0

ধারাবাহিক - সোমঙ্কর লাহিড়ী

Posted in

ধারাবাহিক


পায়ের শব্দ 
সোমঙ্কর লাহিড়ী



১১ 

অ্যান্ডির গলা শুকিয়ে এলো, ভেবে পালোনা কি করে ওরা সাইক্রিয়াটিস্টের রিপোর্ট অবধি জেনেছে, কিছু একটা উত্তর তো দিতেই হবে, মাথা খুব দ্রুত কাজ করতে পারছে না, কি করে বলবে নিজের জীবনের সবচেয়ে অন্ধকার অধ্যায়ের কথা? তারপরের মুহূর্তেই মনে হলো, এই সুযোগ নিজের দোষগুলোকে লঘু করিয়ে দেওয়ার। যে বাবা মা তাকে মাত্র সতের আঠারো বছর বয়েসে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে, আর তারপরে কোনও খোঁজ খবর অবধি করেনি আজ পর্যন্ত তাদের মহান সাজিয়ে ওর নিজের কি লাভ হবে? 

মাথাটা নীচু করে নিজের চোখের জল বা মুখের ঈষৎ ঘেঁটে যাওয়া মেকআপকে লুকানোর চেষ্টা করে অ্যান্ডি ভারী গলায় উত্তর দিল, 

আমি ছোটো বেলায় মোলেস্টেশনের শিকার। 

তারপরে সোজা সম্বিতের দিকে তাকিয়ে বলল, 

আশাকরি আমার ফ্যামেলী হিস্ট্রি যথাযতভাবে রিসার্চ করে নেওয়া হয়েছে? 

অ্যান্ডির মুখ চোখের অবস্থা দেখে সম্বিত ব্রেক নিয়ে নিল। 

ক্যামেরা বন্ধ হলে পরে অ্যান্ডিকে জিজ্ঞাসা করল, 

আনকম্ফোর্টেবল ফীল করলে কি অন্য প্রসঙ্গে যাবো? 

না না! আমি অনেক দিন ধরে এই শয়তানের ইমেজটা বয়ে বেড়াচ্ছি, আজ সেটাকে যদি ঝেড়ে ফেলতে পারি তবে আমি আমাকে যে সব লোকেরা, শ্রোতারা, দর্শকেরা ভালোবাসে তাদের কাছে নিজেকে জাস্টিফাই করতে পারব। চলো যা হবার হবে আই উইল স্পীল মাই গাটস আউট। 

মেকআপ টাচ আপ করে নিয়ে অ্যান্ডি আবার ক্যামেরার সামনে নিজের জীবনের অন্ধকার অধ্যায়ের কথা বলতে শুরু করল। 

আমার জন্মদাত্রী মা আমাকে নিয়ে আমার বাবার কাছ থেকে চলে আসেন আমার পালকপিতার কাছে, উনিও ওনার বিবাহিতা স্ত্রীকে ডিভোর্স না দিয়ে বাড়ী থেকে বের করে দেন, কারণ ওনার কিছু একটা জটিল নার্ভের অসুখ ছিল। উনি ওনার ছেলেকে নিয়ে তাঁর বাপের বাড়ীতে চলে যান। 

মায়ের সাথে এই বাড়ীতে এসে থাকার পর কিছু দিন বাদ থেকে শুরু হয় আমার ও আমার এক দিদি ছিল তার উপরে। প্রথম প্রথম মায়ের অসাক্ষ্যাতে ঐ লোকটা আমাদের দুজনকে আদরের অছিলায় উত্যাক্ত করত। পরে যখন বুঝল যে মায়ের ও আর অন্য কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই বা অবস্থা নেই, তখন ব্যাপারটা মায়ের সামনেও ঘটত। 

সবার সামনে একটা অল্প বয়সী মেয়েকে যদি ক্রমাগত তোকে একদিন রেপ করব, তোকে একদিন রেপ করব বলে মানসিক নির্যাতন করা হয় তার ফল যে কি হতে পারে সেটা আমার দিদিকে যদি কেউ দেখত তো বুঝত। কোনদিন রেপড হয়নি কিন্তু ভয়ে সে উন্মাদ হয়ে যায়। এখন একটা মানসিক হাসপাতালের বাসিন্দা। ঠিকানাটা আপনারা বার করেছেন? না আমিই দিয়ে দেবো। 

সম্বিত অ্যান্ডিকে থামাতে চেষ্টা করে, অ্যান্ডি বলতে থাকে, 

আমার একমাত্র মুক্তির জায়গা ছিল গান। আমায় ছোটোবেলায় মা যতটুকু শিখিয়েছে ব্যাস ততটুকুই সম্বল করে আমি নিজেকে বাঁচিয়ে রাখতে চাইতাম। তার জন্য অজস্র গালিগালাজ, মারধোর আমার কপালে জুটেছে। 

আমি প্রথম মদ খাই ঐ লোকটার জোরাজুরিতে। মদ খেয়ে আরো অশালীন কাজকর্ম আমাকে সেদিন করতে হয়েছিল, আর তারপরেও অনেকবার করতে হয়েছিল। আমার মা আমাকে বাঁচানোর চেষ্টা করে দুবার মাথা ফাটিয়েছেন, একবার বাঁ হাতের কব্জি ভেঙ্গেছেন। 

আর আমি ড্রাগ ধরি যখন আমি ক্লাস টেনের ছাত্র ছিলাম, যখন আমার দিদি ভয়ে পাগল হয়ে গিয়ে পাগলা গারদে ট্রান্সফারড হয় তারপরের দিন থেকে। আমি ভেবেছিলাম ঐ নেশাটা করলে আমি সব কিছু ভুলে যেতে পারব। এখন আপনাদের সবার সামনে বলতে কোন লজ্জা নেই। আমি পুরোপুরি ভুল ছিলাম। আজ অনেকদিন র‍্যাদার অনেক বছর বাদে সমস্ত নেশা মুক্ত হতে পেরেছি আপনাদের সবায়ের ভালোবাসায়, শুভেচ্ছায়। আমি আমার প্রতিটা ফ্যান, স্রোতা, দর্শকদের কাছে একটা কথাই জানাতে চাই। দয়া করে এই নেশার কবলে পড়বেন না। 

একটা প্রশ্ন করে সম্বিত যে রকম একটা বিষ্ফোরক বাইট পেল, ওর আর ব্রেকে যেতে কোন অসুবিধাই রইল না। 

অফ ক্যামেরায় অ্যান্ডি ভেঙ্গে পড়ল পুরোপুরি। বহু দিনের জমে থাকা একটা কষ্টের বাঁধ পুরো ভেঙ্গে গিয়ে ওকে ভাসিয়ে নিয়ে গেল। 

এন্টারটেনার কে বৃষ্টিতে কাঁদতে হয়, এই আপ্তবাক্য অ্যান্ডিকে স্বাভাবিক হতে সাহায্য করল খুব তাড়াতাড়ি। 

অ্যান্ডিকে এবারে তার গানের কেরিয়ার নিয়ে প্রশ্ন শুরু করল সম্বিত। খ্যাতির ব্যাপারে বলতে গিয়ে অ্যান্ডি তার মেন্টর দাদা ইত্যাদি অনেক কিছু বলে কাঞ্চন ঘোষ দোস্তিদার আর তাঁর বাবা কিরন ঘোষ দোস্তিদারের ভূয়ষী প্রশংসা করল। এটাও জানাতে ভুলল না, যে অলিদি, তাঁর বর আর শ্বশুরমশাই ছাড়া তাঁর এই জায়গাটায় পৌছানো সম্ভব হত না। 

এবারে এলো তাঁর উদ্দাম পার্টি করা ও মহিলা সংক্রান্ত কেচ্ছার দিকগুলো। 

অ্যান্ডি খুব সুন্দর করে ব্যাপারটাকে সামাল দিল। একটা মিচকে হাসি মুখে ঝুলিয়ে রেখে বলল, 

একটা মানুষের উপরে ক্রমাগত যদি আলো চমকাতে থাকে তখন ধাঁধিয়ে যাওয়া চোখে সে দেখতে পায় না যে সে কি করছে, ঠিক ভুল সব ধাঁধিয়ে যায়। 

এবারে সম্বিত জিজ্ঞাসা করে, 

আচ্ছা “টি ভ্যালি” না কি একটা রিসর্টে একটা ওপেনিং সেরিমনিতে গিয়ে ঠিক কি হয়েছিল? 

যেটা হয়েছিল সেটা তো মিডিয়া “ব্রেকীং নিউজ” হিসাবে চালিয়েছিল। সে অনেক দিনের কথা ঠিক মনেও নেই। 

না মানে সিসি টিভি ফুটেজ দেখে... 

অ্যান্ডি সম্বিত কে থামিয়ে দিয়ে বলে, 

কোনো একটা জিনিসের একটা খণ্ড অংশ দেখেই কি মিডিয়া সেটার চিরকাল বিচার করে যাবে? আচ্ছা আমি যদি হঠাৎ আপনাকে প্রশ্ন করি আপনার দাদ সেরে গেছে? আর আপনি উত্তরে যখন বলতে গেলেন যে ‘না, আমার কোন দিনই দাদ ছিল না’ সেই ‘না’ টুকু রেখে বাকীটুকু বাদ দিয়ে যদি আমি চ্যাঁচাতে থাকি যে সম্বিত বাবুর দাদ সারেনি, তবে সেটা আপনার উপরে ইনজাস্টিস নয়কি? 

গোটা রিসর্টে বহু সিসি ক্যামেরা রয়েছে, শুধু আমি যে ক্যামেরার সামনে ছিলাম সেটার ফুটেজ দেখিয়ে যদি বলা হয় আমি খারাপ কাজ করছিলাম সেটাও তো আমার উপরে ইনজাস্টিস। তাই নয় কি? 

গোটা রিসর্টের সব ফুটেজ দেখার ধৈর্য যেদিন মিডিয়া দেখাবে সেদিন সব সত্যিটা বেরিয়ে আসবে। 

আর শুধু তাই নয়, যাঁকে জড়িয়ে নিয়ে আমার নামে এই গুজবটা ছড়ান হয়েছিল, তিনি একজন অত্যন্ত সম্ভ্রান্ত মহিলা। মিডিয়া আমার চরিত্র হনন করতে পারে, কারণ মিডিয়ার ভার্সানে আমার মতো ‘সো কলড’ সেলেবদের নাকি প্রাইভেট লাইফ আর পাবলিক লাইফ আলাদা হতে নেই, কিন্তু তাই বলে এতটা নীচে নামার আগে দেখা উচিত নয় কি ওনার সোশ্যাল স্ট্যাটাসটা? একবার চিন্তা করা উচিত নয় কি যে ওনার বাড়ির বাচ্ছারা কি মেন্টাল ট্রমার মধ্যে দিয়ে যেতে পারে ওই সময়? অন্য কেউ নয় তাদের মা! 

সম্বিত প্রসঙ্গ ঘোরাতে চেষ্টা করে, 

আচ্ছা রিসেন্ট যে দুই একটা মারাত্মক আক্রমণ হল তোমার উপরে সেই ব্যাপারে তোমার নিজের কি মত যদি একটু আমাদের দর্শকদের একটু জানাও। 

হঠাৎ করে প্রসঙ্গান্তরে যাওয়া আর এমন একটা ভয় ধরান একটা ব্যাপারকে আচমকা সামনে এনে ফেলায় অ্যান্ডি আবার একটু অফ গার্ড হয়ে পরে। মনে ফিরে আসে সেই ঘটে যাওয়া আক্রমণগুলোর কুস্মৃতি। 

আমি নিজেও সঠিকভাবে বলতে পারব না এর পিছনে যে লোক আছে সে কে আর কি চায়। বিদেশে অনেক পারফর্মারকে বা সেলিব্রিটিকে এই রকম ফ্যান স্ট্যাকিং বা পাপারাৎজি স্ট্যাকিং এর মুখোমুখি হতে হয় বা আগেও হয়েছে, আমরা জন লেননের বা ডায়নার উদাহরন দিতে পারি, কিন্তু আমি নেহাতই একজন সাধারন গায়ক বলে মনে করি নিজেকে। না আমার জন লেননের প্রতিভা না আমি ডায়নার মতো সুন্দরী যে আমাকে এই রকম ফ্যান বা পাপারাৎজিস্ট্যাকিং এর মুখোমুখি হতে হবে। 

অ্যান্ডি একটু দম নেয়, 

আমি এখনো নিজেকে একজন মাচা শিল্পি বলেই মনে করি, সব রকমের গান করি বলে সব ধরনের অডিয়েন্স আমার আছে, আর তারা আমাকে কেন জানি না একটু বেশীই ভালবাসে। কিন্তু তাই বলে বাড়ী বয়ে মারতে আসা, এটা আমি চিন্তাও করতে পারি না। আর এটা আমাদের দেশে আর কোথাও হয়েছে বলে আপনাদের কাছে কোনো হিস্ট্রি আছে? মনে হয় না। 

আর একটা জিনিস আমার খুব অবাক লাগছে, দ্বিতীয়বারে তার আক্রমণের ধরন। কোনো ফ্যান তার প্রিয় গায়ককে এইরকম ভাবে ক্লোরোফর্ম দিয়ে অজ্ঞান করে দিতে পারে? তার নাকে মুখে কোকেনের গুঁড়ো ছড়িয়ে দিয়ে তাকে আবার বদনামের ভাগীদার করে দিতে পারে? কি জানি আমি তো জানি না। এটা আমি বিশ্বাস করি না যে আমার কোনো ফ্যানের করা কাজ। 

আজ অবধি যারা আমার সামনে এসে আমার ফ্যান বলে নিজেকে ক্লেম করেছে তারা হয় সেলফি তুলেছে আমার সাথে। না হয় হ্যান্ডশেক করে বা বার দুয়েক কাছাকাছি হওয়ার সুবাদে সামান্য মুখচেনা হওয়াতে একটু হাগ করেছে, ব্যাস এই অবধিই। আমি বিশ্বাস করি যে এটা তাদের কারো কাজ নয়। 

সম্বিত প্রশ্ন করে, 

তুমি কি মনে কর এটা কোনো প্রফেশনাল রাইভ্যালারি থেকে হচ্ছে? 

অসম্ভব! হতেই পারে না। যাঁরা আমার কনটেম্পোরারি বা সিনিয়ার তারা আমার থেকে অনেক-অনেক বেশী ট্যালেন্টেড বলে আমি মনে করি। সামহাউ আমার এই ফ্লয়্যামবয়ান্ট ক্যারেক্টারের জন্য মিডিয়া আমাকে নিয়ে স্টোরিটা হয়ত বেশী করতে পারে, কিন্তু দে আর ফার বেটার আই থিঙ্ক। তাদের আমার পিছনে লোক লাগাতে যাওয়ার রুচি বা সময় কোনোটাই নেই। 

সম্বিত একটু খোঁচা দেয়, 

উত্তরগুলো একটু বেশী পলিটিক্যালি কারেক্ট হয়ে যাচ্ছে না? 

সত্যি কথার মধ্য যদি মশলা না পাওয়া যায় তবে সেটাকে খাওয়াতে অসুবিধা হয় মিডিয়ার সেটা আমি জানি। বাট কান্ট হেল্প। 

এই যে দুটো অ্যাটাক তোমার উপরে হল, তুমি কি মনে কর এটা তোমার কেরিয়ারে কোনো ভাবে প্রভাব ফেলবে? 

অ্যান্ডি এবারে উজ্জ্বল মুখ চোখ নিয়ে একবার সেটের আলোর বৃত্তের বাইরে থাকা তার কিরণ জেঠুর দিকে তাকাল তারপরে বলল, 

ভাল কি মন্দ জানি না, তবে এই দুটো ঘটনার পরে আমার ওয়াইল্ড পার্টিইং বন্ধ হয়েছে, আমার নেশা করা বন্ধ হয়েছে। বাড়িতে বেশী সময় দেওয়ার জন্য আমার কাজের কোয়ালিটি বেড়েছে, আর প্রথমে যে দুটো প্রোজেক্টের ব্যাপারে প্রশ্ন করে আমায় চমকে দিয়ে ছিলে সেই রকম গুনী মানুষ এখন আমাকে নিয়ে কাজ করার কথা ভাবছেন। আর আমি এখন তোমার টক শো এ তোমার সামনে বসে প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতে মিডিয়ার ভাষায় সেলেব থেকে সেলেব প্লাসে পৌছে যাচ্ছি।

0 comments: