0

গল্প - শুভম চৌধুরী

Posted in

গল্প


হাওয়া 
শুভম চৌধুরী


আজও সারাদিন কাঠফাটা রোদ্দুরটা থাকবে মনে হচ্ছে- দাঁত মাজতে মাজতে বাথরুমের ছোট্ট জানলাটা দিয়ে বাইরেটা দেখে নিলেন বল্লভবাবু। হাতঘড়ি বলছে সোয়া ছটা বাজছে, শ্রেয়সী সবে উঠেছে বলে মনে হয়, সৌম্য কিছুতেই সাড়ে সাতটার আগে উঠবে না। গায়ত্রী সবে ঘুম থেকে উঠলেন...আহ আজ অনেকদিন বাদে তিনি বেটার হাফকে বিট করতে পেরেছেন, আজ তো স্পেশাল ডে। 

"বাবা চায়ের জল বসালাম" - শ্রেয়সী রান্নাঘর থেকে বল্লভবাবুর উদ্দেশ্যে বলে। 

"সৌম্যকে ডাকো, কত ঘুমোবে" - মুখ মুছতে মুছতে বলেন বল্লভবাবু। 

"কাল নাকি রাত দুটো অব্দি বিজনেস পার্টনার এর সাথে কল ছিলো, ডাকলাম উঠলো না"- শ্রেয়সী অভিযোগ জানায় শ্বশুরকে। 

"মহিলা বিজনেস পার্টনার নয় তো?" বল্লভবাবু হালকা চোখ টেপেন। 
"কে জানে, মরুক গে যা পারে করুক" - শ্রেয়সীর গলায় মেকি হতাশার সুর। 

নির্বাচনী হিংসার বলি আরও দুই...তিন জেলাতেই ছাপ্পার অভিযোগ...আবহাওয়া দফতর আজও আশ্বাস বাণী শোনাতে পারল না...বল্লভবাবু বিরক্তিকর মুখে কাগজটা একবার চোখ বুলিয়ে নিলেন। 

"আজ আবার গোপা কাজ করতে আসবে না, এদের একটা ছুতো পেলেই হলো "- চা খেতে খেতে গজগজ করতে লাগলেন গায়াত্রী। 

"আরে বাবা আজকের দিনে তো ছুটি নিতে হবে, সৌম্য, বৌমা এদেরও তো ছুটি নাকি? ভোট বলে কথা" গোপার সাংবিধানিক অধিকার প্রতিষ্ঠা করবার মরিয়া চেষ্টা করেন বল্লভবাবু। 

"রাখো তোমার ভোট, সবই তো এক" গায়াত্রী বিরক্ত হন। 

বল্লভবাবু কথা না বাড়িয়ে একমনে চা খেতে লাগেন। ভোট দেওয়ার উৎসাহ তাঁর আছে, এতে কে কি বললো, না বললো তিনি থোড়াই কেয়ার করেন। 

সাড়ে আটটার মধ্যে মাছ আর সবজি কিনে বাড়ী ফিরে এলেন বল্লভবাবু। পেটটা মোচড় দেওয়াতে আর একবার বাথরুম যেতেই হলো। চান করে ফ্রেশ হয়ে সাদা পাজামা আর ঘিয়ে কালারের পাঞ্জাবী চাপিয়ে নিলেন ওপরে, ঘড়িতে তখন নটা দশ। অল সেট টু কাস্ট দ্য ভোট মার্কা মুখ করে আয়নায় দেখে নিলেন নিজেকে। সৌম্য বাথরুমে ঢুকেছে, শ্রেয়সী ল্যাপটপে কি সব করছে, গায়াত্রী সবজির খোসা ছাড়াচ্ছেন, আর নাতনি অত্রি বই নিয়ে পড়তে বসবে কিনা ভাবছে। 

গায়াত্রীকে বলে বিদ্যাসুন্দরী হাইস্কুলের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লেন বল্লভবাবু। ঠিক ছয় মিনিট চোদ্দ সেকেন্ডের মাথায় স্কুলের গেটে পৌঁছাতে দেখলেন বহু চর্চিত কেন্দ্রীয় বাহিনীদের। এমনিতে এই স্কুলটাকে কেউ পাত্তা দেয় না বড়ো একটা, কিন্তু আজ ব্যাপারটা অন্য। জলপাই পোশাকে অস্ত্র হাতে টহল দিচ্ছে বাহিনী, গুটখার পিক ফেলতে ফেলতে উত্তেজিতভাবে আলোচনা করছে মহান ক্যাডারের দল, মিন্টু, সন্তু, বাবলি, মণ্ডলদা, কাজল, হাসান, পিঙ্কিরা একে একে ভেতরে ঢুকছে আর বেরোচ্ছে। ভোটের স্লিপটা দেখে নির্দিষ্ট ঘরের দিকে পা বাড়ালেন বল্লভবাবু। ঠিক যা ভেবেছিলেন তাই, সামনে লম্বা লাইন, এসেছেন যখন ফিরে যাওয়ার মানে হয় না, অতএব লাইনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে লাগলেন বল্লভবাবু। 

ভোটদাতারা এলুম, দেখলুম সাবড়ে দিলুম ভাব করে আঙ্গুলের কালি প্রদর্শন করতে করতে বেরিয়ে আসছে, যদিও লাইনটা কমার বদলে কেমন যেন বেড়ে চলেছে মনে হচ্ছে। বল্লভবাবুর পিঠটা ঘামে ভিজে সপসপ করছে, সামনের ছেলেটা দুবার বিকট শব্দ করে হাঁচায় এক জওয়ান এসে ধমক লাগিয়েছে "ইতনা জোর সে মত ছিঁকো"। ঠিক পঁচিশ মিনিট বাদে চার নম্বর রুমের ভেতরে ঢুকলেন বল্লভবাবু। গনত্রন্তের ঝাণ্ডা ভোটার কার্ড চেপে ধরে এগিয়ে গেলেন ভোট কর্মীদের দিকে। হাতের স্লিপটা এগিয়ে দিতে চার জোড়া চোখ খুঁজতে লাগলো বল্লভবাবুর নাম। তর্জনী এসে স্থির হলো নির্দিষ্ট জায়গায়....."আরে, আপনার তো ভোট দেওয়া হয়ে গেছে"। 


"বেশ হয়েছে, আরও ভোট ভোট কর " গজরাতে গজরাতে গায়াত্রী জলের গ্লাসটা এগিয়ে দিলেন। বল্লভবাবু থম মেরে বসে আছেন সোফায়। প্রিসাইডিং অফিসারকে তিনি কিছুতেই বোঝাতে পারেননি যে তাঁর ভোট তিনি দেননি, উঁচু গলায় কথা বলতে এক জওয়ান তাঁকে একরকম জোর করে বাইরে বের করে দেয়। লাইনে দাঁড়ানো পাড়ার লোকগুলো বিক্ষুব্ধ বল্লভবাবুকে দেখে কৌতুক মেশানো সহানুভূতি জানায়, কেউ কেউ চিড়িয়াখানার শিম্পাঞ্জী দেখানোর মতো করে আসে পাশের লোকেদের দেখায় -"ওই যে ওই দাদুর নামে ছাপ্পা পড়েছে"। খোরাকের রোল পড়ে যায় চারিদিকে। খুব আশা করেছিলেন এইবার ভোটটা দিতে পারবেন, ছেলেমানুষী হতে পারে, কিন্তু বাহাত্তর বছর বয়সে এইটুকু চাওয়াটাও কি খুব অন্যায়?পাঁচ বছর বাদে বেঁচে থাকবেন এরকম গ্যারান্টি কেউ তাঁকে দেয়নি, তিনি নিজেও ভালোয় ভালোয় চলে যেতে পারলে বেঁচে যান, শুধু এবারের ভোটটা......নিজের ঘরে এসে এসিটা চালিয়ে শুয়ে পড়লেন বল্লভবাবু, মাথাটা ঝিম ঝিম করছে অনেকক্ষণ। 

দুপুরে অল্পই খেলেন, খাসির মাংস নিয়ে একটু নাড়াচাড়া করলেন, মুখে স্বাদ লাগলো না। সৌম্য ব্যাপারটা ক্যাজুয়ালি নিতে বলেছে, "ছাপ্পার জন্য নালিশ করে কোনো লাভ নেই বাবা"। গণতন্ত্র ক্যাজুয়ালি নিতে শিখেছে ছাপ্পাকে, তাই সকালে তাঁর অপমানটা ভারতীয় সংবিধানকে কোনোভাবেই কালিমালিপ্ত করবে না। তবু ভোট দিতে না পাড়ার ভীমরতিটা কিছুতেই মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলতে পারছেন না বল্লভবাবু, সকাল দশটার মধ্যে ছাপ্পা পড়ে গেল? এতটাই মেকি আমাদের গণতন্ত্র? বুথের মধ্যে পার্টির একটা ছেলে, কতই বা বয়স হবে, কুড়ি কি একুশ, রীতিমত ধমক দিয়ে তাঁকে বলে "বল্লভ প্যাটেল ভাবছেন নাকি দাদু নিজেকে? বাওয়াল করে লাভ নেই কিছু"। চেষ্টা করেও বল্লভবাবু কিছুতেই ক্যাজুয়াল হতে পারছেন না। 

পাঁচটা নাগাদ রোদটা একটু পড়তে বল্লভবাবু বেরিয়ে পড়লেন বাড়ী থেকে। বন্ধ ঘরে অনেকক্ষণ থেকে হাঁপিয়ে উঠেছিলেন, একটু খোলা হাওয়া দরকার। চেনা কোনো জায়গায় যেতে ইচ্ছে করলো না, সকালের খবরটা নিশ্চয় সবাই জেনে গেছে, দ্বিতীয়বার শিম্পাঞ্জী হওয়ার ইচ্ছা তাঁর নেই। একটা রিক্সায় চেপে বসলেন, যেদিকে খুশী যাওয়া যায়, ছাপ্পার ভয় নেই এখানে আপাতত। অনেকক্ষণ পর একটা বড়োসড়ো চায়ের দোকান দেখে জায়গাটা বেশ মনে ধরল, এদিকটা আসেননি এর আগে। ভোট প্রায় শেষ বলে দোকানগুলো সব খুলেছে, এই দোকানটাতেও লোকজন মোটামুটি আসছে। চা আর চিঁড়ের অর্ডার দিয়ে বসলেন একটা কোণার বেঞ্চিতে। 

শালা পাঁচশটা ছাপ্পা পার বুথ দিয়েছি, জিতব না মানে" 

"গাণ্ডু, আস্তে কথা বল " 

"যাই বল রতনা, খেটে কাজ করেছি কদিন, আজ কিন্তু রাতে মাল্লু চাই" 

"ক্লাবে চলে আসবি রাত নটার মধ্যে, স্পেশাল শো আছে, সাথে ওল্ড মঙ্ক" 

"উফফ চুমু রতনা তোকে চুমু, শালা হিসি পেয়েছে জোরে, চল মুতে বেড়িয়ে যাই" 

ঠিক পিছনের বেঞ্চি থেকে কথাগুলো আচমকা উড়ে এলো বল্লভবাবুর কানে। আস্তে আস্তে বললেও একটাও শব্দ মিস করেননি তিনি, শিঁড়দাঁড়া সোজা রেখে ঘাড় ঘুরিয়ে বসে রইলেন ছেলে দুটো না ওঠা অব্দি। ওরা চলে যেতে এতক্ষণ ধরে রাখা শ্বাসটা ছাড়লেন, কপালটা ঘেমে উঠেছে, সাত পাঁচ না ভেবেই উঠে পড়লেন একটু পর। চায়ের দোকানের বাইরে আসতে, দেখতে পেলেন ছেলে দুটোকে, ওরা ওঠার সময় কায়দা করে মুখ দুটো দেখে নিয়েছিলেন। অন্য সময় হলে বল্লভবাবু নিশ্চই বাড়ির রাস্তা ধরতেন, কিন্তু আজ অন্য রকম। দূর থেকে ফলো করতে লাগলেন ছেলে দুটোকে। বাহাত্তর বছরের বল্লভ হালদার জানেন না কেন তিনি এগোচ্ছেন, কিছু করার আদৌ কোনো ক্ষমতা নেই ওঁর, তবু খালি মনে হতে লাগলো এদেরই মতো কেউ তাঁর আজকের ভোট দেওয়ার অধিকারে ছাপ্পা মেরে এসেছে, হয়ত এই দুজনের কেউ...বল্লভবাবু হাঁটার স্পিড বাড়ালেন। 

একটু দুরে বড়ো রাস্তায় পৌঁছাতে ওরা ট্যাক্সি নিল। আরও একটা খালি ট্যাক্সিছিলো স্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে। স্মার্ট ট্যাক্সির এসির আরামে কয়েক মাস ধরে বল্লভবাবু হলুদ কালো ট্যাক্সিদের যথেষ্ট গাল মন্দ করেছেন, কিন্তু আজ এই ঢাউস গাড়িটাকে নিজের বড়ো আপন বলে মনে হলো। 

"কিধার চলনা হ্যায়?" ট্যাক্সি ড্রাইভারের আপাত নিরীহ এই প্রশ্নটা বল্লভবাবুর কাছে অঙ্ক পরীক্ষার মতো লাগলো। একটু কেশে গলাটা ঝেড়ে নিলেন বল্লভবাবু - "মেরা পোতা এক দোস্ত কে সাথ আগে ট্যাক্সি মে যা রাহা হ্যায়, উনহে ফলো কিজিয়ে" 

আগের ট্যাক্সি ততক্ষণে স্টার্ট দিয়ে দিয়েছে। 

"লেকিন যাবেন কোথায়? কুছ গড়বড়ো হ্যায় ক্যায়া?" 

বল্লভবাবু খুব করুণ গলায় বললেন-"মেরা পোতা মেরা জান হ্যায়, উসকা দোস্ত রোজ উসে কঁহি লে যাতা হ্যায়, মুঝে ঠিক নেহি লাগতা হ্যায়, মুঝে দেখনা হ্যায় ও লোগ কাঁহা যাতা হ্যায়, মদত কিজিয়ে, প্লিজ" 

ট্যাক্সি ড্রাইভারের মধ্যের ভালোমানুষটা গাড়ি স্টার্ট দেয়। 

লুকোচুরি খেলতে খেলতে বল্লভবাবুর পাতানো নাতিদের ট্যাক্সি এসে থামে এক জায়গায়। একটু দূরে গিয়ে বল্লভবাবুর ট্যাক্সি স্টার্ট বন্ধ করলো। "আভি মত যাইয়ে, পহেলে উনহে জানে দিজিয়ে" ড্রাইভার আস্তে আস্তে ফেলুদার ভূমিকা নেয়। 

ছেলেদুটো ভাড়া মিটিয়ে একটা গলির ভেতর ঢুকে পড়ে। বল্লভবাবুর ভাবার সময় নেই, চকিতে নেমে পড়েন রাস্তায়। 

"আপ দশ মিনিট ইন্তেজার করেঙ্গে, প্লিজ?" 

দাদুর আকুল আর্তিতে ড্রাইভার সাড়া না দিয়ে থাকতে পারে না। 

বল্লভবাবু এগিয়ে যান গলির মধ্যে। একটু এগোতে আরও দুটো গলি দুদিকে, দুই ক্যাডার পরস্পরকে টাটা করে বেঁকে গেল স্ব স্ব গলিতে। বল্লভবাবুর হাতে ভাবার সময় অল্প, কোন জন রতন তিনি জানেন না, একটু ভেবে ডান দিকে বেঁকলেন তিনি। তাঁর ফলো করা ক্যাডার অবশেষে একটা একতলা বাড়িতে ঢুকলো। একটা ত্রিফলার তলায় মিনিট দুয়েক দাঁড়িয়ে রইলেন বল্লভবাবু। মনে মনে হিসেব কষে নিলেন, বাহাত্তর বছর বয়সে মরতে এতটুকু সংকোচ হবে না তাঁর, কি করবে এরা? বড়োজোর একটা চুরি চালিয়ে দেবে পেটের মধ্যে, পিস্তল চালালে ওটাই বেটার হবে, দু সেকেন্ড এর মধ্যে অক্কা, বাইপাস করে আরও পাঁচ বছর হাঁপিয়ে হাঁপিয়ে বাঁচার থেকে এই মৃত্যুটা ভালো নয় কি? তাছাড়া মরে গেলে কলেজের সুস্মিতা আর পুরনো সহকর্মিনী চিত্রার সাথে দেখা হলেও হতে পারে, একঘেয়ে গায়াত্রীকে তো বিয়াল্লিশ বছর ধরে দেখছেন। ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটল বল্লভবাবুর, বাড়িটার সামনে গিয়ে কলিং বেলে কাঁপা কাঁপা হাত রাখলেন । 

ঠিক এগারো সেকেন্ডের মাথায় দরজা খুলল, বল্লভবাবুর পাটা থরথর করে কাঁপছে, সাপোর্ট নেওয়ার জন্য দরজার বাইরে গ্রীলটায় হাত রাখলেন। 

"বলুন..." এক বৃদ্ধা প্রশ্ন করলেন দরজা খুলে 

"ওকে ডাকুন, এখনই ফিরল তো, বলুন পার্টির দাদা ডাকছে " গম্ভীর মুখে বললেন বল্লভবাবু। 

"এই তো এলো দুদিন পর, আবার কেন" ...গজরাতে গজরাতে বৃদ্ধা ভেতরে গেলেন। 

বল্লভবাবু বাইরে থেকে শুনতে পেলেন, চিত্ত নামের কাউকে বাইরে যেতে বলা হলো। কিছুক্ষণের মধ্যে পার্টির বিশ্বস্ত ক্যাডার শ্রীমান চিত্ত হাজির। বল্লভবাবু গ্রীলটা ছেড়ে বিবেকানন্দর ভঙ্গীতে দাঁড়ালেন। 

"আপনি কে?" চিত্ত সন্দিহানভাবে প্রশ্ন করল। 

"খালি রতনের সাথে ঘুরলে হবে? পার্টির কাউকে তো চিনিস না...বাইরে চল একটু,কথা আছে..." ঠাণ্ডা মাথায় বল্লভবাবু আলাপ পরিচয় শেষ করলেন.....পা টা আগের মতো আর কাঁপছে না। 

এদিক ওদিক তাকিয়ে চিত্ত বেড়িয়ে এলো, বল্লভবাবু নিজেই এগিয়ে গিয়ে একটা গলির সামনে দাঁড়ালেন, এই জায়গাটা একটু অন্ধকার। 

"আপনাকে চিনলাম না তো ঠিক" চিত্ত দাঁত খুঁটতে খুঁটতে প্রশ্ন করল। 

"বড়দা পাঠিয়েছে....আমরা আণ্ডারকভার এজেন্ট, তোরা শালা চিনবিও না আমাদের, এই দাদু মার্কা ইমেজটা পার্টির কাজে লাগে অনেক, কদ্দিন রাজনীতি করছিস বে বাল?" বহুদিন বাদে খিস্তিগুলো ঝেড়ে উত্তেজিত হয়ে পড়েন বল্লভবাবু। 

"বড়দা ? মানে নিখিল দা?" চিত্ত বড়ো বড়ো চোখে তাকায়। 

"আর কত বড়দাকে তুই চিনিস বে?" অজানা অচেনা নিখিলদার উদ্দেশ্যে মনে মনে ধন্যবাদ জানান বল্লভবাবু। 

"সরি স্যার, একবছর হলো সবে পার্টিতে ঢুকেছি, বলুন কি দরকার?" 

"গাণ্ডু, দরকারটা আমার নয় বে, তোর। রতন তোকে পথে বসাবার ব্যবস্থা করেছে, সে খবর রাখিস?" বল্লভবাবু লাটাই থেকে সুতো ছাড়তে শুরু করেন। 

"কেন? ও মাল কি করল?" 

"এ কে বে তুই? পার্টির খবর রাখিস না তো উদগান্দুর মতো পার্টি করতে আসিস কেন? নিখিলদাকে পার্টির কয়েকজন লিডার বলে মানতে পারছে না, সেটা জানিস না? আজ রাতে তোদের ক্লাবে লালবাজার থেকে লোক আসবে, তোর ছাপ্পা দেওয়ার ফুটেজ চলে গেছে ঠিক জায়গায়, রতন তোকে নাচিয়েছে রে। নিখিলদার কাছের লোকেদের ধরে ধরে ফাঁসাবে, তুই আজ মামাবাড়ী যাবিই" ঠাণ্ডা গলায় কথা গুলো শেষ করেন বল্লভবাবু। 

এরপর ঠিক ত্রিশ সেকেন্ড ধরে চিত্ত, রতনের বাবা এবং মায়ের সাথে গবাদি পশু এবং কলকাতার এক বহুচর্চিত অঞ্চলের মহিলাদের সম্পর্ক স্থাপন করে তার বাক্যবাণের মাধ্যমে। বল্লভবাবু শান্তভাবে বুঝিয়ে দিলেন ক্লাবে চিত্তকে আসতে বলার আসল উদ্দেশ্য কি, ওল্ড মঙ্ক হলো লালবাজারের পুলিশ, আর স্পেশাল শো হলো লক আপে ভরা। 

"কি করব স্যার তাহলে?" চিত্ত পরামর্শ চায় বল্লভবাবুর কাছে। 

"এলাকা ছেড়ে যত তাড়াতাড়ি পারিস পালা, দূরে কোথাও চলে যা" 

"বর্ধমানে চলে যাব? আমার পিসির বাড়ী" 

"যা ওখানে, ইলেকশান শেষ হলে ফিরিস। আর শোন, ভোটার কার্ড, রেশন কার্ড, যা আছে ওসব এনে আমাকে দে, ওগুলো তোর কাছে রাখা সেফ নয়, ঝামেলা মিটলে বাড়িতে পৌঁছে দেব আমি" 

"দিয়ে দেব ওগুলো?" সামান্য সন্দেহের সুর আসে চিত্তর গলায়। 

"দিস না, এরপর, কিছু হলে নিখিলদা তোর দায়িত্ব নেবে না, আমি ফোন করে বলে দিচ্ছি" খেঁকিয়ে ওঠেন বল্লভবাবু। 

এর ঠিক পাঁচ মিনিটের মধ্যে চিত্ত ব্যাগ হাতে বেরিয়ে পড়ে বাড়ী থেকে। ভোটার আর রেশন কার্ড চলে যায় বল্লভবাবুর পাঞ্জাবীর পকেটে। 

"মোবাইলটা অফ রাখিস কদিন, নিখিলদাকে খবরদার ফোন করিস না, মনে রাখিস তুই পার্টির লোকেদের এখন চিনিস না, হাওয়া ঠাণ্ডা হলে বাড়ী ফিরবি " বল্লভবাবু কঠোর নির্দেশ দেন। 

"শালা রতনাকে আমি ছাড়ব না"। 

"যা করার ইলেকশনের পড়ে করিস চিত্ত, যা পালা এখন"। 

চিত্ত পা বাড়ায় হনহন করে, ওল্ড মঙ্ক আর স্পেশাল শো তার কপালে জোটে না। 

"সাব দশ মিনিট বলকে, বিশ মিনিট লাগা দিয়া পুরা, সব ঠিক হ্যায় না? পোতা কিধার গ্যায়া? ট্যাক্সি ড্রাইভার জানতে চায়। 

"পোতা ঠিক আছে একদম, লুডো খেলনে আতা হ্যায় ইধার" 

"লুডো খেলনে? ইতনে দূর? আরি বাপরে, কেয়া জামানা আ গ্যায়া" ট্যাক্সি এগোতে থাকে উল্টো পথে। 

অনেকদিন বাদে আজ সন্ধ্যেতে ভালো হাওয়া দিচ্ছে, বল্লভবাবু সিটে হেলান দিয়ে বসেন আরাম করে।

0 comments: