0

প্রচ্ছদ নিবন্ধ - মনোজ কর

Posted in

প্রচ্ছদ নিবন্ধ


ধর্ম প্রসঙ্গে
মনোজ কর 


আমাদের বিবেকানন্দ স্কুলের সিঁড়ির ল্যান্ডিং এ বিবেকানন্দের মূর্তির দুইপাশে শিক্ষার এবং ধর্মের সংজ্ঞা লিপিবদ্ধ আছে। স্বামীজি ধর্মের সংজ্ঞা প্রসঙ্গে বলেছেন "মানুষের অন্তর্নিহিত দেবত্বের বিকাশের নামই ধর্ম"। 

‘দেবত্ব’ অর্থে আমি বুঝি মানুষের অন্তরের শুভবুদ্ধি, চিন্তা এবং সুকুমার অনুভূতি। এর সঙ্গে কোনো বিশেষ ধর্মের বা কোনো বিশেষ আচরণের সম্পর্ক নেই। ধর্মাচরণ আমরা তাকেই বলি যা মানবসমাজের মঙ্গলের জন্য। আমার ছোটবেলায় রায়টের গল্প শুনেছিলাম বড়দের কাছে। শুনেছিলাম হিন্দু মুসলমানের দাঙ্গায় অনেক মানুষ মারা গিয়েছিল, অনেক মানুষ ঘরছাড়া হয়েছিল। সেইসময়ের পূর্ব পাকিস্তান (এখন বাংলাদেশ) থেকে দলে দলে মানুষ চলে এসেছিল আমাদের দেশে। একথাও শুনেছিলাম এই দাঙ্গা ছিল মনুষ্যসৃষ্ট ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এবং এর সঙ্গে মূল ধর্মের কোনো সংযোগ নেই। 

আমাদের বাড়ীতে কঙ্খলের এক সাধু আসতেন প্রতিবছর। জ্যাঠামশাই যখন কঙ্খলে বেড়াতে গিয়েছিলেন তখন এই সাধুর সাথে পরিচয় হয়েছিল। উনি প্রতিবছর কলকাতা আসতেন এবং প্রত্যেক পরিচিত ভক্তের বাড়ী একদিন দুদিন করে থাকতেন। জ্যাঠামশাই সেই অর্থে ভক্ত ছিলেন না তবুও পূর্ব পরিচয়ের সূত্রে জ্যাঠামশাই এর আমন্ত্রণে প্রতি বছর আমাদের বাড়ী আসতেন। কোনো ধর্মালোচনা করতেন না। কোনো উপদেশ দিতেন না। আমাদের সঙ্গে নানান বিষয়ে গল্প করতেন। প্রতিদিন সকালে যোগব্যায়াম শেখাতেন এবং প্রতিবার নতুন নতুন যোগাসন দেখাতেন। যতদূর মনে পড়ে একাহারী ছিলেন। সূর্যাস্তের পর নিজের ঘরেই থাকতেন এবং কারো সাথে দেখা করতেন না। সূর্যোদয়ের আগেই ঘুম থেকে উঠে বাইরে বসার ঘরে চলে আসতেন। ফিরে যাওয়ার সময় আমরা সবাই প্রণাম করতাম। উনি সকলকে আশীর্বাদ করতেন। জ্যাঠামশাইকে কিছু না কিছু উপহার দিয়ে যেতেন, হয় রুদ্রাক্ষের মালা , নয়তো কোনো বই। জ্যাঠামশাই যত্ন করে তুলে রাখতেন। বই হলে অবশ্য আগে নিজে পড়তেন ও তারপরে সবাইকে পড়তে দিতেন।

আমাদের বাড়ীতে প্রায়ই এক ফকির আসতেন। বাড়ীর সবাই বলতো 'ফকির সাহেব'। বয়স্ক মানুষ, লম্বা ঘন দাড়ি, পরণে কালো আলখাল্লা, মাথায় তাজ পাগড়ি। কাঁধে থাকত একটা ঝোলা আর হাতে সাদা চামর।উনি বেশীক্ষণ থাকতেন না। উনি এলে জ্যাঠাইমা আমাদের সবাইকে বাইরের ঘরে ডেকে এনে ওনাকে বলতেন আমাদের সকলের মাথায় চামর বুলিয়ে দেবার জন্য। উনি সকলের মাথায় চামর বুলিয়ে দিতেন আর গাইতেন, "মুশকিল আসান করো, দয়াল মানিক পীর"। আমরা সবাই গলা মেলাতাম। তারপর জেঠিমাকে আদাব জানিয়ে চলে যেতেন।

আমাদের মামার বাড়ীর গ্রামে হিন্দু -মুসলমানরা মিলে মিশে থাকেন অনেক কাল ধরে। বাড়ীর সকলের মঙ্গলকামনায় দিদিমা প্রায়ই যেতেন পীরের দরগায়। 

আমাদের পদবি এবং ধর্ম জন্মসূত্রে প্রাপ্ত। কোনোদিন ভাবিনি বা ভাববার চেষ্টা করিনি যে এই পদবির বা ধর্মের কোনো তাৎপর্য আছে কি না। আমাদের বাড়ী এবং স্কুল রামকৃষ্ণ মিশনের সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত। বাবা এবং মা দুজনেই মা, ঠাকুর, স্বামীজির গভীর অনুগামী । বিশেষ করে মা দিনের অনেকটা সময় এই বিষয়ে পড়াশুনা বা অন্যান্য কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকতেন। গত দুবছর শারীরিক অসুস্থতার কারণে বাড়ীর বাইরে যেতে পারেন না। বাড়ী এবং স্কুলের প্রভাবে আমার আগ্রহও বাড়তে থাকে। ক্লাস ইলেভেনে স্কুলে স্বামীজি বিষয়ে প্রবন্ধ প্রতিযোগিতায় যোগ দেওয়ার সূত্রে স্বামীজির চিকাগো বক্তৃতা পড়ে অভিভূত হয়ে পড়লাম। আমার প্রবন্ধের বিষয় ছিল স্বামীজির চিকাগো বক্তৃতা এবং প্রাথমিক পর্বে নির্বাচিত হবার পর রামকৃষ্ণ মিশনের সন্ন্যাসীদের বিচারে ঐ বছর আমার লেখাটি শ্রেষ্ঠত্বের শিরোপা পায়। স্বামীজির জন্মদিনে পুরষ্কার গ্রহনের সাথে সাথে রচনাটির অংশবিশেষ পাঠ করার সুযোগ পেয়ে উৎসাহ আরো বেড়ে গেল। 

কলেজে ঢোকার পর ঠাকুর স্বামীজির উপর পড়াশুনা শুরু করলাম। ধর্ম সম্বন্ধে ঠাকুর রামকৃষ্ণের বাণী 'যত মত তত পথ' এর ব্যাখ্যা পেলাম স্বামীজির রচনায় এবং শ্রীম কথিত রামকৃষ্ণ কথামৃতে।শ্রী রামকৃষ্ণের জীবনকাল ১৮৩৬ থেকে ১৮৮৬। বিস্মিত হলাম দেখে, যে সময় সমগ্র বাংলা জুড়ে হিন্দু ব্রাহ্মণ্যবাদের তাণ্ডব চলছে তখন এক তথাকথিত অশিক্ষিত গ্রাম্য পুরোহিত ব্রাহ্মণ বললেন সর্বধর্মসমন্বয়ের কথ, বললেন 'যত মত তত পথ'।

১৮৬৬ সালে সুফিমতে ইসলাম ধর্মতত্ত্ব শিক্ষা করেন শ্রীরামকৃষ্ণ। তিনি বলেছেন,

"ঐ সময়ে ‘আল্লা’মন্ত্র জপ করিতাম, মুসলমানদিগের ন্যায় কাছা খুলিয়া কাপড় পরিতাম; ত্রিসন্ধ্যা নমাজ পড়িতাম এবং হিন্দুভাব মন হইতে এককালে লুপ্ত হওয়ায় হিন্দুদেবদেবীকে প্রণাম দূরে থাকুক, দর্শন পর্যন্ত করিতে প্রবৃত্তি হইত না"

১৮৭৩ সালের শেষভাগ নাগাদ শম্ভুচরণ মল্লিক তাঁকে বাইবেল পাঠ করে শোনালে তিনি খ্রিস্টীয় মতে সাধনা শুরু করেন। শ্রীরামকৃষ্ণ বলেছিলেন, এই সময় তাঁর চিত্ত খ্রিস্টীয় ভাবে পূর্ণ হয়েছিল এবং তিনি তাঁর ঘরে হিন্দু দেবদেবীদের সঙ্গে পিতরকে ত্রাণরত যিশুর একটি চিত্র ছিল, সেটিতে তিনি প্রত্যহ সকাল ও সন্ধ্যায় ধূপারতি করতেন।

"ঈশ্বর রয়েছেন সকল জীবের মধ্যে, তাই জীবসেবাই ঈশ্বরসেবা- এই ছিল তাঁর দর্শন। ধর্মীয় সম্প্রীতিতে গভীর বিশ্বাসী ছিলেন তিনি।" তিনি বলেছিলেন, "আমি সকল ধর্ম অনুশীলন করেছি, হিন্দুধর্ম, ইসলাম,খ্রিস্টধর্ম এবং আমি বিভিন্ন হিন্দু সম্প্রদায়ের পথও অনুসরণ করেছি। আমি দেখেছি যে একই ঈশ্বরের দিকে বিভিন্ন পথে আমরা ধাপে ধাপে উঠে চলেছি। তোমাকে অবশ্যই সকল মত অনুশীলন করতে হবে এবং সকল পথ একই সঙ্গে অতিক্রম করতে হবে। আমি যেখানেই দেখি, দেখতে পাই মানুষ ধর্মের নামে কলহ করছে হিন্দু, মুসলমান, ব্রাহ্ম, বৈষ্ণব আর সকলে। কিন্তু তারা কখনই বলে না যে, যাঁকে কৃষ্ণ বলা হয়, তিনিই শিব, এবং তিনিই আদ্যাশক্তি, যিশু ও আল্লাহ্‌ নামে পরিচিত, এক রাম, তাঁর হাজার নাম..."

রামকৃষ্ণ ঘোষণা করেছিলেন "যত্র জীব তত্র শিব"। তিনি তাঁর শিষ্যদের শিক্ষা দিতেন, "জীবে দয়া নয়, শিবজ্ঞানে জীব সেবা।" গবেষকদের মতে, স্বামী বিবেকানন্দ এই বার্তা থেকেই শিক্ষা গ্রহণ করে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে ত্রাণকার্য, অনাথ আশ্রম, প্রশিক্ষণকেন্দ্র, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও দাতব্য চিকিৎসালয় স্থাপনের মতো সমাজসেবামূলক কাজের অনুপ্রেরণা লাভ করেছিলেন। রামকৃষ্ণের এই শিক্ষার অনুপ্রেরণাতেই তিনি বলেছিলেন, "কোথায় ঈশ্বরের খোঁজ করতে যাবে? সকল দরিদ্র, হতভাগ্য, দুর্বলরা ভাল নয় কি? তাদের পূজা আগে কর না কেন?... এরাই হোক তোমার ঈশ্বর।"

উনবিংশ শতাব্দীতে হিন্দুধর্মের আচারসর্বস্বতা ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে তিনি সরল ঈশ্বর বিশ্বাস ও সর্বধর্মসমন্বয়ের কথা বলেন। তিন প্রচলিত ধর্মের ( হিন্দু, মুসলমান ও খ্রিস্টান) আগ্রাসন স্তিমিত করতে এই সর্বধর্মসমন্বয়ের তত্ত্ব প্রভূত সাহায্য করেছিল।

রামকৃষ্ণ পরমহংস সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর "পরমহংস রামকৃষ্ণদেবের প্রতি" কবিতাটি লিখেছিলেন, 

"বহু সাধকের বহু সাধনার ধারা,
ধেয়ানে তোমার মিলিত হয়েছে তারা;
তোমার জীবনে অসীমের লীলাপথে
নূতন তীর্থ রূপ নিল এ জগতে;
দেশ বিদেশের প্রণাম আনিল টানি
সেথায় আমার প্রণতি দিলাম আনি।।"

রামকৃষ্ণ মিশন আয়োজিত রামকৃষ্ণ পরমহংসের জন্মশতবর্ষ অনুষ্ঠানে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন প্রধান অতিথি। এই অনুষ্ঠানে তিনি রামকৃষ্ণ পরমহংসের অবদান সম্পর্কে নিজের ধারণার কথা উল্লেখ করেছিলেন। ১৯৩৭ সালে রামকৃষ্ণ মিশন কলকাতায় বিশ্বধর্ম মহাসম্মেলনের আয়োজন করেছিলেন। এই সময় রামকৃষ্ণ পরমহংসের জন্মশতবর্ষ উৎসবও চলছিল। এই উপলক্ষে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, "তাঁর ব্যক্তিত্বের বিশালতা বোঝা যায় আপাত-বিরোধী সাধনপদ্ধতিগুলির অনুশীলনের মধ্যে দিয়ে। আর তাঁর মনের সরলতা পুরোহিত ও যাজকশ্রেণীর আড়ম্বর ও পাণ্ডিত্যকে চিরকালের জন্য ম্লান করে দিয়েছে।"

শ্রী রামকৃষ্ণ বিশ্বাস করতেন এবং বলতেন যে ধর্ম কোন ঈশ্বরপ্রেরিত বার্তা বা আদেশ নয়। ধর্ম হল নিজের প্রতি, পরিবারের প্রতি, অন্য ব্যক্তির প্রতি এবং সমাজের প্রতি দায়িত্ব ও কর্তব্যপালন। তিনি মনে করতেন তথাকথিত ধর্ম ও শাস্ত্রজ্ঞানের চাইতে সাধারণ জ্ঞান এবং শিক্ষা অনেক বেশী প্রয়োজনীয় । 

এই প্রসঙ্গে একটি গল্প তিনি প্রায়ই বলতেন।

"নৌকা করে কয়জন গঙ্গা পার হচ্ছিল। একজন পণ্ডিত বিদ্যার পরিচয় খুব দিচ্ছিল। 'আমি নানা শাস্ত্র পড়িছি—বেদ-বেদান্ত—ষড়দর্শদন।' একজনকে জিজ্ঞাসা কল্লে—'বেদান্ত জান?' সে বললে—'আজ্ঞা না। ''তুমি সাংখ্য, পাতঞ্জল জান?'—'আজ্ঞা না।' 'দর্শন-টর্শন কিছুই পড় নাই?'—'আজ্ঞা না'। পণ্ডিত সগর্বে কথা কহিতেছেন ও লোকটি চুপ করে বসে আছেন। এমন সময়ে ভয়ঙ্কর ঝড়—নৌকা ডুবতে লাগল। সেই লোকটি বলল, 'পণ্ডিতজী, আপনি সাঁতার জানেন?' পণ্ডিত বললেন, ‘না’। সে বললে, ‘আমি সাংখ্য, পাতঞ্জল জানি না, কিন্তু সাঁতার জানি’।”

পরবর্তীকালে স্বামী বিবেকানন্দ তাঁর বিশ্বজয়ী চিকাগো বক্তৃতায় বললেন "যে ধর্ম জগৎকে চিরকাল পরমতসহিষ্ণুতা ও সর্বাধিক মত স্বীকার করার শিক্ষা দিয়া আসিতেছে, আমি সেই ধর্মভুক্ত বলিয়া নিজেকে গৌরবান্বিত মনে করি। আমরা শুধু সকল ধর্মকেই সহ্য করিনা, সকল ধর্মকেই আমরা সত্য বলিয়া বিশ্বাস করি। যে ধর্মের পবিত্র সংস্কৃত ভাষায় ইংরেজী ‘এক্সক্লুশন’ (ভাবার্থ:বহিষ্করণ, পরিবর্জন) শব্দটি অনুবাদ করা যায় না, অমি সেই ধর্মভুক্ত বলিয়া গর্ব অনুভব করি। যে জাতি পৃথিবীর সকল ধর্মের ও সকল জাতির নিপীড়িত ও আশ্রয়প্রার্থী জনগণকে চিরকাল আশ্রয় দিয়া আসিয়াছে, আমি সেই জাতির অর্ন্তভুক্ত বলিয়া নিজেকে গৌরবান্বিত মনে করি। আমি আপনাদের এ-কথা বলিতে গর্ব অনুভব করিতেছি যে, আমরাই ইহুদীদের খাঁটি বংশধরগণের অবশিষ্ট অংশকে সাদরে হৃদয়ে ধারণ করিয়া রাখিয়াছি; যে বৎসর রোমানদের ভয়ংঙ্কর উৎপীড়নে তাহদের পবিত্র মন্দির বিধ্বস্ত হয়, সেই বৎসরই তাহারা দক্ষিণভারতে আমাদের মধ্যে আশ্রয়লাভের জন্য আসিয়াছিল। জরাথুষ্ট্রের অনুগামী মহান পারসিক জাতির অবশিষ্টাংশকে যে ধর্মাবলম্বীগণ আশ্রয় দান করিয়াছিল এবং আজ পর্যন্ত যাহারা তাঁহাদিগকে প্রতিপালন করিতেছে, আমি তাঁহাদেরই অন্তর্ভুক্ত। কোটি কোটি নরনারী যে-স্তোত্রটি প্রতিদিন পাঠ করেন, যে স্তবটি আমি শৈশব হইতে আবৃত্তি করিয়া আসিতেছি, তাহারই কয়েকটি পঙক্তি উদ্ধৃত করিয়া আমি আপনাদের নিকট বলিতেছিঃ ‘রুচীনাং বৈচিত্র্যাদৃজুকুটিলনানাপথজুষাং। নৃণামেকো গম্যস্ত্বমসি পয়সামর্ণব ইব।।"

বিভিন্ন নদীর উৎস বিভিন্ন স্থানে, কিন্তু তাহারা সকলে যেমন এক সমুদ্রে তাহাদের জলরাশি ঢালিয়া মিলাইয়া দেয়, তেমনি হে ভগবান, নিজ নিজ রুচির বৈচিত্র্যবশত সরল ও কুটিল নানা পথে যাহারা চলিয়াছে, তুমিই তাহাদের সকলের একমাত্র লক্ষ্য।

পৃথিবীতে এযাবৎ অনুষ্ঠিত সম্মেলনগুলির মধ্যে অন্যতম শ্রেষ্ঠ মহাসম্মেলন এই ধর্মমহাসভাতে গীতা-প্রচারিত সেই অপূর্ব মতেরই সত্যতা প্রতিপন্ন করিতেছি, সেই বাণীই ঘোষণা করিতেছি ‘যে যথা মাং প্রপদ্যন্তে তাংস্তথৈব ভজাম্যহম্। মম বর্ত্মানুবর্তন্তে মনুষ্যাঃ পার্থ সর্বশঃ।।’–যে যে-ভাব আশ্রয় করিয়া আসুক না কেন, আমি তাহাকে সেই ভাবেই অনুগ্রহ করিয়া থাকি। হে অর্জুন মনুষ্যগণ সর্বতোভাবে আমার পথেই চলিয়া থাকে।

সাম্প্রদায়িকতা, গোঁড়ামি ও এগুলির ভয়াবহ ফলস্বরূপ ধর্মোন্মত্ততা এই সুন্দর পৃথিবীকে বহুকাল অধিকার করিয়া রাখিয়াছে। ইহারা পৃথিবীকে হিংসায় পূর্ণ করিয়াছে, বরাবর ইহাকে নরশোণিতে সিক্ত করিয়াছে, সভ্যতা ধ্বংস করিয়াছে এবং সমগ্র জাতিকে হতাশায় মগ্ন করিয়াছে। এইসকল ভীষণ পিশাচগুলি যদি না থাকিত, তাহা হইলে মানবসমাজ আজ পূর্বাপেক্ষা অনেক উন্নত হইত। তবে ইহাদের মৃত্যুকাল উপস্থিত; এবং আমি সর্বতোভাবে আশা করি, এই ধর্ম-মহাসমিতির সম্মানার্থে আজ যে ঘন্টাধ্বনি নিনাদিত হইয়াছে, তাহাই সর্ববিধ ধর্মোন্মত্ততা, তরবারি অথবা লিখনীমুখে অনুষ্ঠিত সর্বপ্রকার নির্যাতন এবং একই লক্ষ্যের দিকে অগ্রসর ব্যক্তিগণের মধ্যে সর্ববিধ অসদ্ভাবের সম্পূর্ণ অবসানের বার্তা ঘোষণা করুক।"

ধর্মে বিশ্বাস করি সে ধর্মের নাম মানবধর্ম। আমার বিশ্বাস মানুষের মধ্যেই ঈশ্বর বাস করেন। এই প্রসঙ্গে বলে রাখি ধর্ম এবং ঈশ্বর এক নয়। ধর্মের সংজ্ঞা নিয়ে আগে আলোচনা করেছি। ঈশ্বর শব্দের মূল "ঈশ্" এর অর্থ হল দক্ষ, মালিক,শাসক। দ্বিতীয় অংশ 'বর' যার আভিধানিক অর্থ হল "সেরা, চমৎকার, সুন্দর" অতএব, যুগপৎভাবে ঈশ্বর শব্দের অর্থ হল; সেরা বা সুন্দরের স্রষ্টা। অর্থাৎ যে মানুষের অন্তর্নিহিত দেবত্বের বিকাশের নাম ধর্ম সেই মানুষ ছাড়া আর কেই বা পারে সুন্দরের স্রষ্টা হতে। 

বিভিন্ন ধর্মে ঈশ্বর সম্বন্ধে ভিন্ন ব্যাখ্যা আছে। একেশ্বরবাদী ধর্মগুলির প্রতিষ্ঠাতাদের প্রত্যেককেই ঈশ্বরের পুত্র বা অবতার বলে বিশ্বাস করা হয়। 

খ্রিস্ট ধর্ম হচ্ছে একেশ্বরবাদী ধর্ম। নাজারাথের যীশুর জীবন ও শিক্ষাকে কেন্দ্র করে এই ধর্ম বিকশিত হয়েছে। খ্রিস্টানরা মনে করেন যীশুই মসীহ এবং তাঁকে যীশু খ্রিস্ট বলে ডাকেন। খ্রিস্ট ধর্মের শিক্ষা নতুন টেস্টামেন্ট বা নতুন বাইবেলে এ গ্রন্থিত হয়েছে। এই ধর্মাবলম্বীরা খ্রিস্টান বলে পরিচিত। তারা বিশ্বাস করে যে যীশু খ্রিস্ট হচ্ছেন ঈশ্বরের পুত্র।

জরাথুস্ট্রীয় ধর্মের প্রবর্তক জরাথ্রুস্ট। তাঁর নাম অনুসারেই এই ধর্মের নাম হয়েছে জরাথুস্ট্রীয়। এ ধর্মে ঈশ্বরকে আহুরা মাজদা নামে ডাকা হয়। এদের ধর্মগ্রন্থের নাম আবেস্তা। জরাথুস্ট্রীয় ধর্মের অনুসারীরা অগ্নির উপাসক। আগুনের পবিত্রতাকে ঈশ্বরের পবিত্রতার সাথে তুলনীয় মনে করেন পার্সি জরাথুস্ট্রীয়রা।

ইহুদী ধর্মানুসারীরা নিজেদেরকে ইব্রাহিমের পৌত্র জ্যাকব (বা ইয়াকুব)-এর উত্তরপুরুষ বলে মনে করেন। এই ধর্ম কঠোরভাবে একেশ্বরবাদে বিশ্বাসী। তাদের মূল ধর্মীয় বিধান বা হালাখা অনুসারে, এই ধর্মের অন্তর্গত সকল শাখার মূল ধর্মগ্রন্থ একটিই- তোরাহ বা তানাখ বা তাওরাত বা হিব্রু বাইবেল। ইহুদীদের ইতিহাসজুড়ে বিভিন্ন ধর্মসংশ্লিষ্ট পন্ডিত ব্যক্তি ইহুদী ধর্মের মূল মত নির্দিষ্ট করার জন্য বিভিন্ন ব্যবস্থা প্রস্তাব করেন, যাদের সবগুলোই বিভিন্ন আলোচনা-সমালোচনার মধ্য দিয়ে যায়। সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য ব্যবস্থা বলে বিশ্বাসের তেরোটি নীতি স্বীকৃত, যা দ্বাদশ শতকে প্রদত্ত হয়। রক্ষণশীল ইহুদী মতে, মুসা বা মোজেস সম্পর্কিত ভবিষ্যদ্বাণী সত্য; তিনি পূর্বতন বা পরবর্তী সকল নবী তথা প্রেরিতপুরুষের নেতৃত্বস্থানীয়।

ইসলাম একটি একেশ্বরবাদী এবং আব্রাহামিক ধর্ম; যা আল্লাহর বানী (কোরআন) এবং নবী মুহাম্মাদ-এর প্রদত্ত শিক্ষা পদ্ধতি, জীবনাদর্শ (সুন্নাহ এবং হাদিস নামে লিপিবদ্ধ) দ্বারা পরিচালিত। ইসলামের অনুসারীরা মুহাম্মদকে শেষ নবী বলে মনে করেন। ইসলাম হলো শান্তির উদ্দেশ্যে এক ও অদ্বিতীয় আল্লাহ এর কাছে আত্মসমর্পণ করা। অনেকের ধারণা যে মুহাম্মদ হলেন এই ধর্মের প্রবর্তক। তবে মুসলমানদের মতে, তিনি এই ধর্মের প্রবর্তক নন বরং আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রেরিত সর্বশেষ ও চূড়ান্ত রাসূল। খ্রিস্টীয় সপ্তম শতকে তিনি এই ধর্ম পুনঃপ্রচার করেন। পবিত্র কুরআন ইসলাম ধর্মের মূল ধর্মগ্রন্থ। 

জৈনধর্ম কোনো সৃষ্টিকর্তা বা ধ্বংসকর্তা ঈশ্বরের ধারণা গ্রহণ করে না। এই ধর্মমতে জগৎ নিত্য। জৈনধর্ম মনে করে, প্রত্যেক আত্মার মধ্যেই মোক্ষলাভঈশ্বর হওয়ার উপযুক্ত উপাদান রয়েছে। এই ধর্মমতে পূর্ণাত্মা দেহধারীদের বলা হয় ‘অরিহন্ত’ (বিজয়ী) । যে সকল অরিহন্ত অন্যদের মোক্ষলাভে সাহায্য করেন তাঁদের বলা হয় ‘তীর্থঙ্কর’। এই ধর্ম মোক্ষলাভের জন্য কোনো সর্বোচ্চ সত্তার উপর নির্ভর করার কথা বলে না। তীর্থঙ্করেরা হলেন সহায় ও শিক্ষক, যিনি মোক্ষলাভের পথে সাহায্য করেন মাত্র। কিন্তু মোক্ষলাভের জন্য সংগ্রাম মোক্ষলাভে ইচ্ছুক ব্যক্তিকেই করতে হয়।

বুদ্ধের দর্শনের প্রধান অংশ হচ্ছে দুঃখের কারণ জানা ও তা নিরসনের উপায়। বাসনা হল সর্ব দুঃখের মূল। বৌদ্ধমতে সর্বপ্রকার বন্ধন থেকে মুক্তিই হচ্ছে প্রধান লক্ষ্য- এটাকে নির্বাণ বলা হয়। নির্বাণ শব্দের আক্ষরিক অর্থ নিভে যাওয়া (দীপনির্বাণ, নির্বাণোন্মুখ প্রদীপ), বিলুপ্তি, বিলয়, অবসান। কিন্তু বৌদ্ধ মতে নির্বাণ হল সকল প্রকার দুঃখ থেকে মুক্তি লাভ। এই সম্বন্ধে বুদ্ধদেবের চারটি উপদেশ যা চারি আর্য সত্য (পালিঃ চত্বারি আর্য্য সত্যানি) নামে পরিচিত। তিনি অষ্টবিধ উপায়ের মাধ্যমে মধ্যপন্থা অবলম্বনের ওপর বিশেষ জোর দিয়েছেন। 

আক্ষরিক অর্থে "বুদ্ধ" বলতে একজন জ্ঞানপ্রাপ্ত, উদ্বোধিত, জ্ঞানী, জাগরিত মানুষকে বোঝায়। উপাসনার মাধ্যমে উদ্ভাসিত আধ্যাত্মিক উপলব্ধি এবং পরম জ্ঞানকে বোধি বলা হয় (যে অশ্বত্থ গাছের নিচে তপস্যা করতে করতে বুদ্ধদেব বুদ্ধত্ব লাভ করেছিলেন তার নাম এখন বোধি বৃক্ষ)। সেই অর্থে যে কোনও মানুষই বোধিপ্রাপ্ত, উদ্বোধিত এবং জাগরিত হতে পারে। সিদ্ধার্থ গৌতমএইকালের এমনই একজন "বুদ্ধ"। বুদ্ধত্ব লাভের পূর্ববর্তী (জাতকে উল্লেখিত) জীবন সমূহকে বলা হয় বোধিসত্ত্ব। বোধিসত্ত্ব জন্মের সর্বশেষ জন্ম হল বুদ্ধত্ব লাভের জন্য জন্ম। ত্রিপিটকে, বোধিসত্ত্ব হিসেবে ৫৪৭ (মতান্তরে ৫৫০) বার বিভিন্ন কূলে (বংশে) জন্ম নেওয়ার ইতিহাস উল্লেখ আছে যদিও সুমেধ তাপস হতে শুরু করে সিদ্ধার্থ পর্যন্ত অসংখ্যবার তিনি বোধিসত্ত্ব হিসেবে জন্ম নিয়েছেন ।তিনি তাঁর আগের জন্মগুলোতে প্রচুর পুণ্যের কাজ বা পারমী সঞ্চয় করেছিলেন বলে সর্বশেষে সিদ্ধার্থ জন্মে বুদ্ধ হবার জন্য জন্ম গ্রহণ করেন। বুদ্ধত্ব লাভের ফলে তিনি এই দুঃখময় সংসারে আর জন্ম নেবেন না, এটাই ছিলো তাঁর শেষ জন্ম। পরবর্তী মৈত্রেয় বুদ্ধ জন্ম না নেওয়া পর্যন্ত পৃথিবীতে তাঁর শাসন চলবে।

একেশ্বরবাদ, বহুদেববাদ, সর্বেশ্বরময়বাদ, অদ্বৈতবাদ, নাস্তিক্যবাদ – সকল প্রকার বিশ্বাসের সমাহার দেখা যায় হিন্দুধর্মে। তাই হিন্দুধর্মে ঈশ্বরধারণাটি অত্যন্ত জটিল। এই ধারণা মূলত নির্দিষ্ট কোনো ঐতিহ্য অথবা দর্শনের উপর নির্ভরশীল নয়।হিন্দুরা বিশ্বাস করেন যে মানুষের আত্মা শাশ্বত। অদ্বৈত বেদান্তের ন্যায় অদ্বৈতবাদী/সর্বেশ্বরময়বাদী দর্শন অনুসারে, আত্মা সর্বশেষে পরমাত্মা ব্রহ্মে বিলীন হয়। এই কারণেই এই দর্শন ‘অদ্বৈত দর্শন’ নামে পরিচিত। অদ্বৈত দর্শনের মতে, জীবনের উদ্দেশ্য হলো আত্মা ও ব্রহ্মের অভিন্নতা অনুভব করা। উপনিষদে বলা হয়েছে, মানুষের পরমসত্ত্বা আত্মাকে যিনি ব্রহ্মের সঙ্গে অভিন্ন রূপে অনুভব করতে সক্ষম হন, তিনিই মোক্ষ বা মহামুক্তি লাভ করেন।

দ্বৈত ও ভক্তিবাদী দর্শনে ব্রহ্মের উপর ব্যক্তিত্ব আরোপিত হয়েছে। এই মতানুসারে সম্প্রদায় বিশেষে তাঁকে বিষ্ণু, ব্রহ্মা, শিব বা শক্তিরূপে পূজা করা হয়। আত্মা এখানে ঈশ্বরের উপর নির্ভরশীল এবং মোক্ষ নির্ভরশীল ঈশ্বরের প্রতি প্রেম অথবা ঈশ্বরের অনুগ্রহের উপর। পরমসত্ত্বা রূপে ঈশ্বর হিন্দুধর্মে ঈশ্বর (প্রভু), ভগবান (পবিত্র ব্যক্তি) বা পরমেশ্বর (সর্বোচ্চ প্রভু) নামে আখ্যাত। অবশ্য ঈশ্বর শব্দের একাধিক ব্যাখ্যা রয়েছে। মীমাংসাবাদীরা ঈশ্বরে অবিশ্বাস করেন; আবার অদ্বৈতবাদীরা ব্রহ্ম ও ঈশ্বরকে অভিন্ন মনে করেন। অধিকাংশ বৈষ্ণব ঐতিহ্যে তিনি বিষ্ণু। বৈষ্ণব শাস্ত্রগুলি তাঁকে কৃষ্ণ বা কখনও কখনও স্বয়ং ভগবানের রূপে দেখিয়েছে। সাংখ্য দর্শন নাস্তিক্যবাদী মনোভাবাপন্ন।

বিভিন্ন ধর্মে যে বিভিন্ন রূপে ঈশ্বরের কথা বলা হয়েছে তা আসলে একই । এবং সেই ঈশ্বরকে পাওয়ার জন্য যে বিভিন্ন পথের কথা বলা হয়েছে তা আসলে মানবসমাজের মঙ্গলসাধনের পথ ছাড়া আর কিছুই নয়। আমার ব্যক্তিগত ভাবে মনে হয় এই সমাজের বেশীরভাগ মানুষ যাদের সময় মূলত জীবিকা অর্জনেই ব্যয়িত হয় এবং যাদের পক্ষে আত্মা, ধর্ম, দর্শন বা ঈশ্বরের জটিল তত্ত্ব অনুধাবন করা সম্ভব নয় তাদের পক্ষে যে কোনো একটি ধর্মমত এবং পথ অনুসরণ করা তাদের নিজেদের এবং সমাজের পক্ষে মঙ্গল। সাধারণ মানুষের মূল্যবোধ যদি কোনো ধর্মের ভিত্তিতে সৃষ্টি হয় তবে তা সমাজের হিতসাধনই করবে। আসলে তাই হয়। সত্যিকারের ধর্মাশ্রয়ী মানুষেরা সাধারণত সহনশীল হ’ন এবং কোনোরকম অন্যায় কাজ থেকে বিরত থাকেন কারণ তাঁদের মূল্যবোধের ভিত্তি ধর্ম এবং কোনো ধর্মই অন্যায় এবং অনৈতিক কাজকে সমর্থন করেনা। 

বিপরীতভাবে যাদের মূল্যবোধের ভিত্তিতে ধর্মের কোনো প্রভাব নেই তাঁরা ধর্মকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করে মানুষে মানুষে বিভেদ সৃষ্টি ক’রে নিজেদের স্বার্থসিদ্ধি করতে চায়। এই স্বার্থান্বেষী অশুভ শক্তিকে সর্বশক্তি দিয়ে প্রতিহত করা উচিত। যে মত বা পথ মানুষের মঙ্গলসাধন করে তাই ধর্ম এবং যে তা করেনা তাই অধর্ম। 

সমাজের বিদগ্ধজনেরা যদি মনে করেন তাঁদের অধীত বিদ্যা এবং অর্জিত শিক্ষা মানবজাতির মঙ্গলসাধনাতেই ব্যবহৃত হবে ,তবে তাঁরা নির্দিষ্ট কোনো ধর্মমত বা পথ অনুসরণ করতে নাও পারেন। কারণ তাঁদের বৈদগ্ধই তাঁদের মূল্যবোধের ভিত্তি এবং তা অবশ্যই সমাজের পক্ষে হিতকারী। কিন্তু তাঁরা দাবি করতে পারেন না যে সাধারণ এবং অল্পশিক্ষিত বা অশিক্ষিত মানুষের কোনো নির্দিষ্ট ধর্মের অনুগত হওয়ার প্রয়োজন নেই। 

উনবিংশ শতাব্দীর আর দুই মানবধর্মের মহান উদ্গাতা আমাকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছেন। তাঁদের কথা না বললে এই লেখা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। প্রথমজন লালন ফকির।

লালন ছিলেন বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী একজন বাঙালি; যিনি ফকির লালন, লালন সাঁই, লালন শাহ, মহাত্মা লালন ইত্যাদি নামেও পরিচিত। তিনি একাধারে একজন আধ্যাত্মিক বাউল সাধক, মানবতাবাদী, সমাজ সংস্কারকএবং দার্শনিক। তিনি অসংখ্য গানের গীতিকার, সুরকার ও গায়ক ছিলেন। লালনকে বাউল গানের অগ্রদূতদের অন্যতম একজন হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তার গানের মাধ্যমেই উনিশ শতকে বাউল গান বেশ জনপ্রিয়তা অর্জন করে। তাকে ‘বাউল সম্রাট’ হিসেবেও আখ্যায়িত করা হয়ে থাকে।

লালন ছিলেন একজন মানবতাবাদী। যিনি ধর্ম, বর্ণ, গোত্রসহ সকল প্রকার জাতিগত বিভেদ থেকে সরে এসে মানবতাকে সর্বোচ্চ স্থান দিয়েছিলেন। অসাম্প্রদায়িক এই মনোভাব থেকেই তিনি তার গান রচনা করেছেন। তার গান ও দর্শন যুগে যুগে প্রভাবিত করেছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর,কাজী নজরুলঅ্যালেন গিন্সবার্গের মতো বহু খ্যাতনামা কবি, সাহিত্যিক, দার্শনিক, বুদ্ধিজীবীসহ অসংখ্য মানুষকে। তার গানগুলো মূলত বাউল গান হলেও বাউল সম্প্রদায় ছাড়াও যুগে যুগে বহু সঙ্গীতশিল্পীর কণ্ঠে লালনের এই গানসমূহ উচ্চারিত হয়েছে। গান্ধীরও ২৫ বছর আগে, ভারত উপমহাদেশে সর্বপ্রথম, তাঁকে ‘মহাত্মা’ উপাধি দেওয়া হয়েছিল। নিজের সম্বন্ধে লালন লিখেছেন,
সব লোকে কয় লালন কি জাত সংসারে।
লালন বলে জাতের কি রূপ
দেখলাম না এই নজরে।।
কেউ মালায় কেউ তসবি গলায়,
তাইতে যে জাত ভিন্ন বলায়।
যাওয়া কিম্বা আসার বেলায়,
জাতের চিহ্ন রয় কার রে।।
জাত গেল জাত গেল বলে
একি আজব কারখানা
সত্য কাজে কেউ নয় রাজি
সব দেখি তা না না না।
গোপনে যে বেশ্যার ভাত খায়
তাতে ধর্মের কী ক্ষতি হয়
লালন বলে জাত কারে কয়
এই ভ্রমও তো গেল না।

লালনের ধর্ম বিশ্বাস নিয়ে গবেষকদের মাঝে যথেষ্ট মতভেদ রয়েছে, যা তার জীবদ্দশাতে বিদ্যমান ছিল। তাঁর মৃত্যুর পর প্রকাশিত প্রবাসী পত্রিকার ‘মহাত্মা লালন ‘ নিবন্ধে প্রথম লালন জীবনী রচয়িতা বসন্ত কুমার পাল বলেছেন- "সাঁইজি হিন্দু কি মুসলমান, এ কথা আমিও স্থির বলিতে অক্ষম।" বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায় লালনের জীবদ্দশায় তাকে কোনো ধরনের ধর্মীয় রীতিনীতি পালন করতে’ও দেখা যায় নি। লালনের কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছিল না। নিজ সাধনাবলে তিনি হিন্দুধর্ম এবং ইসলামধর্ম উভয় শাস্ত্র সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করেন। তার রচিত গানে এর পরিচয় পাওয়া যায়। প্রবাসী পত্রিকার নিবন্ধে বলা হয়, লালনের সকল ধর্মের লোকের সাথেই সুসম্পর্ক ছিল। মুসলমানদের সাথে তার সুসম্পর্কের কারণে অনেকে তাকে মুসলমান বলে মনে করত’। আবার বৈষ্ণবধর্মের আলোচনা করতে দেখে হিন্দুরা তাকে বৈষ্ণব মনে করতো। প্রকৃতপক্ষে লালন ছিলেন মানবতাবাদী এবং তিনি ধর্ম, জাত, কূল, বর্ণ, লিঙ্গ ইত্যাদি অনুসারে মানুষের ভেদাভেদে বিশ্বাস করতেন না।

বাংলা ১৩৪৮ সালের আষাঢ় মাসে প্রকাশিত মাসিক মোহম্মদী পত্রিকায় এক প্রবন্ধে লালনের জন্ম মুসলিম পরিবারে বলে উল্লেখ করা হয়।আবার ভিন্ন তথ্যসূত্রে তার জন্ম হিন্দু পরিবারে বলে উল্লেখ করা হয়। লালনের ধর্মবিশ্বাস সম্পর্কে ঔপন্যাসিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বলেছেন,‘‘লালন ধার্মিক ছিলেন, কিন্তু কোনো বিশেষ ধর্মের রীতিনীতি পালনে আগ্রহী ছিলেন না। সব ধর্মের বন্ধন ছিন্ন করে মানবতাকে সর্বোচ্চ স্থান দিয়েছিলেন জীবনে।’’

লালনের পরিচয় দিতে গিয়ে সুধীর চক্রবর্তী লিখেছেন,‘‘কাঙাল হরিনাথ তাঁকে জানতেন, মীর মশাররফ চিনতেন, ঠাকুরদের হাউসবোটে যাতায়াত ছিল, লেখক জলধর সেন বা অক্ষয় কুমার মৈত্রেয় তাঁকে সামনাসামনি দেখেছেন কতবার, গান শুনেছেন, তবু জানতে পারেন নি লালনের জাতপরিচয়, বংশধারা বা ধর্ম।”

একটি গানে লালনের প্রশ্ন,

‘‘এমন সমাজ কবে গো সৃজন হবে ,যেদিন হিন্দু মুসলমান বৌদ্ধ খ্রিস্টানজাতি গোত্র নাহি রবে।।” 

দ্বিতীয়জন শিরডির সাইবাবা। সাইবাবা (১৮৩৫-১৯১৮) ছিলেন একজন ভারতীয় ধর্মগুরু, যোগী ও ফকির। হিন্দুমুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের ভক্তরাই তাঁকে সন্ত আখ্যা দিয়েছিলেন। সাই বাবার প্রকৃত নাম জানা যায় না। শিরডিতে আগমনের পর তাঁকে "সাই" নাম দেওয়া হয়। তাঁর জন্ম বা জন্মস্থান সংক্রান্ত কোনো তথ্যও জানা যায় না।

সাই বাবা পার্থিব বস্তুর প্রতি আগ্রহী ছিলেন না। তাঁর একমাত্র চিন্তা ছিল আত্ম-উপলব্ধি। তিনি সন্ত হিসেবে খুবই জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিলেন।বিশ্বের নানা অংশের মানুষ তাঁর পূজা করেন। তিনি ভালবাসা, ক্ষমা, পরস্পরকে সহায়তা, দান, সন্তুষ্টি, আন্তরিক শান্তি ও ঈশ্বর ও গুরুর প্রতি ভক্তির শিক্ষা দিতেন। সাই বাবার শিক্ষার উপাদান সংগৃহীত হয়েছিল হিন্দুইসলাম উভয় ধর্ম থেকেই। যে মসজিদে তিনি বাস করতেন, তার একটি হিন্দু নামও দিয়েছিলেন। এই নামটি হল "দ্বারকাময়ী"। তিনি হিন্দু ও মুসলিম উভয় ধর্মেরই অনুষ্ঠানাদি পালন করতেন। উভয় সম্প্রদায়ের ভাষা ও ব্যক্তিত্বদের উদাহরণ দিয়ে উপদেশ দান করতেন। শিরডির একটি হিন্দু মন্দিরে তাঁকে সমাহিত করা হয়। তাঁর বিখ্যাত উক্তি "সবকা মালিক এক" ("একই ঈশ্বর সকলকে শাসন করেন")। কথাটি ইসলাম ও সুফিবাদের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। তিনি সর্বদা "আল্লাহ্‌ মালিক" ("ঈশ্বরই রাজা") কথাটি উচ্চারণ করতেন। বহু হিন্দু ও সুফি ধর্মনেতা সাই বাবাকে শ্রদ্ধা করতেন।

অনেকের মধ্যে ভ্রান্ত ধারণা আছে যে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করলে আমাদের আশা, আকাঙ্খা এবং চাহিদা পূর্ণ হয়। এই আশায় আমরা অনেকেই মন্দির, মসজিদ, গীর্জায় ভীড় করি। এই প্রসঙ্গে ঠাকুর শ্রী রামকৃষ্ণ এবং স্বামীজির প্রথমদিকের এক সাক্ষাৎকারের উল্লেখ করতে চাই। 

স্বামীজি একদিন ঠাকুরকে বল্লেন তাঁর পরিবারের অভাবের কথা। ঠাকুর তাঁকে বল্লেন পাশেই মন্দিরে মা ভবতারিনী আছেন সেখানে গিয়ে নিজের দুঃখের কথা বলতে। মা নিশ্চয় একটা সুরাহা করবেন। স্বামীজি মন্দিরে প্রার্থনা সেরে ফিরে এলেন। ঠাকুর জিজ্ঞাসা করলেন স্বামীজি কি চাইলেন। স্বামীজি বল্লেন যে তিনি বলেছেন " জ্ঞান দাও, বুদ্ধি দাও, বিবেক দাও, বৈরাগ্য দাও"। ঠাকুর মৃদু হেসে আবার স্বামীজিকে আবার পাঠালেন। পরপর তিনবার গিয়েও স্বামীজি এ ছাড়া আর কিছুই চাইতে পারলেন না। 

মাদার টেরেসার দুটি উক্তি এই প্রসঙ্গে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ন।

"Prayer is not asking. Prayer is putting oneself in the hands of God, at his disposition, and listening to his voice in the depths of our hearts.” 

এবং 

“I always used to think that Prayer changes things, but I now realise that Prayer changes us and we change things"

নিজেকে ক্রমাগত পরিবর্তন ক’রে চেতনা এবং চৈতন্যের উন্নততর পর্যায়ে নিয়ে যাওয়াই ধর্মাচরণের মূল উদ্দেশ্য। একেই অধ্যাত্মবাদীরা ঈশ্বরলাভের প্রক্রিয়া বলে থাকেন। আপাতভাবে যারা ঈশ্বরে বিশ্বাস করেন না তাঁরাও আত্মপরিবর্তন ও আত্মোন্নয়নের প্রক্রিয়ার অন্তর্গত। বিদ্যা, বুদ্ধি, জ্ঞান এবং অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়েই এই প্রক্রিয়া চালিত হয় এবং এই প্রক্রিয়ার শেষে মানুষের চিন্তা ও চেতনার ক্ষেত্রে বিপ্লব সংঘটিত হয়। বিংশ শতাব্দীর বিশিষ্ট দার্শনিক ও নাট্যকর্মী ব্রেখট বলেছেন ' শিক্ষা আনে চেতনা, চেতনা আনে বিপ্লব'। চিন্তার ও চেতনার ক্ষেত্রে বিপ্লব ব্যতীত বহির্জগতে বিপ্লবের ক্ষেত্রে নেতৃত্ব দেওয়া যায় না। শ্রেণীবিভক্ত সমাজের অভ্যন্তরে বাস ক’রে শ্রেণীহীন সমাজের স্বপ্ন দেখা এবং তাকে বাস্তবায়িত করার পথনির্দেশ করা চেতনার একটি স্তরে না পৌঁছনো পর্যন্ত সম্ভব নয়। এমনকি পৃথিবীর বিভিন্ন কম্যুনিস্ট আন্দোলনের অনেক নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি নিজেদের শ্রেণীচরিত্র সংশোধন করে শ্রেণীচ্যুত হতে পেরেছেন একমাত্র নিজেদের চিন্তার জগতে সামগ্রিক পরিবর্তন ও উন্নতি সাধন ক’রে। শ্রেণীহীন সমাজ সৃষ্টিই হোক বা পরম সত্যের সন্ধানই হোক উভয়ক্ষেত্রেই নিজেকে ক্রমাগত অভীষ্ট লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য কোনো প্রচলিত ধর্ম বা কোনো দার্শনিক নির্দেশিত পথ অবলম্বন করতেই হবে। 

রবীন্দ্রনাথ তাঁর শেষ জীবনে রচিত কালান্তর প্রবন্ধে লিখেছেন "মানুষ যেহেতু মানুষ এই হেতু বস্তুর দ্বারা সে বাঁচে না, সত্যের দ্বারাই সে বাঁচে। এই সত্যই তাহার যে তমেব বিদিত্বাতিমৃত্যুমেতি, নান্যঃ পনথা বিদ্যতে অয়নায়– তাঁহাকে জানিয়াই মানুষ মৃত্যুকে অতিক্রম করে, এতদ্ব্যতীত অন্য কোনো উপায় নাই।"

শ্রমিক কৃষক মেহনতি মানুষের দ্বারা চালিত যে সমাজ দর্শনের কথা কার্ল মার্ক্স বলেছেন তাঁর ঐতিহাসিক এবং দ্বন্দ্বমূলক বস্ত্তুবাদের ভিত্তিতে, আধ্যাত্মিক চিন্তার ভিত্তিতেও সেই একই সত্যের সন্ধান পেয়েছেন স্বামীজি। 

কিন্তু যে প্রশ্নের মুখোমুখি আমরা এই সময়ে দাঁড়িয়ে আছি তা হল মেহনতি মানুষের নেতৃত্বে শ্রেণীহীন সমাজ প্রতিষ্ঠাই কি মানবসভ্যতার শেষ কথা এবং চরম সত্য না কি তার পরেও আছে কোনো চরমতর সত্য যে সত্যের সন্ধান পেয়েছিলেন প্রাচীন মুনি ঋষি এবং কোনো কোনো ধর্মসাধক? কি সেই সত্য, কেমন করে আমরা সেই সত্যের সন্ধান পাব?

0 comments: