প্রাচীন কথা - দোলা সেন
Posted in প্রাচীন কথা
প্রাচীন কথা
পঞ্চকন্যা - মন্দোদরী
দোলা সেন
অহল্যা দ্রৌপদী কুন্তী তারা মন্দোদরীস্তথা।
পঞ্চকন্যা স্মরেন্নিত্যং মহাপাপম বিনাশনম॥
পঞ্চকন্যার পঞ্চমা। এই কন্যাটির জন্য সপ্তকাণ্ড রামায়ণে বেশি শব্দ ব্যয় করেননি মহাকবি বাল্মিকী। কিন্তু ব্যক্তিত্বের হীরকদ্যুতির প্রভায় তাঁর এই স্বল্প উপস্থিতিও মনের চোরাকুঠুরিটা আলোয় আলোময় করে তোলে।যত অল্প জায়গা জুড়েই থাকুন না কেন, রামায়ণ পড়লে এই নামটি মনের মধ্যে শিকড় গেড়ে বসে – আরও হাজার একটা চরিত্রকে পিছনে ফেলে।
শুরুটা অনেক আগে থেকে। এক মেয়ে কৈলাসে এসেছিল শিবের পুজো করতে। তার সৌন্দর্যে কামমোহিত হলেন আশুতোষ। সেই মেয়ে অপ্সরা মধুরা। দেবতাদের তুষ্টিসাধনই তার কাজ। আর আজকের আহ্বানকর্তা তো স্বয়ং দেবাদিদেব। আত্মনিবেদন শেষে ফিরে যাচ্ছিল মধুরা। গোল বাধলো অন্য জায়গায়। পার্বতী বাড়ি ছিলেন না। তিনি এই সময়েই ফিরলেন। রমনতৃপ্ত স্বামীর মুখ তাঁর নজর এড়াল না। পত্নীব্রত স্বামীর মতোই শিবঠাকুর দেবীকে প্রবোধ দেবার চেষ্টা করলেন, কিন্তু পার্বতীর চোখে পড়ল মধুরার স্তনের উপর মহেশ্বরের ভস্মের চিহ্ন। আর যায় কোথায়! রেগে আগুন হলেন পার্বতী। শিবকে তিরস্কার করেও তাঁর রাগ শান্ত হলো না। মধুরাকে শাপ দিলেন – তুই কুয়োর ব্যাঙ হয়ে থাক!
এখানে লক্ষণীয় বিষয় এটাই যে পার্বতী কিন্তু শিবকে অভিশাপ দেননি! নিজের কপালকেই দুষলেন বরং। অপরাধের সব দায় তো সেই সত্যযুগ থেকেই নারীর। “হীরের আংটি”রা সোজা না ব্যাঁকা সেটা ধর্তব্যের মধ্যে কোনকালেই ছিল না।
শিবঠাকুরের বোধহয় একটু খারাপ লেগেছিল। তাই তিনি দেবীকে বুঝিয়ে টুঝিয়ে অভিশাপটাকে একটু হালকা করে দিলেন। মধুরা এক নোংরা কুয়োর ব্যাঙ হয়ে থাকবে আজীবন নয়, মাত্র বারো বছর! শুধু তাই নয়, এই ‘সামান্য’ কটা দিন কেটে গেলেই সে তার সুন্দর রূপ ফিরে পাবে এবং এক মহা পরাক্রমী বীরকে স্বামী রূপে লাভ করবে।
মধুরার আর কোন আপশোষ না থাকারই কথা!
কশ্যপমুনির ছেলে মায়াসুর আর তার বউ অপ্সরা হেমার দুই ছেলে। মায়াবী ও দুন্দুভি। কিন্তু একটি মেয়ের বড় শখ তাদের। তাই দুজনে মিলে বনে গিয়ে শিবের তপস্যা করছিলেন। সেই সময় মধুরার বারো বছর পূর্ণ হলো। নির্জন বনের কুয়ো থেকে মেয়ের গলার কান্না শুনে সেখান থেকে মধুরাকে উদ্ধার করলেন এই দম্পতি। এই কন্যা শিবের দান জ্ঞানে তাকে নিয়ে মনের আনন্দে বাড়ি ফিরে এলেন। নাম রাখলেন মন্দোদরী।
দিন যায়। একদিন শিবের বর সত্যি করে রাক্ষসরাজ রাবণের সঙ্গে মন্দোদরীর বিয়ে হলো। যথাসময়ে তাঁদের তিনটি ছেলে হলো – মেঘনাদ, অতিকায় আর অক্ষয়কুমার। শৌর্যে বীর্যে মেঘনাদই সর্বশ্রেষ্ঠ। বাবার চোখের মণি।
মন্দোদরী পতিপ্রাণা পত্নী। তিনি রাবণকে নিজের চেয়েও বেশি ভালোবাসেন। তবু স্বামীর কোন কাজ অন্যায় বলে মনে হলে, তার প্রতিবাদ করতে কখনো পিছু হটেন না। কিন্তু, সেই চিরন্তন পুরুষতান্ত্রিকতার সমস্যা! বউয়ের কথা যতই যুক্তিযুক্ত হোক, রাবণ তা মোটেও শোনেন না।
অতএব মন্দোদরীর বারংবার নিষেধ সত্ত্বেও রাবণ বেদবতীকে ধর্ষণ করবেন এবং অভিশপ্ত হবেন – কোন নারীর ইচ্ছার বিরুদ্ধে তাতে উপগত হলে রাবণের তৎক্ষণাৎ মৃত্যু ঘটবে। রামায়ণের কিছু সংস্করণ অনুযায়ী এই বেদবতীই পরে সীতা হয়ে জন্ম নেন এবং রাবণবংশ ধ্বংসের কারণ হন।
ইতিমধ্যে রাম সীতা ও লক্ষ্মণকে নিয়ে পিতৃসত্য পালনের জন্য চোদ্দ বছরের বনবাসে এসেছেন। পঞ্চবটী বনে থাকাকালীন রামের আদেশে শূর্পনখার নাক কান কেটে নিলেন লক্ষ্মণ। ছোটবোনের এহেন লাঞ্ছনায় স্বাভাবিকভাবেই রাবণ খুব রেগে গেলেন। রামকে উচিত শিক্ষা দিতে তিনি ছদ্মবেশে সীতাকে হরণ করে লঙ্কায় নিয়ে এলেন। মন্দোদরী যথারীতি নিষ্ফল প্রতিবাদ করলেন। এই পর্যন্ত ঠিক ছিল। কিন্তু সীতার রূপ রাবণকে উন্মত্ত করে তুলল। তিনি সীতাকে বিয়ে করতে কৃতসংকল্প হলেন। সীতার প্রত্যাখ্যান তাঁকে আরও ক্রুদ্ধ করল। কিন্তু বেদবতীর অভিশাপের দরুন তিনি অসহায়। সীতার সঙ্গে কোনরকম জোর জবরদস্তি করা তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়। তাই রাগের মাথায় তিনি সীতাকে হত্যা করতে উদ্যত হলেন। এইবার সর্বশক্তি দিয়ে প্রতিরোধ করলেন মান্দোদরী। মূলতঃ তাঁর জন্যই প্রাণে বেঁচে গেলেন জনকনন্দিনী। কিন্তু, মজার কথা এটাই যে মন্দোদরী সীতাকে নীচকুলের মেয়ে ভাবলেও স্বামীর প্রতি তাঁর একান্ত নিষ্ঠাকে তিনি শ্রদ্ধা করতে পেরেছিলেন। এমনকী তাঁকে দেবী অরুন্ধতীর সঙ্গে তুলনা করতেও তাঁর বাধে নি। এই চিন্তার প্রসারতা বিশেষ করে সেই যুগে আমাদের বড়ই বিস্মিত করে। ভুললে চলবে না, এ সেই যুগ, যেখানে শূদ্র হযে বেদ পড়ার অপরাধে মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা করেন সর্বশাস্ত্রনিপুণ যুগাবতার রামচন্দ্র স্বয়ং।
মন্দোদরী রাবণকে আপ্রাণ বোঝাতে চেষ্টা করেন যে, এক সামান্যা নারীর জন্য রামের মতো মহাবীর এবং প্রভাবশালী রাজপুত্রের সঙ্গে শত্রুতা করা কোন কাজের কথা নয়। বিশেষতঃ তাঁর দৈবী ক্ষমতা ও তাঁর উপর দেবগণের অপার করুণার কথা সর্বজনবিদিত। কিন্তু রাবণের ভারি বয়েই গেছে সে কথা শুনতে!
অতএব যুদ্ধ বাধল। যুদ্ধের শুরুতেই রাবণের ভাই বিভীষণ রাক্ষসদল ত্যাগ করে রামের পক্ষে যোগ দিলেন। এর ফলে রাক্ষসপক্ষের অনেক গোপন কথা রাম আগেভাগেই জানতে পেরে যান। এই জ্ঞান তাঁর যুদ্ধজয়ে একটা বড় ভূমিকা নিয়েছিল।
একে একে রাক্ষসদের সবাই মারা যেতে লাগল। মন্দোদরী তাঁর তিন পুত্রকেই হারালেন। রাবণের ভাই কুম্ভকর্ণ, বিভীষণের পুত্র তারিণীসেন – সকলেই মারা গেলেন। এবার রাবণের পালা।
রাবণ অত্যন্ত নিষ্ঠাবান পূজারী। যুদ্ধযাত্রার আগে তিনি এক যজ্ঞের আয়োজন করলেন। একাসনে বসে সেই যজ্ঞ শেষ করতে পারলে তাঁকে আর কেউ হারাতে পারবে না। তিনি হবেন অজেয়। স্বভাবতঃই এই খবর রামের চিন্তা বাড়ালো। বিভীষণের পরামর্শে তিনি অঙ্গদকে পাঠালেন যজ্ঞ পণ্ড করতে। অঙ্গদ যজ্ঞস্থলে গিয়ে মন্দোদরীর চুল ধরে টানতে টানতে নিয়ে চলল। স্ত্রীর অপমানের কাছে তুচ্ছ হয়ে গেল রাবণের নিজের সুরক্ষার চিন্তা। তিনি আসন ছেড়ে উঠলেন অঙ্গদকে শায়েস্তা করার জন্য। অঙ্গদ তো এটুকুই চাইছিল। সে যঃ পলায়তি স জীবতি অনুসরণ করে প্রাণ রক্ষা করল। এরপরেও কিন্তু রাবণকে মারার পথ প্রশস্ত হল না। কারণ, রাবণকে মারতে হলে একটি বিশেষ তীর চাই এবং সেই একমাত্র বিশেষ তীরটি মন্দোদরীর কাছে গোপনে সুরক্ষিত থাকে। বিভীষণের কাছেই এ তথ্য জানা গেল। মন্দোদরীর সরলতার সুযোগ নিয়ে হনুমান কৌশলে তাঁর কাছ থেকে সেই বিশেষ তীরটি চুরি করে আনল। এরপর রামকর্তৃক রাবণবধ তো শুধু সময়ের অপেক্ষা।
আর মন্দোদরী? আমরা যুদ্ধক্ষেত্রে তারার মতো আরেক শোকাকুলা রমণীকে পাই – যিনি রামের দ্বারা সহমরণে বাধাপ্রাপ্ত হলেন। হয়ত বা রামের প্রবোধ বাক্যে তিনি কিছু সান্ত্বনা পেয়ে থাকবেন। কিন্তু তিনি বিভীষণকে বিবাহ করতে সম্মত হলেন না। পরিবর্তে নিজেকে অন্তরীণ করে রাখলেন রাজপ্রাসাদের নিভৃত কোণে। তাঁকে বিরক্ত করার সাহস কারো হলো না! তারার থেকে এইখানে তিনি স্বতন্ত্র। তারার দুর্বলতা ছিল পুত্র অঙ্গদ। কিন্তু মন্দোদরীর সন্তানেরা সবাই যুদ্ধে বীরগতি লাভ করেছিল। তাই তাঁর কোন দায়বদ্ধতা ছিলনা।
কিন্তু, সত্যিই কি তাই? তাহলে এর কিছুদিন পরে তিনি স্বেচ্ছা নির্বাসন থেকে আবার জনজীবনে ফিরে বিভীষণকে স্বামী হিসেবে স্বীকার করে নিলেন কেন? চমকের এখানেই শেষ নয়, রামায়ণকার বলছেন, এ নিতান্তই এক কূটনৈতিক বিবাহ। মন্দোদরী কখনোই তাঁর স্বামী, পুত্র ও বংশনাশের অন্যতম কারিগরটিকে স্বামীর মর্যাদা দেননি! তবে রাজ্য পরিচালনার কাজে সহায়তা করেছেন।
মহাকবি মন্দোদরীর জন্য আর কালি খরচ করেননি। কিন্তু মন্দোদরীর এই সিদ্ধান্ত আমাদের মনে অনেকগুলো প্রশ্নের জন্ম দেয়। বিভীষণকে স্বীকারই যদি না করবেন, তাহলে এ বিবাহের কী প্রয়োজন ছিল? তাহলে কি রাক্ষস সমাজ একজন গৃহশত্রুকে তাদের অধিপতি হিসেবে মানতে রাজি হচ্ছিল না? রাজ্যকে খণ্ড বিখণ্ড হয়ে যাওয়া থেকে বাঁচাতেই কি মন্দোদরীর এই পদক্ষেপ? মনে হয় তাই। নয়তো সেই পুরুষপ্রধান যুগে বিভীষণ মন্দোদরীর এই অবস্থান মেনে নিতেন না নিশ্চয়। সিংহাসন বাঁচাবার জন্য তিনি বাধ্য হয়েছিলেন এই শর্তে রাজি হতে। অবশ্য এসবই আমার যুক্তিনির্ভর অনুমান। প্রকৃত অধিকারী কেউ এ বিষয়ে আলোকপাত করলে কৃতজ্ঞ থাকব।
তারাও খানিকটা এইসব কারণেই সুগ্রীবের পতিত্ব স্বীকার করেছিলেন। কিন্তু মন্দোদরী তাঁর প্রতিবাদী অবস্থানে অনেক বেশি উজ্জ্বল। আর এখানেই তিনি বাকিদের চেয়ে এক কদম এগিয়ে। তিনি আপোষের রাস্তায় চলেননি।
মন্দোদরী রাবণকে ভালোবেসেছিলেন। তাই তাঁর অন্যায়ের প্রতিবাদ করলেও দিনের শেষে স্বামীর অনুগত হতে তাঁর বাধেনি। কিন্তু যখন তিনি বিভীষণকে রাজ্যের প্রয়োজনে স্বামী হিসেবে স্বীকার করে নেন, তখন অন্দরমহলে তার জন্য এক অনতিক্রম্য পাঁচিল খাড়া করে দিলেন। ত্রেতাযুগে তিনি যে অসীম মনোবল এবং স্বাধীন ভাবনার পরিচয় দিলেন, তা আজকের যুগেও এক উদাহরণ হয়ে রইল। নারীর এই রূপ তৎকালীন সমাজভাবনার পক্ষে নিরাপদ নয় বলেই হয়তো বাল্মিকী মন্দোদরীর এই আচরণের ব্যাখ্যায় যাননি।
*
এই পাঁচজন নারীকে শ্লোককার কন্যা বলে উল্লেখ করেছেন। এঁদের পরিচয় দিতে গিয়ে গৃ্হিনী, দুহিতা, সচিব, সখী, ললিতা এমন কি জননী শব্দটাও উচ্চারিত হয়নি। শ্লোককার কি এই ইঙ্গিত দিতে চেয়েছিলেন যে এই পাঁচজন শুধুই কন্যা? আপনার পরিচয়ে আপনি ভাস্বর। বাকি অভিধা তাঁর অলঙ্কার হতে পারে যদি সে চায়, কিন্তু তার পরিচয় সে নিজে।
এই নগ্ন সত্য বড়ো কঠিন। তাই কি রূপকের আড়ালে ঠেলে দিয়ে পুজোর বেদীতে বসাবার চেষ্টা? জীবজগত যে পঞ্চভূতে তৈরি সেই জল, আগুন. মাটি, বাতাস আর আকাশের সঙ্গে তুলনা টানা হল অহল্যা, দ্রৌপদী, কুন্তী, তারা আর মন্দোদরীর। জলের স্বচ্ছ্বতা, আগুনের তেজ, মাটির সহনশীলতা, বাতাসের অনিবার্যতা এবং আকাশের উদাসীন সর্বব্যাপী ভাবনার সঙ্গে এই পাঁচ নারীর তুলনা। জীবজগতের সৃষ্টির সঙ্গে মিলিয়ে দিয়ে মাতৃরূপে সংস্থিতার পূজার্চনা। এর একটা কারণ বোধহয়, রমণীর এই রূপেই পুরুষ নিজেকে সবচেয়ে সুরক্ষিত এবং অসমালোচিত মনে করে।
রূপক ছেড়ে যদি সাধারণভাবে এই পাঁচজনের জন্ম ও জীবনকথার দিকে তাকাই তাহলে আমরা কী দেখি?
প্রথম কন্যা অহল্যা অযোনিজ। তিনি প্রজাপতি ব্রহ্মার মানসকন্যা। পৃথিবীর মরমানুষের মলিনতা তাঁকে স্পর্শ করে না। নগরজীবন থেকে অনেক দূরে একান্ত প্রকৃতির কোলে তপোবনের পবিত্র পরিবেশে তাঁর বেড়ে ওঠা। তাঁর সারল্য প্রশ্নাতীত। বিবাহসূত্রে মহামুনি গৌতমের পত্নী।
দ্বিতীয় কন্যা দ্রৌপদী। ইনিও অযোনিজ। তবে রাজা দ্রুপদের সন্তান কামনার যজ্ঞের আগুন থেকে তাঁর আবির্ভাব।মানুষী প্রার্থনা আর দেবতার আশীর্বাদের মিলিত ফসল। রাজপরিবারে বড়ো আদরে সম্মনে বড় হয়ে ওঠা। তেজস্বিনী এই নারী পঞ্চস্বামীর পত্নী।
তৃতীয় কন্যা কুন্তী। রাজবংশে সাধারণ মানবজন্ম। শৈশবেই মা-বাবাকে ছেড়ে অন্য রাজার আশ্রয়ে দাসীর সান্নিধ্যে বড়ো হয়ে ওঠা। অপারগ স্বামীকে সন্তান দান এবং পরবর্তী জীবনে তাদের সিংহাসনে সুপ্রতিষ্ঠিত করার মতো লড়াইটা তিনি জয় করতে পেরেছিলেন।
চতুর্থ কন্যা তারা। দেবতা, রাজপরিবার ছেড়ে এবার সাধারণ ঘরে নেমে এসেছেন শ্লোককার। তারার পিতা অনার্য রাজবৈদ্য। তিনি বিবাহসূত্রে রাজরানী। সামাজিক রীতিনীতি মেনেও পুরুষের পাশে দাঁড়িয়ে সমানভাবে রাজ্যচালনায় সক্ষম এক নারী।
পঞ্চম কন্যা মন্দোদরী – দেবতাদের চিত্তবিনোদনে নিবেদিত এক অপ্সরা। তবুও মহেশ্বরের ইচ্ছাপূরণের দায়ে অভিশপ্ত জীবন। এরপর এক অনার্যের কন্যারূপে পালিতা। রাক্ষসরাজ রাবণের স্ত্রী। স্বামীর মৃত্যু পরে নিজের শর্তে জীবন কাটাতে পারা এক বিদ্রোহিনী।
এই যে ক্রমবিন্যাস – এর সবটাই কি সমাপতন? একটু কষ্টকল্পনা লাগছে না কি? কি বলতে চেয়েছেন শ্লোককার? নারীর পরিচয় জন্মে নয়, তার পাতিব্রত্যে নয়, তার পরিচয় তার কর্মে, তার বিশ্বাসের সততায়, চারিত্রিক দৃঢ়তায়? সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্র থেকে উঠে আসা এই পাঁচ নারী একই কর্মসূত্রে বাঁধা। সামাজিক বাধানিষেধ অতিক্রম করে তাঁরা পুরুষের সঙ্গে একাসনে বসেছেন জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে। সমাজ তাঁদের দিকে বারবার বাড়িয়ে দিয়েছে বেদনার বিষে নীল পেয়ালা। তাঁরা পান করেছেন, যন্ত্রণায় দীর্ণ হয়েছেন, কিন্তু স্বধর্মচ্যুত হননি। সমাজ তাঁদের নাম জপ করেছে তাঁদের ভুলতে পারেনি বলেই। প্রভাতে নামজপ করেছে, কিন্তু সন্ধ্যায় নিজের মেয়েকে বলেনি – এদের মতো হও। মানতে পারেনি – হৃদয়ের স্থান, সত্যের স্থান সমাজের উপরে।
তবু তাঁরা আসেন যুগে যুগে। তাঁদের স্মরণে মহাপাপ বিনষ্ট হয়। মহাপাপ কি? আমার স্বল্পবুদ্ধিতে মনে হয়েছে ভয়ের চেয়ে বড় পাপ আর কিছু হয় না। ভয় মানুষকে যত নীচু করে তত আর কিছুতে করে না। পঞ্চকন্যার জীবনধারা বিভিন্ন দিকে প্রবাহিত হলেও এই একটি জায়গায় তাঁরা সবাই এক। তাঁরা নির্ভয়। যন্ত্রণা দিয়ে, অপমান আর অবিচার করেও সমাজ তাঁদের মেরুদণ্ড বাঁকাতে পারেনি। তাই তাঁরা সত্য জীবনের দিগদর্শক। তাই তাঁরা প্রণম্য।
0 comments: