ঝরনাতলার নির্জনে - শিবাংশু দে
Posted in ঝরনাতলার নির্জনে
ঝরনাতলার নির্জনে
জোড়াসাঁকো জংশন ও জেনএক্স রকেটপ্যাড -৭
শিবাংশু দে
'... তখন এমনি করেই বাজবে বাঁশি এই নাটে'
১৯২৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে পঙ্কজকুমারের যখন বছর বাইশ বয়স, তখন কেউ তাঁকে গার্স্টিন প্লেসে রেডিও কোম্পানির দফতরে নিয়ে যান। বৃহত্তর জনতার কাছে পৌঁছোনোর জন্য ইন্ডিয়ান ব্রডকাস্টিং কোম্পানির এই মাধ্যমটিই ছিলো একমাত্র উপায়। যদিও পঙ্কজকুমারের নাড়াবাঁধা গুরু ছিলেন দুর্গাদাস বন্দোপাধ্যায়, কিন্তু দিনু ঠাকুরের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ ছিলো। দিনু ঠাকুর ছিলেন সদাশিব প্রকৃতির মানুষ। কেউ ভালোবেসে রবিবাবুর গান শিখতে চাইলে তিনি সাগ্রহে এগিয়ে আসতেন। এইসূত্রেই পঙ্কজকুমারের সঙ্গে তাঁর একটা বিনিময় সম্পর্ক গড়ে উঠেছিলো। পঙ্কজকুমারের বিধিবদ্ধ সঙ্গীতশিক্ষা ছিলো অন্য গুরুর কাছে, কিন্তু দিনু ঠাকুর তাঁকে রবীন্দ্রসঙ্গীতের স্বরূপ ও সাধনার বিষয়ে দিকনির্দেশ করতেন। এই নতুন পাওয়া 'ভালোবাসার ধন'টি তরুণ পঙ্কজকুমারকে এমন আচ্ছন্ন করে রাখতো যে অন্য সব গান ছেড়ে তাঁর রেডিও স্টেশনের প্রথম অনুষ্ঠানে তিনি গাইলেন দু'টি রবীন্দ্রসঙ্গীত, ' এমনদিনে তারে বলা যায়' এবং 'একদা তুমি প্রিয়ে' । রেডিও কোম্পানির সঙ্গে তাঁর সুদীর্ঘ আটচল্লিশ বছরের সম্পর্ক এভাবেই তৈরি হলো।
১৯২৯ সালে কর্তৃপক্ষের অনুরোধে তিনি আরম্ভ করলেন পরবর্তীকালের প্রবাদপ্রতিম 'সঙ্গীত শিক্ষার আসর। বাংলাগানের প্রথম 'গণসঙ্গীতশিক্ষণ প্রকল্প'। এই 'গণসঙ্গীত' শব্দটি যেভাবে আজকাল একটি নির্দিষ্ট জঁরের গীতধারা হিসেবে ব্যবহার হয়, এটি তা নয়। এ ছিলো আমাদের দেশের জনমাধ্যমে প্রথম আপামর জনসাধারণকে শর্তবিহীন গান শেখানোর আয়োজন। যদিও এই আসরে সবরকম বাংলাগানই শেখানো হতো, কিন্তু সিংহভাগ ছিলো রবীন্দ্রসঙ্গীত। আমাদের শৈশবে দেখতুম, যদিও সময় তখন অনেক বদলে গেছে, সারা বাংলাদেশে রবিবারের সকালে সাধারণ গৃহলক্ষ্মী থেকে শুরু করে ছাত্রছাত্রী, চাকুরে কিম্বা প্রবীণ গুরুজনেরা নিয়ম করে এই অনুষ্ঠানটি শুনতেন । শুধু তাই নয়, কেউ গুনগুন করে বা উচ্চস্বরে পঙ্কজকুমারের সঙ্গে গানের মহলাও দিতেন। এই আয়োজনে যোগ দেবার একমাত্র শর্ত ছিলো যোগদানকারীকে বাংলা জানতে, বুঝতে হবে এবং গান'কে ভালোবাসতে হবে। আমরা প্রবাসী বাঙালিরা দেশের নানা প্রান্তে অনেক অবাংলাভাষীকেও এই অনুষ্ঠানটি নিয়মিত শুনতে দেখতুম। কারণ, ভাষা নির্বিশেষে, এক বিশেষ প্রজন্মের ভারতীয় শ্রোতাদের কাছে পঙ্কজকুমার একজন স্বীকৃত আইকন ছিলেন। এই অনুষ্ঠানটি হয়তো কোনও 'বড়ো' গায়কগায়িকা আমাদের দিতে পারেনি, কিন্তু রবীন্দ্রসঙ্গীতকে মূলস্রোতের মানুষজনের ধরাছোঁয়ার মধ্যে নিয়ে এসে শিল্পহিসেবে তার ভাবমূর্তিটি তৈরি করে দিয়েছিলো। রবীন্দ্রসঙ্গীতকে কেন্দ্র করে জনরুচির উৎকর্ষের যে মান ও স্বাভাবিক মূল্যবোধের বিকাশ আমরা চল্লিশ দশক থেকে লক্ষ্য করি, তার প্রেক্ষিতে পঙ্কজকুমারের এই প্রয়াসটির বৃহৎ ভূমিকা ছিলো। মনে রাখতে হবে ১৯২৯ সালে পঙ্কজকুমারের বয়স ছিলো মাত্র ২৪ বছর এবং সেই সময় রবীন্দ্রসঙ্গীতের 'মালিকানা' ছিলো অত্যন্ত সীমিত সংখ্যক অভিজাত মানুষের অধিকারে, যাঁদের সঙ্গে ইতরযানী মানুষের কোনও প্রত্যক্ষ সম্পর্ক ছিলোনা। ১৯৩১ সালে কবির সত্তরতম জন্মবর্ষ পূর্তির অনুষ্ঠানে মূল রবীন্দ্রবলয়ের বাইরের মানুষ হয়েও গান গাইবার জন্য পঙ্কজকুমার ডাক পেয়েছিলেন সসম্মানে। হয়তো দিনু ঠাকুরেরও এর মধ্যে কিছু ভূমিকা ছিলো। কারণ সমগ্র অনুষ্ঠানটির সঙ্গীত শিক্ষা ও নির্দেশনার দায়িত্ব ছিলো দু'জনের হাতে, দিনু ঠাকুর ও ইন্দিরা দেবী।
এর পর থেকে পঙ্কজকুমার পিছনে ফিরে তাকাননি। তাঁর সম্বল ছিলো অনুপম কণ্ঠসম্পদ ও আশিরনখর রবীন্দ্রভক্তি। তাঁর কণ্ঠে রবীন্দ্রসঙ্গীত সাধারণ শ্রোতার কাছে এক সম্পূর্ণ নতুন রূপ নিয়ে আসে। বস্তুতঃ তাঁর ব্যারিটোন কণ্ঠের গায়নশৈলি পরবর্তীকালে রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পীদের জন্য লোকপ্রিয় হবার সব থেকে জরুরি শর্ত হয়ে দাঁড়ায়। যদিও তাঁর শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে কিছু তালিম ছিলো, কিন্তু গাইবার সময় তিনি সচেতনভাবে শাস্ত্রীয়সঙ্গীতের ঢঙে সুর লাগানোর পক্ষপাতী ছিলেন না। দিনু ঠাকুর রবীন্দ্রসঙ্গীতে নিজস্ব ধরনে খোলা গলায় সোজা স্বরস্থান নির্ভর যেভাবে সুর লাগাতেন, তাঁর দুই শিষ্য শান্তিদেব ও পঙ্কজকুমারকেও সেই শিক্ষাই দিয়েছিলেন। পঙ্কজকুমারের জন্য এই শিক্ষা অভূতপূর্ব সাফল্যের স্বাদ নিয়ে এলো। ব্যারিটোন কণ্ঠ ও সোজা সুর লাগানোর গায়নভঙ্গিটি তাঁর টার্গেট শ্রোতৃদল, অর্থাৎ বৃহত্তর ইতর জনতার কাছে বিশেষ সমাদৃত হয়ে ছিলো। তিনি কিন্তু সে অর্থে ন্যাচরল গায়ক ছিলেন না, ছিলেন না কুন্দনলাল সহগলও । কিন্তু তাঁদের গাওয়া রবীন্দ্রসঙ্গীতে শাস্ত্রীয়সঙ্গীতের উপজিত স্বেদবিন্দু টের পাওয়া যেতোনা। 'গুরু' ও 'শিষ্যে'র পরিবেশিত এই গায়নকৌশলের জাদু সংখ্যাগুরু শ্রোতাদের জন্য ছিলো মাঠঘাট, গলি-রাজপথে রবীন্দ্রসঙ্গীতের নতুন পরিপ্রেক্ষিত ও প্রাসঙ্গিকতার আবিষ্কার। স্বতই রবীন্দ্রসঙ্গীতে 'ন্যাচরল' গায়ন ও লোকপ্রিয়তা পেয়ে গেলো এক মুদ্রার দুই দিক হিসেবে সহজ স্বীকৃতি। শ্রোতাদের রসগ্রাহিতায় রবীন্দ্রসঙ্গীতের একটি নির্দিষ্ট ছাঁচ এই সূত্রে গড়ে উঠেছিলো।
পঙ্কজকুমারই প্রথম রবীন্দ্রসঙ্গীতে তালবাদ্য হিসেবে তবলার প্রয়োগ শুরু করেছিলেন। ভারতীয় চলচ্চিত্রে প্লেব্যাক গায়নেরও তিনি ছিলেন ভগীরথ। এর থেকেও বড়ো কথা তিনিই প্রথম একজন সুরকার যিনি রবীন্দ্রনাথের রচনায় সুর করার শুধু 'দুঃসাহস'ই করেননি, কবির অনুমতিও লাভ করেছিলেন। ১৯৩৭ সালে 'মুক্তি' ছবি করার সময় প্রমথেশ বড়ুয়া পঙ্কজকুমারকে নিয়ে গিয়েছিলেন জোড়াসাঁকোয়। কবির সামনে অর্গ্যান বাজিয়ে নার্ভাস পঙ্কজকুমার খেয়া কাব্যের কবিতাটি নিজের সুরে পরিবেশন করেছিলেন। কবি তৎক্ষণাৎ কিছু বলেননি, কিন্তু পরে তাঁর স্বীকৃতি জানিয়ে দিয়েছিলেন।
কবি স্বীকার করেছিলেন গায়কে গায়কে এক্সপ্রেশনের ভেদ থাকবেই, থাকবে ইন্টারপ্রেশনের স্বাধীনতা। এই স্বাধীনতার বিভিন্ন রূপ তো আমরা দেখতে পাই দেবব্রত বিশ্বাস ও সুবিনয় রায়ের গানে অথবা সুচিত্রা মিত্র বা কণিকা বন্দোপাধ্যায়ের পরিবেশনে। কবির মনে এই স্বাধীনতার ব্যাখ্যা ছিলো, ' স্বরোচ্চারণে, গায়নভঙ্গিমায় গায়কের নিজস্ব উপলব্ধির মধ্য দিয়ে বাণীর অন্তর্গত বোধের উন্মোচন'।
(ক্রমশ)
0 comments: