ধারাবাহিক - সুজিত নারায়ণ চট্টোপাধ্যায়
Posted in ধারাবাহিকধারাবাহিক
এক কিশোরীর রোজনামচা - ৩২
সুজিত নারায়ণ চট্টোপাধ্যায়
Diary Entry - 31
17th. Noember, 1942, Tuesday
প্রিয় কিটী,
শেষ পর্যন্ত ড্যাসেল এসে পৌছিয়েছেন। আমাদের গুপ্তগৃহের সদস্য হয়েছেন। মোটামুটি সবকিছু পরিকল্পনা মত ভালই চলছে। মিয়েপ আগে থেকেই ড্যাসেলকে বলে এসেছিল, ঠিক বেলা এগারোটার সময় পোস্ট-অফিসের সামনে একটি বিশেষ জায়গায় দাঁড়াতে, এবং সেখানে অপেক্ষা করতে। ঔইখানেই ওর সাথে একজন লোক দেখা করবেন। এবং সে ও'কে বলে দেবে, কি করতে হবে। ড্যাসেল একদম ঠিক সময়ে পূর্বব্যবস্থামত পূর্ব নির্দিষ্ট স্থানে পৌছে যান, এবং দাঁড়িয়ে থাকেন। ঠিক সেই সময় মিঃ কোপহৌস, লম্বা পায়ে তাঁর কাছে হেঁটে গিয়ে, অকারণেই তার পাশে গিয়ে দাঁড়ান। মিঃ কোপহৌস আগে থেকেই মিঃ ড্যাসেলকে চিনতেন। তাই ড্যাসেলকে খুঁজে পেতে তাঁর কোন অসুবিধা হয় নি। মিঃ কোপহৌস তাঁর কাছে গিয়ে বলেন, “যে ভদ্রলোকের আসার কথা ছিল, তিনি বিশেষকাজে আটকে পড়েছেন, তাই আস্তে পারবেন না। তবে তিনি বলে পাঠিয়েছেন, "আপনি কি মিয়েপের অফিসে গিয়ে তার সাথে দেখা করতে পারবেন ?" ড্যাসেল সম্মতি দেওয়াতে, মিঃ কোপহৌস তাকে অফিসের ঠিকানাটা দিয়ে, লম্বা পায়ে এগিয়ে গিয়ে ট্রামে গিয়ে উঠে পড়েন। এবং নিজের গন্তব্য, অফিসের দিকে চলে গেলেন। অন্যদিকে ড্যাসেল ট্রামে না উঠে (ইহুদিদের দিনের বিশেষ সময়গুলোতে ট্রামে ওঠার অনুমতি ছিল না---- অনুবাদক), ট্রামটা যেদিকে গেল সেই দিকের রাস্তা ধরে হাঁটা শুরু করলেন। ঠিক বেলা এগারোটা কুড়ি মিনিটে ড্যাসেল অফিসের দরজায় এসে টোকা দিয়ে ভিতরের লোকের দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন। মিয়েপ এগিয়ে এসে ড্যাসেলকে অফিসের ভিতরে নিয়ে গেয়ে, তার গা' থেকে কোটটা খুলে দিলেন।(যাতে হঠাত করে অফিসে কেউ ঢুকে পড়লে, তাঁর কোর্টে হলুদ স্টারটা দেখে সন্দেহ না’করে)। আসল উদ্দেশ্য হল, হলুদ স্টারটাকে আড়াল করা। তারপর ড্যাসেলকে অফিসের ভিতরের দিকে ব্যক্তিগত অফিসে নিয়ে যাওয়া মাত্র মিঃ কোপহৌস তাঁর সাথে বিভিন্ন প্রাসঙ্গিক অপ্রাসঙ্গিক বিষয়ে কথা বলতে শুরু করলেন। কারণ তখন অফিসের ঠিকা কাজের মহিলা, অফিস ঘর পরিষ্কার করছিল। ঠিকা ঝি তার কাজ করে চলে যাওয়ার পর মিয়েপ এসে ড্যাসেলকে নিয়ে ওপরের তলায় কাজের অছিলায় উঠে গেলেন। তার যাওয়া দেখে এটাই মনে হতে পারে, যে, মিয়েপ ড্যসেলকে নিয়ে ওপরের তলার অফিস থেকে কিছু দরকারী জিনিষ আনতে যাচ্ছেন। তারপর হঠাতই ড্যাসেলের সামনে, একটু চাপ দিয়ে র্যাক/দরজাটা খুলে, ড্যাসেলকে নিয়ে ভিতরে ঢুকলেন। মিয়েপের ওপরে ওঠা, চাপ দিয়ে র্যাক/দরজা খোলা, সব শেষে ড্যাসেলকে নিয়ে ভিতরে ঢোকা---- এ'সব দেখে ড্যাসেল "ছানাবড়ার" মত চোখ করে হতভম্ব হয়ে ভাবতে লাগলেন তিনি কোথায় যাচ্ছেন!এই রকম অফিসে যে র্যাক/দরজার, গুপ্ত পথ থাকতে পারে, এ'সবই ছিল ড্যাসেলের ভাবনার অতীত।
ড্যাসেলকে যখন ওপর তলায় নিয়ে আসা হল। সেই সময় আমরা খাওয়ার টেবিলের চারদিকে বসে কফি আর উৎকৃষ্ট ফরাসী মদের বোতল নিয়ে ড্যাসেলকে অভ্যর্থনার জন্যে অপেক্ষা করছিলাম। কারণ আমরা জানতাম নতুন কেউ একজন আসছেন। যাঁর নাম ড্যাসেল। মিয়েপ প্রথমে তাঁকে আমাদের বসবার জায়গায় নিয়ে গেলেন। আমরা অবাক, তিনি আমাদের আসবাবপত্রগুলোকে ঠিকঠাক চিনতে পারলেন। কিন্তু তাঁর অতিদূর ধারণার মধ্যেও ছিল না, যে এই গুপ্তগৃহে আমরা আছি। এটা কোনভাবেই তাঁর মাথাতেই আসে নি। মিয়েপ যখন আমাদের সকলের পরিচয় ও পূর্বেকার অবস্থানের কথা বললেন, তখন তাঁর মুখে বিস্ময় ছাড়া আর কিছুই ছিল না। তবে বেশী কিছু ভাববার বা প্রশ্ন করার সুযোগ না দিয়ে, মিয়েপ সরাসরি তাকে নিয়ে ওপরের তলায় চলে গেলেন।
ওপরতলায় উঠে ড্যাসেল ধপ করে একটা চেয়ারে বসে পড়লেন। তারপর বেশ কিছুক্ষণ হতবাক হয়ে আমাদের দিকে তাকিয়ে রইলেন। মনে হচ্ছিল জীবনে বোধহয় প্রথম আমাদের দেখছেন। কিছুক্ষণ পর প্রায় তোতলাতে তোতলাতে বললেন, "হা ঈশ্বর!!তোমরা তা'হলে বেলজিয়াম যাওনি? আমরা অনেকেই ভেবেছিলাম, সেনা আসার আগেই তোমরা দেশ ছেড়ে চলে যেতে সক্ষম হয়েছ! এবং বেলজিয়াম পৌছে গেছ।
আমরা তাকে সব কিছু বুঝিয়ে বললাম। বললাম, আমরা ইচ্ছা করেই রটিয়েছিলাম যে, আমাদের সৈন্যদের গাড়ি তুলে নিয়ে গেছে। এই গল্প চাউর না করতে পারলে, আমাদের খোঁজাখুঁজি শুরু হয়ে যেত। আমাদের উদ্দেশ্য ছিল সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে জার্মানদের ভুল পথে চালিত করা, তাদের নজর আমাদের ওপর থেকে সরিয়ে দেওয়া, যাতে করে তারা আর আমাদের না খোঁজে।
ড্যাসেল আমাদের এই উদ্ভাবনী দক্ষতা দেখে একেবারে হতবাক। তারপর তিনি ক্রমে আমাদের সঙ্গে আমাদের একান্ত সুন্দর এবং অতিবাস্তব ছোট গুপ্তগৃহ ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগলেন। তিনি, মনে হচ্ছিল, যেন অবাক বিস্ময়ে আমাদের গুপ্তগৃহ দেখছিলেন। তাঁর মুখ দিয়ে বিস্ময়ে কোন কথা বেরোচ্ছিল না।
সেদিন একসাথে বসে আমরা মধ্যাহ্ন ভোজন সারলাম। তারপর তিনি কিছুক্ষণ দিবানিদ্রা দিলেন। ঘুম থেকে উঠে আমাদের সঙ্গে বৈকালিক চা'এর আসরে এসে যোগ দিলেন। এরপর তাঁকে দেখিয়ে দেওয়া নির্দিষ্ট জায়গায়, নিজের জিনিষপত্র পরিচ্ছন্নভাবে গুছিয়ে রেখে,(ড্যাসেলের আসার আগেই মিয়েপ তার জিনিষপত্রগুলো নিয়ে চলে এসেছিল),নিজে আনেকটা স্বাচ্ছন্দ বোধ করলেন। তারপর তিনি সুস্থ হয়ে বসার পর তাঁকে আমরা আমাদের গুপ্তগৃহের "আবাসস্থলের নিয়মকানুন ও শর্তাবলী"-র কাগজটা ধরিয়ে দিলাম। বললাম এটা মিঃ ভ্যান ড্যান এখানকার সকলের জন্যে তৈরী করেছেন। আপনি এটা পড়লে বুঝতে পারবেন, ভবিষ্যতে কি'ভাবে এখানে থাকতে হবে।
গুপ্ত অ্যানেক্সের বিবরণ সংক্রান্ত নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালন পত্র।।
ইহুদি বা সম্প্রদায়ভূক্ত ব্যক্তি তথা পরিবারের আপতকালীন অস্থায়ী বাসস্থানে বসবাসকারীর নিকট নিম্নলিখিত নিয়মাবলী মেনে চলা আবশ্যিক।
1. ইহা সারা বৎসর খোলা থাকে ঃ- সুন্দর, শান্ত্ চারদিকে গাছপালায় ঘেরা এই গুপ্তগৃহটি আমস্টারডামের শহরের মূল কেন্দ্রে অবস্থিত। ১৩ এবং ১৭ নম্বর ট্রামে চড়ে এখানে এসে পৌঁছান যায়। বিশেষ বিশেষ পরিস্থিতিতে এখানে পায়ে হেঁটেও আসা সম্ভব। অবশ্য জার্মান সরকারের নির্দেশ অনুসারে যদি কাহারো যানবাহনে ওঠা নিষেধ থাকে, তবে তাকে পায়ে হেঁটেই এখানে পৌছাতে হবে। এ'ছাড়া অন্যকোন উপায় নেই।
2. আসা ও অস্থায়ী বসবাসঃ- বিনামূল্যে বসবাস করার সুযোগ প্রদান করা হয়।
3. স্পেশাল মেদ-হীন আহারঃ- ইহা আহার সংক্রান্ত নিয়মাবলী। প্রয়োজন মোতাবেক খাবার সরবরাহ করা হয়।
4. অবিরাম জলঃ- স্নানাগারে অবিরাম জলের ব্যবস্থা (স্নানের জন্যেও পাওয়া যায়) করা আছে। সীমানার মধ্যেও বিভিন্ন স্থানে অবিরাম জল সরবরাহ করা হয়। তবে নষ্ট করা থেকে বিরত থাকাই বাঞ্ছনীয়। অন্যথায় জলের অভাব দেখা দিতে পারে।
5. পর্যাপ্ত স্টোর ব্যবস্থাঃ- অ্যানেক্স ভবনের বাসিন্দাদের জন্যে পর্যাপ্ত পরিমাণ আহার্য দ্রব্যাদি এখানকার স্টোরে মজুদ করা আছে।
6. নিজস্ব বেতার ব্যবস্থাঃ- নিজস্ব পরিচালনাধীন বেতার কেন্দ্র থেকে সরাসরি লন্ডন সংবাদ সংস্থার সাথে যোগাযোগের ব্যবস্থা আছে। এ'ছাড়াও নিউইয়র্ক, তেল আবিভ ও অনান্য বেশকিছু বেতার কেন্দ্রের সাথে সরাসরি যোগাযোগ স্থাপনের ব্যবস্থাও আছে। এই সুব্যবস্থা অ্যানেক্সের বাসিন্দারা সন্ধ্যে ছয়টার পর ব্যবহার করতে পারবেন। বেতার কেন্দ্র থেকে যে'কোন বেতার সংস্থার সাথে যোগাযোগ প্রতিষ্ঠা করা যাবে। কেবল মাত্র বিশেষ সময় ও অবস্থায় জার্মান বেতার সম্প্রচার শোনা যাবে। যেমন জার্মান বেতারের রাগাশ্রয়ী সংগীত প্রভৃতির সম্প্রচার শোনা যাবে।
7. বিশ্রামের সময় ঃ- নিয়মানুসারে বিশ্রামের সময় হল, রাত্রি দশটা থেকে সকাল সাড়ে সাতটা। রবিবার এই সময়টা সকাল সোয়া দশটা পর্যন্ত সম্প্রসারিত করা যেতে পারে। এখানকার বাসীন্দারা মধ্যাহ্নে বিশ্রাম গ্রহণ করতে পারেন, তবে এবিষয়ে কর্তৃপক্ষ নিয়মাবলী সময়ে সময়ে পরিবর্তন করতে পারে। নিজস্ব সুরক্ষার স্বার্থে, বিশ্রামের সময় নির্ধারণ করা হয়েছে। কর্তৃপক্ষের অনুমোদন সাপেক্ষে এর পরিবর্তন করা হতে পারে।
8. গৃহের বাইরে উন্মুক্ত স্থানে ভ্রমণঃ- বর্তমান অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে অনির্দিষ্টকালের জন্যে স্থগিত রাখা হয়েছে। অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে এই অনুমতি ভবিষ্যতে দেওয়া যেতে পারে।
9. গুপ্তগৃহের অভ্যন্তরে কথাবার্তা বলার নিয়মাবলীঃ- গুপ্তগৃহের অভ্যন্তরে আবাসিকদের নিম্নস্বরে বাক্যালাপ বাঞ্ছনীয়। জার্মান ভাষা ব্যতিরেকে যেকোন প্রচলিত সভ্যভাষায় বাক্যালাপ করা যাবে।
10. লেখাপড়াঃ- আবাসিকদের জন্যে প্রতি সপ্তাহে শর্টহ্যান্ড লেখা শেখার সুব্যবস্থা আছে। এ'ছাড়া সপ্তাহে সমস্তদিন ইংরাজী, ফরাসী ভাষা শিক্ষার সুবিধাও আছে। ইতিহাস, অঙ্ক বিষয়গুলিও সমান মর্যাদা দিয়ে শিক্ষার ব্যবস্থা করা হয়েছে।
11. ছোট জন্তুর পালনঃ- এবিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্যে ভিন্ন একটি বিভাগ আছে। এই বিভাগ পোষ্য পালন সংক্রান্ত অনুমতি ও নিয়মাবলী নির্ধারণ করবে। কীট বা মূষিক ভিন্ন অনান্য পালিত পশুর জন্যে উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণের চেষ্টা করা হবে।
12. খাওয়ার সময়ঃ- রবিবার ও সাধারণ ছুটির দিন বাদে সপ্তাহে অনান্য সবদিনে সকাল নয়টার সময় প্রাতঃভোজন প্রদান করা হয়। রবিবার বা ব্যাঙ্কের ছুটির দিন ১১টা ৩০ মিনিটে প্রাতঃভোজন প্রদান করা হবে।
13. মধ্যাহ্ন ভোজনঃ- (বৈচিত্র্যপূর্ণ মধ্যাহ্ন ভোজন প্রদান করা হয় না) বেলা সোয়া একটা থেকে পৌনে দু'টো পর্যন্ত সময়ে মধ্যাহ্ন ভোজনের জন্যে বরাদ্দ।
14. সান্ধ্য ভোজন ঃ- ঠাণ্ডা এবং/অথবা গরম উভয় প্রকার খাদ্য সরবরাহ করা হবে। সান্ধ্যভোজনের সময় নির্ধারিত নয়। বেতার সম্প্রচারের সময়ের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত।
15. কর্তব্য ঃ- আবাসিকবৃন্দ প্রয়োজনানুসারে আবাসনের প্রশাসনিক ও অনান্য কাজে অংশগ্রহণে বাধ্য থাকবে।
16. স্নান ঃ- প্রতিটি আবাসিক স্নানের প্রয়োজনে স্নানের টবটিকে ব্যবহার করতে পারবেন। রবিবার সকাল ৯টার সময় বাথরুম হিসাবে গুপ্তগৃহের অভ্যন্তরে যে কোন একটি বাথরুমকে ব্যবহার করা যাবে। এই বিষয়ে প্রত্যেকে প্রত্যেকের সঙ্গে সহযোগীতা করবেন।
17. মদ ও সুরার ব্যবহার ঃ- একমাত্র ডাক্তারের নির্দেশ অনুসারে এবং তাঁর নির্দেশপত্র থাকলেই মদ বা সুরা ব্যবহার করা যাবে।
শেষ
ইতি,
অ্যানি।
0 comments: