1

গল্প - স্নেহাশিস ভট্টাচাৰ্য্য

Posted in

গল্প


দৃশ্যান্তর
স্নেহাশিস ভট্টাচাৰ্য্য


চোখে মুখে জলের ঝাপটা আর অনেক ধরণের শব্দের মাঝে চোখ মেললো অরণ্য। অনেক অচেনা মুখের ভিড়ের ভিতর থেকে চোখে পড়লো একটা আবছা হয়ে যাওয়া চেনা মুখ। ঠিক লাগছে একটু? গলার আওয়াজটা বুকের ভিতর গিয়ে পৌঁছলো।

রোজকার জীবন যাত্রায় টালিগঞ্জ মেট্রো স্টেশন, মেট্রো ধরে একদম শেষ প্রান্তের আগে, দমদম। ওখানে নেমে অটো ধরে একটুখানি অরণ্যের গন্তব্য। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রছাত্রীদের সাথে আজ নয় নয় করে ১৮ বছর। অকৃতদার, সুদর্শন ইতিহাসের অধ্যাপক। রোজকার পথ, ৮বি থেকে অটো ধরে টালিগঞ্জ মেট্রো। কিন্ত হঠাৎই চোখে অন্ধকার আর বাকিটা পরীর মুখে শোনা। 

রাণীকুঠি, ওর বাড়ী থেকে ফিরছিল ও, হঠাৎই জনতার চিৎকারে বরাবরের কৌতূহলী মন উঁকি মারে কি হয়েছে দেখতে। তারপর বহু বছরের অদর্শনের পরেও চিনতে ভুল হয় না অরণ্যদাকে।
নিজেই এগিয়ে এসে পুলিশ আর বাকিদের সাহায্য নিয়ে জল, জলের ঝাপটা, তারপর জ্ঞান এলে নিশ্চিন্ত। গরম কফির মগটায় চিনি দিয়ে হৃদয়ের চিহ্ন এঁকে এগিয়ে দিতেই দুজনেই হেসে ফেলল। অনেক বছর পর সিসিডি।

ওখান থেজে বেরিয়ে গল্ফ কোর্স রোড ধরে যেতে গেলে রাস্তার ডান দিকে। ওরা বাইরেই বসেছে, অরণ্য সিগারেট ধরাবেই। 
কফির কাপে চুমুক দিয়ে সত্যিই ভাল লাগলো।
কি হলো জীবনে কোন টেনশন? নাকি সত্যি কোন অসুবিধা? জিজ্ঞেস করলো ও
আগে মনে আছে খুব টেনশনে তোমার এইরকম হতো। বয়েসটা অনেক বেড়েছে সোনু, ক্ষনিকের নীরবতা। নিজের অজান্তেই এই সম্বোধনটা গলা, আলজিভ, তালু, দাঁত, জিভ হয়ে বেরিয়ে এলো অরণ্যের।
অরণ্য জানতে চাইলো পরীর খবর। পরী আজ এক সন্তানের মা। নিজেও কর্মরতা বেসরকারি ব্যাংকে। ও এখন লেক টাউনের বাসিন্দা।

কত দিন পরে তোর সাথে দেখা হলো, কিন্ত অদ্ভুত এক পরিস্থিতিতে। কত দিন পরে বলো তো? অরণ্য মৃদু হাসি হেসে বলে ঠিক ঠাক বলতে গেলে ২১ বছর ৬ মাস ২১ দিন। স্যান্ডউইচ আর গার্লিক ব্রেড দুটোই এসে হাজির। পরী একটু চুপ করে থাকে। অরণ্য ধীরে সুস্থে চুমুক দেয় কফির কাপে। তুই অবিকল একই আছিস। পরী বলে ওঠে, মেঘে মেঘে অনেক বেলা হলো। না রে আমি সেই একই রকম বলিনি। ওগুলো তো তোর স্তাবকের দল বলবে। আগেও শুনেছি। বললাম সেই একই রকম ভাবলেশহীন তুই। কোনো কিছুই দাগ কাটে না, আবার ফোঁস করতেও ছাড়বি না। তোমার এখনো কত অভিযোগ না অরণ্যদা? মৃদু হেসে গার্লিক ব্রেডে একটা কামড় বসায় পরী। স্যান্ডউইচটায় অল্প সস লাগিয়ে এগিয়ে দেয় মুখের কাছে, সেই ২৩ বছর আগের মতোই বেশ খানিকটা মুখে নেয় অরণ্য, বলে জানিস আমি আজ ও হাত দিয়েই খাই। জানি, যার ৯য়ে হয় না তার ৯০তেও হবে না। বেশ জোরেই হেসে ওঠে ওরা। গোল্ড ফ্লেকে আগুন ধরিয়ে অনেকটা ধোঁয়া বুকের ভিতর নিয়ে ফুসফুসটাকে আরো একটু বিব্রত করে অরণ্য। এটা আর ছাড়া গেল না? ধরলাম আর কৰে যে ছাড়বো? আমি তো জীবনে কিছুই ধরলাম না পরী। ও, সংক্ষিপ্ত উত্তর পরীর। তা প্রেসারটা একবার মাপালে কি খুব ক্ষতি হয়ে যাবে? নাঃ তা হবে না। ফেরার পথে ডাক্তার দেখিয়ে নেবো একবার। মাসিমা কেমন আছে গো? মা ভালোই আছে রে। বয়েস বাড়লেও মা কিন্ত সক্ষম। তোর কথা বল। তোর ছেলে না মেয়ে? একটাই মেয়ে। ক্লাস এইট। বাঃ। এই দেখো ও, মোবাইলের স্ক্রিন সেভারে ছোট্ট পরীর মুখ ভেসে ওঠে। এ তো অবিকল তুই রে। সবাই তাই বলে। পরীর চোখে তৃপ্তির ছাপ স্পষ্ট। খুব মিষ্টি রে ও। এক মিনিট, অরণ্য ওর ব্যাগ খুলে বের করে আনে একটা ফাউনটেন পেন। ভারী সুন্দর দেখতে। এটা ওকে দিস। ও তো খুব পেন ভালোবাসে গো। এটা ওকে দিস বলিস অনেক ঘষা খেয়েও এ মুক্তি পায়নি, আজ বোধ হয় পেলো। 
এখনো লেখো? চুপ করে ঘাড় নাড়ে অরণ্য। লিখি না, রক্তক্ষরণ হয়। পরীর পরণে আজ সাদা ঢাকাই, কপালে টিপ, ঘামে ভেজা মুখ আর কপাল এসির ঠাণ্ডায় শুকিয়ে গেছে। নাকে হীরের একটা নাকচাবি, ডান হাতে ভারী ডায়ালের ঘড়িটার রং লাল, লাল কালো ব্লাউজের সাথে মিল রেখে। খুব মন দিয়ে পরীকে দেখছিল অরণ্য। কি দেখছ? আজ ড্রেস কোড ছিল। কাল ২৬ শে জানুয়ারী। তাই শাড়ী। অরণ্য উত্তর দিলো না, আর একটা সিগারেট ঠোঁটের কোণে জ্বলে উঠেছে। 

ঘড়ি দেখে পরী, ৭ টা বেজে ১০ মিনিট। মেয়েটাকে আনতে হবে গো, এবার উঠি? কিসে যাবি? উবের পুল করে নেব। চল যাই তোর সাথে, একা ছাড়বো না। তুই সেই ঘড়ি মিলিয়ে চলিস এখোনো?
চল ওঠ। চিন্তা নেই আগেই নামবো। এখান থেকে তো আধ ঘন্টা লাগবে। পরী কোন কথা বলে না। উবের বুক করে। 4 মিনিট, সুইফট ডিজ্যার। বাইরেটা বেশ লাগছে অনেক দিন পরে। হাতের নিচটা হঠাৎ একটু জ্বালা করে উঠলো। পড়ে গিয়ে কেটে গেছে বোধ হয়। ঈষৎ অবিন্যস্ত অরণ্য অকারণেই নিজেকে একটু গুছিয়ে নেবার চেষ্টা করে। মাথার চুলগুলো খোঁজার বৃথা চেষ্টার পর জামার হাতগুলো সমান করে গুটিয়ে নেয়, চশমাটা মুছে নিতে নিতে উবের মুখ বাড়ায়। উঠে বসে ওরা, ২৩ বছর পর, একই সাথে, পাশাপাশি, অনেকটা ছোয়াঁ বাঁচিয়ে। ফোনটা বেজে ওঠে অরণ্যর। মা। হ্যাঁ মা আমার একটু দেরী হবে। চিন্তা করো না, আমি রুটি নিয়ে ফিরবো। পরীর চোখে একটা জিজ্ঞাসা। পড়তে পেরেও পাত্তা দেয় না অরণ্য। রাস্তায় আজ অদ্ভুতভাবেই প্রত্যাশিত জাম জট নেই। আধ ঘন্টার পথ কুড়ি মিনিটেই প্রায় এসে পড়ে ওরা। নেমে যাবার আগে সেই আগের মতোই টাকাটা ড্রাইভার সাহেবের হাতে ধরিয়ে দেয় ও। তাকিয়ে দেখে পরীর ফোনটা বাজছে স্ক্রিনে ভেসে উঠছে জয় জিও।

পরীর হাতের লেখায় ওর শরীরের গন্ধ পায় অরণ্য। আজ কতগুলো দিন পর পুরনো ডাইরির চারখানা পাতার একটা চিঠি বা অনুযোগ লাঘবের চেষ্টা। ওর হাতের লেখাটার দিকে একমনে চেয়ে ছিল অরণ্য, মোহাবিষ্টের মতো। চারিদিকটায় একটা ঝিমধরা সন্ধ্যা নামছে।
জানো অরণ্য, মনে হয় এই সেইদিনের ঘটনা। আমাদের কারণে অকারণে হেসে ওঠা, দুকূল ছাপানো ভালোবাসা, অনির্দিষ্ট হেঁটে বেড়ানো, সব, সব যেন সেই দিনের ঘটনা মনে হয়। খুব ইচ্ছে করে তোমার সাথে এক পাহাড় সময় কাটানোর ওই পাহাড়ী রাস্তাগুলোর হাত ধরে। তোমার কত অনুযোগ না? সেই আগের মত করে তুমি আমায় আর পাওনা বলে? আচ্ছা এত যে অবহেলায় ফিরিয়ে দিই তোমাকে তাও কি পারো না তোমার আমায় নিয়ে স্বপ্ন বোনাগুলো বন্ধ করতে?? 
আনমনা অরণ্য। লেখাটা পড়তে পড়তে চোখ বোজে ও। ট্যাক্সি থেকে নামার আগে পরীর কপালে একটা আলতো চুমু খায় ও। পরীও অপেক্ষায় থাকে বোঝে ও। তুমি কি আমায় আর বোঝো না পরী! তোমার সাথে সহস্র ঋতু সময় কাটাতে চাই। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কোনো বিকিকিনির হাটে নয়, রাস্তার কোনো অচেনা মোরাম কিংবা একচিলতে কোণ বা অচেনা কোনো বয়ে যাওয়া নদীর পাড়ে তোমার দিকে চেয়ে থাকবো চুপচাপ। তুমি আনমনা হয়ে অন্য কোন চাউনিতে। জানি পারো না আমার চোখে চোখ রাখতে। খুব অল্প সময়ে আমায় মুখর থেকে মুক করে তোলা তোমার বহু পুরোনো অভ্যাস। নীল শাড়িতে প্যাঁচানো তোমার শরীর, কাজলরঙা চোখে বার বার প্রেমে পড়ার গভীরতা আর ঠোঁটে জাহির করা চুম্বনের বিদ্রোহ, আমায় করে তোলে আদম আদিম। কপালে এসে পড়া চুলের গোছা আলতো হাতে সরিয়ে দিয়ে হাঁটতে থাকলে তুমি। তোমার সময় শেষ। এক নিরবিচ্ছিন্ন ভালোবাসা নিয়ে আমি বসে থাকি আবার তোমার সময়ের অপেক্ষায়। লিখে চলে অরণ্য। হাতে ধরা ২৩ বছর আগের এক বিকেলের গন্ধ মাখা চিঠি।
সমস্ত আবরণ আজ নিরাভরণ হয়ে পরীর সারা শরীরে মুক্ত হতে থাকে এক দৃশ্য থেকে আর এক দৃশ্যে।

1 comment: