0

ধারাবাহিক - ফাল্গুনি ঘোষ

Posted in


ধারাবাহিক


বই পাড়ার তন্ত্রধারক
ফাল্গুনি ঘোষ 


১৭৫৭ সালে পলাশির যুদ্ধের সময়ে এক সৈন্যের ধাক্কায় ক্লাইভের মাথার টুপিটি খুলে পড়ে যায়। এক ছোটোখাটো শ্যামলাবরণ বাঙালি সেটি কুড়িয়ে মাথায় পরে নেন। ঐতিহাসিকরা এ-কাহিনি জানেন না, ফলে কোনো হিস্ট্রি কিতাবে এর দেখা মিলবে না। অথচ আজও সেই টুপি মাথায় বাঙালিটির দেখা মেলে বইপাড়ায়। পিঠে একটি ব্যাগ নিয়ে হনহনিয়ে চলেছেন। কোনো মোড়ে বা কোনো দোকানের সামনে অথবা কফিহাউসে কোনো বৃদ্ধ অথবা প্রৌঢ় অথবা যুবক কিম্বা কোনো সদ্যকৈশোর-পেরোনোর সঙ্গে গল্পে মশগুল। মাথায় কবচকুণ্ডলতুল্য অজর অমর টুপি। টুপির প্রাচীনত্ব বিষয়ে ওই শুরুর গল্পটা তাঁরই বলা। বইপাড়ায় এসে পড়ার পর থেকেই এই মানুষটিকে দেখছি হেঁটে চলতে। আশির দশকের গোড়ায় বামপন্থী রাজনীতিকে কেন্দ্র করে তাঁর বইপাড়ায় আগমন। "বইপাড়া বলেই তো এখানে এসেছি আমরা। এটাই তো তখন সব বামপন্থী রাজনীতির লোকদের কেন্দ্র।" এমনটাই বলে থাকেন তিনি। কোথাও যেন শোনা যায় প্রাচীন ইতিহাসের গর্ভে আরেক ইতিহাসের ঘন্টাধ্বনি। বইপাড়া যে এক পুথিগত অবস্থানমাত্র নয়, অনেক স্বপ্ন অনেক ঠিক অনেক ভুল নিয়ে সে যে এক তরতরে জৈবনিকতায় ভরা সভ্যতা, সেই কথাটি বলতে বলতেই যেন একটু থমকান তিনি। যে- মানুষটি রাজ্যের নানা জায়গায় ছুটে বেড়ান বিচারাধীন রাজনৈতিক বন্দীদের সহায়তা করতে, যে-মানুষটি মৃণাল সেনের সঙ্গে বিতর্কে উস্কে গিয়ে তৈরি করে ফেলেন দরিদ্র মানুষের উপর অত্যাচারের সিনেমা-সাক্ষ্য, তিনি আজকের সক্রিয়তার মধ্যেও তাঁর বহুদিন চেনা বইপাড়ার সান্ধ্যকালীন হলদেটে গলিপথ বেয়ে পিছনে তাকান। বলে যান মিছিল থেকে পথ অবরোধ আর স্লোগানের নানা কাহিনি। ফিরে ফিরে এই পাড়ার অলিগলিতে দেখা হয় এককালের সাথীদের সঙ্গে, যাঁরা এককথায় যেকোনো অন্যায়ের প্রতিবাদে স্তব্ধ করে দিতেন কলেজস্ট্রিট। এক ভাঁড় চা খান তাদের সঙ্গে সূর্য সেনের পার্টি অফিসের সামনে। বঙ্কিম চাটুজ্জে হয়ে হেঁটে যান প্রেসিডেন্সি রেলিঙের দিকে। দেখা হয় বইপাড়া ফুটপাথের সেই বইবিক্রেতাদের সঙ্গে, যাঁরা বহু বিপদে পাশে থেকেছেন। তাঁর মনে পড়ে, এক রাজনৈতিক কর্মীকে তৎকালীন শাসকদলের মারের হাত থেকে বাঁচাতে লাঠিসোটা নিয়ে বেরিয়ে এসেছিলেন এ-পাড়ার ফুটপাথের বইবিক্রেতারা। একটু থেমে থেমে বলেন, "রাজনীতিটা বোঝার জন্যই মার্ক্সবাদের বাইরেও নানা তত্ত্ব পড়তাম আমরা। আর সে জোগান বইপাড়া ছাড়া কেই বা দিতে পারত?" এখন কি এলিয়েনেটেড লাগে? "লাগে তো। আগে নেতৃত্ব আর কর্মীদের মধ্যে যে একই সমাজ-অবস্থান ছিল, সেটা বদলে গেছে। কিছু একপাক্ষিক তত্ত্বের বাইরে পড়াশুনোটাও কমেছে অনেক।" ক্রমশ গড়ে ওঠা এক নয়া হায়ারার্কির আয়নায় একটু যেন অসহায় এক ছায়া দেখতে দেখতে স্বভাবত আশাবাদী এই মানুষটি বইপাড়া প্রকাশনজগতের বদলে যাওয়ার এক ছবিই যেন বলে চলেন। "একসময়ে প্রবল হেরে যাওয়ার পরে এই বইপাড়াই হয়ে উঠেছিল একদল মানুষের প্রতিবাদী আত্মপরিচয় সন্ধানের পরিসর। আবার নতুন করে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টাও এখান থেকেই।" এই ঘুরে দাঁড়ানোর অধিকার রক্ষার স্বপ্ন নিয়েই আজও নানা প্রজন্মের মানুষের সঙ্গে কথা বলেন তিনি। প্রতিটি গলিতে হাঁটতে হাঁটতে যেন বলেন যান, বইপাড়া গ্রন্থজীবী, বইপাড়া গ্রন্থপ্রিয় কিন্তু সেই প্রবল গ্রন্থ কিছু কাগজ-কালির সমাহার মাত্র নয়; সে-গ্রন্থ নতুন জীবনের স্বপ্নের। বইপাড়ার বহু রাজনৈতিক ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে হেঁটে চলেছেন ডাকুদা ওরফে সীতাংশুশেখর। "বইপাড়া ছাড়া এত কথা বলবই বা কোথায়, আর শুনবেই বা কে, বলো?" বলেন ডাকুদা।

0 comments: