বেজে উঠল। "হ্যালো হ্যাঁ আপ লোগ ব্যায়ঠিয়ে দরজা খোলাই আছে আমি তোদের দেখতে পাচ্ছি। এক্ষুনি আসছি”। গুরুচণ্ডালী ভরা বাংলা হিন্দি মেশানো কথায় মিসেস চাড্ঢা জবাব দিলেন। সবাই দেখতে পেল মিসেস চাড্ঢা আম গাছের ডালে বসে দুটো পা এক সঙ্গে করে ঝুলিয়ে ঝুলিয়ে আম খাচ্ছেন আর নীচে নামার তোড়জোড় করছেন। আমার বানানো কথা নয়, এগুলো বিজ্ঞাপনের কথা টিভিতে দেখায়।
ব্যাক-গ্রাউন্ডে এই রকম একটা পরিবেশ ভাবতে ভাবতে সোমনাথের বাড়ী পৌঁছে গেলাম। সোমনাথ আমি আসার আগেই বাড়ী পৌঁছে গিয়েছিল। বাড়ীতে ঢুকে বেল চাপতেই ধোপ দুরস্ত পাজামা পাঞ্জাবী পরে বেরিয়ে এলো সোমনাথ। আমায় একটু পরিবারের সঙ্গে প্রাথমিক আলাপ করিয়েই নিয়ে চলে গেল ছাতে। একটু বোঝার চেষ্টা করছিলাম ছাতে কেন হঠাৎ? আমাদের তো সোমরস পানের কোনও কথা ছিলনা আর সোমনাথ তা ছাড়া ওসব জিনিস বাড়ীতে করেনা। যাই হোক, বেশ ফুলের বাগান গাছ গাছালি ভরা ছাদে গিয়ে বসলাম। অপূর্ব মনোরম পরিবেশ ও আবহাওয়া। সন্ধ্যেবেলায় ছাতে কি ফুল কি ফল হয়ে রয়েছে কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। কিন্তু সব কিছু মিশে গিয়ে একটা অপূর্ব গন্ধের মাদকতায় নৈসর্গিক আনন্দ নিচ্ছিলাম।
ছাতে বসতেই সোমনাথের স্ত্রী তিন চারটে খালি প্লেট কাঁটা চামচ ছুরি এসব নিয়ে এসে টেবিলের ওপর রেখে বলল, আপনারা খেয়ে নিন তারপর আমি আবার আসছি। আমি বেশ অবাক হয়ে গেলাম কি খেয়ে নিন, প্লেট তো ফাঁকা কিছু থাকলে তো খাব। পরের বার হাতে ভেজ-পাকোড়া বেগুনি পেঁয়াজী নিয়ে এসে না দিয়ে সেগুলো নিয়ে আবার ফেরত চলে গেল ওর স্ত্রী আর বলল সেকি আপনার এখনও শেষ করেননি। আমি আরও বেশী অবাক হয়ে গেলাম, কি শেষ করব। আমাদের মধ্যে এত আড্ডা জমে গিয়েছিল যে সোমনাথ উঠে ওর কাজটা করার কথা ভুলেই গিয়েছিল। তারপর দেখলাম সোমনাথ চাকু হাতে দাঁড়িয়ে পড়ল। দাঁড়িয়ে থেকে ওর মাথার ওপর ঝোলা একটার চাইতে একটা বড় বড় পাকা আম পাড়ল। দাঁড়িয়ে থেকেই হয়ে গেল কাজটা করতে কোথাও যেতেও হলো না। এতক্ষণে বুঝলাম গাছ গাছালি যেটা মনে হচ্ছিল, ওটা আসলে পাশের বাড়ীর আম গাছ। খালি গুড়িটা পাশের বাড়ীতে গাছের বেশীর ভাগটাই সোমনাথের দিকে। ছাতে দাঁড়িয়ে থেকে আম পাড়া যায়। খচ খচ করে পাঁচ ছটা আম চাকু দিয়ে কেটে ছাতের বেসিনে ধুয়ে কাটতে কাটতে সোমনাথ কথা বলে যাচ্ছিল।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, "আজকে তোর কেসের ব্যাপারটা কি ছিল যে হঠাৎ সময় পাল্টালি"। সোমনাথ বলল, আর বলিস না, এই পাশের বাড়ীর আম গাছটা দেখছিস, আমার বাউন্ডারি দেওয়াল নষ্ট করে দিচ্ছে। পাশের বাড়ীর ভদ্রলোককে বললাম গাছটা কেটে ফেলতে, উনি কাটবেন না। পরপর কয়েক বার অনুরোধ করে ফল না পাওয়াতে আমি প্রস্তাব দিলাম গাছটা আমি কাটাব, আমি কাটার খরচা দেব। এক সপ্তাহ আগে একটা লোক ঠিক করে পাঠালাম ওর বাড়ীতে, সেই লোককে তিনি মারধোর করে ফেরত পাঠিয়ে দিলেন। আমাকে ফোনে শাসালেন এই ধরনের ঘটনা যদি দ্বিতীয় বার ঘটে তাহলে উনি কোর্ট কেস করবেন। আমিও হুমকি দিলাম ওর বাড়ীর কাউকে আমি আমার বাড়ী ঢুকতে দেব না ছাতে উঠে আম পাড়ার জন্যে। সেই ভদ্রলোক বললেন, ঠিক আছে তার মীমাংসা হবে কোর্টে। আমি ওর শর্ত মেনে নিলাম। ও হাই কোর্টের জাঁদরেল দুঁদে উকিল ভেবেছিল হুমকি দেখিয়ে কাজ করিয়ে নেবে। কিন্তু আমি শোনার কোনও চেষ্টাই বোধ করিনি একদম। আজকেই কোর্ট থেকে সমন এল আমাকে হাই কোর্টে যেতে হবে। আমিও ভাবলাম, ঠিক আছে এর একটা হেস্তনেস্ত হওয়া দরকার।
চিঠিটা একটু দেরীতেই এসে পৌঁছেছে প্রথমে ভাবছিলাম রিসিভ করবোনা। পরে ভাবলাম না দেখাই যাক না ব্যাপারটা কতদূর গড়ায়। গেলাম কোর্টে আমায় কোর্টে দেখতে পেয়ে আমার পাশের বাড়ীর উকিল সমীরণ কি খুশী আমায় কোর্টে আনতে পেরে আমার কিছু অসুবিধে করতে পেরেছে বলে। সমীরণ আমায় দূর থেকে সম্ভাষণ করে বললেন, সোমনাথ-বাবু বাড়ীতে তো আর দেখা হয়না এমনিতে, তো এই কোর্টেই একটু দেখা সাক্ষাত হয়ে যাক এই আরকি। সোমনাথ বলল, রাগে আমার গা পিত্তি জ্বলে যাচ্ছিল কিন্তু সামলে নিয়ে বললাম, তবে নেমন্তন্ন পেলে সেটা কিন্তু আমি রক্ষা করি। আপনি আমায় ডাকলে তো আপনার বাড়ী যাব। এই দেখুন আপনি এখানে ডাকলেন চলে এলাম, হোকনা সেটা কোর্ট। নাও তো আসতে পারতাম একটা মেডিকেল সার্টিফিকেট দেখিয়ে দিয়ে।
জজ সাহেব খুব তাড়াতাড়িই চলে এলেন একদম বসে থাকতে হয়নি। জজ সাহেব বললেন, আমি ঠিক পনের মিনিট সময় দেব। এর মধ্যে ঝগড়া মিটিয়ে ফেলতে হবে। এসব জিনিস নিয়ে কোনও কেস হয়না, আমাদের আরও অনেক জরুরী কাজ রয়েছে। পাঁচ মিনিট, পাঁচ মিনিট বাদী বিবাদী পক্ষের আর পাঁচ মিনিট রায় দেওয়া। সোমনাথ বলে যাচ্ছে সমীরণ যত বড়ই উকিল হোক না কেন বুঝে গেলাম এই কেস ও ঠেকাতে পারবে না। এতক্ষণ ধরে মামলাটা কিসের সেটাই জানতে পারছিলাম না। মামলার শুরুতেই বুঝতে পারলাম আমার বিরুদ্ধে মামলা আনা হয়েছে আম চুরি করার অভিযোগ। সমীরণ অভিযোগ করলেন, “আমার বাড়ীর আম গাছ থেকে সোমনাথ প্রতি দিন প্রকাশ্যে আম চুরি করে একে তাকে খাওয়ায়, আম গিফট করে আর আমাদের দেয়না। আমার আম গাছ থেকে আমায় আম পাড়তে দেয়না”।
সোমনাথ বলল "এটা ওর আম গাছ হতে পারে কিন্তু আমগুলো আমার এর কারণ আমগুলো আমার জমিতে হয় ওর জমিতে হয়না। আমার জমিতে আম হলে সেই আমের মালিক আমি সমীরণ উকিল নয়। সমীরণের ছানা পোনারা যদি অ্যামেরিকায় গিয়ে ডিম পাড়ে সেই ডিম পাড়া ছানা পোনাগুলো ভারতের নয় ওরা অ্যামেরিকার"।
সত্যি একদম অকাট্য যুক্তি। জজ সাহেব প্রথমটায় সোমনাথকেই ভেবে ফেলেছিলেন দোষী কিন্তু সোমনাথের এই যুক্তিতে বমকে গেলেন। ফ্যাল ফ্যাল করে শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন।
“অবজেকশান ইয়োর অনার আমার ছানা পোনা নয় ছেলে মেয়ে, আর ডিম পাড়া নয় বাচ্চা হওয়া। তাহলে আমার নাতি-নাতনীরা যদি অ্যামেরিকান হয় তার মানে এই নয় যে অ্যামেরিকা ওদেরকে খেয়ে নেবে” সমীরণ উকিল বলল। সোমনাথ বলল "হ্যাঁ ওদের যদি ভিসা পাসপোর্ট ঠিক মতো প্রসেস করা থাকে আর ওরা যদি অ্যামেরিকার সম্মতি নিয়ে যায় তাহলে সমীরণ উকিল যা বলছে ঠিক। কিন্তু ওদের যদি ভিসা পাসপোর্ট না থাকে তাহলে রুল অফ দ্যা ল্যান্ড মানে অ্যামেরিকার রুল ফলো হবে, ভারতের কোন রুল সেখানে চলবে না। এক্সিকিউট ও হতে পারে যদি অ্যামেরিকান রুলে লেখা থাকে"।
জজ সাহেব বললেন "সমীরণ এসবের চাইতে তুমি গাছটা কাটিয়ে কেন ফেলছ না গাছের গুড়িটা তো তোমার জমিতে"।
সোমনাথ বলল “জজ সাহেব আমি সবার আগে সমীরণ উকিলকে সেটাই বলেছিলাম। কাটাবার পয়সাও বলেছিলাম আমি দেব, আমি লোকও পাঠিয়েছিলাম কিন্তু আমার সেই লোককে সমীরণ উকিল মারধোর করে ফেরত পাঠিয়ে দেয়। এখন আমি ঠিক করেছি সমীরণ উকিলকে আর আম গাছ কাটার কথা বলব না কিন্তু ওর সব আমগুলো পেড়ে পেড়ে আমি খাব সমীরণ উকিলকে দেখিয়ে দেখিয়ে, লোককে বিলোবো সমীরণ উকিলকে দেখিয়ে দেখিয়ে কিন্তু ওকে দেব না, দেখি ও কি আইনি ব্যবস্থা নিতে পারে আমার বিরুদ্ধে”।
তবে আমি একটা কথা বলে দিচ্ছি যেদিন সমীরণ উকিল আম গাছটা কেটে ফেলবে গুড়ি থেকে সেদিন আমি আমার অধিকারের আমগুলো থেকে তাঁকে একটা আমের বাক্স রাঙতা লাগিয়ে চুমকি বসিয়ে মোটা সিল্কের লাল ফিতে দিয়ে বেঁধে গিটঠু মেরে মাঝখানে একটা ফুল বানিয়ে সমীরণ উকিলকে গিফট করব”। এটা আইনি আদেশ নয় এটা আমার ভদ্রতা কারণ আমগুলো আমার, সমীরণ উকিলের নয়।
সমীরণ উকিল খেপে গিয়ে উঠে বলল "শালা নিকুচি করেছে তোর গিফট্। ঐ আম খেলে তোর, আর যাকে যকে খাওয়াবি সবার আমাশা হবে। লাথি মারি তোর গিফটে"
সোমনাথ এবার শান্ত গলায় বলে উঠল "অবজেকশান ইয়োর অনার। আমি পেশায় একজন ডাক্তার, আম থেকে আমাশা হতে পারে এরকম কোন তথ্য আমার জানা নেই। আর আমার প্রতিপক্ষ যেরকম ভাষার প্রয়োগ করলেন আমি এতে আহত, আমি মান হানির মামলায় যেতে চাই"।
জজ সাহেব প্রচণ্ড কড়া ভাবে সমীরণ উকিলকে বললেন আর একবারও যদি এরকম ভাষার প্রয়োগ করা হয় তাহলে তিনি মানহানির মামলা করার অর্ডার রিলিজ করে দেবেন। জজ সাহেব অর্ডার দিলেন এক সপ্তাহের মধ্যে এই গাছ সমীরণ উকিলকে কেটে ফেলতে হবে আর আদালতে তার ছবি দেখিয়ে এই কেসের ক্লোজ আউট করতে হবে মুহুরিকে এই অর্ডার লিপিবদ্ধ করিয়ে জজ সাহেব তাড়াতাড়ি উঠে চলে গেলেন আরেকটা কেসের জন্যে অন্য ঘরে।
ঘর খালি হয়ে গিয়েছিল। সমীরণ উকিল তখনও গজগজ করে চলেছে। সোমনাথ ইতি টেনে সমীরণ উকিলকে বলল “পরের সপ্তাহে তাহলে এদিন আবার দেখা হবে এই আদালতে সমীরণ-বাবু”। নিজের মনেই বলে উঠল সমীরণ উকিল "শালা নিজের দিকটায় গাছে একটাও আম হয়না সব আমগুলো শালা চলে যায় সোমনাথ ডাক্তারের দিকে”। সোমনাথ বলল “ছেলে মেয়েরা বড় হলে কি আর চিরকাল নিজের বাড়ীতে পরে থাকে, থাকেনা অন্যের কাছে চলে যায়। গাছ যে কিনা কোথাও যেতে পারেনা সে ও আজকাল এই পলিসি নিয়েছে”।
কটমট করে সমীরণ উকিল দুবার তাকিয়ে উঠে চলে গেল। আমরা ছাতে আম খাওয়া পর্ব শেষ করে পরের আইটেমটায় গেলাম। যে আমের পেছনে এত ইতিহাস সে সুস্বাদু না হয়ে পারে? সোমনাথ বলল আজকেই তোর নেমন্তন্নটা শেষ করে ফেললাম, জানিনা যা ক্ষেপে আছে লোকটা কাল অবদি গাছটা থাকবে কিনা।
এতক্ষণে রাত্তিরে আম খাওয়ার মাহাত্ম্য বোধগম্য হলো।
0 comments: