1

প্রবন্ধ - ধ্রুবজ্যোতি চক্রবর্তী

Posted in

প্রবন্ধ


কমলাকান্ত উবাচ – গব্যশক্তি 
ধ্রুবজ্যোতি চক্রবর্তী


কমলাকান্তর সাথে মধ্যরাতে আমার আলাপ-আলোচনা’র বিষয় নিয়ে পরে অনেক চিন্তা-ভাবনা করে দেখেছি যে এই পুরো আলোচনার পরিচালনটা কমলাকান্ত’র হাতেই থাকে। 

মাঝে মধ্যে আমার প্রশ্নের উত্তর সে দেয় বটে তবে সেটা আলোচনাটা এগিয়ে নিয়ে যাবার খাতিরেই, এর মধ্যে আমার তরফ থেকে কোনো বিশেষ উল্লেখযোগ্য অংশগ্রহণ ছিল না। তারপর ধীরে ধীরে আমি নিজেকে দুজনের কথপোকথন থেকে আস্তে আস্তে আরও সরিয়ে নিয়ে তার কথা বলার সময়টা বাড়িয়ে দেবার প্রচেষ্টাটা চালিয়ে যেতে থাকি। 

আমার এই প্রচেষ্টার ফলে কমলাকান্ত আমার কাছে নিজেকে উজাড় করে দিতে পিছপা হয় না। বর্তমান কালে তার সমস্ত বক্তব্যের এরকম প্রায় নির্বাক মনোযোগী শ্রোতা খুঁজে পাওয়া মুশকিল। সেটা সে জানে বলেই আমার কাছে কমলাকান্ত খুব নিশ্চিন্ত অবস্থায় থাকে বলে আমার মনেহয়। আর তার ফলে কমলাকান্তের স্মৃতির অফুরন্ত ভান্ডার থেকে আমি একের পর এক আনমোল রতনের সন্ধান পেয়ে চলেছি। 

তবে যেটা সবচেয়ে বড় অনিশ্চয়তা সেটা হচ্ছে কমলাকান্তের ধারাবাহিকতা। তাকে নিয়ম মতো কোনো বাঁধাধরা ছকে বেঁধে রাখা খুবই মুশকিল। 

তাই আমার তরফ থেকে কমলাকান্তের ব্যাপারে কোনোরকম আগাম ভবিষ্যৎবাণী করা খুবই মুশকিল এবং আমি তা কখনই চেষ্টা করে দেখতে চাই না। 

পুজোর আগে আশা করেছিলাম একবার অন্তত কমলাকান্তের দেখা পাব। কিন্তু সে আশায় ছাই ঢেলে দিয়েছিল কমলাকান্ত। 

সেদিন বৈকালিক ভ্রমণ সাঙ্গ করে বাড়ি ফেরার সময় নজর পড়ল আমার লেটার বক্সের দিকে। একটা হলুদ রঙের খাম উঁকি দিচ্ছে দেখলাম। এযুগে কে আবার খামে চিঠি লিখেছে, এই কৌতুহল নিয়ে লেটার বক্স থেকে চিঠিটা উদ্ধার করে বাড়িতে ঢুকলাম। 

বাইরের ঘরের সোফাতে বসে হাতে ধরা হলুদ খামটার দিকে নজর দিলাম। ঠিক পরিচিত সাদামাটা খাম নয়। হ্লুদ তুলোট কাগজে তৈরি খাম। আমার বাড়ির ঠিকানাটা ভিক্টোরিয়ান যুগের ইংরেজি স্টাইলে লেখা। প্রেরকের নাম লেখা আছে দেখলাম – শ্রীকমলাকান্ত, নিবাস – নসীধাম। 

প্রেরকের নাম ঠিকানাটা দেখেই শিড়দাঁড়া দিয়ে একটা হিমবাহের ধারা বয়ে গেল। কমলাকান্তের চিঠি! মুহূর্তকাল আমার এক্কেবারে কিংকর্তব্যবিমূঢ় অবস্থা!!

আড়চোখে টিভিতে মগ্নমৈণাক গিন্নীর দিকে তাকিয়ে বুঝলাম উনি আমার এই সহসা শারিরীক এবং মানসিক পরিবর্তণ লক্ষ্য করেননি। তাঁর প্রিয় সিরিয়াল কন্যা তখন সালঙ্কারা, মাস্কারারূপ ধারন করে সুসজ্জিতা অবস্থায় নেকি-নেকি কান্নায় স্ক্রীন জুড়ে উপস্থিত। বুঝলাম বেশ একটা রগরগে সেন্টিমেন্টের একটা হড়হড়ে সিন চলছে। 

ভগবান মঙ্গলময়। তাই আমি গিন্নীর রাডারের বাইরে আছি আর তাই তৎকালিক কোনো বিপদের আশঙ্কা নেই। তাঁর কাছ থেকে “কার চিঠি?”-এই আপাত নিরীহ প্রশ্নটা আমাকে বাধ্য করত ঝুড়ি ঝড়ি মিথ্যের ডালি সাজিয়ে বসবার জন্য। 

যাইহোক মনের উত্তেজনা মনেই চেপে রেখে ঠিক করলাম যে এখন নয়, যথাকালে রাতের খাওয়া-দাওয়া সম্পন্ন করে আমার লেখার টেবিলে গুছিয়ে বসে কমলাকান্তের চিঠিটা মনযোগ সহকারে পড়তে হবে। 

তারপর আলোকের গতিতে সেই রাতের নিজের প্রয়োজনীয় কর্মকাণ্ড  সম্পন্ন  করে আজ একটু তাড়াতাড়িই লেখার টেবিলে এসে বসলাম। ঠাকুর্দাদার ঘড়িতে দেখলাম কমলাকান্ত’র আগমন কালের বেশ দেরি আছে। উত্তেজনায় নিজের হৃদয়ের শব্দ নিজের কানেই যেন শুনতে পাচ্ছিলাম। 

আর বেশী চিন্তা ভাবনা না করে সন্তর্পনে হলুদ রঙের তুলোট কাগজের খামটা আমার লেখার টেবিলের দেরাজ থেকে বের করলাম। তারপর কাগজ কাটার ছুরিটা দিয়ে থেকে খুব সাবধানে খামের কোনাটা একটু ছিঁড়ে নিয়ে ছুরিটা দিয়ে খামটা খুলে ফেললাম। 

খোলা খামের ভেতর থেকে টেনে বের করে আনলাম হাতে তৈরি কাগজে জ্বলজ্বলে মুক্তোর মতো হস্তাক্ষরে লেখা একটা চিঠি। নিচের সাক্ষরের জায়গায় দেখলাম কমলাকান্তের দস্তখত। 

এক লহমায় মনে হলো যেন সারা পৃথিবী আমার হাতের মুঠোয়।

একটু সময় নিয়ে মনটাকে একটু শান্ত করে আমার প্রিয় রাত্রিকালীন পাণীয়তে একটা লম্বা চুমক সহযোগে চিঠিটা পড়া শুরু করলামঃ


“পূজ্যপাদ শ্রীযুক্ত বাবু লেখক মহাশয় 

শ্রীচরণকমলেষু, 

(কমলাকান্ত আমাকে “লেখক” বলে সম্বোধন করেছে দেখে যারপরনাই আহ্লাদিত হলাম) 


মহাশয়! আপনাকে পত্র লিখিব কি – লিখিবার অনেক অনেক শত্রু। আমি এখন যে কুঁড়ে ঘরে বাস করি তাহাতে কাল রাত্রে কেহ বা কাহারা আসিয়া তাহার বিস্তর ক্ষতি সাধন করিয়া গিয়াছে। 

গত সন্ধ্যায় আমার বাড়ির দাওয়ায় প্রসন্ন গোয়ালিনী তাহার মঙ্গলা গাভীকে খোঁটা বাঁধিয়া রাখিয়া পাগলা চন্ডী নদী তীরবর্তী তাহার গ্রামে অসুস্থা মায়ের পরিদর্শনে যাইবার প্রাক্কালে বলিয়া গিয়াছিল,”ঠাকুর, একরাত মঙ্গলার খেয়াল রাখিও। আমি তাহার রাতের খোল বিচালির ব্যবস্থা করিয়া যাইতেছি। তুমি কেবল খেয়াল রাখিও। আমি কাল সকালেই ফিরিয়া আসিব।“

সকালে প্রাতঃকৃত্য যাইবার প্রাক্কালে দেখি মঙ্গলা নাই আর আমার গৃহের দালানটি কেহ বা কাহারা যেন কোদাল চালাইয়া এমন ক্ষতি করিয়া গিয়াছে যে গৃহের দরোজা খুলিয়া বাহিরে আসিতে পদযুগল দাওয়াতে রাখিতে গিয়া আমি ধরণী চুম্বন করিয়াছি। 

আমার অপরাধ আমার জানা নাই। 

অপরাধের বিরুদ্ধে নালিশ জানাইতে কোতোয়ালিতে হাজির হইলে কোতোয়াল আমার নালিশ লিপিবদ্ধ করেন নাই। তাহার কারণ হিসেবে তিনি আমায় জানাইয়াছেন যে বর্তমানে তাঁহার সান্ত্রী, পেয়াদা সকল রাজনৈতিক নেতাদের জিলা সফরে ব্যস্ত আছে। আমি যেন কয়েকদিবস পরে তাঁহার শরণাপন্ন হই।

আমি জীবনে কখনও এই প্রকার আশ্চর্য হই নাই।

কি করিব ভাবিতে ভাবিতে গৃহে প্রত্যাবর্তন করিয়া ভগ্নদূতের ন্যায় মস্তকে হস্ত রাখিয়া নিজ ভাগ্যকে অভিসম্পাত করিতে ছিলাম। কিছুক্ষন পর প্রসন্ন আসিয়া উপস্থিত হইল। তাহাকে আমার অবস্থার কথা জানাইলাম। 

প্রসন্ন কপালে করাঘাত রোদন করিতে করিতে মঙ্গলার সন্ধানে বাহির হইয়া গেল। প্রসন্ন’র লাগি আমার প্রাণ কাঁদিয়া উঠিল। কিন্তু কি করিব! আমি গরীব ব্রাহ্মণ, আমার কথা কেহ শুনিবে না। আমার নসীবাবুও নাই যে তাঁহার শরণ লইব। অতএব, ভগ্নস্তুপ সদৃশ দাওয়ায় বসিয়া আকাশ পাতাল ভাবিতে লাগিলাম। 

প্রসন্ন’র সঙ্গে আমার একটু প্রণয় ছিল বটে, কিন্তু সে প্রণয়টা গব্যরসাত্মক। এই কারণে আমি নিজের জন্য যত না দুঃখিত, প্রসন্নের জন্য আমি গভীর দুঃখিত। তবে প্রসন্নের প্রতি আমার যেরূপ অনুরাগ, তাহার মঙ্গলা নামে গাইয়ের প্রতিও তদ্রূপ। একজন ক্ষীর সর, নবনীতের আকর, দ্বিতীয়, তাহার দানকর্ত্রী। গঙ্গা বিষ্ণুপদ হইতে জন্মগ্রহণ করিয়াছেন বটে, কিন্তু ভগীরথ তাঁহাকে আনিয়াছেন,; মঙ্গলা আমার বিষ্ণুপদ; প্রসন্ন আমার ভগীরথ; আমি দু-জনকেই সমান ভালবাসি। 

কিন্তু মন্দলোকের ধারণা যে আমি প্রসন্ন’র প্রতি আসক্ত। 

এই সকল মন প্রাণের কথা লেখক তোমায় জানাইতেছি এই আশা করিয়া যে তুমি খোসনবীসের ন্যায় ইহা লইয়া ব্যবসা ফাঁদিবে না। আজকাল দিনকাল ভাল নয়। প্রসন্ন’র প্রতি আমার হৃদয় দৌর্বল্যতা অকারণ মানুষের রসনাকে তৃপ্ত করিতে পারে। ইহার পর হয়ত দেখিতে পাইতে পার যে আমি আদালতের কাঠগড়ায় গরু চুরি মামলার সাক্ষীরূপে নহে “আম্মো” মামলায় আসামী রূপে বিরাজমান।

তৎকালে “আম্মো” ঘটনা যে ঘটে নাই তাহা বলিলে ভুল হইবে কিন্তু তাহা আদালত পর্যন্ত গড়াইবার পূর্বেই বলবান ব্যক্তিসকল তাহার কন্ঠ রোধ করিয়া দিত। তাহার ফলে সমাজের বাহুবলীদের প্রবল প্রতাপে অসহায় নারীদিগের ক্রন্দন চাপা পড়িয়া যাইত। সেইকালে সমাজের বহু বিশিষ্ট ব্যক্তিই এই সকল আম্মো কেসে যে নাসিকা অবধি নিমজ্জিত ছিল তাহা বলিলে মোটেই অত্যুক্তি করা হইবে না বলিয়াই আমার ধারনা। 

প্রসন্ন আর তাহার গাভী মঙ্গলার প্রতি যে আমার মাত্রাতিরিক্ত প্রীতি তাহা আমার এলাকার কর্তাব্যক্তিগনের চক্ষুশূলের কারন হিসাবে দেখা দিতে লাগিল। শুকনো কথায় চিড়া ভিজিতেছে না দেখিয়া তাহার আমায় শিক্ষা দিবার নামে মঙ্গলাকে লইয়া গিয়াছে আর আমার বাসস্থানটিতে লাঙ্গল চালাইয়া দিয়া গিয়াছে বলিয়া আমার বোধ হইল। 

বর্তমানে কিছু করনীয় নাই দেখিয়া শেষমেস কোতোয়ালিতে নালিশ লিখাইবার জন্য অপেক্ষা করিতে মনস্থ করিলাম বটে।

দিনের প্রায় দ্বিপ্রহর কালে সূর্যদেব মস্তকের উপর আরোহণ করিলে এক পাত্র জল আর এক থালা মড়ি-মুরকি লইয়া ক্ষুৎপিপাসা নিবারণার্থে ভগ্ন দাওয়ায় বসিতে না বসিতে ভগ্নদূতের ন্যায় প্রসন্ন ঝড়ের বেগে আসিয়া উপস্থিত হইল। 

অগ্নিপূর্ণ দৃষ্টিতে সে আমাকে নিরীক্ষণ করিয়া কহিল,”নির্লজ্জ পেটুক ব্রাহ্মণ! যে মঙ্গলার দুধ হইতে নির্মিত দই, ননী, ঘী সেবন করিয়া এই নধর কান্তি দেহটি তৈয়ার করিয়াছ, সেই মঙ্গলার উদ্ধার কার্য সম্পন্ন না করিয়া তুমি কিনা ঘরে নিশ্চিন্তে বসিয়া আহার করিতেছ! তুমি প্রকৃতই অকৃতজ্ঞ বটে।“ 

এই সকল অনৈতিক কথা বলিয়া প্রসন্ন কপালে করাঘাত করিয়া তাতস্বরে ক্রন্দন করিতে লাগিল। 

আমি পড়িলাম মহা মুশকিলে।

হাঁ, আমি মঙ্গলা নামক গাভীর দুধ এবং সেই দুধ দ্বারা নির্মিত দই, ননী, ছানা, ক্ষীর ইত্যাদির স্বাদ হামেশাই লইয়া থাকি বটে তবে গাভী তো আমার নয়। আবার প্রসন্ন তাহার পরিচর্যা করে বলিয়া গাভী তাহার হইবে এমন কোন কথা নাই। তাহার পরিচর্যা প্রসন্ন নিজের স্বার্থের জন্যই করিয়া থাকে। সে গাভীর দুধ এবং দুগ্ধজাত দ্রব্য বিক্রয় করিয়া পয়সা উপার্জন করিয়া থাকে। অতএব মঙ্গলা এবং প্রসন্নের ভিতর একটি লেনা-দেনার সম্পর্ক আছে যাহা একে অন্যের পরিপূরক রূপে বিবেচিত হইবে। এই বিবেচনায় কেহই কাহারো সম্পত্তি বলিয়া নির্দেশিত হইতে পারে না। 

অতএব মঙ্গলা কাহার?

ইতিপূর্বে গরু চুরি মামলায় হাকিম সাহেবের সামনে ঈশ্বরকে প্রত্যক্ষ জানিয়া হলফনামা পাঠ করিয়া বলিয়াছিলাম যে ব্যক্তি দুধ পান করিয়া থাকে, গরু তাহার বলিয়া বিবেচিত হইবে। কিন্তু এখন দেখিতেছি তাহা পূর্ণ সত্য নহে। কারণ হিসাবে বলা যাইতে পারে যে সুরাসেবী ব্যক্তিগণ সুরা সেবন করেন বলিয়া যে স্কচ প্রস্তুত কারক কোম্পানীর উপর তাঁহাদের মালিকানা বর্তাইবে তাহা হইতে পারে না। 

এইসকল চিন্তায় আর ভুখা পেটের জ্বালায় মাথা গরম হইয়া উঠিল। 

প্রসন্নকে কহিলাম যে যদ্যপি “গরু কার?” এই প্রশ্নের তর্কাতীতভাবে মিমাংসা না হইতেছে তদ্যপি মঙ্গলার সন্ধান করিয়া কোনো লাভ নাই। কারন মঙ্গলার অন্বষনে বাহির হইয়া যদি প্রমাণিত হয় যে মঙ্গলার আসল মালিকই তাহাকে লইয়া গিয়াছে তবে সেই ব্যাপারে আমাদের তো কোনো কথা থাকে না। 

ইহা শুনিয়া প্রসন্ন পুনরায় অগ্নিমূর্তি ধারণ করিয়া কহিল,”নষ্টবুদ্ধি তরল মস্তিস্ক ব্রাহ্মণ! তোমার জাহান্নামে যাওয়া উচিৎ।“

অতএব আমি পুনরায় কোতোয়ালিতে হাজির হইয়া কোতোয়ালকে আমার সমস্যার কথা জানাইলাম। 

কোতোয়াল সাহেব হাতের তালুতে গুঠকা লইয়া তাহার গুণ বিচারে নিমগ্ন ছিলেন। সারা দেশে গুঠকা সেবন, বিক্রয় এবং সঞ্চয় নিষিদ্ধ হইলেও কোতোয়ালিতে তাহার অবাধ ব্যবহার দেখিলাম। 

গুঠকার প্রতি নিমগ্ন অবস্থায় কোতোয়াল মহাশয় প্রশ্ন করিলেন,”কি সমস্যা?”

“আজ্ঞে, গরু কার?”কিন্তু কিন্তু করিয়া আমার প্রশ্নটি পেশ করিলাম। 

একটুও অবাক না হইয়া কোতোয়াল সাহেব বলিলেন,এক্ষণে তাঁহার অবস্থান কোথায়?”

আমি আমতা আমতা করিয়া কহিলাম,বর্তমানে নিখোঁজ।”

“নিখোঁজ হইবার পূর্বে তিনি কাহার জিম্মায় ছিলেন?”

“আঁজ্ঞে, এই অধ্ম ব্রাহ্মণের।“

“তা তুমি কি সেইকালে তাঁহার অন্নজল সংস্থানের দায়িত্বে ছিলে?”

“না, আঁজ্ঞে মানে ঠিক তা নয়”- এই বলিয়া আমি কোতোয়াল সাহেবকে যথাসম্ভব বিস্তারিত ভাবে প্রসন্ন-মঙ্গলা কাহিনী বর্ণণা করিলাম। 

কোতোয়াল সাহেব দক্ষিণ হস্তের তালুবন্দি গুটখা সকল তাঁর মুখ গহ্বরে চালান করিয়া চক্ষু মুদিয়া অমৃতের স্বাদ আহরণ করিবার কালে প্রায় দুই মিনিটকাল নীরবতা পালন করিবার পর চক্ষু খুলিয়া কহিলেন,”তোমার গৃহে যদি কোনো পারিবারিক সম্পর্কহীন স্ত্রীলোক কোন গাভীমাতাকে খোঁটাবন্দি করিয়া যায় এবং তাহার পরবর্তীকালে সেই গাভীমাতাকে কেহ মুক্তিদান করিয়া সঙ্গে লইয়া গেলে তাহার বিপরীতে কোনো ফৌজদারি মামলা রুজু করা নিরর্থক।“ 

আমি কহিলাম,”কিন্তু সেই স্ত্রীলোকটি যে এই গাভীটির লালন পালন তাহার জন্মকাল হইতে করিয়া আসিতেছে। অতএব গাভীটির মালিকানা তাহার উপরেই বর্তায়।“ 

আমার যুক্তি শুনিয়া কোতোয়াল সাহেব মুচকি হাসিলেন। কহিলেন,”শুন হে ব্রাহ্মণ, গাভী আমাদের দেশে সত্য যুগ হইতেই মাতৃরূপে পূজিতা। আমাদের শাস্ত্রে গাভী উচ্চস্থানে প্রতিষ্ঠিত এবং অন্যায়ের বিরূদ্ধাচারী। বিশ্বামিত্র মুনি যখন বাহুবলে স্বত্ত্বগুণী ঋষি বশিষ্ঠের আশ্রম হইতে কামধেনু অপহরণ করিবার মতলব করিয়াছিলেন, তখন সদাশিব বশিষ্ঠমুনি মাতা কামধেনুরই শরণাপন্ন হইলে কামধেনু হইতে শত সহস্র বীর যোদ্ধা উৎপন্ন হইয়া বিশ্বামিত্রের সৈন্যবাহিনীকে পগার পার করিয়া দেয়। অবশেষে বিশ্বামিত্রমুনি নিরুপায় হইয়া ঋষি বশিষ্ঠের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করিলে মামলার মীমাংসা হয়। অতএব গাভীমাতার শক্তিকে অস্বীকার করা কখনই উচিৎ নহে।“

এই পর্যন্ত বলিয়া কোতোয়াল সাহেব দম নেবার জন্য একটু অবকাশ সৃষ্টি করিলে আমি বলিয়া উঠি,”কিন্তু বর্তমান কালে গাভী তো দুগ্ধ, দধি, ক্ষীর, ননী ইত্যাদিই সৃষ্টি করিয়া থাকে, কমান্ডো বাহিনী সৃষ্টি করিয়াছে বলিয়া তো কখনও তো শুনি নাই।“

“আমাদের দেশের এইটাই তো সমস্যা। আমরা আত্মবিস্মৃত জাতি বলিয়া আজি পৃথিবী বিখ্যাত। আমাদের হৃত গৌরব পুন্রুত্থানের জন্যেই তো বর্তমানে দেশের রাজনীতির মঞ্চে গাভীমাতা আজি সদর্পে বিরাজমান। এতদিনে তিনি তাঁহার ভুলুন্ঠিত স্থান পুনরুদ্ধার করিয়া লইতে বদ্ধপরিকর হইয়াছেন।“ গাভীমাতা বিষয়ক আলোচনা কালে কোতোয়াল সাহেবের মুখ যেন সহস্র সূর্যের কিরণে আলোকিত হইয়া উঠিয়াছে। 

আমি দেখি আরে এতো ভ্যালা মজা। এখন আমি কি করি। একদিকে প্রগলভা প্রসন্ন গোয়ালিনী আর অপরদিকে গাভীমাতার সম্মান উদ্ধারকারী গুঠখা প্রিয় কোতোয়াল। এই দুই শক্তিশালী চরিত্রের মাঝে আমার প্রাণ তো ওষ্টাগতপ্রায়। কি করিয়া এই অকুস্থল হইতে ছাড়া পাই তাহাই ভাবিতেছি। কাজ নাই আমার আর মঙ্গলার মালিকানার ইতিহাস অবগত হইবার। আমি এখন এই উন্মাদ সদৃশ কোতোয়ালের হাত হইতে নিস্তার পাইবার রাস্তার সন্ধান পাইতে ইষ্টদেবতার নাম জপিতে লাগিলাম। 

কোতোয়াল সাহেবকে একটি নমস্কার করিয়া পালাইবার তাল করিতেই কোতোয়াল সাহেব আমার ঊর্ণি ধরিয়া এক হেঁচকা টানে আমাকে আবার আমার জায়গায় বসাইয়া দিলেন। আমার তখন ন যযৌ ন স্তথৌ অবস্থা। 

আমার দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করিয়া কোতোয়াল সাহেব আবার শুরু করিলেন,”আপুনি যে প্রশ্ন লইয়া আসিয়াছিলেন তাহার উত্তর না লইয়া তো আপনার প্রস্থান উচিৎ হইবে না বলিয়া আমার মনে হয়। অতএব আলোচনাটায় আবার প্রত্যাবর্তন করা যাক। বর্তমানে দেশে রামরাজত্ব প্রতিষ্ঠা প্রকল্পে সর্বপ্রথমে গাভীমাতৃকার নায্য অধিকার সর্বাগ্রে সুপ্রতিষ্ঠিত করিতে হইবে। এবং সেই কার্যে সর্বপ্রথমে তাঁহার মালিকানা আইনের ব্যাপক সংস্কার করিতে হইবে। এই নব্য আইনের বলে সরকার দেশের সমস্ত গাভীকুলের অভিভাবক রূপে বিবেচিত হইবেন। তবে তাঁহার ভরন পোষনের দায়িত্ব দেশের জনগণের উপর অর্পিত থকিবে। জনগণ আপন খরচে দেশের সমস্ত গাভীকূলকে লালন পালন করিবেন। তবে রাষ্ট্রের রাজনৈতিক কর্মকান্ডে গাভীর প্রয়োজন হইলে যে কোনো সময়ে সরকার যে কোনো গাভী অধিগ্রহণ করিতে পারিবেন। অতএব, গাভী বাছুর বয়সে গাভীমাতার, যৌবনে ষণ্ডের, দুগ্ধদান কালে রাজনৈতিক নেতাদিগের এবং দুগ্ধদানে বিরত হইলে গরুপাচার মাফিয়াগোষ্ঠীর সম্পত্তি বলিয়া বিবেচিত হইবে। তবে এই সকল পর্যায়েই দেশের আপামর জনগন আপন আপন রৌপ্যমুদ্রা ব্যয় করিয়া সমস্ত গাভীকুলের উদরপূর্তি নামক এক অতি সামান্য কাজে জাতীয় সরকারকে সাহয্য করিবেন। তবে জনগণের সরকার মোটেই অবিবেচক নহেন। যে সকল দেশবাসী আনন্দের সহিত এই সরকারি কার্যে অংশ গ্রহন করিবেন তাঁহাদের জন্য আয়কর দপ্তর শীঘ্রই বিশেষ ছাড় ঘোষনা করিবেন। আর যে সকল জনগণ নিরানন্দের সহিত এই কার্যে লিপ্ত থাকিবেন তাঁহাদের তলিকা প্রস্তুত করিবার জন্য সমস্ত কোতোয়ালীকে নির্দেশ দেওয়া হইবে। এই প্রকল্প সর্বাঙ্গসুন্দর করিয়া তুলিবার জন্য বাছুরকালেই তাহাদের জন্য এবং তাহাদের ভরনপোষনের দায়িত্বে নিয়োজিত দেশবাসীর জন্য ডিজিটাল সামাজিক রক্ষণাবেক্ষণ পত্র বিতরণ করা হইবে।“

আমার কিংকর্তব্যবিমূঢ় অবস্থা দেখিয়া কোতোয়াল সাহেব একটু বিরতি ঘোষণা করিয়া তাঁহার জলের গেলাসটি আমার দিকে এগিয়ে দিলেন। 

আমি এক নিঃশ্বাসে সেই জল গলাধঃকরন করিয়া একটু ধাতস্থ হইলে কোতোয়াল সাহেব আবার শুরু করিলেন,”এটি একটি বৃহৎ প্রকল্প। বর্তমান সরকার দ্বারা পরবর্তী সরকার গঠিত হইলে এই প্রকল্প আলোকের গতিবেগ পাইবে বলিয়া দেশের বহু বিদদ্ধ রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের ধারনা। এই কারনে উদাহরণ স্বরূপ প্রসন্ন গোয়ালিনীর গাভী মঙ্গলাকে লইয়া গাভী মুদ্দার এক রাজনৈতিক নেতা এলাকার ভোটদাতাদের ঘরে ঘরে ঘুরিয়া ফিরিতেছেন তাঁহার দলের হাইকমান্ডের নির্দেশে। অতএব মঙ্গলা এখন জাতীয় সম্পত্তি। ব্রাহ্মণ আশা করি তুমি তোমার “গরু কার?” প্রশ্নের উত্তর জলবৎ তরলং রূপে অবগত হইয়াছ। যাও, ঘরে প্রত্যাবর্তন করিয়া প্রসন্ন গোয়ালিনীকে দুশ্চিন্তা করিতে মানা কর। রাজনৈতিক প্রচার সম্পন্ন হইলেই সে সময় মতো মঙ্গলাকে ফেরত পাইবে। তাহার পর সে যেন অতি অবশ্যই মঙ্গলাকে যত্নআত্তি করিয়া পর্যাপ্ত ভোজন করাইয়া প্রস্তুত রাখে। কিছুদিনের মধ্যেই হাইকমাণ্ডের প্রতিনিধি এই অঞ্চলে আসিলে আবার মঙ্গলার প্রয়োজন হইবে।“

কিংকর্তব্যবিমূঢ় অবস্থাতেও আমি প্রশ্ন করিলাম,”আচ্ছা, বকনা বাছুর তো বড় হইয়া গাভী হইয়া দুগ্ধ প্রদান করিবে, কিন্তু এঁড়ে বাছুরগুলির ভবিষ্যৎ কি?”

কোতোয়াল সাহেব আমাকে পূর্ণদৃষ্টিতে দেখিয়া কহিলেন,”গুড কোশ্চেন। বর্তমানে এঁড়ে বাছুর গুলির সিংহ ভাগ সিংহ-ব্যাঘ্র এবং আরও সকল মাংশাসী প্রাণীদের খাদ্যরূপে বিবেচিত হয়। আর অবশিষ্ট এঁড়ে বাছুরসকল ষণ্ডরূপে কাশীর শহরের ন্যায় অপর সকল শহরের মন্দিরের অলিগলি এবং গ্রামগঞ্জ-শহরের বাজার অলোকিত করিয়া থাকে। তবে অতি শীঘ্রই সিংহ, ব্যাঘ্র এবং আর সকল মাংশাসী প্রাণীদের নিরামিষাশী প্রাণীতে পরিণত করিবার জন্য এক ব্যায়ামবীর মহারাজকে হিমালয়ের জরিবুটি সহযোগে এক বটিকা আবিস্কার করিবার গবেসনা কার্যে নিযুক্ত করা হইয়াছে। তবে মহারাজ এক সাংবাদিক সম্মেলনে বলিয়াছেন যে সিংহ-ব্যাঘ্র ইত্যাদি মাংশাসী প্রাণীদের নিরামিষভোজী করিতে শুধু আয়ুর্বেদিক বটিকার ওপর নির্ভর করিলেই চলিবে না, সেই সঙ্গে তাহাদের কিছু পাওয়ার যোগাও করাইতে হইবে।“

একটু দম লইয়া কোতোয়াল সাহেব আমার দিকে একবার ক্রুণাঘন দৃষ্টি নিক্ষেপ করিয়া আবার তাঁহার বক্তৃতা শুরু করেন,”এই প্রকল্প সফল হইলে দেশের সমস্ত এঁড়ে বাছুর ষণ্ডরূপে আমাদের দেশের সর্বত্র বিচরন করিতে করিতে দেশের সমগ্র ষন্ডশক্তির অবিরাম প্রদর্শন করিয়া সমস্ত বিশ্বকে স্তম্ভিত করিয়া দিবে। আমাদের পড়শী দেশগুলি আমাদের ষণ্ডশক্তির প্রদর্শনে যারপরনাই ভীত সন্ত্রস্ত হইয়া আমাদের বশ্যতা স্বীকার করিয়া লইবে।“ 

কোতোয়ালের কবল হইতে নিস্তার পাইবার ইহাই সুবর্ণ সুযোগ বুঝিয়া আমি বলিয়া উঠি,”এই অতীব লোমহর্ষক সংবাদটি এই মূহুর্তে প্রসন্ন’র অবগত হওয়া অত্যন্ত জরুরি। তাহার মঙ্গলা এখন দেশের এক বৃহত্তম কর্মকাণ্ডে নিযুক্ত আছে। অতএব তাহার দুশ্চিন্তা করিবার কোন কারন নাই।“ 

এই বলিয়া আমি আর পশ্চাতে না তাকাইয়া একপ্রকার দৌড়াইয়া কোতোয়ালী ত্যাগ করিয়া গৃহাভিমুখী হইলাম। 

পথ চলিতে চলিতে হেঁটমুন্ড আমি ভাবিতে লাগিলাম “গরু কার?” প্রশ্নের উত্তর তো আমি তো অষ্টরম্ভা স্বরূপ অনেক কিছু বুঝিলাম, এক্ষণে প্রসন্নকে বুঝাইব কিরূপ! 

এই চিন্তায় গৃহে প্রত্যাবর্তন করিয়াই কাগজ আর কলমদানির সাহায্য লইয়া লেখক, তোমায় এই পত্রাঘাত। অতি সত্বর এই পত্রের উত্তরের আশা রাখি।

নমস্কারান্তে,

ভবদীয় 

শ্রীকমলাকান্ত চক্রবর্ত্তী 

1 comment: