0

স্মৃতির সরণী - বিপুল দাস

Posted in

স্মৃতির সরণী 


কথামালা
বিপুল দাস


শোষণহীন সমাজের স্বপ্ন দেখেছিল একটা ঝকঝকে প্রজন্ম। জীবনমৃত্যু পায়ের ভৃত্য করে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল সংগঠিত রাষ্ট্রশক্তির বিরুদ্ধে। পুঁজি বলতে ছিল কিছু দেশি বন্দুক, পেট, রেডবুক, চোখে স্বপ্ন আর বুকে আদর্শের আগুন। কিন্তু একটা সুসংগঠিত, নিষ্ঠুর, পেশাদার ঘাতক বাহিনীর সঙ্গে দীর্ঘদিন গেরিলা যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার মত রণকৌশল, রসদ, এবং অস্ত্র তাদের ছিল না। অন্তর্দ্বন্দ্ব ছিল, গ্রামেগঞ্জের আমাশা-ম্যালেরিয়া ছিল। সুসংহত বাহিনী না গড়ে, উপযুক্ত রাজনৈতিক এবং সামরিক প্রশিক্ষণ ছাড়াই যুদ্ধ শুরু করার ডাক শুনে এরা স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে, ঘর ছেড়ে পথে নেমে এসেছিল। এদের ঝাড় শেষ করে দিয়েছিল সিদ্ধার্থ রায়, কিন্তু বংশ লোপ করতে পারেনি।

মাঝে মাঝে পুরনো বন্ধুদের সঙ্গে দেখা হয়। অ্যাকশন স্কোয়াডের শঙ্কর পূজারি বামুন হয়ে গেছে। কী করব বল, চাকরি পাব না জানি, ভেরিফিকেশনে আটকে যাবে। সংসার তো চালাতে হবে – বলেছিল শঙ্কর। শঙ্কর জানে না কত হার্ড-কোর নকশালপন্থী, কত আগুনখেকো বিপ্লবী কী সব ভুজুংভাজুং দিয়ে পুলিশ ভেরিফিকেশন ক্লিয়ার করে নিয়েছে। মিহির হাত দেখে আর পাথর বেচে বেশ কাঁচা পহা আমদানি করেছিল। লাং ক্যান্সারে মারা যায় মিহির। কত বন্ধু ঠিকাদারি-প্রোমোটারিতে চকচকে হয়ে উঠল। কত বন্ধু লাইন করে সরকারি চাকরি পেল। বন্দীমুক্তি পর্বে ছাড়া পাওয়ার পর বেসীর ভাগ কেমন নির্জীব হয়ে পড়েছিল। চোখে আর সেই দ্যুতি ছিল না। অনেকেই ফিজিক্যালি হান্ডিক্যাপড্‌ হয়ে পড়েছিল। খড়দার হোগলাদা পরে চেষ্টা করেছিল মেডিক্যাল রিপ্রেজেন্টেটিভ হিসেবে আবার উঠে দাঁড়াতে। হয়নি। চারুদার বড় মেয়ে অনীতার বর সেন্ট পলস্‌-এর মেধাবী ছাত্র সুগত সেনগুপ্ত আবার পার্টির কাজ শুরু করেছিল। অসম থেকে ফিরে এল জ্বর নিয়ে। পরে যখন ধরা পড়ল মেনেজাইটিস ম্যালেরিয়া, তখন আর কিছু করার ছিল না।

সেই ছাতিমগাছটা সব জানত। কিন্তু এখন আর গাছটা খুঁজেই পাই না। এক রকম গাছ আছে, বনে আগুন লাগলে সেই গাছ নিজের ধ্বংস বুঝতে পেরে খুব দ্রুত নিজের বীজ ঝরিয়ে দেয় মাটিতে। আমি পুড়ে যাচ্ছি, তোরা থাক। আমাদের ছাই-এর ওপর তোদের নবাঙ্কুর জেগে উঠুক নতুন ধারাপাতে। কে জানে, আবার নতুন সপ্তপর্ণী জেগে উঠবে কিনা।

সত্তরের দশকের মাঝামাঝি থেকে আমি আমার মত করে নিজেকে বিশ্লেষণ করতে শুরু করেছিলাম। কতটুকু বুঝেছিলাম মার্ক্সবাদ, লেনিনবাদ। নির্বাচিত লেনিন রচনাবলির ক’পৃষ্ঠা পড়েছি আমি। বিশ্ব-রাজনীতির প্রেক্ষাপটে এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, ভারতবর্ষের মানুষের সনাতন সাংস্কৃতিক কাঠামো, ভারতের পরিবর্তিত সামাজিক পরিস্থিতি ও মানুষের মানসিক কাঠামো – এ সবের প্রেক্ষিতে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের ডাক দেওয়ার সময় কি হয়েছিল। বিপ্লবের জন্য মাটি কি প্রস্তুত ছিল। এ যেন আগুনটুকু শুধু আছে, রান্নাবান্নার জিনিস নেই, হাতাখুন্তি নেই, অথচ দেশসুদ্ধ লোকের নেমন্তন্ন হয়ে গেছে।

যত বিশ্লেষণ করি, মোহমুক্তি ঘটতে থাকে আমার। আমার মত করে লেখালেখি আর সঙ্গীতের জগতে নিজেকে সমর্পণ করি। ক্রমশ এই উপলব্ধি হয়, ‘ বাহির হইতে প্রযুক্ত বল দ্বারা অবস্থার পরিবর্তন না হইলে’ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় অংশগ্রহণ করে সেই পরিবর্তন হয়তো সম্ভব।

এখনকার আশাবাদী সি পি এম –এর কমরেডরা বলেন – পার্টি আবার ঘুরে দাঁড়াবে। কিন্তু কেমন করে ঘুরে দাঁড়াবে, সে কথা কোথাও শুনি না। তেভাগা বা তারও আগে শ্রমিক-কৃষক-মেহনতি ঐক্যে যে শক্তি জেগে উঠতে শুরু করেছিল, যে ভাবে গানে-নাটকে-চলচ্চিত্রে-সাহিত্যে প্রগতিশীল মানুষ নিপীড়িত, লাঞ্ছিত, বঞ্চিত মানুষের কথা প্রচার করেছেন, যে ভাবে দিনের পর দিন চিড়েমুড়ি খেয়ে আদর্শে নিবেদিত কম্যুনিস্ট গ্রামে গ্রামে সংগঠন গড়ে তুলেছে, যে ভাবে কম্যুনিস্ট পার্টি শ্রমিকের স্বার্থে শহরে তীব্র গণ-আন্দোলন গড়ে তুলেছে, তৎকালীন প্রশাসনকে ব্যতিব্যস্ত করে রেখেছে – আর এক দল চৌত্রিশ বছর ধরে তার ফল ভোগ করেছে। যে গাছকে রোদজলঝড়বৃষ্টি থেকে রক্ষা করে, আগাছা নিংড়ে, পোকা মেরে, জল ও সার দিয়ে মহাবৃক্ষে পরিণত করা হয়েছিল, সেই বৃক্ষ ফলবতী হতেই সেই গাছের ছায়ায় এসে বসল চালাক মানুষের দল, ফড়ের দল। তারা যথেচ্ছ ফল খেল, ফুল তুলল, পাতা ছিঁড়ল, ডাল ভাঙল। গাছকে বাঁচানোর কথা আর কেউ ভাবল না। ভেবেছিল আরও পঞ্চাশ বছর এই গাছ আমাদের ছায়া দেবে, ফলপাকুড় দেবে। পেটে গামছা বেঁধে, ঝড়জলরোদে গ্রামে গ্রামে কম্যুনিস্ট পার্টির সংগঠন গড়ে তোলা এবং ধরে রাখার লোক তখন আর নেই। প্রতিটি সিদ্ধান্ত দ্বিধাগ্রস্ত। দক্ষিণ মুখাপেক্ষিতা। ভুলের ওপর ভুল। পরে আবার ভুল স্বীকার। গ্রামেগঞ্জে গিয়ে মাটি কামড়ে পড়ে থেকে সংগঠন করার লোক আর রইল না। নতুন কোনও প্রজন্ম এগিয়ে এল না সেই আরব্ধ কাজের দায়িত্ব নিতে। ভাগ্যিস পুব-পাকিস্তান থেকে বিশাল সংখ্যায় বামপন্থী মনোভাবের লোক, তেভাগায় অংশগ্রহণ করা কিছু লোক পশ্চিমবঙ্গজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছিল। এরা ছিল বামপন্থীদের একটা অন্যতম শক্তি। পার্টি ভাগ হওয়ার পর মগজ কমে গিয়েছিল সি পি এমের। সেটি সি পি আই নিয়ে আলাদা হয়ে যায়। আর মগজবিহীন ক্রমবর্ধমান ধড় নিয়ে সি পি এম ভেবেছে – দ্যাখো আমি বাড়ছি মাম্মি।

আশির দশকের মাঝামাঝি থেকেই অনিয়ন্ত্রিত কোষ-বিভাজনের ফলে উদ্ভুত মারণ রোগের লক্ষণ টের পাওয়া যাচ্ছিল।ক্রমে জনসংযোগের বদলে জনবিচ্ছিন্নতা শুরু হ’ল। স্থানীয় নেতারা সবাই প্রায় ছোটখাটো সামন্তপ্রভু হয়ে বসেছিল। প্রোমোটারি-রাজ দৃঢ় ভাবে কায়েম হয়ে বসল। আস্তে আস্তে পায়ের তলার মাটি নরম এবং সরে যাচ্ছে – এটা না বোঝার কথা নয়। কিন্তু হিটলার যেমন ভাবতে পারেনি রাশিয়ার তুষারাবৃত প্রান্তর থেকে তার অজেয় বাহিনী মার খেয়ে পালিয়ে আসবে, তেমনই বামফ্রন্টের ছোটবড় নেতারা বিশ্বাস করতে পারেনি এই সরকারের পতন হতে পারে। মার্ক্সবাদ বিজ্ঞান, তাই সে অজর, অমর, অক্ষয়, অব্যয়। তাকেও যে স্থানকালপাত্রের প্রেক্ষিতে প্রয়োগের উপযুক্ত করার জন্য সামান্য ঘষামাজা করে নিলে মহাভারত অশুদ্ধ হবে না, এই শুচিবাই থেকে বেরোতে না পারা ভয়ানক ক্ষতি করে ছিল। শহরে, গ্রামে, গঞ্জের অফিসে-স্কুলকলেজ-আদালতে ছোট দরের একপো-আধপো নেতাদের দেখেছি কথায় কথায় বিরোধীদের, সরকার বা পার্টির সামান্য সমালোচনা করলে আস্তিন গুটিয়ে তেড়ে আসতে। এরা কেউ সংগ্রামের ভেতর দিয়ে, ত্যাগতিতিক্ষার ভেতর দিয়ে, আদর্শের জন্য সি পি এম করতে আসেনি। যাঁরা এসেছিল, তারা অনেকেই বীতশ্রদ্ধ হয়ে বসে গেছে। শহরে ছাত্র আন্দোলনের নেতারা, শ্রমিক বেল্টের নেতারা অনেকেই তখন বড় নেতা মন্ত্রী। মুড়ি, রুটিগুড় তখন ইতিহাস। গ্রামেগঞ্জে সামন্তপ্রভুদের কড়া হাতে রাশ টানা, আত্ম-সমালোচনা, আত্মশুদ্ধি –এ সব কথা মাঝে মাঝে প্রকাশ্যে এবং রুদ্ধদ্বার বৈঠকে উচ্চারিত হ’ত বটে, কিন্তু কঠোর হাতে পরিমার্জনা করতে সে রকম উৎসাহ কারও ভেতরেই ছিল না। যেমন-আছে-থাক, স্ট্যাটাস কো-এর এই সুখপ্রদ অবস্থাকে কেউ আর টালমাটাল করতে চায়নি। যদি এই মসৃণ জীবনযাপন পালটে যায়।

সেই মহাবৃক্ষের নীচে তখন ফল কুড়িয়ে খাওয়ার লোক বেশি। গাছ মরে গেলে তাদের কিছু আসে যায় না। আবার অন্য গাছের ছায়া খুঁজে নেবে। এরা বাংলার মাটিতে কম্যুনিস্ট আন্দোলনের ইতিহাস কিছুই জানে না। এরা সলিল চৌধুরী, শম্ভু মিত্র, বিজন ভট্টাচার্যের নাম শোনেনি। তেভাগা আন্দোলনের কথা জানে না। একমাত্র বামপন্থার শক্তিই পারে জাতিধর্ম, শ্রেণিগতস্থান নির্বিশেষে সম্প্রীতি ও ঐক্যের বন্ধনে সমাজকে সুস্থ ও সংহত রাখতে – এসব কিছু তারা বুঝতে চায়নি। পরগাছার মত সেই বৃক্ষ থেকেই ক্রমাগত রস টেনে স্ফীত হয়েছে। এদের নির্মূল করার অভিযান কোনও দিন হয়নি। প্রবল আত্মবিশ্বাস, গরিমা, দম্ভ, স্বচ্ছল জীবনযাপনে অভ্যস্ত কমরেডরা টের পায়নি শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ঘরে, ঘরের বাইরে অসংখ্য সুযোগ-প্রত্যাশী ও স্তাবকদের ভীড়েসংগ্রাম হারিয়ে যাচ্ছে। ভিটেতে ঘুঘুর ডাক অস্পষ্ট শোনা যাচ্ছিল। শোনা যাচ্ছিল ভিতের নীচে উইপোকার শব্দ। তখন আর সময় নেই। বস্তু যখন খুব ভারি হয়ে যায়, তখন তার আপন ভারেই গতিজাড্য নিয়ে সামনে গড়ায়। তাই হয়েছিল। বিশাল পার্টি তার নিজস্ব ভরেই গড়িয়ে চলছিল। সবাই ভাবত – এই তো দিব্যি চলছে।

পশ্চিমবঙ্গের কম্যুনিস্ট আন্দোলন, কম্যুনিস্ট-শাসিত সরকার – দীর্ঘদিন ধরেই অনেকের মাথাব্যথার কারণ হয়ে ছিল। এর পতন তারা চেয়েছিল। ভূমিসংস্কারের সুফল এই সরকার দীর্ঘদিন ভোগ করেছে। কিন্তু ক্ষতিগ্রস্ত দেশীয় ভূস্বামীদের একটা বড় অংশ, অ-কম্যুনিস্ট দলগুলো, বিদেশি পুঁজিপতিদের দালালশ্রেণি – নানা ভাবে চেষ্টা করেছে এই সরকারকে উৎখাত করতে। কিছু জাতীয়তাবাদী সংবাদপত্র, ইলেক্ট্রনিক প্রচারমাধ্যম, কেন্দ্রের সরকার – এই কম্যুনিস্ট পার্টি এবং তার সরকারকে কোনও দিনই পছন্দ করেনি। কম্যুনিস্টদের প্রতি ঘৃণা ছিল অনেক বিখ্যাত লোকেরও। সেটা আমরা পরবর্তী পর্যায়ে লালগড়, নন্দীগ্রাম আন্দোলনে দেখেছি। শুনেছি লাল রং তারা কেমন ঘৃণার চোখে দেখেন। কম্যুনিস্ট নেতাদের শহিদ বেদিতে পদাঘাত করতেও তাদের বাধেনি। লালগড়, নন্দীগ্রাম, সিঙ্গুর, নেতাই – তারও আগে সাঁইবাড়ি, মরিচঝাঁপি, অনীতা দেওয়ান, নেতাদের বক্রোক্তি-দম্ভোক্তি ইত্যাদি ঘটনা মানুষ ভালো ভাবে নেয়নি। অনেকগুলো ক্ষত তৈরি হয়েই ছিল। সুতরাং যাঁরা সেদিন বা আজও কম্যুনিজম্‌কে ঘৃণা করছে, নিশ্চয় তাদের কাছেও অজস্র যুক্তি আছে। আবার এমনও বহু মানুষ আছেন, যাঁরা কম্যুনিজম্‌কে নয়, ঘৃণা করেছেন তথাকথিত সরকারি বামপন্থীদের।

চৌত্রিশ বছরের বাম জমানার অবসান ঘটানোর জন্য তখনকার বিরোধী নেত্রীর কৃতিত্ব অস্বীকার করার কোনও প্রশ্নই নেই। ছল-বল-কৌশল, মিথ্যাচার, ক্রমাগত মিথ্যা-প্রচার –এ সব রাজনীতির অঙ্গ। দোষারোপ অর্থহীন। ক্ষমতার গন্ধ পেয়ে তিনি বাম-বিরোধী সমস্ত শক্তিকে সং গঠিত করতে পেরেছিলেন। এমন কী, কিছু বামাদর্শের রাজনৈতিক দলও আর একটি বাম সরকারকে উৎখাত করার জন্য তার সমর্থনে জোট বেঁধেছিল। কৃতিত্ব অবশ্যই বিরোধী নেত্রীর। ক্ষমতায় আসার পর দক্ষ কূটনীতির চালে অদরকারী এবং ভবিষ্যতে ক্ষতিকারক হতে পারে, এমন শক্তিকে নিকেশ করলেন, বর্জন করলেন। দীর্ঘদিনের বিশ্বস্ত সঙ্গীদের নিয়েই নিজস্ব বৃত্ত তৈরি করলেন। এটি ছিল অন্তর্বলয়। আর একটি বহির্বলয়ে স্থান দিলেন সহযোগী শক্তিগুলিকে। বাংলার সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলের এবং অন্যান্য জগতের বিশিষ্টজন, যাঁরা এই লড়াই-এ তাকে সমর্থন করেছিল এবং পরবর্তীতে ক্ষমতার পদলেহী কিছু মানুষ এই বহির্বলয়ে স্থান পায়।

কিন্তু প্রশ্ন হ’ল, পরিস্থিতির এই অবস্থায় পৌঁছনোর জন্য মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের রণনীতিই কি সর্বাংশে কাজ করেছে ? সেটাই কি একমাত্র কারণ ছিল ? বাম-ঐক্য কেন রুখতে পারল না এই ভাঙন। এ কথা ঠিক, সমস্ত বিরোধী শক্তি একজোটে এই সরকারের পতন চেয়েছিল। যে জনশক্তি ছিল বামেদের দাঁড়িয়ে থাকার মূল স্তম্ভ, পার্টি সেই সাধারণ মানুষের থেকে অনেক দূরে চলে যাচ্ছিল। মানুষও তাদের ‘চোখের মনির মত’ সরকার এবং পার্টি থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিচ্ছিল। ছোটখাটো নেতাদের উদ্ধত আচরণ, চাপা একটা সন্ত্রাসের আবহ, সীমাহীন স্বজনপোষণ, গ্রামেগঞ্জের নেতাদের অনৈতিকতা, নেতামন্ত্রীদের সংগ্রাম-বিমুখতা, শিক্ষা-স্বাস্থ্যের হাল ফেরাতে না পারা – মানুষ সত্যি বদল চেয়েছিল। এই বদল ঘটানোর জন্য যতটা না মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে সমগ্র বিরোধী জোত দায়ী, তার চেয়ে অনেক বেশি দায়ী বাম-সরকার নিজে এবং বামদলগুলি। মানুষ যতটা না মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ক্যারিশমা দেখে ভোট দিয়েছে, তার চেয়ে বেশি ভোট দিয়েছে যে ভাবে হোক এই সরকারের বদল চেয়ে।

তবু, অবস্থা বোধহয় এর চেয়ে কিছুটা ভালো ছিল। মোটামুটি একটা গণতান্ত্রিক আবহ ছিল। যে রাজ্যে মুখ্যমন্ত্রীর চেয়ারে বসে গেছেন বিধান রায়, প্রফুল্ল সেন, অজয় মুখোপাধ্যায়, সেখানে জ্যোতি বসু, এমন কী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য পর্যন্ত বেমানান মনে হয়নি। যে রাজ্যে রাজনীতি করে গেছেন চিত্তরঞ্জন দাশ, সুভাষচন্দ্র বসু, উমেশ ব্যানার্জী, বিধানচন্দ্র রায়, মুজাফ্‌ফর আহ্‌মেদ, প্রমোদ দাশগুপ্তের মত রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব – সেখানে অশোক মিত্র, বিনয় কোঙার, সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়, অরুণাভ ঘোষ, তথাগত রায় পর্যন্ত তবু চলে যায় – কিন্তু তারপর যা পড়ে রইল, এই বাংলার বরাবরের রাজনীতির সভ্য, মার্জিত, সংস্কৃত রূপের আবহমান ধারাটি তারা তছনছ করে দিলেন।

এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই দক্ষ দাবাড়ুর মত মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মরণ-পণ চালের কাছে, কূতনীতির কাছে, রাজনীতির কাছে চালবাজির কাছে বামদলের পোড়খাওয়া দক্ষ রাজনীতিক বাহিনী হেরে গেছে। কিন্তু আবারও বলছি, নেত্রীকে তার কাজের জন্য কৃতিত্ব দিলেও, ক্ষেত্র বামসরকার এবং পার্টিই তৈরি করে দিয়েছিল তাদের অবিমৃষ্যকারিতা দিয়ে। বোঝেনি, এক একটা দাম্ভিক উক্তি জনমানসে কেমন বিরূপ প্রতিক্রিয়া তৈরি করতে পারে। বুমেরাং হয়ে ফিরে আসতে পারে একদিন দু’শো পঁয়ত্রিশ আর পয়ঁত্রিশের তুল্যমূল্য অহংকারী ঘোষণা। 

বাম-সরকার আর পার্টি সমার্থক হয়ে গিয়েছিল। সরকারি আমলাদের অপদার্থতা, নৈতিক স্খলন, জমি অধিগ্রহণের নীতি, অন্যান্য কিছু ভুল সরকারকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়ার কথা ছিল পার্টির। ভুল সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করার কথা ছিল পার্টির। ছোট শরিকরা দু’একবার মিঁউ মিঁউ করেছে, তাতে কোনও কাজ হয়নি। মার্ক্সবাদী কম্যুনিস্ট পার্টি কেন তখন সরকারের সমালোচনা করল না। তারাও কি চেয়েছিল ভুলটা ধামাচাপা দেওয়া যাক। কেন সরকারের সব সিদ্ধান্তকেই অন্ধের মত সমর্থন করে গেল। কেন সরকারকে সাবধান করেনি অসাধু আমলা, ধান্দাবাজ ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে। “ওরা আমাদের সমর্থক”—এই যুক্তির কাছে মাথা নুইয়েছে পার্টি। শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে চাপ দেয়নি কেন। বিশেষত শিক্ষার ক্ষেত্রে অনেক জনসমর্থন বিরোধী সরকারি ফরমানকেই সমালোচনা না করে স্বাগত জানিয়েছে। ক্ষেত্র সরকার এবং পার্টি, উভয় মিলেই তৈরি করে দিয়েছিল কোনও এক মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্য। ‘কোনও এক’ বললাম এই জন্য যে, তিনি যে কেউ হতে পারতেন। মমতা, প্রমিতা, অমল, বিমল বা ইন্দ্রজিৎ। পড়ে-পাওয়া ঘুঁটিগুলো চমৎকার সাজিয়েছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কুড়িয়ে-পাওয়া সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে তার মত কূটবুদ্ধিসম্পন্না রাজনীতিকের অসুবিধা হয়নি। সমস্ত পরিবেশ কার্যকারণযোগে দশচক্রে ভগবান ভূত হওয়ার মত তার অনুকূলে এসে গিয়েছিল। প্রবল একটা হাওয়া উঠেছিল পরিবর্তনের। ঝড়ের মুখে খড়কুটোর মত উড়ে গেল কয়েকটা দীর্ঘযুগ। লক্ষ মানুষের কান্নাঘামরক্ত দিয়ে তৈরি একটা দল। আবার যদি এই পার্টিকে উঠে দাঁড়াতে হয়, তবে মুখ থেকে কোকের বোতল সরিয়ে, আমেরিকা-আলবেনিয়া-কিউবার কথা ভুলে রংপুর থেকে আসা লুঙি পরে অবিরত সাইকেল চালিয়ে গ্রামে-গ্রামান্তরে ঘুরে সংগঠন গড়ে তোলা আরও অনেক বলরাম সাহা, কেষ্ট দাস, অমৃত মুখার্জী, স্বদেশ পাল, ভোলা মুখার্জীর দরকার। আবার যদি গ্রামে গ্রামে ঘুরে জনসংযোগের মাধ্যমে গণসংগঠন গড়ে তোলা যায়, যদি তাঁদের মত জাগতিক সুখদুঃখের বিলাসিতা ভুলে শুধুমাত্র আদর্শের জন্য এগিয়ে আসতে পারে নতুন একটা প্রজন্ম, তবেই হয়তো পার্টি আবার উঠে দাঁড়াতে পারবে।

কিন্তু মুশকিল আছে। সেই সময় পক্ষে কতগুলো সমীকরণ কাজ করেছিল। তেভাগা আন্দোলনের টাটকা স্মৃতি, তার অভিজ্ঞতা, দেশ ছেড়ে এসে নতুন ইহুদি হওয়ার মানসিক যন্ত্রণা, ফলে প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ক্ষোভ – সহজেই দানা বেঁধেছিল কৃষক আন্দোলন, শ্রমিক আন্দোলন, খাদ্য আন্দোলন। শহর জনজোয়ারে উত্তাল হয়ে উঠেছে সরকারবিরোধী আন্দোলনে। তাকে যোগ্য সহযোগিতা করে গেছে বামপন্থী, প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক কার্যক্রম। গানে, নাটকে, চলচ্চিত্রে, সাহিত্যে মুখর হয়ে উঠেছিল মানুষের প্রতিবাদের ভাষা।

বাম আমলের ‘ধীরে খাও, দিয়ে খাও’ নীতি রাতারাতি পালটে গেল। শুরু হ’ল অন্য কায়দায় শাসন। প্রতিবাদের মুখগুলোকে চুপ করিয়ে রাখার জন্য সরাসরি শাসানি। কেউ সরকারের সমালোচনা করবে না, কেউ কোনও সামাজিক অন্যায়ের প্রতিবাদ করবে না, কেউ নারী নিগ্রহের প্রতিবাদে পথে নামবে না, চাষিরা ন্যায্যমূল্যে সার পাচ্ছে না কেন – কেউ সে প্রশ্ন করবে না, কেউ কোনও অস্বস্তিকর প্রশ্ন তুলবে না।করলেই তুমি মাওবাদী, করলেই তোর বাপ সিপিএম ছিল, করলেই সরকারকে হেয় করার চক্রান্ত, করলেই নাশকতার ষড়যন্ত্রের তত্ত্ব খাড়া করা হতে লাগল। এমন কী – রাশিয়া, স্পেন, ইটালির কথা মনে পড়ে – নির্দোষ রসিকতার মূল্য চোকাতে হ’ল অধ্যাপককে।

বাম শাসনের অবসান চেয়ে, পরিবর্তনের ডাক দিয়েছিলেন রাজ্যের শিল্পীসাহিত্যিক, কলাকুশলীদের এক বৃহদংশ। খুব প্রভাবিত হয়েছিল শহুরে নাগরিক। নন্দীগ্রামে গুলিচালনার প্রতিবাদে পথে নেমেছিল সহস্র সাধারণ মানুষ। আমিও হেঁটেছিলাম। কিন্তু খুব আশ্চর্যের বিষয়, পরবর্তীতে সরকারের কোনও অন্যায় সিদ্ধান্ত, নেতামন্ত্রীদের অনৈতিক কার্যকলাপ, পথেঘাটে নেতামন্ত্রীদের ঔদ্ধত্য, সিন্ডিকেট-প্রোমোটাররাজ –এসব দেখাও এরা কাঠপুতুলের মত নির্বাক রইলেন। প্রতিবাদে পথে নামলেন না। অথচ, পূর্ববর্তী সরকারের এই ধরণের অনৈতিক ক্রিয়াকলাপ নিয়ে এরা চ্যানেলে চ্যানেলে মুখর হয়ে ছিলেন। এদের কারও গলা দিয়েই প্রতিবাদের কথা উচ্চারিত হ’ল না। কোন এক অদৃশ্য বন্ধনীতে এদের ঠোঁট বন্ধ রইল। কে জানে, কোথায় বন্ধক দিয়ে রেখেছেন নৈতিক শক্তিটুকু। অন্যায়কে অন্যায় বলার সৎসাহসটুকু।

প্রসঙ্গত বলা ভালো, দিনবদলের ডাক-দেওয়া সেই সব বুদ্ধিজীবীদের অনেকেই পরে বিভিন্ন ভাবে রাজানুগ্রহ লাভ করেছেন। সাংসদ, মন্ত্রী, বিভিন্ন কমিটির চেয়ারম্যান, প্রেসিডেন্ট, উপদেষ্টামণ্ডলীর সভ্য। অনুগত লেখক-শিল্পীরা পেয়েছেন সরকারি খেতাব। বিভিন্ন ভূষণে ভূষিত হয়েছেন তারা।

২০১১-এর পালাবদলের পর সরকারের কাজকর্মের খতিয়ান নিলে দেখা যাবে কাজ কিছু হয়নি, তা নয়। অনেক কাজ হয়েছে। সেটাই তো স্বাভাবিক। রাজ্যের উন্নয়নই তো সরকারের প্রধান লক্ষ্য হওয়া উচিত। কিন্তু অনেক কেন্দ্রীয় সরকারের প্রোজেক্ট তাদের টাকায় সম্পন্ন হলেও গ্রামেগঞ্জের সাধারণ মানুষের ধারণা এটা এই সরকার করে দিয়েছে। গ্রামগঞ্জের সাধারণ অশিক্ষিত মানুষ তো দূরের কথা, শহুরে শিক্ষিত মানুষের ক’জন খবর রাখেন কোন কাজ কোন সরকারের। বিরোধী দলগুলোর এমন ছন্নছাড়া অবস্থা, সত্যিমিথ্যেটুকুও তারা সঠিক ভাবে প্রচার করতে পারে না। মাঝে নেপোয় দই মেরে চলে যায়। কাজ হয়েছে। গ্রামেগঞ্জে যোগাযোগের ব্যবস্থার অনেক উন্নতি হয়েছে। দু’টাকার চাল, কন্যাশ্রী, সাইকেল – যে কথা ভেবে এসব প্রকল্প চালু করা হয়েছিল, সেটা সম্পূর্ণ সফল। প্রতিটি প্রকল্পের পেছনে সুদূরপ্রসারী ভাবনা কাজ করেছে। প্রগতির ফলের কথা ভেবেই উন্নয়নের কাজ হয়েছে, অন্তত কিছু ক্ষেত্রে তো বটেই। তবু বলব, চুরিচামারির ভেতরেও কিছু কাজ হয়েছে।

এ রাজ্যে রাজনীতির একটা সুষ্ঠু পরিমণ্ডল ছিল। যার যে রাজনৈতিক আদর্শ পছন্দ, সে সেই রাজনীতি করেছে। রাজনৈতিক ভাবেই চাপান-উতোর চলেছে। আমার এই প্রায় সত্তর বছর বয়সে এসে এই প্রথম দেখলাম নোংরা, কুৎসিত ভাষায় বিরোধী পক্ষকে আক্রমণ। তবে এ ব্যাপারে প্রগতিশীল বামেরাও পিছিয়ে নেই। তাদেরও অতীত এবং বর্তমান রেকর্ড ভালো নয়। ভাবতে অবাক লাগে একদিন এ রাজ্যের ইন্দ্রজিৎ গুপ্ত, সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়ের মত বাগ্মী সাংসদের ভাষণ শুনে মুগ্ধ হয়েছে বিরোধী নেতারাও, হাততালি দিয়ে অভিনন্দন জানিয়েছে, আজ সেই পার্লামেন্টে পশ্চিমবঙ্গের সাংসদরা মাথায় কলসি, হাতে কুলো, কাঁখে কয়লায় ঝুড়ি নিয়ে ধরণা দিচ্ছে। সাংসদ বলছে – ঘরে ছেলে ঢুকিয়ে রেপ করিয়ে দেব। এ কোথায় নেমেছে রাজনীতি। এমন দেউলেপনা, এমন রুচিহীন, বিকারগ্রস্তের মত রাজনীতি করছে সুস্থ সংস্কৃতির পীঠস্থান পশ্চিমবঙ্গ। সরকারি বুদ্ধিজীবীর দল নিশ্চুপ। মুখে কুলুপ। অনেকে আবার কুযুক্তি দেখিয়ে দোষ খণ্ডানোর চেষ্টা করে। চৌত্রিশ বছরের কথা বলে। যেন ‘ব’ চুরি করেছে, সুতরাং ‘ত’-এর চুরি আইনত সিদ্ধ হয়ে গেছে। একটা অন্যায়কে আর একটা অন্যায় দিয়ে জাস্টিফাই করার চেষ্টা।

এই মুহূর্তে পশ্চিমবঙ্গের অবস্থা ভালো নয়। খুব দ্রুত মেরুকরণ ঘটে যাচ্ছে। এই সরকারের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের প্রতি অতিরিক্ত নমনীয়তা, তোষণ-নীতি সাধারণ হিন্দু বাঙালি ভালো ভাবে নেয়নি। বিশেষত যাদের এখনও আপশোষ রয়েছে “ ওই পারে দালান, পুষ্কর্ণী, নাইহলের বাগান শ্যাখেরা ভোগ করতাসে”, যারা ঘরবাড়ি, ইজ্জৎ, সব হারিয়ে এখানে আবার শিকড় বসাতে চেয়েছেন এটাই তাদের প্রকৃত স্বদেশ – এই ভাবনায়, বুকে এখনও দগদগে স্মৃতির ক্ষত, তারা ব্যাপারটা একেবারেই পছন্দ করেনি। এই প্রথম বোধহয় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় একটা ভুল হিসেব করে ফেললেন।

সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ধর্মীয় নেতাদের উদ্ধত জবান, দু’একটি জায়গায় উৎসব নিয়ে অশান্তি – কড়াহাতে দমন করার ব্যাপারে দ্বিধাগ্রস্ত হয়েছেন তিনি। পূর্ববর্তী একজন মুখ্যমন্ত্রীর মত বলতে পারেননি – এ রাজ্যে দাঙ্গা করতে এলে মাথা গুঁড়িয়ে দেওয়া হবে। সাম্প্রতিক কালে দু’ সম্প্রদায়ের ভেতরে এ রকম অবিশ্বাসের আবহ এর আগে আমি দেখিনি। কাজচালানো গোছের যে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানটুকু ছিল, সেটাও বিলীন হয়ে যাচ্ছে। এ বড় সুখের সময় নয়। এখন যা দেখা যাচ্ছে, তা সত্যি উদ্বেগের কথা। সাধারণ, মধ্যবিত্ত বাঙালি ভয় পেয়েছে। এবং আরও ভয়ের কথা এই ভয় থেকে উত্তরণের জন্য যার অভয়বাণী দেবার কথা, তিনি আশ্চর্যজনক ভাবে নীরব রইলেন। সমস্ত পৃথিবীতে যখন ইসলাম জগতে নারীমুক্তি আন্দোলন ক্রমশ জোরদার হয়ে উঠছে, আধুনিক প্ররথিবীর দিকে তাকাবে বলে তারা বোরখা ছেড়ে মুক্ত অক্সিজেন নিতে চাইছে, তিন তালাকের মত একটি নিষ্ঠুর ও পুরুষতান্ত্রিক নিয়মের শৃঙ্খল থেকে বাইরে বেরিয়ে আসতে চাইছে, তখন আমাদের সরকারের প্রতিনিধি সেই তিন তালাকের সমর্থনে বলছেন – কে কার সঙ্গে থাকবে, সেটা তারাই ঠিক করুক। এ যেন শাহবানু মামলায় রাজীব গান্ধীর ভূমিকারই নব্য-সংস্করণ। আলমদুলিল্লাহ্‌।

এ সব ধর্মীয় নেতারা সাধারণ আতরাফ শ্রেণির নিম্নবর্গীয় মুসলমান নয়। এরা বহিরাগত আশরাফ শ্রেণির। সাধারণ খেটে-খাওয়া মুসলমানদের ওপর হয়তো এদের বিরাট প্রভাব আছে, সরকারি পলিসি বোধহয় সে রকমই ভেবেছিল। তাই এদের বেয়াড়াপনা দেখেও প্রশাসন আশ্চর্যজনক ভাবে নীরব থেকেছে। আর সেখানেই ভুল বার্তা গেছে। এখন দেখা যাচ্ছে প্রচুর সাধারণ মুসলমান এ সব ফতোয়া অস্বীকার করছে। বলছে, এ সবের সঙ্গে তাদের কোনও সম্পর্ক নেই। বলছে – বরকতি হুজুরের কথা আমাদের কথা নয়। উনি এ রাজ্যের সবশ্রেণির মুসলমানের প্রতিনিধি নন। আর এখানেই বর্তমান সরকার একটু থমকে গেছে। তা হলে কি কিছু ভুল হ’ল। একে তো এক রকম হিসেব কষে ধর্মগুরুদের প্রতি নমনীয়তা দেখানো হয়েছে, তাদের নানারকম সুবিধা পাইয়ে দেওয়া হয়েছে। এখন দেখা যাচ্ছে এই ধর্মগুরুদের কথাই শেষ কথা নয়। মুসলিম সমাজে মুক্তচিন্তার মানুষও প্রচুর রয়েছে। আবার, এদের প্রতি নমনীয় থাকতে গিয়ে খুব দ্রুত একটা ভাঙন ধরে গিয়েছে। খুবই ভয়ের এবং আশঙ্কার কথা দ্রুত মেরুকরণ ঘটছে পশ্চিমবঙ্গে। নিরপেক্ষ বাঙালি রামনবমীর মিছিল দেখে খুশি হচ্ছে। হাটেমাঠে, চায়ের দোকানে কথা বলে বুঝেছি যত লোক মিছিলে ছিল, তার অন্তত একশ গুণ লোক এই মিছিলকে সমর্থন করেছে। এ কী অশনিসংকেত নয়।

ইদানীং শুরু হয়েছে এ রাজ্যে বসে কিছু ধর্মীয় নেতার ‘ফতোয়া’ দেওয়ার আস্ফালন। আমরা, যারা বাংলার আবহমান ভাষা-সংস্কৃতির সঙ্গে আবাল্য পরিচিত, তারা 'ফতোয়া' শব্দটি ক্বচিৎ শুনেছি। পির, ফকির,ইমাম, মহরম, আজান, কোরান,ইদ, ইফতার, সালাম অনেকটাই হিন্দু বাঙালির গ্রহণীয় হয়ে উঠেছে। কিন্তু 'ফতোয়া' কখনওই হয়নি। এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই হিন্দু সমাজেও ফতোয়া ছিল, অন্য নামে। ব্রাহ্মণ্য ধর্মের বাড়বাড়ন্তের সময় উচ্চবর্ণের মানুষ তুচ্ছ অপরাধেই নিম্ন বর্ণের মানুষকে বিধান দিয়ে জাতিচ্যুত করেছে, সমাজ থেকে তাড়িয়ে দেবার ফরমান জারি করেছে। রামমোহন, বিদ্যাসাগর, আরও অনেক সমাজ সংস্কারকদের যুদ্ধের ফলে এবং, অবশ্যই ডিরজিওপন্থী নব্যযুবাদের আধুনিকতা, ইংরেজি শিক্ষা গ্রহণে হিন্দুদের এগিয়ে আসা ইত্যাদি কারণে উচ্চবর্ণের মানুষদের সেই বিধান দেবার প্রবণতা ক্রমশ কমে যায়। ধর্মের কড়া কানুনের শৃঙ্খলা অনেকটাই শিথিল হয়ে যায়। মুক্ত চিন্তার প্রসার ঘটে হিন্দু বাঙালিদের ভেতরে। 
" ফতোয়া" ইসলাম শাস্ত্রসম্মত রায় বা নির্দেশ। ফতোয়ার প্রয়োজন পড়ে তখনই, যখন কোনও ব্যক্তি বা কোনও বিচারক কোরান বা হাদিস থেকে প্রাপ্ত শরিয়ত বা ফিকাহ্‌ গ্রন্থগুলিতে উদ্ভূত সমস্যার সন্তোষজনক সমাধানে পৌঁছতে পারেন না। ইসলামের আদি পর্ব থেকে ইমাম ও মুফ্‌তিদের দেওয়া বহু ফতোয়া সংগৃহীত হয়েছে। সেগুলিই ফিকাহ্‌ নামে পরিচিত। সাধারণ ভাবে একজন মুফ্‌তি ফতোয়া দেওয়ার অধিকারী।এই বিংশ শতাব্দীতেও কোনও কোনও মুসলিম রাষ্ট্রে ইসলামি ধর্মশাস্ত্রের পণ্ডিতদের নিয়ে ফতোয়া কমিটি গঠন করা হয়। ওই সব দেশে প্রচলিত আইনের পাশাপাশি ফতোয়াও কার্যকর হয়। কিন্তু গণতান্ত্রিক দেশে ফতোয়াকে নিছক ধর্মীয় অভিমত হিসেবে দেখা হয়। স্বাভাবিক ভাবেই তার কোনও আইনি বা সাংবিধানিক গুরুত্ব নেই। ভারতে তো নয়ই, বাংলাদেশের মত মুসলমান-প্রধান দেশেও ফতোয়াকে অসংবিধানিক বলে ঘোষণা করা হয়েছে। তা সত্ত্বেও দুই দেশেই ফতোয়া দেওয়ার প্রবণতা বন্ধ করা যায়নি। এ দেশে বেশির ভাগ ফতোয়া দিয়ে থাকেন দারুল উলুম দেওবন্দের মুফ্‌তিরা। সেই ফতোয়া ে দেশের মুসলমানেরা কতটা গ্রহণযোগ্য মনে করেন, তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহের অবকাশ রয়েছে। ২০০৭ সালের জুলাই মাসে দেওবন্দের এক মুফতি ছেলেমেয়েদের একই স্কুলে পড়া নিষিদ্ধ করে ফতোয়া দেন। তার কয়েক মাস আগেই মুসলমানদের জন্য জীবন বীমা বে-আইনি ঘোষণা করে ফতোয়া জারি হয়। তারও আগে উত্তরপ্রদেশের একটি গ্রামে ইমরানা নামের এক মহিলাকে তাঁর শ্বশুর ধর্ষণ করলে ওই মাদ্রাসা থেকে ফতোয়া দেওয়া হয় ইমরানা আর তার স্বামীর সঙ্গে বাস করতে পারবে না। নারীদের বিরুদ্ধে ফতোয়া জারির প্রবণতা বেশি। নারী নিজের অধিকারের জন্য যত সচেতন হচ্ছে, এই ধরণের ফতোয়া তত বাড়ছে। ধর্মের সঙ্গে নারী-প্রগতির সঙ্ঘাতের ফলেই ফতোয়ার প্রবণতা বাড়ছে। (চলতি ইসলামি শব্দকোষ, মিলন দত্ত)
সাত আট'শ বছর ভারত শাসন করেছে বাঙালি মুসলমান নয়, বিদেশি মুসলমান। তাঁদের উত্তরপুরুষদের রক্তে এখনও সেই অহংকার রয়েছে। ক্ষোভ রয়েছে এখন পরাধীন হয়ে থাকার। বিদেশাগত উচ্চবর্ণের আশরাফ এরা। সৈয়দ, শেখ, মুঘল, পাঠান। ভারতের সঙ্গে বার বার যুদ্ধে এরাই জয়ী হয়েছেন, বিজিতের ভূমিতে বসবাস করেছেন যাঁরা ফিরে যাননি। এদের অর্থের জোর ছিল। বড় বড় শহরে এরা স্থায়ী ভাবে কায়েম হ'ন। তা ছাড়া উচ্চবিত্ত আমির-ওমরাহ্‌, নবাববংশের উত্তরাধিকারীরাও নগরেই থিতু হ'ন। কলকাতার কথাই যদি ধরা যায়, এদের ভেতরে অনেক রকম মানসিকতা কাজ করেছে। শহরে সংখ্যালঘু হওয়ার জন্য জোট বেঁধে থাকার প্রবণতা (প্রাণীমাত্ররই এই প্রবণতা থাকে), অপ্রয়োজনেও আস্ফালন করে পায়ের তলার মাটি শক্ত করা, ধর্মের কড়া অনুশাসনে নিজের কৌমকে সংগঠিত করা রাখা, ভোটার হিসেবে যতটা পারা যায় সুবিধা উসুল করে নেওয়া। এবং পূর্বপুরুষের সংস্কৃতিকে হারিয়ে যেতে না দেওয়া। 
এরা বাদেও এক বিশাল সংখ্যক মুসলমান রয়েছে পশ্চিম বাংলায়। রয়েছে শিক্ষিত এবং প্রকৃত অর্থেও আলোকপ্রাপ্ত, আধুনিক-মনস্ক মুসলমান। এরা আজ এই সব মৌলবি, মুফতি, বরকতিদের সামাজিক সর্দারি সরাসরি অস্বীকার করছেন। হয়তো একদিন সত্যি আমাদের দেশের মুসলমান সমাজ পরিপূর্ণ ভাবে আধুনিক হয়ে উঠবে। মনুষ্যত্বের পক্ষে, ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে ওরাই স্বর তুলবে। ইমামভাতা নয়, চাই আরও আধুনিক শিক্ষা, চাই আরও স্বাস্থ্য নিকেতন। কয়েক জন ধর্মগুরুর নির্দেশ এই বাংলার সমগ্র মুসলিম সমাজের কণ্ঠ নয়। ("ধর্মীয় মেরুকরনের সঙ্গে সঙ্গে সাংস্কৃতিক মেরুকরণও হচ্ছে। পশ্চিম বাংলাতে মুসলমান সমাজের অধিকাংশ বাঙালি। কিন্তু যে ইসলামিক আচার আমরা দেখি তা কিন্তু বাঙালি মুসলমানেরা পালন করেননা। বাঙালি হারিয়ে না যায়।" -- আরিফ আহমেদ।)

এক ক্রান্তিকারী সময়ে বসে আছি। আগের সরকারের অবিমৃষ্যকারিতার ফল ভালোমন্দ মিশিয়ে ভোগ করছি, কিন্তু এই সরকারের অবিমৃষ্যকারিতার ফল আরও খারাপ হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। কী করতে পারি আমরা ?

মনুষ্যত্ববোধের অহংকার মানুষকে প্ররোচিত করে যে কোনও রকমের ভাঙন, যা তার এবং তার প্রজাতির অস্তিত্বকে বিপন্ন করে তুলতে পারে – তার বিরুদ্ধে দাঁড়াতে। বিভিন্ন জনের ক্ষেত্রে প্রতিক্রিয়া বিভিন্ন হয়। কেউ ওয়ার অ্যান্ড পিস লেখেন, কেউ কমোডে বসে মেঝেয়ে থুথু ফেলেন, কেউ গেয়ে ওঠে উই শ্যাল ওভারকাম, কেউ রিকশাওয়ালা পেটায়, কেউ ডেপুটেশন দেয়, কেউ পুলিশকে খিস্তি দেয়, আবার কোনও কবি বন্দুক হাতে গ্রানাডা পাহাড়ে চলে যান তবে সব কিছু এত সহজে হয় না। রক্তে বিরুদ্ধগতির প্রবাহও থাকে। অনেক প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবীও পাকিস্তানের সঙ্গে খেলা থাকলে এক্সট্রা উত্তেজনায় জারিত হ’ন। কোথা থেকে আসে এই এক্সট্রা ? এও কভারেজ। রাষ্ট্র বা তার নিজের অস্তিত্বের সংকটের বিরুদ্ধে এক রকম ডিফেন্স মেকানিজম্‌। এক ধরণের পোকা আছে, বিপদ দেখলে দুর্গন্ধময় রস ছড়ায়।

মানুষ নামক জটিল প্রাণী অসীম অনন্ত এক রহস্যে মোড়া। আপাতভাবে মনে হয় শান্ত নদীর জল। কিন্তু অনেক চোরাপাথর, মগ্নমৈনাক থাকে জীবনের গভীরে। রহস্যের গোপন কন্দরে ডুবে থাকে সেই সব ডুবোপাহাড়। অসীম বিশ্বাস ও কোটি টাকার অহংকারী টাইটনিকও ডুবে যায় কত সহজে।

বয়স যখন সত্তরের দিকে ঢলে পড়েছে, যখন ভবিষ্যৎ বলে আর কোনও উজ্জ্বল আকাশ নেই, তখন বারে বারে পেছন ফিরে দেখা ছাড়া আর কিছু থাকে না। তবু বর্তমানও নাছোড়বান্দা নীল ডুমো মাছির মত বিনবিন করতে থাকে। লিখি, পুরনো দিনের কথা। আমার বাল্যের মহানন্দা, কৈশোরের শিলিগুড়ি, যৌবনের টালমাটাল সময়ের কথা। প্রথম প্রেমিকার অকাল-মৃত্যু ও এখনও তার স্বপ্নে আমার অশ্রুপাত।

“শিকড়ের ডানা হোক, ডানার শিকড়” --- হুয়ান রামোন হিমেনেথ।

(শেষ)

0 comments: